Jyoti Basu

Jyoti Basu: He is equally relevant in today’s politics – Rabin Dev

শুধু বামপন্থী ও কমিউনিস্ট আন্দোলনেই না, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশে জ্যোতি বসু যে অবদান রেখে গেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর এই অবদানের কথা আমাদের স্মরণ করতে হবে।
সংসদীয় রাজনীতিতে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় তিনি কাজ করেছেন। ১৯৪৬ থেকে মাঝখানে বাহাত্তরের জালিয়াতি নির্বাচনের পাঁচ বছর বাদ দিলে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা ৫০ বছর ধরে মানুষের রায়ে নির্বাচিত হওয়ার অনন্য নজির তিনি গড়েছেন। সদ্য স্বাধীন ভারত কিভাবে গড়ে উঠবে, সে সম্পর্কে একজন তরুণ বিধায়ক হিসাবে তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন। ১৯৪৮সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নিহত হওয়ার পর সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৪৮সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় এবিষয়ে শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তরুণ কমিউনিস্ট সদস্য জ্যোতি বসু আলোচনা করতে গিয়ে গান্ধীজীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন: ‘‘…গভীর দূরদৃষ্টিতে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সাম্প্রদায়িক হানাহানি আবার একবার পরাধীনতার নয়া সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল আমাদের পায়ে পরিয়ে দেবার পথ প্রশস্ত করবে। যখন ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আমাদের মন ছেয়ে ফেলেছিল, হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর যন্ত্রণাবিদ্ধ চিৎকারে বাতাস যখন ভারী হয়ে উঠেছিল, এমনকী কংগ্রেসের নামীদামি নেতারাও যখন আদর্শচ্যুত, এই সর্বজনীন ঘৃণার প্লাবনের গতিরুদ্ধ করতে কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব যখন সর্বাংশে ব্যর্থ, তখন নিজস্ব সহজ-সরল পথে গান্ধীজী নোয়াখালি, কলকাতা, দিল্লি, দেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের দরজায়-দরজায় তাঁদের মৌলিক মনুষ্যত্বের দরবারে আবেদন জানিয়ে ফিরেছেন।…’’


পরে ১৯৯৯ সালে ‘একুশ শতকের ভারত’কে তিনি কিভাবে দেখতে চান, সেই প্রশ্নের উত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আমাদের দেশের ঐতিহ্য। একটি বহুজাতিক, বহু ভাষাভাষী, বহু ধর্মীয় ও বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন সমাজের বৈচিত্রকে আমাদের দেশ রক্ষা করে চলেছে। এই ঐতিহ্য যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, তা দেখা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মজবুত করে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব। জনজীবনের নৈতিকতাকে সুউচ্চ রাখতে হবে। নৈতিকতার ব্যাপারে মূল্যবোধহীনতা ও কদাচার যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, প্রশাসনিক কঠোর ব্যবস্থা এক্ষেত্রে যেমন প্রয়োজন, তেমনই ব্যাপক সদিচ্ছা জরুরি।’’ (১৯৯৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘একবিংশ শতাব্দী : কিছু ভাবনা, কিছু পুরানো কথা’)।


১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত লাগাতার ৮৫৪০ দিন ধরে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার বিরলতম নজিরও তিনি গোটা দেশের সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে, ক্ষমতায় যেনতেনপ্রকারেণ টিকে থাকার জন্য ভারতের রাজনীতিতে যখন আত্মসর্বস্বতার নিকৃষ্ট উদাহরণ আকছার মিলছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নিয়ে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের সামনে আত্মত্যাগের নজিরবিহীন উপমা তুলে ধরেছেন জ্যোতি বসু।
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার অনন্য পথিকৃৎ ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। সংসদীয় গণতন্ত্রে দীর্ঘসময় থাকার কারণে জ্যোতি বসুকে কখনো বিরোধী দলের বিধায়ক, কখনো বিরোধী দলের নেতা, কখনো উপ-মুখ্যমন্ত্রী এবং সর্বোপরি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা শুধু তত্ত্বগতভাবেই নয়, বাস্তবেও তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরেছেন। বিরোধী দলের নেতা থাকাকালীন সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায়, সংসদীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করায় তিনি যে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সেই সময়ের বিধানসভার অধিবেশনের কার্যবিবরণী দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন।


স্বাধীনতার পর ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, তা রাজ্যে রাজ্যে এবং পরবর্তীতে গোটা দেশের ক্ষেত্রে খর্ব করতে ‘কোয়ালিশন পলিটিকস’ বা জোট রাজনীতির কৌশল প্রয়োগ করার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার পিছনে ছিল এই রাজনীতিই— ছিল কমিউনিস্টদের কৌশল। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার পতনের পর রাজ্যজুড়ে প্রচার আন্দোলনের ঝড় ওঠে। নেমে আসে নৃশংস আক্রমণ। খুন, সন্ত্রাস, বিনা বিচারে আটক, মিথ্যা মামলায় জড়ানো সহ স্বৈরাচারী কাজ চলে ব্যাপকভাবে।
১৯৭২-এ সংসদীয় গণতন্ত্রকে কোতল করার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁর লেখা ‘সাবভার্সন অব ডেমোক্রেসি’ নামে একটি পুস্তিকা দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জুন বিবিসি থেকে এই মর্মে প্রচারিত হয় জ্যোতি বসুর বেতার ভাষণ।


১৯৭২ থেকে ৭৭, আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস, জরুরি অবস্থার দিনগুলিতে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ৭৭, এই সময়ে বামপন্থীদের মধ্যে জোটে কয়েকবার ভাঙাগড়া হয়েছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার মধ্যে দিয়েই বামফ্রন্ট তৈরি হয়েছে। প্রথমে ৬দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট ১৯৭৭ সালের ২১ জুন সরকার গঠন করে। ১৯৮০ সালে সিপিআই যুক্ত হলো। পরে ৮দল এবং সর্বশেষে দশটি দলকে নিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন জ্যোতি বসু। অজস্র কুৎসা, অপবাদ, হুমকি, কারাবাস, মিথ্যা মামলা, ষড়যন্ত্র, অপপ্রচারের জালকে যেমন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করেছেন, তেমনি উদ্দীপ্ত করেছেন, প্রেরণা দিয়েছেন শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত কর্মচারী, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ছাত্র-যুব-মহিলা আন্দোলনকে। পুষ্ট করেছেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে, আমাদের দেশের ও আমাদের রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বাস্তবানুগ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একটি অঙ্গরাজ্যে সীমিত আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিকল্প কী কর্মসূচি নেওয়া সম্ভব হতে পারে তা জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গোটা দেশের সামনে হাতেকলমে সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছিল। দেশে জোট রাজনীতির যুগে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর ধরে চলা ৯ দলের একটি দৃঢ় জোট হিসাবে বামফ্রন্ট সরকার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরেছিল। কারণ জোট সরকার মানেই যখন অস্থিতিশীল, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বলে প্রমাণ হচ্ছিলো, তখন এরাজ্যে এই জোট স্থিতিশীল, শান্তির পরিবেশ এবং জনমুখী উন্নয়নের নজির তৈরি করে গোটা দেশের সামনে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম তুলে ধরেছিল। একথা আজ সকলেরই জানা যে এরাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে অনুকরণ করেই গোটা দেশে তা রূপায়ণের জন্য আইন তৈরি করা হয়েছে। ভূমি সংস্কার, কৃষি ও গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে। পাশাপাশি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, শান্তি-সুস্থিতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় ক্ষেত্রেও দেশের সামনে জ্যোতি বসুর পশ্চিমবাংলা উদাহরণ তৈরি করেছিল। আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং তৃণমূলস্তরে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের সামনে মডেল হিসাবে স্বীকৃত।

Taking Oath for 5th Left Front Govt. on 20/05/1996


শুধু জোট রাজনীতির প্রশ্নই নয়, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকেও সামনে তুলে এনেছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারই। রাজ্যগুলির হাতে আরও বেশি আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার দাবিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের ইস্যুকে সামনে রেখে গোটা দেশে অকংগ্রেসী বিরোধী দলগুলি এবং বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসবিরোধী দলের দ্বারা পরিচালিত সরকারগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। শ্রীনগর, কলকাতা ও বিজয়ওয়াড়ায় বিরোধী দলগুলির কনক্লেভের নেতৃত্ব দেন তিনিই। কংগ্রেসের একচেটিয়া আধিপত্য ভাঙার লক্ষ্যে কোয়ালিশন রাজনীতির সূচনা এভাবেই তাঁর নেতৃত্বে ভারতে শুরু হয়েছিল। একটি রাজ্যের সফল ও জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কখনো প্রাদেশিকতার গন্ডির মধ্যে তিনি সীমাবদ্ধ না থাকায় জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর সর্বজনগ্রাহ্যতা ও নেতৃত্বের আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের অখণ্ডতা, সংসদীয় গণতন্ত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাঁর ঋজু ও দৃঢ় অবস্থান সমগ্র ভারতেই দল-মত-নির্বিশেষে উচ্চপ্রশংসিত হতো। ১৯৮৭ সালের ২৫ এপ্রিল দিল্লির অন্ধ্র হলে বিরোধী দলগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে জ্যোতি বসু যে অসাধারণ বক্তব্য রেখেছিলেন, তার পরদিন সেই সময় তাঁর কট্টর সমালোচক আনন্দবাজার পত্রিকাও লিখতে বাধ্য হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রনায়কের মতো বক্তব্য করেছেন জ্যোতি বসু।’ ১৯৮৯ সালে ভিপি সিং-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকার গড়ারও অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। এই সময়েই ভারতে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যানন্ডেলা। ১৯৯০ সালের ১৮ অক্টোবর ইডেন উদ্যা নে বিশাল সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং-র উপস্থিতিতে জ্যোতি বসু সংবর্ধনা জানান ম্যািন্ডেলাকে। এই সমাবেশ শেষেই ভিপি সিং এবং জ্যোতি বসু দিল্লিতে গিয়ে যৌথভাবে রথযাত্রার নামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি বন্ধ করতে আবেদন জানিয়েছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিকে।
জাতীয় রাজনীতিতে অকংগ্রেসী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর নেতৃত্ব খুব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে রাজি হয়েছিল। এইচডি দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে সংযুক্ত মোর্চার সরকার গঠিত হলে গঙ্গার জলবণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি করার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জ্যোতি বসু। ১৯৯৬ সালের ১২ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের মধ্যে এই আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০০০ সালের ৬ নভেম্বর জ্যোতি বসু শারীরিক কারণে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। অবসর নিলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আমাদের রাজ্য এবং গোটা দেশের গণআন্দোলনে অন্যতম পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘কমিউনিস্টদের কাছে কোনও অবসর নেই। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাপগ করা পর্যন্ত তাদের মানুষের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে।’

JYOTI BASU PRIZE DICCHEN TAR NATNI DOYEL BASU KE/NEHRU CHILDREN MUSEUM HALLE TOLA CHBI ON 19/11/1998


সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকার গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি এবং সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক হরকিষাণ সিং সুরজিৎ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেকথা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ইউপিএ চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী বারেবারে স্বীকার করেছেন।
২০১০ সালের ১৭জানুয়ারি জ্যোতি বসু শেষ নিঃশ্বাস ত্যারগ করেন। ২০১০’র ১৯ জানুয়ারি এক কমিউনিস্ট নেতার মরদেহ রাষ্ট্রীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গান স্যালুট দিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রী, বিদেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রনেতাদের ও তাঁদের প্রতিনিধিদের উপস্থি‍‌তিতে এক জনজোয়ারে শেষ বিদায় জানানো হয় কমরেড জ্যোতি বসুকে। সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষের পদচারণায় রেড রোড হয়ে উঠেছিল প্রকৃতই রেড রোড।
জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের পর তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা ও শোক জানাতে গিয়ে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রনেতারা ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসাবে তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা বারেবারে উল্লেখ করেছেন।


কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে মানুষই ছিল শেষ কথা, জনগণই ছিল তাঁর শক্তির উৎস। তাঁর সত্তর বছরের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন অংশের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম-আন্দোলন-ধর্মঘটে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কেবল যখন বিরোধীপক্ষের বিধায়ক বা বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তখনই নয়, যখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী কিংবা বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখনও। মানুষের প্রতি অপরিসীম আস্থা ও ভালোবাসা থেকেই তিনি পেয়েছিলেন মানুষের ভালোবাসা।
জ্যোতি বসু ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রক্ষার যে আদর্শের জন্য সারা জীবন লড়াই করে গেছেন, বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে তা আক্রমণের মুখে। ফ্যাসিবাদী সংগঠন আরএসএস’র মতাদর্শে চালিত বিজেপি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। অসামান্য দূরদর্শিতায় এই বিপদকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলেই তিনি এবং হরকিষাণ সিং সুরজিৎ ২০০৪ সালে বিজেপি’কে ক্ষমতা থেকে দুরে রাখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। এরাজ্যেও গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর তীব্র আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তৃণমূল সরকার। শুধু তাই নয়, বিজেপি’র সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তৃণমূল প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় নেমেছে। যার জেরে এরাজ্যে আরএসএস ক্রমশ ডালপালা বিস্তার করে চলেছে। জ্যোতি বসু বারবার সতর্ক করে বলতেন, ‘তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ, ওরা এরাজ্যে বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এরাজ্যে ডেকে এনেছে।’ তাঁর এই সতর্কবাণী মনে রেখে আমাদের আগামীদিনে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো রক্ষার শপথ গ্রহণ করতে হবে।
অনেক বাধা, বিপত্তি অতিক্রম করে সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় কমরেড জ্যোতি বসুর স্মৃতিতে গঠিত ‘জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’-র প্রথম পর্যায়ের কাজ তাঁর ১৫তম প্রয়াণ দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে। জ্যোতি বসু যে আদর্শের জন্য সারাজীবন লড়াই করেছেন, এই সেন্টার তা চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। নতুন প্রজন্ম যেমন লড়াই-আন্দোলনে এগিয়ে আসছেন, তেমনি সমাজবিজ্ঞান গবেষণার লক্ষ্যে এই সেন্টার নির্মাণে ও ব্যবহারেও তারা এগিয়ে আসবেন, সেই আশা রয়েছে।

Spread the word

Leave a Reply