প্রাককথন
মার্কসবাদ শিক্ষার পাঠ্যক্রম বুনিয়াদি স্তরে মূলত তিনটি বিষয় কেন্দ্রিক। ‘মার্কসবাদের তিনটি উৎস এবং তিনটি অঙ্গ’ শিরোনামে লেনিনের প্রবন্ধে উল্লেখ রয়েছে ১) মার্কসীয় দর্শন, ২) মার্কসীয় অর্থনীতি এবং ৩) সমাজতন্ত্রের ধারণা এগুলিই হল মূল ভিত্তি।
এই তিনটি বিষয়েই মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুং রচিত অনেকগুলি পাঠ্যবই রয়েছে। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের লেখা গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলির মধ্যে ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ (Dialectics of Nature), ‘পরিবার, ব্যাক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ ( Origin of Family, Private property and The State) এবং ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ (Anti Duhring) সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসীয় সাহিত্যে অনন্যসাধারণ কীর্তি হিসাবেই এদের কদর।
মতাদর্শ সিরিজের প্রথম পর্যায়ে আটটি পর্বে মার্কসীয় দর্শনের বুনিয়াদী প্রসঙ্গ আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের মূল বিষয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব ও তার নিয়মাবলী। আজ তারই প্রথম অধ্যায় হিসাবে ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ (Dialectics of Nature)-র একটি ছোট অংশ প্রকাশিত হল।
বইটি লেখার জন্য এঙ্গেলস’কে সমসাময়িক প্রকৃতি বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি খুঁটিনাটি সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। এই লেখার মাধ্যমে তিনি যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারই চূড়ান্ত রূপ আমরা ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ (Anti Duhring)-এ খুঁজে পাই। বিজ্ঞানচেতনা, মতাদর্শ, যুক্তিবোধ ইত্যাদিতে ড্যুরিং-কে ছিন্নভিন্ন করে দিলেও এঙ্গেলস একটিবারের জন্যও ড্যুরিং-কে ব্যক্তিগতভাবে কুৎসা করেননি। এঙ্গেলসের রসবোধ দুনিয়ায় যে কারনে বিখ্যাত তার আঁচ পেতে একটি লাইনই হয়ত যথেষ্ট হবে। অনেকটা শেষ পাতে মিষ্টান্ন সাজিয়ে দেওয়ার মতোই তিনি প্রতিপক্ষের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে নিজের লেখা শেষ করছেন এই বলে- ‘When a man is in possession of the final and ultimate truth and of the strictly scientific approach’ it is only natural that he should have a certain contempt for the rest of erring and unscientific humanity.’
এই লাইনটি উল্লেখ করা হল যাতে নতুন প্রজন্মের পার্টি কর্মীরা মনে রাখেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ নিছক কোনও মতাদর্শগত ট্রেনিংমাত্র না। এ হল নতুন সমাজব্যবস্থার দিকে একনিষ্ঠ বিপ্লবীর জীবনদর্শন। সেই জীবনযাত্রায় উন্নত রুচির প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে নেই, অন্যান্য কাজের সাথে সেই রুচিকেও সচেতনভাবে চর্চা করতে হয়।
ফ্রেডরিক এঙ্গেলস
প্রকৃতি ও মানব সমাজের ইতিহাস থেকেই দ্বন্দ্বের নিয়মসমূহ আহরিত হয়েছে। এই সকল নিয়মসমূহ আসলে কি? মানব সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ ও জ্ঞানচর্চার পরম্পরা- এ দুটির সাধারণ নিয়মই হল দ্বন্দ্বতত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল বক্তব্যগুলিকে তিনটি প্রধান সুত্রে ব্যখ্যা করা যায়-
১) পরিমাণগত পরিবর্তনের গুনগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হওয়া ও তার বিপরীতক্রম দুটিই সত্য।
২) একে অন্যের উপরে বিপরীত গুনসমূহের মিথস্ক্রিয়া।
৩) নেতির নেতিকরনের নিয়ম।
উপরোক্ত তিনটি সুত্র হেগেলেরই কৃতিত্ব। ‘চিন্তার নিয়মাবলী’ (লজ অফ থট) হিসাবে নিজস্ব ভাববাদী কেতায় তিনি যে গবেষণাকর্মটি প্রকাশ করেছিলেন এসকল সূত্রাবলী তারই অন্তর্ভুক্ত। প্রথম সুত্রটি তার প্রখ্যাত রচনা ‘লজিক’ এর প্রথম অংশে অর্থাৎ ‘অস্তিত্বের তত্ত্ব’ (দ্য ডকট্রিন অফ বিইং)-এ আলোচিত হয়েছিল। হেগেলের মতবাদে দ্বিতীয় সুত্রটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটি সংগৃহীত হয় ‘মর্মবস্তুর তত্ত্ব’ (দ্য ডকট্রিন অফ এসেন্স) থেকে। সবশেষে আসে তৃতীয় অর্থাৎ নেতির নেতিকরনের নিয়ম। চিন্তার সার্বিক কাঠামোটি নির্মিত হওয়ার মূল নিয়ম হিসাবেই হেগেল একে তুলে ধরেন।
এই তিন সুত্র সম্পর্কে সবেচেয়ে বড় ভুল ধারণা হল এগুলি নাকি প্রকৃতি ও মানব সমাজের ব্যখ্যায় আরোপিত ব্যখ্যা বিশেষ, আসলে এর ঠিক উল্টোটিই সত্য। কার্যত ওদুটির পর্যালোচনা হতেই নিয়মগুলি বেরিয়ে আসে। এহেন ভয়ানক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই ধরে নেওয়া হয় সমগ্র মহাবিশ্ব হয়ত মানব চেতনার নিজস্ব ইচ্ছানুসারে প্রতিভাত সত্য। আর তাই মনে হয় মানব চেতনার বিকাশের একেক পর্যায়ে বস্তুগত দুনিয়ার বাস্তবতা একেক রকম চেহারা নিয়েছে। এমন বিচার- বিশ্লেষণকে উল্টে দিলেই আসল সত্যের উপলব্ধি হয়, জগতের রহস্যাবলী তখন অনেক সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। আগেকার অবস্থায় দ্বন্দ্বতত্ত্বের সুত্রগুলি বেশ জটিল বলে মনে হত, হেগেলের ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গীটিকে উল্টে দেওয়ার পরেই সেসব দিনের আলোর ন্যায় স্বাভাবিক হিসাবে উপলব্ধি করা যায়।
হেগেল সম্পর্কে অল্পবিস্তর পরিচিত এমন যে কেউই জানেন তার রচনাবলীর কয়েকশো অণুচ্ছেদের শুরু থেকে শেষ অবধি তিনি যা কিছু লিখেছেন সেসবই প্রকৃতি জগত ও মানুষের ইতিহাসের সারমর্ম হিসাবে সক্রিয় দ্বান্দ্বিক নিয়মাবলীরই এক অসামান্য রূপরেখা ব্যতীত অন্য কিছুই না।
এই মুহূর্তে দ্বন্দ্বতত্ত্ব সম্পর্কে আমরা কোনও হ্যান্ডবুক লিখতে চাই না। দ্বন্দ্বের সুত্রগুলি যে আসলে প্রকৃতিজগতের বিকাশেরই নিয়ম-কানুন সেটুকু স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য। এই সকল সূত্রাবলী প্রকৃতি বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার বেলাতেও একইরকম কার্যকরী। তাই ঐ তিনটি সুত্রের আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে আপাতত খুব বেশি কথা বলার নেই।
প্রাককথন ও অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ