সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং একুশের চেতনা
মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে মহান একুশের আন্দোলন আজ দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে একটি জ্বলন্ত প্রতিবাদ হিশেবে গোটা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের আদর্শ। ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রামে একুশের চেতনা গোটা বিশ্বের কাছে প্রেরণা। মুসলিম জাতীয়তাবাদ , যা অবিভক্ত ভারতে হিন্দুত্বের মোড়কে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদের পাল্টা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল,সেই ভাবনা বিচ্ছেদের ভূগোলকে নির্মাণ করে দেশভাগের ভিতর দিয়ে।দেশ ভাগের মাত্র পাঁচ বছরের ভিতরেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান, আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মানুষ মহান একুশের লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে সেই “মুসলিম জাতীয়তাবাদে”র কফিনে পেরেক পোঁতার কাজ শুরু করেছিলেন।সেই কফিনে শেষ পেরেক তাঁরা পুঁতেছিলেন অবিভক্ত পাকিস্থানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে(১৯৫৪)মুসলিম লীগ কে গোহারা হারিয়ে দেওয়ার ভিতর দিয়ে।এই একুশের অখন্ড বাঙালি জাতি সত্তার সম্যক বিকাশের ভাবনাই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ও বীজ রোপন করেছিল।
জিন্নার ভিতরের আপাত দ্বৈততার চরম নিদর্শন আমরা পেয়েছিলাম প্রথম পূর্ব পাকিস্থানে তাঁর সফরের ভিতর দিয়ে।একদা যাঁকে সরোজিনী নাইডুর মতো মানুষ ” হিন্দু মুসলমানের মিলনের অগ্রদূত ” বলে প্রাণভরা শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, সেই জিন্নাই জাতীয় আন্দোলনের কালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সদম্ভ পদচারণায় বাধ্য হয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতার কোটরে আশ্রয় নিতে।বিগত শতাব্দীর তিনের দশকের সূচনা পর্বেই পুনেতে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার চেষ্টা করে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির।তারা সেবার ব্যর্থ হলেও জাতীয় কংগ্রেসের ভিতরে বল্লভভাই প্যাটেল, বসন্ত শ্রীহরি অ্যানে প্রমুখের মাধ্যমে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমে ক্ষমতাবান হয়ে ধীরে ধীরে গান্ধীযুগের অবসান ঘটাতে চাইছে -এটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি জিন্নার। তাই পন্ডিত নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত নয়, গান্ধীযুগের অবসানে জাতীয় কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র থেকে দূরে ঠেলে দেবে-এই আশঙ্কাই ১৯৩৩ সালে কেমব্রিজের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলির পাকিস্থান ভাবনাকে ছাত্র সুলভ প্রগলভতা বলে উড়িয়ে দেওয়া জিন্নাকে ঠেলে দিয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের কোটরে।করে তুলেছিল “মুসলিম জাতীয়তাবাদ” এর প্রবক্তা।
সেই জিন্নাই পাকিস্থানের সংবিধান সভাতে ধর্মনিরপেক্ষতাই পাকিস্থানের ভাবনাতে ঠাঁই পাবে-এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।সেই মানুষটিই আবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে প্রথম এসে অবিভক্ত পাকিস্থানের সংখ্যাগুরু বাংলাভাষাভাষীর দাবিকে অস্বীকার করে উর্দুকে গোটা পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা করবার পক্ষে প্রকাশ্যে অভিমত জানিয়েছিলেন। জিন্নার এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষীর দাবিকে অস্বীকার করবার ভিতর দিয়েই পাক শাসকদের পূর্ব পাকিস্থানের বাংলাভাষী মানুষদের উপর চরম ঔপনিবেশিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।বস্তুত সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্থানের মানুষদের উপরে দেশভাগের মাত্র পাঁচ বছরের ভিতরেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মতোই শোষকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্থানের শাসকেরা।
ব্রিটিশের অর্থনৈতিক শোষণ ই উনিশ শতকে অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তার উন্মেষ ঘটাতে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। উনিশ শতকের নবজাগরণের বুদ্ধিদীপ্ত বিভাষা এই জাতীয়তাবোধের উন্মেষের সঙ্গে খুব সচেতনভাবেই যুক্ত করে দিয়েছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের চেতনা।নবজাগরণের কালে শিক্ষার প্রসারে সার্বিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনা না থাকাটা প্রথম শিক্ষার আলো পাওয়া কাঁচা মন গুলিতে স্বধর্মের প্রতি অনুরাগ অপরধর্মের প্রতি বিরাগকে অনেক বেশি উৎসাহিত করেছিল।বিতর্কিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বয়ং বিদ্যাসাগরের সীমাবদ্ধতা জাতীয়চেতনার উন্মেষকালের একটা ক্ষত।সংস্কৃত কলেজে হিন্দু ব্যাতীত অন্য ধরমাবলম্বীদের পরবেশের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আমরা বিদ্যাসাগরকে কেবল প্রতিবাদী হতে দেখি না তাই ই নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল গুলিতেও তাঁরই উইলবশত মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই গভীর ক্ষতের জেরে বিগত বিশ শতকের চারের দশকে পরবর্তীকালে স্বনামধন্য কলিম শরাফিকে সিঁউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তিই হতে দেন নি সেই সময়ের সিঁউড়ির বিশিষ্ট্য ব্যক্তিত্ব মিহিরলাল চট্টোপাধ্যায়।
বাহান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান, আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সেই শতকের ই তিন চারের দশকের “মুসলিম জাতীয়তাবাদ” ‘র কফিনে পেরেক পুঁতে বিজয় বৈজয়ন্তী উড়েছিল “অখন্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদের” । সেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল তার ঠিক দুই বছর পরে। ‘৫৪ সালে অখন্ড পাকিস্থানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় ঘটে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা মুসলিম লীগের।মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি দেখিয়ে দেয় তাঁদের হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে লালন করা প্রবাহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রটিকে।সেই অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ই পশ্চিম পাকিস্থানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে।
বিশ শতকের অখন্ড বাংলাতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কালে বঙ্কিমের আনন্দমঠের ভবাণী মন্দিরের ভাবনাতে জাতীয় চেতনার সঙ্গে হিন্দু র প্রাতিষ্ঠানিক চেতনাকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষ, বাল গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, বারীন ঘোষ প্রমুখের প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম ও হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ ধারার যে চেতনার মোড়কে বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছিল তা নিয়ে কেবল মুসলম্ন সমাজের ভিতরেই বেদনা ছিল তা নয়।ব্রাক্ষ্ম ভাবাদর্শে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের ভিতরেও দেশমাতৃকাকে ;” ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী ” বলতে অনেক খানি ই দ্বিধা ছিল। এমন দ্বিধা ছিল শিখদের ভিতরে, শৈব সম্প্রদায়ের মানুষদের ভিতরে, কৃষ্ণ উপাসক বৈষ্ণবদের ভিতরে।
একুশের চেতনার ভিতর দিয়ে যে অখন্ড বাঙালি জাতি সত্তার সম্যক বিকাশের লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে তার ভিতরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ একটি মুহুর্তের জন্যেও ঠাঁই পায় নি।এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা কিন্তু বাঙালি বুকে চিরদিন লালন করেছে।দেশভাগের জটিল কুটিল ঘুর্ণাবর্তের ভিতরেও মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাখার সম্পাদক আবুল হাশেম অখন্ড বাংলার ভাবনা ভেবেছিলেন।তাঁর সঙ্গী ছিলেন কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু।এই ভাবনা যে কেবলমাত্র কলকাতা বা ঢাকা শহরের অভিজাতের বৈঠকখানাতে আবদ্ধ ছিল তা ভাবা ইতিহাসের প্রতি চরম অবিচার। মুসলিম লীগের সেই সময়কালের বগুড়া জেলা সভাপতি বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের মতো মানুষ ও এই ” অখন্ড বাংলা” আন্দোলনের একজন অতি সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বদিউজ্জামানের পুত্র ই বাংলা সাহিত্যের ঝড়ের পাখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
বহু রক্ত ঝরিয়েও বাংলাদেশ আজ ও বুকের গহীনে বাঁচিয়ে রেখেছে মহান একুশের শিখাটি।তাঁদের উপরে দেশী , বিদেশি অনেক অত্যাচার হয়েছে।সেই নির্যাতন আজ ও বন্ধ হয় নি।তবু তাঁরা একটি মুহুর্তের জন্যে মলিন হতে দেন নি মহান একুশের চেতনাটিকি, নেভানো তো দূরের কথা।আজ ও একটি কায়েমী শক্তি সেদেশে এই আলোকবর্তিকা নিভিয়ে গোটা দেশটিকে অন্ধকারের ঘন আবর্তে ঢেকে ফেলতে চায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই নির্মীয়মান পদ্মাসেতুর তথাকথাত দুর্নীতি নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক স্তরে শোরগোল ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখানকার একটি স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার প্রধানের পদ থেকে আদালতের নির্দেশে অপসারিত হয়েছেন এক ব্যক্তি। তাঁকে পুনর্বহাল করতে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন পর্যন্ত করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারী ক্লিন্টন। কানাডার সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন পদ্মাসেতু নির্মানে আদৌ কোনো দুর্নীতি হয় নি।যে মার্কিন দেশের একদা বিদেশ সচিব হেনরী কিসিঞ্জার সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ কে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন,তাঁর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত হিলারী ক্লিন্টন কিন্তু কানাডার আদালতের রায় শোনবার পর আদৌ কোনো মন্তব্য করেন নি। তাহলেই বোঝা যাচ্ছে একুশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের জাল আজ ও দেশে -বিদেশে কতোখানি সক্রিয়।
ভারতে বিগত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বায়নের জেরে উদার অর্থনীতির থাবা প্রকট হয়। এর জেরে আমাদের দেশীয় সমাজ সংস্কৃতির উপর একটা তীব্র আক্রমণ নেমে আসে।একদিকে চলে ভারতীয় সংস্কৃতি মূল্যবোধের নাম করে আর এস এসের সদর দপ্তর নাগপুরের কেশব ভবণ অনুমোদিত সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকেই হিন্দু , হিন্দি সংস্কৃতির নাম করে ভারতীয় সংস্কৃতি হিশেবে দেখাবার একটা উদগ্র প্রবণতা। তার বাইরে মার্কিন মুলুকের অনুমোদিত সাংস্কৃতিক ভাবনা একটা ছিন্নমূল চেতনা প্রয়োগের উদগ্র অভিসন্ধি।দেশীয় কৃষ্টির নাম করে আর এস এসীয় চেতনার বিকাশ ঘটবার পিছনেও উদার অর্থনীতির ভূমিকাকে কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করতে পারা যায় না।বিশেষ করে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রজন্ম এই শতকেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে কার্যত অবসৃত হতে শুরু করেন পুরোমাত্রাতে।ফলে মূল্যবোধের সঙ্কটটা এই সময় থেকে তীব্রতর হয়ে উঠতে শুরু করে।
সাতের দশকের নানা সঙ্কটকালেও জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের একটা বড়ো অংশের শারীরিক উপস্থিতি মানুষকে সঙ্কট থেকে উত্তোরিত হতে অনেকখানি সাহায্য করেছিল।মূল্যবোধের সঙ্কট সেই সময়কালের প্রেক্ষিতে তীব্র হলেও তাকে মোকাবিলার শক্তি মানুষ তার শিকড় থেকেই অর্জন করেছিল। আর বিশ্বায়নের জেরে প্রথম চেষ্টাটাই চলে মানুষকে তার শিকড় থেকে টেনে উপড়ে ফেলবার।শারীরিক এবং মানসিক -দুই ভাবেই মানুষকে উপড়ে ফেলবার যে চেষ্টা তখন শুরু হয়েছিল , সময়ের সঙগে পাল্লা দিয়ে তা আমাদের সমাজ জীবনে দুরারোগ্য কর্কট ব্যাধির মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে।ফলে নিজের সাংস্কৃতিক চেতনা, মূল্যবোধ এখন সম্পুর্ণভাবে স্বকীয়তা হারাতে বসেছে।যে রবীন্দ্রনাথের গান একদিন ছিল কথা ও সুরের মেলবন্ধনে মানবমুক্তির একটা খোলা আকাশ, সেই রবীন্দ্রনাথের গান এখন ফিউশন নির্ভর যন্ত্রের যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে যন্ত্রণা আমাদের জীবনে নয়ের দশকে নেমে এসেছে সেই তীরবিদ্ধ জীবন বাংলাদেশের মানুষকে যাপন করতে হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্টের ফজরের নামাজের ও আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর থেকেই। একুশের চেতনায় রিদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে যে অর্জনের অধিকার কায়েম করেছিল তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে সেই অর্জনে আবার হায়নার থাবা বসে। বাংলাদেশ এই সময়কাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত আবার কার্যত পাকিস্থানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত হয়। ইতিহাসের রথচক্র সম্পুর্ণভাবে পিছনের দিকে ঘুরতে থাকে। এই কালরাত্রি ও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তবুদ্ধির মানুষ যাপন করেন একুশের চেতনায় সিক্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ই ভিতর দিয়ে।মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি , পাকিস্থানী হানাদারদের সহযোগী শক্তি এই সময়কালে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় রণমদে মত্তহস্তীর মতো আস্ফালন করে গেছে।বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এই সময়ে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির অবাধ মৃগয়া ভূমি।
একুশের চেতনায় সম্পৃক্ত বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় বৈজয়ন্তী উড়িয়ে অর্জন করেছিল বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। বঙ্গবন্ধু কে সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে। অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী স্বৈরাচারী এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই ইসলাম কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করে। ইসলামীকরণের এটি ছিল প্রাথমিক চেষ্টা।আমাদের দুর্ভাগ্য সেই স্বৈরাচারী এরশাদকে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের একটি বামপন্থী বলে দাবি করা রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা পর্যন্ত দিয়েছে। সেই রাজনৈতিক দলের এক নেতার সঙ্গে স্বৈরাচারী এরশাদের ব্যক্তিগত সখ্যতার জের টেনে তাঁর পুত্র তথা বামভোটে জিতে বিধায়ক হওয়া ব্যক্তি শাসক শিবিরে যোগ দিয়েও এরশাদ ভজনা থেকে বিরত হয় নি।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পরও একুশের চেতনায় আত্মনিবেদিত বাংলাদেশের মানুষ একটি বারের জন্যেও আত্মসমর্পণ করেন নি মৌলবাদের কাছে, সাম্প্রদায়িকতার কাছে।এই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের থেকেও অনেকবেশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন সুফিয়া কামাল,জাহানারা ইমাম, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী, বদরুদ্দিন উমর, অনুপম সেন, বিচারপতি দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি হাবিবুর রহমান( উনি একজন ভাষা সৈনিক।’৫২ র একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্রদের যে দল টি প্রথম ১৪৪ ধারা অমান্য করেন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী ছিলেন তার নেতৃত্বে)মহাদেব সাহা, আহমদ শরীফ,শওকত ওসমান, সৈয়দ হাসান ইমাম, পান্না কায়সার ,বেগম মুশতারী সফী, লায়লা হাসান, শমী কায়সার প্রমুখ সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব। এঁদের আন্দোলন তৈরী করেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা, যার জেরে তৈরী হয়”গণতদন্ত কমিশন”।
এই আন্দোলনেরই পরিণতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে ‘৯২ এর ২৬ শে মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ আদালত। তারই ফলশ্রুতি ‘৯৬ তে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সরকার প্রতিষ্ঠা।সাময়িক চ্ছেদের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্থান আমলের ” শত্রু সম্পত্তি আইন” টি অবলুপ্ত হয়েছে। এই আইনটি ভারতবর্ষে এখনো বিদ্যমান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর মতিউর রহমান নিজামী, সাকা চৌধুরী প্রমুখ কয়েকজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। এসবই একুশের চেতনার ফলশ্রুতি এবং সাফল্য। একুশের ধারাবাহিকতাকে এভাবেই বজায় রেখেছে আজকের বাংলাদেশ।