সূর্যকান্ত মিশ্র
পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত একটি ইতিহাস সিপিআই(এম)-র পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। সেই ইতিহাসই আজকের দিনে বিশেষ করে স্মরণে রাখতে হবে।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ রচিত স্মৃতিকথা ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ বইটি এক্ষেত্রে আমাদের জন্য প্রামাণ্য রেফারেন্স হিসাবে থাকবে। এই বইতে কাকাবাবু অজস্র দলীল, দস্তাবেজ – চিঠিপত্রের বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। এইসমস্ত তথ্যের বেশকিছু আজও প্রাসঙ্গিক। যারা পার্টির ইতিহাস চর্চায় আগ্রহী তারা এগুলি থেকে অনেক জরুরী কিছু সংগ্রহ করতে পারবেন।
আমাদের আলোচনার মূল সুরটি বুঝতে সেই বইটি থেকে ছোট্ট একটি অংশ এখানে উল্লেখ করতে চাইব। আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কারা? কাকাকাবু এই প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন ‘তাসখন্দ ও মস্কোতে যারা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন তারাই পার্টির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা স্বীকৃত হয়েছিল। প্রবাসী পার্টির কিছু সভ্য অনেক দুঃখকষ্টের ভিতর দিয়ে ভারতে এসে জেল খাটার পরেও পার্টির কাজ ছেড়ে দেননি। তাঁরা আমাদের সাথেই কাজ করেছেন। … ১৯২১ সালের শেষের দিকে কিছু কিছু নড়াচড়া আমরাও আরম্ভ করেছিলুম। ১৯২২ সালে তো আমরা যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছি। আর ১৯২৩ সালে আমাদের বন্দী জীবনও আরম্ভ হয়ে গেছে। সকলেই জানেন ভারতের বিপ্লবী কর্মীদের পক্ষে বন্দী জীবনের সম্মুখীন হত্তয়া ছিল এক কষ্টকর ব্যাপার। এসব সত্বেও আমরা কি দাবি করতে পারি যে আমরা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য? আমি কিন্তু এ দাবি করার পক্ষে খুব জোর পাই না। তবে আমরা যে দেশে … সে দাবি অবশ্য আমরা করতে পারি।’
আমরা [সিপিআই(এম)] মনে করি কাকাবাবু পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদেরই অন্যতম একজন।
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম থেকেই ১৭ অক্টোবর দিনটিকে আমাদের পার্টি, প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। এখন সারা দেশেই সেই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এক সময় পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসের সন-তারিখ সংক্রান্ত কিছু বিতর্ক ছিল- এখন আর তা নেই। সেই বিতর্কের সমাধান হয়েছে।
একথা ঠিক যে ১৯২১ সালে কানপুরের সম্মেলনই হল ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলন। কাকাবাবু লিখেছেন কানপুর সম্মেলন আয়োজনের প্রথমদিকে তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। সত্যভক্ত সেই সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অসুস্থ শরীরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি এই সম্মেলনের আমন্ত্রন পান। সত্যভক্ত ঠিক কার সাথে কিংবা কোথায় আলোচনা করে সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আহ্বান জানিয়েছিলেন- সেই ইতিহাস এখনও অস্পষ্ট। উল্লেখযোগ্য হল তাঁর ইচ্ছামত পার্টির নামকরণে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সংক্রান্ত তাঁর প্রস্তাবটি খারিজ হলে তিনি নিজেই সেই সম্মেলন ছেড়ে চলে গেছিলেন। তিনি এই নামকরণের পক্ষে নিজের যুক্তিতে অনড়, অবিচল ছিলেন বলেই এমনটা ঘটেছিল। জানকিপ্রসাদ বাঘেরহাট্টা’কে কার্যত সেই সম্মেলন থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে তিনিও পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হলেন। অবশ্য এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে প্রশ্নটা বিশেষ কোনও ব্যক্তির না – মতাদর্শগত অবস্থানের। একথা সুবিদিত যে ১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের পর লেনিনের নেতৃত্বেই ৩য় আন্তর্জাতিক (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিনটার্ন) গড়ে ওঠে। কমিন্টার্নের সদস্য হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পার্টির কর্মসূচিটি সেখানে জমা দেওয়ার কাজটি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে স্বীকৃত হওয়ার অন্যতম শর্ত। পার্টি সংগঠন সম্পর্কিত মৌলিক নীতিগুলি সম্পর্কে লেনিনের মতামতই আলোচনাক্রমে গৃহীত হয়। জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান সম্পর্কে কমিন্টার্নের গৃহীত প্রতিবেদন সমূহকে এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গের বিতর্কে মানবেন্দ্রনাথ রায় যেসব সংশোধনী জমা দেন, সেইসব গ্রহণ করা হল- সংশোধনী সমেতই লেনিনের থিসিসটি গৃহীত হয়। এভাবেই ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে থাকা বুর্জোয়াদের অংশটিকে সাথে নিয়ে নিজেদের কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
কাকাবাবুর বইতে এই বিতর্ক, লেনিনের মতামত এবং রায়ের প্রস্তাব সম্পর্কে অনেক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
পরবর্তীকালে মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ডিকলোনাইজেশন তত্ত্বটি (যার মূল কথা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি আপনা আপনি পরাধীন দেশগুলিকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হবে) পুনরায় তুলে ধরতে থাকেন এবং তাতেই অনড় থাকতে চান। এছাড়া চীনের বিপ্লবের প্রসঙ্গে তার মতামত, অবস্থানও ছিল ভ্রান্ত। তিনি সেদেশে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষে (এশিয়াটিক ব্যুরো) প্রতিনিধি ছিলেন, চীন বিপ্লবের অন্যতম নেতা মাও সে তুং সম্পর্কে রায় নিজের স্মৃতিকথা মূলক রচনায় (ম্যান আই মেট) সেই সময়কার চীনের অবস্থার কিছু বর্ণনা দিয়েছেন।
মানবেন্দ্রনাথ রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে বিতাড়িত হলেন। কাকাবাবুর বইতে এই প্রসঙ্গে ক্লেমেন্স পাম দত্তকে লেখা চিঠি ও তার জবাবি বয়ানটি উল্লেখযোগ্য। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে ঔপনিবেশিক দেশের শাসক দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে নিজেদের দেশে ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরই প্রভাবে বেন ব্র্যাডলি, ফিলিপ স্প্রাট’রা ভারতে এসে উপস্থিত হন, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এরা প্রায় সকলেই ভারতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সাথেই কারাবরণ করেছিলেন, অশেষ নিপীড়ন সহ্য করেও কমিউনিস্ট সুলভ অঙ্গীকার থেকে একচুল সরেন নি। এমনকি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তারা অনেকে এদেশেই রয়ে গেছেন, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। কাকাবাবুর স্মৃতিকথায় এদের প্রত্যেকের বিশেষ অবদানের উল্লেখ পাওয়া যাবে।
এই যে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে কমিউনিস্ট পার্টিরই একজন হয়ে সক্রিয়তা, কারাবরণ- এসবই হল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতা বোধ। মতাদর্শগত অবস্থানে দৃঢ় না হলে এমনটা করা যায় না। এই অনুভব, এই উপলব্ধি থেকে আমাদের পার্টি [ সিপিআই(এম) ] কখনো বিচ্যুত হয় নি। আজকের প্রজন্মের কর্মীদেরও এই মহান উপলব্ধি আত্মস্থ করতে হবে।
মুজফ্ফর আহ্মদ মূলত বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বোম্বাই, মাদ্রাজ এবং পাঞ্জাব (লাহোর) এগুলি একেকটি প্রদেশ (প্রভিন্স) ছিল। অবিভক্ত বাংলাও ছিল তেমনই একটি প্রদেশ। বাংলার মতো অন্যান্য প্রদেশেও পার্টি গড়ে তোলার ইতিহাস রয়েছে। ঐ সব এলাকা থেকেই অনেকে দেশের বাইরে গিয়ে স্বাধীনতার লড়াইতে সক্রিয় ছিলেন, তাদের একটি অংশ তাসখন্দ- এ গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। এদের পরবর্তী জীবন ও কাজ সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য কাকাবাবুর বইতে পাওয়া যায়।
বাংলায় পার্টি গড়ে তোলার সূচনা পর্বের বিষদ বিবরণ এই একটি লেখায় দেওয়া সম্ভব না। আজকের প্রজন্মের অনেকেরই অজানা থাকতে পারে এমন ভাবনা থেকেই একটি কথা বলি, কাকাবাবুর স্মৃতিকথায় রয়েছে বাংলায় পার্টি নির্মাণের কাজে যার সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটেছিল তিনি হলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। এরপরে আব্দুর রেজ্জাক খান এবং কিছুদিনের মধ্যেই আব্দুল হালিমের সাথে। আবদুল হালিমের সাথে একসাথে মুজফ্ফর আহ্মদ প্রায় ৪৫ বছর কাজ করেছেন। আবদুল হালিমের আকস্মিক মৃত্যুতেই অসামান্য দক্ষ দুই কমরেডের যৌথ (কমিউন) জীবনযাপনের অবসান ঘটে। নিজের বইতে কাকাবাবু লিখে গেছেন, ‘অল্প কিছু দিনের মধ্যে এই যোগাযোগগুলি স্থাপিত হলেও তার একটা ক্রম এখানে লিখে রাখলাম। কোনোদিন কারোর রেফারেন্সের প্রয়োজন পড়লে এই লেখাটি কাজে লেগে যেতে পারে।’ ডকুমেন্টেশন কিভাবে করতে হয়, কমিউনিস্টদের জীবনে সেই কাজ কেন জরুরী এই উপলব্ধি শিখতে কাকাবাবুর কথা আমাদের স্মরণে রাখা উচিত। আজকের ভারতে শাসকের অন্যতম হাতিয়ারই হল ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি সাধন, সেকথা মাথায় রাখলেই বোঝা যায় কাকাবাবু আমাদের কেন এসব শিখিয়ে গেছেন।
১৯৪৬ সালে বোম্বেতে পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়া’তে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস অবধি প্রকাশিত দলীলসমূহে স্বাধীনতার আগে এবং অব্যবহিত পরে পার্টির আন্দোলন, বিতর্ক সম্পর্কিত বিবরণ ও তথ্যসমূহ অনেকটাই পাওয়া যায়। এরই মধ্যে কলকাতায় আয়োজিত অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯৪৮) গৃহীত রাজনৈতিক (রণকৌশলগত) লাইন নিয়ে যে বিতর্ক হয় সেগুলির নিষ্পত্তির জন্য কমরেড স্ট্যালিনের পরামর্শের ভিত্তিতে পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসেই ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি দলীল গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেইসব সিদ্ধান্ত প্রয়োগের বাস্তবতা না থাকায় একসময় দলীলটি অন্যান্য সহযোগী সিদ্ধান্ত সমেতই পরিত্যক্ত হয়। বিতর্কের অন্যতম একটি বিষয় ছিল রণকৌশলগত কর্মসূচি পরিচালনা সংক্রান্ত। এর মূল কথা ছিল ভারতীয় বিপ্লবের পথ ‘রাশিয়া’ নাকি ‘চীন’ কোন্ দিকে পরিচালিত হবে? স্টালিন স্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন ভারতীয় বিপ্লবের পথ এই দুয়ের কোনোটিরই অনুসরণ করে হবে না। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকেই নিজেদের দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট রণকৌশলগত পরিপ্রেক্ষিত নির্ধারণ করতে হবে।
সেই কারণেই ২০০০ সালে আমাদের পার্টির কর্মসূচিটি সময়োপযোগী করার আগে অবধি লিখিত আকারে যে পার্টি কর্মসূচি প্রকাশিত হত তাতে আলাদা করে রণকৌশলগত পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ থাকত। একটা সময় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে নয়া বাঁক-মোড় (বিশেষত স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে) দেখা দিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে ক্রুশ্চেভ-র নেতৃত্বে সংশোধনবাদের নির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষিতে তাদের বিতর্কও শুরু হল। এরই সমাধানকল্পে প্রথমে ১৯৫৭ সালে, ১২’টি সমাজতান্ত্রিক দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মিলিত দলীল (১২ পার্টির দলীল) এবং পরে ৬০’র দশকে ৮১’টি পার্টির (কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টিগুলির) দলীল গৃহীত হল।
এইসব দলীল প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বিবদমান মতাদর্শগত বিষয়গুলির নিষ্পত্তি করার চেষ্টা চলেছিল। মনে রাখতে হবে রণকৌশলগত পরিপ্রেক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ হলেও আসলে মূল বিষয়টি ওটা না, মূল বিষয় হল পার্টির রণনীতিগত অবস্থান, সেই দলীল। অর্থাৎ পার্টির কর্মসূচি। এই অবধি এলে তবেই লেনিনের সেই কথাটির মর্মার্থ যথাযথ উপলব্ধি করা যায় – নির্দিষ্ট দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি। আর তাই tactics নয় it’s about strategy।
বিজয়ওয়াড়া’তে পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের পরেও ভারতীয় বিপ্লবের স্তর ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ নাকি ‘জনগণতান্ত্রিক’ এই নিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে কোনও একটি দেশে কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি বা কর্মসূচি (যা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে একটি ঐক্যবদ্ধ ধারণা ব্যতীত গড়ে উঠতে পারে না) তৈরি করা যায় না। এই প্রসঙ্গেই সম্মিলিত ৮১ পার্টির দলিলেরেও কিছু দায় থেকে যায় – আমাদের পার্টি [সিপিআই(এম)] মনে করে সেই ব্যর্থতার দায়স্বীকার করতে হবে সবাইকেই।
পার্টি ভাগ হয় এই প্রেক্ষিতেই। ১৯৬৪ সালে আলাদা ভাবে দুজায়গায় দুটি ৭ম কংগ্রেস আয়োজিত হয়। একটি কলকাতায়, আরেকটি বোম্বেতে। এই কংগ্রেস থেকে সিপিআই(এম) ‘জনগণতান্ত্রিক কর্মসূচি’ এবং সিপিআই ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ কর্মসূচি গ্রহণ করে। আবার ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি’তে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৬৪ সালের গৃহীত কর্মসূচি ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মতাদর্শগত প্রশ্নটি সামনে আসে। সেগুলি নিষ্পত্তির জন্য ৬৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি একটি মতাদর্শগত প্লেনাম (বর্ধমান প্লেনাম) আয়োজন করে। ৬৪ সালের কংগ্রেসেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল মতাদর্শগত প্রশ্নগুলি নিয়ে আগামীদিনে প্লেনাম আয়োজিত হবে। বর্ধমান প্লেনাম থেকে যে দলীল গৃহীত হল তা পার্টির অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য প্লেনামে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়। সেই কারনে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বিতর্কিত প্রশ্নগুলির প্রসঙ্গে Letter to Andhra Comrades নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এইবারের মতাদর্শগত বিতর্কেরও মূল ভিত্তি ছিল ঐ ‘রাশিয়া’ ও ‘চীন’র মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ। আমাদের পার্টি [সিপিআই(এম)] অনেক প্রশ্নে চীনের পার্টির পক্ষে দাঁড়ালেও চারটি বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করে। এই অবস্থায় সিপিআই(এম) চীন এবং রাশিয়া দুইদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, কারোর সমর্থন পাওয়া যায় নি। এইবার পার্টি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া অংশটি [সিপিআই(এম-এল)] কার্যত চীনের পক্ষে অবস্থান নেয়, আরেকদিকে সিপিআই নিজেদের রাশিয়ার পক্ষে রাখে।
পরবর্তীকালে অবশ্য চীনের পার্টির পক্ষে ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেদের পূর্বের অবস্থানে বদল ঘটে, অনেক বিষয়েই তারা নিজেদের পূর্বেকার অবস্থান, মতামত থেকে সরে আসেন। আমাদের মনে রাখতে হবে সেইসময় চীনের পরিস্থিতি- তখন সেদেশে কমিউনিস্ট পার্টি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছে।
যাই হোক না কেন, ১৯৭৭ সালের পরে এই দুটি পার্টির সাথেই আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার অনেকটাই উন্নতি ঘটে, এই রাজ্য সহ সারা দেশেই মূলত ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এসব কথা উল্লেখ করার আসল উদ্দেশ্য হল পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট পার্টি কোনও অনড়, অচল অবস্থানে স্থিত থাকতে পারে না, এমন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না- এটি উপলব্ধি করা। বিশেষত ৯১ সালের পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয় ঘটার কারণে বিশ্বের রাজনৈতিক ভারসাম্যের বদল ঘটেছে তখন তো একথা আরো বেশি করে সত্য। আর তাই গর্বাচেভকে শুধুই সংশোধনবাদী বললে সবটা বলা হয় না, উনি আসলে যা ছিলেন তাকে সোজাসুজি লিক্যুইডেটর বিবেচনা করাই সঠিক হবে। আমাদের পার্টির ১৪তম এবং ২০তম পার্টি কংগ্রেসে আমরা মতাদর্শগত প্রসঙ্গে দলীল গ্রহণ করেছি। যারা এইসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী তারা সেই দলীলগুলি পড়বেন।
আমরা যা বলছি
মূল কথাটা হল উনবিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদ, বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদের সাথে আজকের সময়ে একবিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদের চেহারা হবহু এক হবে না। ৬৫-৬৭ সাল পর্বের শুরুর সময়ে কাকাবাবু জীবিত ছিলেন। পার্টি ভাগ হওয়ার প্রথমার্ধের সংগ্রামে তিনি পার্টিকে, পার্টির কর্মীদের সঠিক রাজনীতির দিশায় সংহত করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সেই অনন্যসাধারণ ভূমিকা স্মরণ করতেই সিপিআই(এম) কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আজকের দিনে আমরা যাদের পার্টিতে নবরত্ন বলি তারা আর কেউই বেঁচে নেই। সুতরাং মতাদর্শগত দলীল গৃহীত হওয়ার পরে আজকের প্রেক্ষিত তারা কেউই দেখেন নি। মতাদর্শগত অবস্থান বজায় রেখেই যে সংগ্রাম তারা পরিচালনা করেছিলেন আজকের সময়ে সেই দায়িত্ব আমাদের সবার। বর্তমান পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি, এর মোকাবিলায় আমাদের অনেকদূর অবধি যেতে হবে। স্বাধীনতার পরে এমন অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতির মুখোমুখি পার্টি কখনো হয় নি। নয়া উদারবাদ, ১৯৭৪ সালে লাতিন আমেরিকার চিলিতে জন্ম নেয় এবং ক্রমশ এক বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশেও ক্রমে জাঁকিয়ে বসে। এই ব্যবস্থা দুনিয়াজুড়ে ক্রমবর্ধমান সংকট (মূলত অর্থনৈতিক, পরে তারই অভিঘাতে রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বত্র) তৈরি করেছে। আজকের পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা নিজেই ভয়ানক সংকটগ্রস্থ। ২০০৭-০৮ সাল থেকে শুরু হয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী মন্দা ক্রমশ জটিল চেহারা নিচ্ছে। একদিকে বিরাট মন্দা আরেকদিকে অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতি – দুয়ের যৌথ অভিঘাতকেই অর্থনীতিবিদেরা নাম দিয়েছেন stagflation বলে। একে ভিত্তি করেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নয়া ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। আমাদের দেশে মোদী সরকারের দ্বিতীয় পর্বটি ক্রমাগত সেদিকেই এগোচ্ছে। এমন অবস্থাতেই দুনিয়ার নানা জায়গায় মানুষের প্রতিরোধও ক্রমশ তীব্র আকার নিচ্ছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য লড়াই হচ্ছে লাতিন আমেরিকায়।
আমাদের রাজ্যের শাসকদল কেন্দ্রে আসীন শাসকেরই অনুসরণকারী। আর তাই আমাদের, বামপন্থীদের এই রাজ্যে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই রাজনৈতিক সংগ্রাম এই মুহুর্তের গুরত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলির অন্যতম একটি।
আমাদের সময়ের দাবি অনুযায়ী আজকের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি মোকাবিলার যে ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে তাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
মতাদর্শ বাদ দিয়ে রাজনীতি কিংবা এই দুটিই ব্যতিরেকে সংগঠন, সংগ্রাম কোনোটাই হয় না। এই চারটি বিষয় পরস্পর পরস্পরের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি এই চারটি হাতিয়ারকে ( মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগঠন, সংগ্রাম) শাণিত করেই আজকের পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সক্ষম হব।
২০২৩ সালে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে এটাই আমাদের শপথ।