কনক মুখার্জী – চেতনায় আজও ভাস্বর – কনীনিকা ঘোষ….

৩০ ডিসেম্বর ২০২১ , বৃহস্পতিবার

কনক মুখার্জী - নাম উচ্চারনের সাথে সাথেই আমার মনে ওনার সাদা শাড়ি, ভারী কাচের চশমা পরা ছোটখাট কিন্তু অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী চেহারাটা ভেসে ওঠে। ওনার ওজস্বিনী বক্তৃতার কিছু সাক্ষী ছিলাম, ছোট বেলা থেকে ছাত্র আন্দোলন করার সুবাদে। ছাত্র আন্দোলন থেকে ওই সময় মহিলা সমিতিতে ভ্রাতৃপ্রতিম করা হত আর তাতে আমি গেছি তাই ওনার বক্তৃতার সাথে পরিচিতি ছিলাম। ক্ষুরধার রাজনৈতিক বক্তব্য কিন্তু সহজ সাবলীল ভাষা ও প্রাণের আবেগ মিশিয়ে। তার উপস্থাপনায় যেন ‘অধরা মধুরী’ ‘ছন্দো বন্ধনে’ ধরা পড়ত। তাই কনকদি আমার চেতনার আজও উজ্জ্বল। আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন কনকদির দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হয়ে এসেছে। মনে আছে একদিন মহিলা সমিতি অফিসে এসেছি কোন কাজে, শ্যামলী দি আমাকে কনকদির কাছে নিয়ে গেছিলেন, কনকদি আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমাকে অনুভব করছিলেন, কি স্নেহের সেই স্পর্শ তা ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হই, বলেছিলেন “হ্যাঁ তুমি কনীনিকা, তোমার কথা শুনেছি, ছাত্র নেত্রী তো, ভাল বল শুনেছি কিন্তু শুধু বললে হবে না তোমাদের লিখতে হবে, লেখো, তোমরাই তো লিখবে, তৈরী হবে, কি পারবে না?” লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়ে কনকদিকে সেদিন ‘হ্যাঁ’ বলে এসেছিলাম তখন কি জানতাম কালের প্রবাহে কনকদিকে নিয়েই তার জন্মশতবর্ষে আমাকে বারে বারে কলম ধরতে হবে। এরকমই ছিলেন কনকদি, সমস্ত নেতৃত্বের মুখে শুনেছি, তাগাদা দিয়ে লেখা আদায় করে ছাড়তেন। তার প্রেরণার বাজারী পত্রিকার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক বিকল্প সমাজ চেতনা নির্ভর ‘একসাথে’ পত্রিকার এক লেখিকা গোষ্ঠী তৈরী হয়েছিল, যা আজও বহমান, ঐতিহ্যে উত্তরাধিকারে, ‘একসাথে’ ও তো তার অবিচ্ছিন্ন চলার পথে গৌরবের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেছে এ তো এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা, এর পেছনে কনকদির দান অসামান্য। আসলে আজকের সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি যে চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে তাকে তৈরী করার সর্বক্ষেত্রেই যে কনকদির ছোঁওয়া, সেই কবে ১৯৪৩ এ ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবিরোধী মহিলা আন্দোলন দানা বেঁধে তৈরী হয় ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ তা গঠন করার কাজেই তো যুক্ত ছিলেন কনকদি, সাথে ছিলেন গীতা মুখার্জী, বেলা লাহিড়ী, পঙ্কজ আচার্য, যূঁইফুল রায়, বানী দাশগুপ্ত-র মত নেত্রীরা। প্রতিকুলতার সমুদ্র সাঁতরে, প্রতিক্ষনে যুঝে যুঝে মেয়েদের লড়াইকে - দাবীকে নিয়ে এগিয়েছেন সামনে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি থেকে ১৯৫৮-৫৯ পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি তৈরী হল, কনকদি নেতৃত্বের পুরো ভাগে। 
অপরিসীম রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আর মার্কসবাদে দীক্ষিত কনকদি, অভ্যন্তরের মতাদর্শগত বিতর্কে ১৯৭০ এ যখন পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতি ভাগ হয়ে যায় তখন ১৯৭১-এ গঠনতন্ত্র তৈরী হয় গণতন্ত্র, সমানাধিকার, নারীমুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে, নাম হয় পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, সেই গঠনতন্ত্রের ছত্রে ছত্রেও তো কনকদির অবদান ছড়িয়ে আছে। এই সংগঠনেরই তো তিনি ১৯৭৩ সালে চতুর্দশ সম্মেলন থেকে ১৯৮৩ সপ্তদশ সম্মেলন পর্যন্ত কার্যকরী সভানেত্রী ছিলেন। ১৯৮৩ সপ্তদশ সম্মেলন থেকে ২২তম সম্মেলন পর্যন্ত ছিলেন সংগঠনের সভানেত্রী। ১৯৮১ সালে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় মাদ্রাজে, কনক মুখার্জী ছিলেন এই সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম সম্মেলন থেকে ১৯৯৮ সালের পঞ্চম সম্মেলন পর্যন্ত ছিলেন অন্যতম সহসভানেত্রী, তারপর থেকে আমৃত্যু ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
কনকদির বহুধাবিস্তৃত কর্মধারায় একদিকে সংগঠন ও আর একদিকে তার সৃজনশীল প্রতিভার বিচ্ছুরণ কাব্যে-সাহিত্যে-কবিতায়। যেমন - ‘কালো বোরকা’ কবিতায় তিনি বোরখার নিচে থাকা মহিলার যে বর্ননা দিয়েছেন তাতে যেন ওই মেয়েদের জীবনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। লিখেছিলেন - “বোরকার নাম নেই/ছিল কিনা সেও গেছে ভুলে/হাসে কিনা? কাঁদে নাকি?/এইসব খবরে/ দুনিয়ার কি বা কাজ আছে?/ এই ঘরে এসেছে সে কবে? সে কথা কি মনে আছে তার?/ মন কই? / মন তার খুঁজে পাওয়া ভার।”
একজন মানুষ একই সাথে এত কিছ করতে পারে তা কনকদিকে না জানলে ভাবা যায় না। সেই ১৯২১ এর ৩০শে ডিসেম্বর যশোহর জেলা কালিয়া থানার অর্ন্তগত বেন্দা গ্রামে জন্মে দুই বছরের মধ্যে মাতৃহারা হয়ে ঠামমা সৌদামিনীর আদরের ‘পুঁটুরানী’ প্রতিমুহূর্তে লড়াই করেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর আপোস হীন মনোভাবে তিনি লড়াই করেছেন লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তিনি তথাকথিত নারীবাদীদের মত ছিলেন না। তিনি লিখেছেন ‘আমি নারীবাদী নই তবু কেন সংরক্ষণ চাই
AIDWA’s quarterly English-language journal, Women’s Equality, vol.1, no. 2 (July–September 1988)
Women and Secularism, a book by vice president of AIDWA in Tamil Nadu Mythili Sivaraman. Both the text and illustration address the importance of secularism for women’s rights

শ্যামলী দি, মনুদি, রেখা দি, মিনু দি, মালিনী দি, বিভা দিদের লেখা থেকেই কনকদির সন্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি। রেখা গোস্বামীর একটি লেখায় পাই, কনকদি প্রথমে সংরক্ষণের বিরোধী ছিলেন কারণ নারী-পুরুষ সমানাধিকারের দাবীতেই তো ছিল তাদের লড়াই কিন্তু পরবর্তীকালে তিনিই বলেছেন পুরুষশাসিত এবং শ্রেণী বৈষম্যের সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য নানাভাবে আধুনিক সমাজে দেখা যাচ্ছে তাই আগের কায়দায় বর্বররূপ হয়তো থাকবে না কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে আর্থিক সঙ্কট যত তীব্র হবে তার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রটিও তত কুৎসিৎ হয়ে তার প্রকাশ লিঙ্গ বৈষম্যের মধ্যে পড়বে। তাই তিনি মনে করেছেন সংসদ ও বিধান সভায় সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে নারীরা এগিয়ে এলে তাদের অধিকারের দাবী জোরালো হবে। – আজও যখন এ দাবী পূরণ হয়না, সরকারের পর সরকার চলে যায়, তখন কনকদিদের ভাবনা কত সঠিক ছিল, পিতৃতান্ত্রিক আজকের দিনে আরো কত তীব্র আকার নিয়েছে তা আমরা অনুভব করতে পারি। এক অপরিসীম আধুনিক মনোভাব নিয়ে তিনি সমাজকে দেখেছেন। তার ‘লাভ ম্যারেজ বনাম পণপ্রথা’ নামক লেখায় তিনি স্বাধীন বিবাহ প্রথার পক্ষে যে জোরালো সওয়াল করেছেন পণপ্রথাকে যেভাবে সমালোচনা করেছেন তা যেন আজকেরও সমাজ জীবনের প্রতিবিম্ব। আবার একই সাথে কনকদি মেয়েদেরকে যোগ্যতায় উন্নীত করতে চেয়েছেন তাই বারে বারে বলেছেন হীনমন্যতা নয়, পুরুষরা যেহেতু সমাজের সুবিধাগুলি অনেক বেশি করে যুগে যুগে ভোগ করেছে, তাই হয়তো তারা অনেক এগিয়ে আছে, তাদের থেকে শিখতে হবে, জানতে হবে কিন্তু কখনই আত্মসমর্পন করে নয়, তাহলে যে মেয়েদের শ্রদ্ধার আসন টলে যাবে। উপযুক্ত সাহায্য পেলে মেয়েরা যে অসাধ্য সাধন করতে পারে একথা তিনি বারে বারে বলে গেছেন। আজ যখন দেশ বা রাজ্যের এই প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে অসীম সাহসিকতা নিয়ে এক বড় অংশের লড়াকু মেয়েরা রাস্তায় আছেন প্রতিবাদে প্রতিরোধে সমিতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখন কনকদিকে মনে পড়ে, মনে পড়ে তার মেয়েদের সন্বন্ধে দৃঢ় আস্থার কথা। আমরা উদ্দীপিত হই, আবার সামিল হই সংগ্রামে, লড়াইয়ে – তারই দেখানো পথে। তাই তার শিক্ষার মধ্য দিয়ে, কাজের মধ্যে দিয়েই তিনি রইবেন চেতনার চির ভাস্বর।

Spread the word

Leave a Reply