Chandan Das Cover

Jinnah-Savarkar, Erdogan-Modi, And The ‘State’

চন্দন দাস

স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি ধারা ছিল। স্বাধীনোত্তর ভারত গঠনেরও ছিল তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি।

‘দেশ’-র ধারনায় তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি আজও আছে। আজও আছে সেই তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির পারস্পরিক সম্পর্ক, দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে দেশ গঠনের প্রশ্ন। 

স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনটি ধারার একটি ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নামক মঞ্চের। একটি সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসুদের মত সশস্ত্র সংগ্রামীদের। তৃতীয় ধারাটি ছিল কমিউনিস্টদের — যাদের পথ ছিল শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তদের সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার। সশস্ত্র সংগ্রামীদের অনেকেই পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন।

স্বাধীনতার পরে দেশ কোন পথে এগোবে, সেই ক্ষেত্রেও তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। একটি কংগ্রেসের। একটি কমিউনিস্টদের। অন্যটি মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির।

Nehru-and-UCC

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, ভারতের বৈচিত্রকে মর্যাদা দিতে হবে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন অবিভক্ত। সিপিআই-র পক্ষ থেকে কংগ্রেসের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করা হয়। তবে কমিউনিস্টরা স্পষ্ট  দাবি তোলে দেশবাসী যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবে তাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। একমাত্র তাহলেই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারনা রক্ষিত হতে পারে। সেই পথেই দেশ সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে। ভারতের বৈচিত্রের বৈশিষ্ট্যকে ভিত্তি করে সেই সময় কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ভারত যদি সমাজতন্ত্রের দিকে, অর্থনৈতিক সমতার দিকে এগিয়ে না যায় তবে দেশের মানুষের মধ্যে ক্রমশ অসন্তোষ গড়ে উঠবে। যা একটি সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিপন্ন করবে।

আজকের ভারতের পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের মতাদর্শ, দূরদৃষ্টির কথা বিচার করা আবশ্যিক।

তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল প্রথম দুই দৃষ্টিভঙ্গির থেকে আলাদা, প্রবল বিরোধী। সেদিনের মুসলিম লীগ এবং আরএসএস, হিন্দু মহাসভার দাবি ছিল — ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ব্যাখ্যা করতে হবে। এই ক্ষেত্রে মহম্মদ আলি জিন্নাহ এবং বিনায়ক দামোদর সাভারকার খুবই কাছাকাছি ছিলেন।

ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান গড়ে উঠেছিল। হিন্দুত্ববাদীরা তাকে সমর্থন করেছিল। কী হাল হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সেই পাকিস্তানের — তা আজ স্পষ্ট। সেদিন ভারতে সাভারকার, সঙ্ঘের ধারনা জয়ী হতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৬ বছরে তারা দেশের ক্ষমতায়। স্বভাবতই তাদের শাসনে বিপন্ন দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ধারনা।

আসলে বিপন্ন সেই ‘ভারত।’ কখন? যখন উগ্র দক্ষিণপন্থা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় মাথা তুলছে।

‘ঐস্লামিক জাতিয়তাবাদ’-র কথা বলছেন এরদোয়ান। তুরস্কে। তিনিই সে দেশের শাসক। সেই দেশ একসময় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম অহঙ্কারের ভূখন্ড ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল দেশের আদর্শ। এখন, বারবার এরদোয়ানের ক্ষমতা দখলের অ্যাজেন্ডা হয়ে উঠেছে ‘ঐস্লামিক জাতিয়তাবাদ’।

অনেকটা ‘হিন্দু জাতিয়তাবাদ’-র মত। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক এই জাতিয়তাবাদের কথা বলে। জন্মলগ্ন থেকেই বলে। কিন্তু সেই ঘোষনা, বিশেষত গত চার বছরে, মোদী-শাসনে তীব্র হয়েছে।

সঙ্ঘ এখন শাসনের কেন্দ্রে পৌঁছেছে। প্রশাসন, পুলিশ, সামরিকবাহিনীসহ দেশ পরিচালনার নানা অঙ্গে তারা ঢুকে পড়েছে। রাম মন্দিরের কথাই ধরা যাক। তার নির্মাণ চলছে। বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল উন্মত্ত করসেবকরা। আর সেই জমিতে আইনি পথে রাম মন্দির বানানো হচ্ছে। সেই রাম মন্দিরকে কেন্দ্র করে অযোধ্যা-উন্নয়ন যজ্ঞে টাকা খরচ কেন্দ্রীয় সরকারের — মানুষের করের টাকা।

ভারতে দক্ষিণপন্থা ছিল। কিন্তু সেই সাবেক দক্ষিণপন্থার সঙ্গে আজকের উগ্র দক্ষিণপন্থার অনেক তফাৎ। যারা এই গণতান্ত্রিক কাঠামোই মানে না, যারা গনতন্ত্রের ধারনা মানে না, যাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে ঘোর বৈরিতা, সেই উগ্র দক্ষিণপন্থার ক্ষমতা দখল এই প্রথম।

কিন্তু এই প্রবণতা শুধু জাতীয় প্রবণতা নয়। এখন, এর চেহারা আন্তর্জাতিক।

জর্জিয়ো মেলোনি? তিনি ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’-র নেতা। যুব আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি এখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী। তিনি বেনিতো মুসোলিনির সমর্থক এবং একজন মহিলা। রোম দখল করার জন্য মুসোলিনির মার্চের ঠিক ৭০ বছর পরে সংসদীয় ব্যবস্থায় ইতালির শাসক হয়েছেন মুসোলিনির সমর্থক!

উদাহরণ এই মুহূর্তে আরও আছে। জার্মানিতে আছে। ফ্রান্সে আছে। স্পেন, সুইডেনে আছে। সর্বত্রই তারা শাসক দল নয়। কিন্তু তারা রীতিমত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এবং তা মানুষেরই ভোটে — নির্বাচনী ব্যবস্থায়। এই দলগুলি প্রধানত ভিন দেশ থেকে সেই দেশে যাওয়া মানুষদের প্রতি বিদ্বেষী। যাবতীয় সঙ্কটের কারন তারা সেই ভিন দেশ থেকে নানা কারনে যাওয়া মানুষদের চিহ্নিত করছে। যেমন ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ কী বলছে? তারা প্রচার চালাচ্ছে — সমস্ত অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ইতালি শুধু ‘প্রকৃত ইতালিয়ান’দের জন্য।

আরএসএস কী বলে? এই দেশে আর্যদের। হিন্দুরাই আর্য। বাকিরা বহিরাগত। সেই সূত্রে সঙ্ঘের রাজনৈতিক মুখোশ বিজেপি কী করছে? এনআরসি। সিএএ। ‘অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ’। আসলে মুসলমানদের নির্দিষ্টকরণ — তাদের তাড়ানোর সরকারি উদ্যোগই এনআরসি, সিএএ।

তবে ইউরোপের সঙ্গে ভারতের একটি অমিল আছে। ইউরোপের দেশগুলিতে অভিবাসীরা ভিন দেশ থেকেই যেতে বাধ্য হয়েছেন নানা কারনে। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা বহিরাগত নন। তাঁরা এই দেশেরই মানুষ। তাঁদের অনেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপটে নির্যাতিত অংশ।

তবে সাদৃশ্য আছে দেশে দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থার। সমাজের কোন না কোন অংশকে তারা যাবতীয় সঙ্কটের কারন বলে চিহ্নিত করে। তার ভিত্তিতে জাতিয়তাবাদের প্রচার চালায়। একে ‘এথনো ন্যাশনালিজম’ বলা হয়। সেই প্রচার মূলত বিদ্বেষমূলক, হিংসাত্মক। আর একটি সাদৃশ্য সামগ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতির সূচক। সোভিয়েতের সাময়িক বিপর্যয়ের পরে প্রচার হয়েছিল মুক্তবাজার অর্থনীতি এক সুদিন নিয়ে আসবে। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় সবার আর্থিক, সামাজিক উন্নতি হবে। কিন্তু তা একটি বিরাট ধাপ্পা, সেদিন কমিউনিস্টরা তা সোচ্চারে বলেছিল। আজ প্রমাণিত। তীব্র সঙ্কটে সাম্রাজ্যবাদ, আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি। ধনী আরও ধনী হয়েছে। সম্পদ মুষ্ঠিমেয়র কব্‌জায়। এই পরিস্থিতিতে সঙ্কট থেকে নজর ঘোরাতে মাথা তুলেছে উগ্র দক্ষিণপন্থা।

ভারতে অতি দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক দলের পাশে দাঁড়িয়েছে কর্পোরেটরা।

আজকের ভারতে চ্যালেঞ্জ বিজেপি-র আর্থিক নীতিকে রোখা। একইসঙ্গে বিপন্ন ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে রক্ষা করতে হবে। লড়াই তাই দ্বিমুখী। যদিও দুটি ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত।

Capitalism is the crisis

দেশের নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করতে রাজ্যসভায় বিল পেশ করেছে মোদী সরকার গত ১০ই আগস্ট। এই বিলে তিন নির্বাচন কমিশনার বাছাই প্যানেল থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকেই বাদ দেওয়া হয়েছে! তিন সদস্যের বাছাই প্যানেলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির বদলে ‘প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত কোনও মন্ত্রীকে’ রাখার নির্লজ্জ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে!

দিল্লি সার্ভিস বিলে কী দেখা গেল? লোকসভায় ধ্বণিভোটে পাশ করিয়ে রাজ্য সভায় গত ৮ই আগস্ট বিলটি পেশ করেছিল বিজেপি সরকার। সেখানে ভোটাভুটিতে জিতে বিলটি পাশ হয়েছে। বিলটির লক্ষ্য কী? দিল্লির নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা থাকবে না আধিকারিক নিয়োগ ও তাদের বদলির কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার। সবই কেন্দ্রই নিয়ন্ত্রণ করবে। সংবিধান রচনার সময়ে গণপরিষদে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। একটি নির্বাচিত সরকারের মানুষের কাছে দায়িত্ব পালনে দায়বদ্ধ থাকার কথা সংবিধানে আছে। রাজ্য সরকার ক্ষমতা সেখানে নির্দিষ্ট করা আছে। দিল্লি সার্ভিস বিলে দিল্লির নির্বাচিত রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যা সংবিধানের নীতি বিরোধী। স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ। এবং অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী।

স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ আমাদের রক্ষা করতেই হবে। রক্ষা করতে হবে ‘ভারত’-কে। আর্থিক, সামাজিক সমতার লক্ষ্যে লড়াই এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার সংগ্রাম অঙ্গাঙ্গী। সেই লড়াইয়ের অগ্রগতির জন্য বিজেপি-কে পরাজিত করতেই হবে।

Spread the word

Leave a Reply