ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
উৎসবের অষ্টমী’তেই বিসর্জনের সাক্ষী রইল কলকাতা।
এই বিসর্জন কিসের? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের, সাংবিধানিক অধিকারের।
শুধু কলকাতা কেন! বলা উচিত সারা পশ্চিমবঙ্গই এমন অভূতপূর্ব অর্বাচীন ব্যবস্থাপনা দেখছে।
দুর্গাপুজার আবহে খবরের চ্যানেলর পর্দায়, কাগজের সামনের পাতা থেকে শুরু করে ফেসবুকের ওয়াল, হোয়াটস্যাপের ইনবক্স ভরে উঠছে ‘সর্টেড’ ক্যাপশন সহ। পরিবার-পরিজন-বন্ধুবান্ধবদের সাথে আনন্দের মুহূর্তগুলিকে ছবিতে, কথায়, গানে সবাই নিজেদের মত করে ধরে রাখতে চাইছেন এবং দুটো দিনের হলেও হয়ত ভুলে থাকতে চাইছেন আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, রেকর্ডস্পর্শী বেকারত্ব এবং পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি- ঠিক সেই সময়েই কলকাতার বুকে সরকারী পরীক্ষা পাশ করেও ন্যায্য চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় বসে রয়েছেন। সরকার, প্রশাসন চেষ্টা করেছিল রাজপথ পরিস্কার রাখতে এদের তুলে দিতে, পারেনি। তারা নিজেদের লড়াই জারী রেখেছেন- আমরাও রয়েছি সেই লড়াইতে- এমনিতে পাশে, দরকার পড়লে সামনেও। আজই সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সহ গণআন্দোলনের বিভিন্ন নেতৃত্বরা হাজির ছিলেন ন্যায্য চাকরিপ্রার্থীদের ধর্নামঞ্চে।
তারা বসে রয়েছেন কারণ সরকারী তালিকায় তাদের নাম থাকা স্বত্বেও ঘুষ খেয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করেছে রাজ্য সরকার। খবরে প্রকাশ সিবিআই-ইডি নাকি আদালতে জানিয়েছে আট হাজারেরও বেশি নিয়োগ হয়েছে এভাবেই! প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে রয়েছেন, তারই অনুসারী হয়েছেন একের পরে এক শিক্ষাদপ্তরের ‘বিগ শট’ আমলারা। সবাই বুঝছেন সবকটা চোর ধরতে এখনও বাকি আছে। তবু নাকি মুখ্যমন্ত্রী চান না, অবৈধ পন্থায় নিয়োগ পেয়েছেন এমন কারোর চাকরি চলে যাক!
একমাস আগে থাকতে দুর্গোৎসবের ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী যতই জনসাধারণকে মাতিয়ে রেখে চোখ ঘোরানোর রাজনীতি করুন না কেন, চোখ কিন্তু ঘুরছে না। যেটুকু ঘুরছে, ঘুরেছে সেটা হল সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণের টাকায় স্পনশর্ড জনপ্রিয় সরকারী শব্দবন্ধ- ‘খেলা’।
গত পরশু রাসবিহারী (কলকাতা) মোড়ে শারদ উপলক্ষে প্রগতিশীল বই বিপণন কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। সারা রাজ্যেই পার্টি কর্মী-সমর্থকেরা বহু বছর ধরে এই সময় প্রগতিশীল সাহিত্য, মার্কসীয় চিরায়ত গ্রন্থাবলী সহ বইয়ের অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেন। এই রাজ্যের আন্দোলনের ইতিহাসে এই কর্মসূচির নিজস্ব পরম্পরা রয়েছে, ইতিহাস রয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা সদ্য পড়া শেষ করে আসা কম বয়সী পার্টি কর্মীরাও নিজেদের ছুটির সময় থেকে বেশ কিছুটা সময় এই সব বুক স্টলে যুক্ত থাকেন, কাজ শেখেন। বাজারি সংস্কৃতি মোকাবিলার প্রশ্নে এই কাজ গুরুত্বপূর্ণ।
রাসবিহারী মোড়ের সেই বুক স্টলেই হামলা চলে রবিবার। ভাড়াটে বাহিনী পাঠিয়ে স্টল ভাংচুর করা হয়। স্থানীয় কমরেডরা সিদ্ধান্ত নেন পরেরদিন আবার বুক স্টল উদ্বোধন হবে। ঐ জায়গাতেই। বই বিক্রির সাথেই স্টলের বাইরে ‘চোর ধরো জেল ভরো’ এবং ‘আমরা বই বিক্রি করি, চাকরি বিক্রি করিনা’ লেখা পোস্টার ঝুলবে। সেইমতো সোমবার বিকাল পাঁচটায় জনসভার আয়োজন হয়, বুক স্টল বসে ওখানেই। আচমকা আক্রমণ হয় সেই স্টল ভেঙ্গে দিতে। পুলিশ কার্যত নির্বাক থাকে। তবে কমরেডরা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির মোকাবিলায় মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকায় এদিন ‘খেলা ঘুরে যায়’। উপযুক্ত প্রতিরোধের সামনে পড়ে বই নষ্ট করতে আসা বাহিনী প্রথমে পিছু হটে, পরে চওড়া রাস্তা ধরে দৌড়তে থাকে- পালিয়ে যেতে চায়।
এইবার পুলিশ সক্রিয় হয়। অশান্তির পরিবেশ সামলানোর অজুহাতে আক্রান্তদেরই আটকাতে চায়! স্থানীয় পার্টির এরিয়া কমিটির সম্পাদক সঞ্জীব রাণা গাঙ্গুলি, কলকাতা জেলার পার্টি সম্পাদক কল্লোল মজুমদার, কলকাতা জেলার পার্টি নেতা গৌতম গাঙ্গুলি সহ মোট ন’জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ- গ্রেপ্তার হন বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ও।
বাংলার সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনেরা এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির হন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। রাতে গ্রেপ্তার হওয়া সবাইকেই নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। একটা গণতান্ত্রিক দেশের একটি রাজ্যে উৎসবের সময়ে মানুষের হাতে প্রগতিশীল সাহিত্য তুলে দেওয়া যাবে না, চুরি হলেও চুরি হয়েছে বলা যাবে না। কেউ মূর্খের স্বর্গে বাস করতে চাইলে অন্য কথা, নাহলে মনে রাখাই উচিত শাসকের অমন অনেক দিবাস্বপ্ন ভঙ্গের ঐতিহ্য এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।
বুক স্টল হয়েছে এবং ঐ জায়গাতেই হয়েছে।
বেকারত্বের জ্বালাকে নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে তৃনমূল কংগ্রেস। হাতে অল্প কিছু গুঁজে দেওয়ার বিনিময়ে দিশাহীন যুবক-যুবতীদের একটি অংশকে (গ্রাম কিংবা শহরাঞ্চলে গরীব পরিবারের সন্তানরাই মূলত এর শিকার) লুম্পেন বাহিনীতে পরিণত করা হচ্ছে, এরাই ব্যবহৃত হচ্ছেন বিভিন্ন হামলা, আক্রমনের পরিকল্পনায়। লুট করা ভোট আর বিলিয়ে দেওয়া চুরির টাকার ভরসায় শাসক একটা সহজ সত্য ভুলে যাচ্ছে- ধৈর্যচ্যুতিতে ফেটে পড়া জনগণের ক্ষোভের মুখোমুখি কোনও গুণ্ডা, কোনও গুণ্ডামি এক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারে না, তখন উল্টোদিকে দৌড়তে হয়… হবে, হবেই।
সেই দৌড়ও এদিন কলকাতা দেখে ফেলেছে।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ