১৯৫৯ সালের ৩১ আগস্ট শহীদ মিনার ময়দানে তিন লক্ষাধিক মানুষ জমায়েত হয়েছিল খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের অপসারণ এবং খাদ্যের দাবিতে। পুলিশ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। এই খাদ্য আন্দোলনে ৮০ জন শহীদ হন, নিখোঁজ হন অন্তত ২০০ মানুষ। তখন পুলিশ মন্ত্রী ছিলেন কালিপদ মুখার্জী। ১৯৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করতেও অস্বীকার করেছিলেন কংগ্রেস এবং পিএসপি সদস্যরা। এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি উড়িয়ে দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। ঐদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিধান রায় মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে বিরোধী নেতা হিসেবে জ্যোতি বসু বাংলায় প্রায় আধ ঘণ্টার একটি ভাষণ দেন। বিধান সভার কার্যবিবরণী থেকে ভাষণটি সংগৃহীত।
স্যার, আমি এই প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই যে এই সভা মন্ত্রিপরিষদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।
মাননীয় ডেপুটি স্পিকার মহাশয়, আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি গত দুমাস ধরে খাদ্য নিয়ে যে আন্দোলন হয়ে গেল অ্যাসেমব্লির বাইরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় থানায় এবং তার জন্য যে সাধারণ ধর্মঘট, আইন অমান্য ইত্যাদি চলেছে তা থেকে বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষ অনাস্থা প্রকাশ করেছে তাদের সরকারের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ বর্তমান মন্ত্রীমন্ডলীর বিরুদ্ধে। যাদের এই সরকার অত্যাচার করেছে, নিপীড়ন করেছে, যাদের এই সরকার পচা চাল খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এবং যাদের বাধ্য করেছিল ১৯ টাকা কন্ট্রোল দরে চাল কিনতে যে চাল ৩২ টাকা হয়ে গিয়েছিল তাদের কন্ট্রোল অর্ডার এর ফলে। তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে আজ আমরা এই সরকারের বিরুদ্ধে এখানে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি। আমরা মনে করি সেই সকল মানুষ, বিশেষ করে রক্তাক্ত কলেবরে যে মানুষ সংগ্রাম করেছে এই সরকারের বিরুদ্ধে যাদের সরকার শত হুমকি, শত অত্যাচার সত্ত্বেও দাবিয়ে রাখতে পারেনি, যারা তাদের দাবি নিয়ে প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন করে চলেছে, তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো যদি এই অনাস্থা প্রস্তাব আজ আমরা এই এসেম্বলির ভিতর না আনতাম। ঠিক তেমনি আমরা মনে করি বাইরে যখন চালের দাম অত্যন্ত বেড়ে গিয়ে চতুর্দিকে অন্য সংকট দেখা গেল এই সরকারের দোষে, তখন যদি সাধারন লোকের আন্দোলনকে গড়ে না তুলতাম তাহলে মানুষের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো। সেই জন্যই খাদ্য আন্দোলনে আমাদের যোগ দিতে হয়, এবং তারই জন্য আজ অনাস্থা প্রস্তাব আমরা এনেছি।
এই অনাস্থা প্রস্তাবের আমি দুটো বিষয়ের উপর বিশেষ করে আলোচনা করতে চাই। একটা হচ্ছে সরকারের খাদ্যনীতি এবং তার ফলে সারাদেশে যে খাদ্য পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে সরকার যেভাবে অকথ্য দমননীতি চালিয়েছেন খাদ্য আন্দোলন কে ধ্বংস করার জন্য, সেই ব্যাপারে এবং সরকার যেভাবে ষড়যন্ত্র করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে।
আমরা গত দুইদিন ধরে যেখানে খাদ্য এবং কতগুলি বেসরকারি প্রস্তাব রাখা হল সেখানে দেখলাম যে সরকার পক্ষ থেকে এবং তাদের সমর্থকদের পক্ষ থেকে একটি কথা বলা হয়েছে এই যে আমরা কি করব, আমরা তো নিরুপায়। তারা আবিষ্কার করেছেন যে খাদ্য ঘাটতি পশ্চিমবাংলায় যখন আছে তখন কি আর করা যাবে মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা আমরা যতটা পেরেছি করেছি কিন্তু খাদ্য উৎপাদন বেশি হচ্ছে না তার কারণ অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি উদ্বাস্তুদের দলে দলে আগমন, পাট চাষ বেশি হওয়ায় ধান উৎপাদনের জমির পরিমাণ কমে যাওয়া এইসব কারণে তারা বলছেন যে বেশি উৎপাদন না হলে আমরা কি করতে পারি। আমরা বলি এই জন্যই তো আমরা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি। এখানে দোষটা কার ? আমরা দেখছি ১২ বছর কেটে গেল কংগ্রেস পশ্চিমবাংলায় রাজত্ব করছেন, আট বছর পরিকল্পনা করলেন কিন্তু আমরা দেখছি শতকরা ৩ ভাগ এর বেশি জল সেচের ব্যবস্থা হয়নি, সেচের ব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে যা ছিল তা থেকে শতকরা ৩ ভাগ এর বেশি করতে পারেননি। আমরাদের দেখেছি শতকরা ২৮ ভাগ জমিতে বছরে এক ফসল হয়, দুই ফসল হয় না। আমরা দেখেছি গড়পড়তা সাড়ে তিন মন বিঘা প্রতি ধান উৎপাদন হচ্ছে। এই যে অবস্থা এর থেকে বোঝা যাচ্ছে ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের আগে যে অবস্থা ছিল উৎপাদনের ব্যাপারে তা থেকে কংগ্রেসের আমলে গড়পড়তা উৎপাদন কমে গেছে। এই যদি অবস্থা হয়ে থাকে এর জন্য অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, উদ্বাস্তু আগমন, অন্য কোন চাষ বৃদ্ধির জন্য জমি চলে যাচ্ছে এসব বললে চলবে না। এর জন্য সরকার দায়ী, কাউন্সিল অফ মিনিস্টারস – মন্ত্রীমন্ডলী দায়ী এর জন্য। সরকারের অপদার্থতা, সরকারের চরম ব্যর্থতা, গাফিলতি প্রমাণিত হয়েছে। তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। এই ব্যর্থতার ফলে পশ্চিমবাংলায় তারা চরম সংকট ডেকে এনেছেন। প্রথম কথা ছিল পশ্চিমবাংলার মানুষকে খাওয়াতে হবে, বারেবারে বলেছিলাম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। কোথাও তা হয়নি। কাজেই এই সরকারকে আমরা দোষী করছি। আমরা মনে করি এরকম অপদার্থ সরকারের নিজের থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। দ্বিতীয়তঃ এখানকার সরকার পক্ষ থেকে যা বলছে আর কেন্দ্রীয় সরকার থেকে যা বলা হচ্ছে – পন্ডিত নেহরু, শ্রী জৈন, শ্রী পাতিল এরা যা বলছেন তার মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। তারা বলছেন খাদ্য সংকট অন্য ব্যাপার, খাদ্য যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে, বাম্পার ফলন হয়েছে – এত খাদ্য ভারতবর্ষে কোনদিনই হয়নি এবং বলছেন যে পশ্চিমবাংলা যা কিছু সাহায্য চেয়েছেন আমরা তার অতিরিক্ত দিয়েছি। তাহলে এখানে কে সত্য কথা বলছেন – পশ্চিমবঙ্গ সরকার না কেন্দ্রীয় সরকার? এখানে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে। শ্রী জৈন বলেছেন পশ্চিমবাংলা সরকার যা চেয়েছিলাম তার বেশি দিয়েছি যা তাদের ঘাটতি তার থেকে বেশি দিয়েছি।
এটা আমরা হিসাব করে দেখেছি, প্রতিদিন বলেছি, ব্ল্যাক মার্কেটে অনেক খাদ্য চলে গিয়েছে এটা সত্য কথা নইলে এই অবস্থা হলো কি করে। এর থেকে আর চরম অপরাধ কি হতে পারে। আপনারা বলেছেন ৮ লক্ষ, ৯ লক্ষ টন ঘাটতি আছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছে তাহলে আর ঘাটতি নেই। তবুও কেন ৩৪ – ৩৫ টাকা মণ চাল কিনতে হয়। এরপর মানুষ এর প্রতিবাদ করল এবং আপনারা কি মনে করেন যে এর পরও মানুষ প্রতিবাদ না করে নতজানু হয়ে থাকবে। সমাজের মানুষ কি করে এটা করতে পারে। তারা কখনোই তা রাখতে পারেনা এবং এই সরকারের উপরে মানুষের আস্থা থাকতে পারে না। তারপর আমার যা মনে হয়েছে তাতে আমরা মনে করি বন্টন ব্যবস্থা ও উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর আস্থা মানুষ আজকে রাখতে পারেন না এবং এই সরকারের ওপর মানুষের আস্থা থাকতে পারেনা। তারপর আমার কথা হচ্ছে আমরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি, এর কারণ সরকার পক্ষ থেকে এবং বিশেষ করে মন্ত্রীমন্ডলীরা – আগেও দেখেছি আগেও বলেছি – এমন ষড়যন্ত্র করলেন, নিকৃষ্টতম ষড়যন্ত্র, অমানুষিক ষড়যন্ত্র করলেন যে বাংলাদেশের মানুষকে চিরকালের মতো শিক্ষা দেবেন। এই ব্যবস্থা করে তাঁদের উপর আক্রমণের ব্যবস্থা করলেন। তারা বললেন বাংলার গ্রামে ও শহরে বিভিন্ন জায়গায় এমন শিক্ষা দেবেন যাতে তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, কোন আন্দোলন বা প্রতিবাদ আর কোন মানুষ না করতে পারে। এই মনে করে কলিকাতা, হাওড়া ও শিল্পাঞ্চলে এমন ব্যবস্থা করলেন যে ব্যবস্থার ফলে মানুষের মনে সেই শিক্ষা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের অত্যাচারের কাহিনী মনে করাতে এই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি।
সেদিন ওদিক থেকে বক্তৃতা দিলেন শ্রী শংকর দাস ব্যানার্জি তিনি আমাদের বললেন যে আমরা নাকি রাইটার্স বিল্ডিং ক্যাপচার করবো বলেছি। আমরা বলেছিলাম রাইটার্স বিল্ডিং যাব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙবো, দলে দলে ১৪৪ ধারা ভাঙবো, একজন দুজন করে নয়, হাজার হাজার লোক ১৪৪ ধারা ভাঙবো, রাইটার্স বিল্ডিং ক্যাপচার করব একথা বলিনি। এখানে এইভাবে মিথ্যা কথা সাজানো হয়েছে যাতে করে তারা এই দমননীতি চালাতে পারেন। এই কথা আবার বলতে হচ্ছে, এ কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে, ৩১ তারিখে পুলিশের গায়ে আঁচড়ও পড়েনি, আঁচড় না লাগলেও ১৪ হাজার কনস্টেবল সমস্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছন থেকে। সামনে থেকে, চারপাশ থেকে, এবং লাঠিপেটা করলো লোকের উপর। এবং ছাত্রদের উপর ১লা তারিখে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। এখানে এমন চমৎকার ঘটনা ঘটে গেল যে পুলিশ কতকগুলি কেস, মামলা শুরু করল এবং অমর বসু প্রভৃতি কয়েকজন কে সেই লক্ষ্যে আটকে রাখবার চেষ্টা করল এই বলে যে পুলিশের উপর এরা আক্রমণ করেছে। এইভাবে ওয়েলিংটন স্কোয়ার এর সামনে ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে দুইটি মামলা সাজাবার চেষ্টা করলেন সে দুইটি মামলাই ভেস্তে গেল। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট কিছু দেওয়া হয়নি অথচ বারবার পুলিশের কাস্টডিতে রাখা হচ্ছে এবং জিজ্ঞাসা করলেই বলা হয় যে ইনভেস্টিগেশন শেষ হয়নি। এমনকি চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে এই দুইটি মামলার ডায়েরি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তিনি বললেন যে বারবার আপনার এড্রেস নিচ্ছেন অথচ এর ডায়রী পর্যন্ত নেই কোনো মামলা এদের বিরুদ্ধে নেই এই জন্য এদের ছেড়ে দিলাম। দুইটি ক্ষেত্রেই এই জিনিস দেখতে পেলাম। ৩১ তারিখে এবং ১লা তারিখে মিথ্যা মামলা করা হলো এবং তারপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হল।
এই জিনিস আমরা দেখলাম এবং এরপর আমরা দেখেছি আগেও এসব ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখলাম পণ্ডিত নেহেরু তাদের পার্টি মিটিংয়ে কংগ্রেস নেতা হিসেবে বলেছিলেন যে পশ্চিমবাংলায় যা হয়েছে তাতে পশ্চিমবাংলা কলঙ্কিত হয়েছে ভারত বর্ষ কলঙ্কিত হয়েছে এবং তার কন্যা ও বলেছিলেন গণতন্ত্রের বিপদ, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিপদ। একথা তিনি বলেছিলেন। আমরা ভাবলাম কেরলে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে তার পর অন্তত তিনি এখানেও গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাবেন। এখানে দু-দুটো জেনারেল স্ট্রাইক, স্টেট ওয়াইস সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়ে গেল, কোথাও কি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখতে পেলেন না? এমন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট কি কোথাও দেখেছেন? কিন্তু সে জিনিস তো হল না, পন্ডিত নেহরু সেদিকে তো নজর দিলেন না, তিনি এখানে গণঅভ্যুত্থান দেখলেন না, কেরোলি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখলেন। আরো তিনি বললেন যে অ্যাসেমব্লির ভিতর পবিত্র জায়গা, এখানে বিধানসভায় যে জুতো ছোড়াছুড়ি হয়েছে সেসব কথাও তিনি বললেন। আমি সেখানে বলতে চাই এটা সত্য কথা, যে গণতন্ত্রের বিপদ আমরা ওদের দেখেছি পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিপদ আমরাও দেখছি – কিন্তু সেটা কি শুধু এত দিনের মধ্যে অ্যাসেম্বলির ভিতরে যে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার বেলাই খাটে? তা নয়। এইযে প্রবিত্র জায়গা এটা কি শুধু অ্যাসেমব্লির ভিতর! পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি কি আমরা যখন বাইরে যাব কিংবা মাঠে-ময়দানে যাব সেইখানে, মাতৃভূমির আর কোন স্থানে কি পবিত্র জায়গা নেই? তিনি কি আর কোন জায়গা পবিত্র বলে জানেন না, শুধু কি অ্যাসেম্বলির হাউজের ভিতরে পবিত্র জায়গা বলে পন্ডিত নেহরু ঠিক করেছেন? পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি কি বাইরে থাকবে না – সুজুকি এর ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এটাই কি তিনি ঠিক করেছেন? কারণ এর একটু মুশকিল আছে। কারণ বাইরে কি হচ্ছে। এমনই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি যে আমি নাকি লিডার অফ অপজিশন এমনই লিডার অফ অপজিশন যে আমার নামই হচ্ছে প্রথম লিস্ট – এর মধ্যে যাকে বিনা বিচারে আটক করতে হবে। আমার বাড়িতে ভোরবেলায় পুলিশ চলে গেল বাড়ি সার্চ করবার জন্য। বিনা বিচারে আটক করা – এটাই কি পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি? কি এমন অপরাধ করেছিলাম যার জন্য এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরোলো? আমরা এমনই পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি দেখছি যে, আমার প্রতিটি চিঠি, করেস্পন্দেন্স, সিআইডি, ডিপার্টমেন্টের পুলিশ আই বি পুলিশ খুলে পড়ে, প্রতিটি টেলিফোন কল কান লাগিয়ে শুনে ট্যাপ করে। এরপরও কি আমাদের পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কথা শুনতে হবে? পন্ডিত নেহরু পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কথা শোনালেন, কিন্তু কেরলে কেন গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন? কেরলে তো আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, তথাপি প্রেসিডেন্ট আডভাইস করলেন যে কেরলে এদের দরকার নেই মেজরিটি থাক বা না থাক এদের পদত্যাগ করতে হবে, এদের তাড়িয়ে দিতে হবে। কেন তাড়িয়েছেন তাও বলেছেন। বলেছেন তারা কনস্টিটিউশন মতো চলছে না। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম কনস্টিটিউশন এর কোন ধারা ভায়োলেট করা হল? তা বলবেন না। কিন্তু তা তোমরা করেছো যে জন্য চলে যেতে হবে। সেখানে যে কোন পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিপদ তা তিনি দেখলেন না। শুধু জুতো ছড়াছড়িতে পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি র বিপদ এসে গিয়েছে, এই যদি সাধারন মানুষও তো বলতাম হামবাগিজম অ্যান্ড হাইসোক্রেসি কিন্তু পন্ডিত নেহেরু কে কি বলি? তিনি এত বড় নেতা তাকে কি বলি। তাকে শুধু বলবো, বিনীত ভাবে বলবো, আর একবার ভেবে দেখুন, চিন্তা করে দেখুন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আচ্ছা, আমাদের এখানে কি পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি আছে? বাইরে চলে গেলাম ডালহৌসি স্কোয়ারে, সেখানে যদি ১৪৪ ধারা থাকে, তা যদি ভাঙ্গে তাহলে আইন মতে গ্রেফতার করতে পারেন। কিন্তু কি দেখলাম। লাঠিপেটা করে মানুষকে মারলেন, গুলি করে হত্যা করল মানুষকে, পুলিশ। সেখানে নারীর মর্যাদা দিলেন না, যদি পারি তো আমি পন্ডিত নেহরুর কাছে ছবি পাঠিয়ে দেবো কিরকম ভাবে বিবস্ত্র নারী উপর পুলিশ অত্যাচার করেছে। কই তখন পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কথা কোনরকম সভ্যতার কথা পন্দিত নেহেরুর কাছে শুনিনি। শুনিনি তো তখন মন্ত্রীদের কাছে, অপরাধীদের কাছে কোন রকম দুঃখ প্রকাশ করতে এই ঘটনার জন্য? কিন্তু এই যে ঘটনা হলো, পন্ডিত নেহরু এত কথা বললেন কিন্তু কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ করতে পারলেন না। ৪১ জন মারা গেলেন সরকারি হিসাবে আমাদের মতে ৮০ জন – তিন-চার দিনের মধ্যে মারা গেল, বলি, পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি তখন কোথায় ছিল? এভাবে আমরা দেখলাম এরা মাতৃভূমির প্রতিটি জায়গায় – মাঠে ময়দানে ডালহৌসি স্কোয়ারে যেখানেই হোক এরা আক্রমণ করতে পারেন। তার পরেও কি বলবেন অ্যাসেমব্লির ভিতর পবিত্র জায়গা, কেন কিসের জন্য? অগণিত মানুষের উপর এত যে অত্যাচার হলো সেখানে কোন পবিত্রতা নেই?
এরা পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি র কথা বলেন – চুপচাপ থাকবেন, বেশি কথা বলবেন না, সাবধানে কথা বলবেন এই হচ্ছে এদের পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি। এদের পর্লামেন্টারি দেমোক্রেসি নমুনা ইংল্যান্ড, আমেরিকা কোথাও দেখিনি, শুনিনি। সুতরাং এই কথা আমরা শুনতে রাজি নই। পণ্ডিত নেহেরু বা মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার রায় – এদের কাছে আমি জানতে চাই, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি কি শুধুমাত্র এই হাউসের ভিতর! পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কথা যদি বলেন তবে সেই দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। এদের সঙ্গে আমাদের কোনো মতেই কম্প্রোমাইজ হতে পারে না – এদের সঙ্গে আমাদের মেলামেশা হতে পারেনা – এতদিন কি মিলন ছিল? কিসের ভিত্তিতে মিলন হবে? খাদ্যই শুধু নয়, কোন ব্যাপারেই হবে না, আপনারা গুলি করে মারবেন কৃষকদের, তাদের বলবেন হোর্ডার আর বড় বড় ব্যবসায়ী আড়তদারদের রক্ষা করে চলবেন – আপনাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য আছে। আপনাদের সঙ্গে আমাদের যদিও কোন কোন ব্যাপারে মিল হতে পারত আজ কি আর কোন ব্যাপারে মিলনের উপায় আছে? আমি অন্তত জানি না। আজ কোথায় আপনাদের সঙ্গে আমরা হাত মেলাবো? রক্তাক্ত যাদের হাত, যারা এভাবে নির্মম অত্যাচার করতে পারে এবং ৩ দিনের মধ্যে ৪১ জন লোককে গুলি করে হত্যা করতে পারে তাদের সাথে আমাদের কোথায় মিলতে পারে? আমরা দুই ভিন্ন ধরনের নীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি – আপনাদের নীতির মধ্যে মানবতার কোনো লক্ষণ নেই। এতে জনসাধারণ পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি পাবে না। এজন্য অনাস্থা প্রস্তাব এনে আমরা বাংলাদেশের লোক কে সজাগ করার চেষ্টা করছি কোন ফ্যাসিস্ট পথে আপনারা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন, কোন ধ্বংসের মুখে দেশকে ছেড়ে দিচ্ছেন।
অনেকে বলে থাকেন, এবং ডাক্তার ঘোষ ও বলছেন, আরো আলোচনা করলে পারতেন। ডাক্তার ঘোষ জানেন যে, এ নিয়ে আমরা ছয় মাস ধরে আলোচনা করেছি – এই অ্যাসেম্বলিতে বহু আলোচনা করেছি। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারে বারে তা ভঙ্গ করেছেন। তারা কন্ট্রোল অর্ডার করলেন – সব ফাঁকির কথা, সব মিথ্যা কথা বলেন, – ছয় মাস যেতে না যেতে আরতদার, বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে সব চাল চলে গেল – তারা কন্ট্রোল অর্ডার ডিফাই করতে আরম্ভ করলো যখন তখন আপনারা কন্ট্রোল তুলে দিলেন। এখানে কেন্দ্রীয় অফিসার এসেছেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। দেবেন বাবু যে কথা বলেছেন, খাদ্য উপদেষ্টা কমিটিতে বারেবারে আপনারা আমাদের অপমান করেছেন – আপনারা কখনো আমাদের কনফিডেন্সে নেন নি। আমরা অনেক রকম সাজেশন করেছি, কিন্তু আমাদের কোন কথায় আপনারা কর্ণপাত করেননি। আজ চালের দাম ৩২ টাকা উঠেছে। আপনারা কি ভেবেছেন চিরকাল মানুষকে ধাপ্পা দিয়ে দাবিয়ে রাখতে পারবেন। আপনারা কেরালার কথা বলেন – নাম্বুদিরিপাদ এর মন্ত্রিসভা যখন হয় তখন সেখানে যে ডেমোনস্ট্রেশন হয়েছিল সেই ডেমোস্ট্রেশনে মন্ত্রীদের ধাক্কা দিয়ে অ্যাসেমব্লির ভিতরে গিয়েছিল তারা কি করেছিলেন? আর আপনাদের এখানে হলে আপনারা কি করতেন? তারা ডেমনস্ট্রেটর দের বলেছিলেন, তোমরা কি চাও, তোমরা কেন এসেছ? পণ্ডিত নেহেরু কি একথা জানেন না? সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল, তার জানবার কথা। কিন্তু তখন তো তিনি পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির কোন বিপদ দেখেননি। কেরালা লেবার মিনিস্টার আন্দোলনের সময় পথ দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন, তখন তার হাতে আসল্ট করা হয় একথা পন্ডিত নেহেরু জানেন না? তখন তো তিনি কিছুই বলেননি। পন্ডিত নেহরু এবং তার কন্যা বলেছিলেন কেরালায় গুলি চালিয়েছে, জুডিশিয়াল এনকোয়ারি করা হোক। এখানে মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে এখন তো পন্ডিত নেহেরু তার কন্যা কিছু বলছেন না। আমি মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার রায় কে জিজ্ঞাসা করছি তিনি তার কি জবাব দেবেন। ডাক্তার রায় এবং কালিপদ মুখার্জী কন্ট্রোল রুমে বসে অর্ডার দিলেন ছাত্রদের লাঠিপেটা করো। আপনারা চরম অপরাধী। যদি আপনারা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির এতই ভক্ত হন তাহলে একটা পাবলিক এনকোয়ারি করছেন না কেন? আজকে মানুষ আপনাদের ধিক্কার দিচ্ছে। মানুষ যা শরীরে কতটুকু রক্ত আছে আপনাদের কখনো ক্ষমা করবেন না। আমাদের মধ্যে একটা প্রাচীর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, যাদের রক্তে বাংলাদেশের মাটি রাঙা হয়েছে, তাদের আমরা ভুলতে পারি না, তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য আছে। তাই আমরা আজ এই অনাস্থা প্রস্তাব এনেছি।