সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এর আইকন : চে -সমন্বয় রাহা

১৪ জুন , ২০২২ (মঙ্গলবার )
আজ থেকে ৯৪বছর আগে ১৯২৮র ১৪ই জুন আর্জেন্টিনার রোজারিও তে যে ছোট্টো শিশু জন্মগ্রহণ করে তার নাম আর্নেস্টো রাফায়েল গ্যেভারা ডি লা সেরনা।গোটা বিশ্ব যাকে চেনে চে নামেই।

প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পরে বুয়েনেস আয়ার্সের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারির ছাত্র হিসেবে যোগ দিয়ে লাতিন বিশ্বের শোষিত মানুষের কাছাকাছি আসেন।অনুভব করেন তাদের নিদারুণ অভিজ্ঞতা।


১৯৫৬সাল নাগাদ যখন ফিদেলের নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে সেসময়ে চে-র সাথে পরিচয় হয় ফিদেলের।যোগ দেন ফিদেলের বিপ্লবীদের সাথে।আসতে আসতে তিনি বাহিনীর কমান্ডার হয়ে ওঠেন।প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটিয়ে বাহিনীর ব্যপ্তি বাড়ে। যে বিপ্লবী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন চে, ফিদেল। সেই বিপ্লবী বাহিনীর ৮০% এরও বেশি মানুষ ছিলেন কৃষক। কেউ কেউ নিজের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ হওয়া সাধারণ মানুষ। প্রায় সবাই ছিলেন জমিদার সামন্তপ্রভুদের অত্যাচারে শোষিত মানুষ। প্রত্যেকেই উদয়াস্ত কাজ করতে বাধ্য হতেন শুধুমাত্র নিজের পরিবার কে কোনো রকমে বাঁচিয়ে রাখতে। প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন রোগাক্রান্ত এবং অপুষ্টির শিকার। এই ভয়ানক বাস্তবতা অনুভব করেছিলেন চে, নিজেই। তাই বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই দেশের কৃষিনীতি নতুন ভাবে রূপায়ন করার ভাবনা চিন্তা ছিল চে-র মধ্যে। বাতিস্তা সরকারের পতনের পর তাই প্রধান গুরুত্ব পায় কৃষি নীতি। চে-র নীতি ছিল খুব সহজ। এতদিন যারা জমিতে চাষাবাস করতেন তাদের হাতে জমি ছিলনা। ছিল সামন্তপ্রভু দের হাতে। চে-র নীতি ছিল,জমিতে যে চাষাবাস করবে,জমি তার হবে।

যুদ্ধ চলাকালীনই যে সমস্ত জায়গা বিপ্লবীরা বাতিস্তার হাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন সেই সমস্ত জায়গায় ১৯৫৮র শেষ দিক থেকে এই নীতি প্রাথমিক ভাবে প্রয়োগ শুরু হয়।


এই কাজ চলাকালীন সময়ে যখন কিউবার বুকে পুর্নাঙ্গ বিপ্লব সংগঠিত হয় তখন প্রাথমিক ভাবে যে চিন্তা মাথায় আসে তা হল যারা বিপ্লবী বাহিনীতে ছিলেন তারা ভূমিহীন কৃষক। এর বাইরেও গোটা দেশের বহু ভূমিহীন কৃষক ছিলেন যাদের অবস্থা সঙ্গীন। অর্থনৈতিক ভাবে চরম বৈষম্যের শিকার। তাই নতুন রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ ছিল টেলিফোন ব্যবস্থা, জনপরিবহন ব্যবস্থার জাতীয়করণ। এরপরই ওষুধের দাম প্রায় অর্ধ্বেক থেকে আরও কম করা হয়। যা হল নতুন রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ঠ্য। এরপরই তৈরি হয় নতুন কৃষি সংস্কার আইন।

১৯৫৯র ৭ই আগস্ট চে ডিরেক্টর হিসেবে কৃষি সংস্কার ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নেন। তাঁর কাজ ছিল বিগত ১০মাসে যে সমস্ত শিল্প গুলি জাতীয়করণ হয়েছে তা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা। এর জন্য নতুন নিয়মচালু করেন তিনি। এই শিল্প গুলোর জন্য যা অর্থের প্রয়োজন তা বরাদ্দ হবে একমাত্র কেন্দ্রীয় ভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা। যা ছিল কেন্দ্রীয় কৃষি নীতি তৈরি সাথে সাথেই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র তৈরি করার আরেকটি পদক্ষেপ।

১৯৫৯র নভেম্বরে তিনি National Bank of Cuba র প্রধান নিযুক্ত হন। মূলত: এই সময় থেকেই কিউবার অর্থনৈতিক ভাবে খানিক স্বাবলম্বী হওয়ার শুরু। ১৯৬০সাল নাগাদ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে যে কোনো রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পায় কিউবা। এই বছরেরই শেষের দিকে এই প্রতিশ্রুতির প্রত্যুত্তরে আমেরিকা কিউবার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক বয়কট নীতি চালু করে। চে-র নেতৃত্বে এই সময়কালেই প্রায় ৬০০র অধিক শিল্প কারখানা এবং ১৫০র অধিক চিনি কল জাতীয়করণ হয়। কারণ এগুলোই ছিল প্রাথমিক ক্ষেত্র যা বয়কটের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারতো। তিনি লক্ষ্য করেন কিউবার শিল্প গুলো মূলত কাঁচামাল নির্ভর।অর্থাৎ শুধু কাঁচামাল উৎপাদন হয়। কিন্তু বিক্রয়যোগ্য পণ্য উৎপাদনে ভয়ঙ্কর ঘাটতি। তখন থেকে আসতে আসতে পণ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এই সময়কালে কিউবার উন্নয়নের স্বার্থেই চে নিজে চেকোস্লোভাকিয়া,মস্কো,চীন,উত্তর ভিয়েতনাম,পূর্ব জার্মানী যাত্রা করেন।প্রায় প্রত্যেকের কাছ থেকেই তিনি অর্থনৈতিক,বাণিজ্যিক সাহায্য লাভ এবং দেশে উৎপাদিত চিনি বিক্রির প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
১৯৬১র ফেব্রুয়ারি মাসে Industrial Department (INRA) শিল্প মন্ত্রকের রূপ নেয়। যার মন্ত্রী হন তিনি। এর পরবর্তী তেই তিনি একটি Board of Directors তৈরি করেন। যার কাজ ছিল দেশের অর্থনীতি, শিল্পনীতি কে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ করা এবং নির্ধারণ করা। ১৯৬১ সাল নাগাদ মূলত তাঁর নেতৃত্বেই স্টিল এবং লোহা শিল্প ৭৫% অগ্রগতি লাভ করে। পরবর্তী কালে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট নীতি রূপায়ন সহ তাদের মজুরি বৃদ্ধিসহ আরও বেশ কিছু কাজ হয় তাঁর নেতৃত্বেই। যার ফলাফল নিরক্ষরতা দূরিকরণ,সবার জন্য কাজ সুনিশ্চিত হয় এবং লাতিন বিশ্বে কিউবা শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়।

Argentine Marxist revolutionary Che Guevara (1928 – 1967, second from left) with fellow members of the ELN (Ejercito de Liberacion Nacional de Bolivia, or National Liberation Army of Bolivia) at Nancahuazu Camp in the Bolivian jungle, 1967. (Photo by Hulton Archive/Getty Images)

বিপ্লব পূর্ব কাজ এবং বিপ্লব পরবর্তী নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাজের সাথে সাথেই চলছিল তাঁর মার্কসবাদের চর্চা।মার্কসবাদের মূল শিক্ষা সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ।তা যেন চে নিজের শিরা উপশিরায় ধারণ করেছিলেন।তাঁর কাছে যেনো দেশ মানে ছিল গোটা বিশ্ব,যার কোনো কাঁটাতার থাকবেনা।ধর্ম মানে ছিল শোষিত মানুষ।আর প্রেয়সী ছিল বিপ্লব।

তাই তো খ্যাতির চূড়ায় থাকতে থাকতে।সমস্ত ক্ষমতার চূড়ায় থাকতে থাকতে তিনি ত্যাগ করেন মন্ত্রীত্ব।ছেড়ে দেন কিউবার নাগরীকত্ব।এবং ছদ্মনামে গোপনে পাড়ি দেন কঙ্গোর উদ্দেশ্যে।ফিদেলের উদ্দেশ্যে শেষ চিঠি তে ফুটে উঠেছে তাঁর ফিদেলের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা।গোটা পু্ঁজিবাদী দুনিয়া পরবর্তী কালে প্রচার করেছিল ফিদেলের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতির কথা।আসলে তা সত্য নয়।কঙ্গোর শোষিত কালো মানুষ দের লড়াইএ কিউবা থেকে দুই শতাধিক সেনা যায়।যে সময়কালে ফিদেলের সাথে ভরপুর যোগাযোগ ছিল চে-র।শুধু কঙ্গোর মানুষ দের যুদ্ধের অনুশীলন করানোই নেয়।চে স্বয়ং যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্বও দেন।
১৯৬৫র ডিসেম্বর পর্যন্ত চে ছিলেন কঙ্গোতে।শোম্বের অপসারণের পর কঙ্গোলিজরা কিউবার সেনা প্রত্যাহারের কথা বলেন।চে নিঃশব্দে কঙ্গো ছাড়েন।রওনা দেন তানজানিয়ার উদ্দেশ্যে।দীর্ঘ ছয় ঘন্টার বিমান সফরে তিনি ব্যস্ত ছিলেন দাবার চাল নিয়ে লেখা একটি বই পড়তে।এরই মাঝে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজেয়ার্সে ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাফ্রো-এশীয় সংহতি সম্মেলনে চে’র প্রত্যয়ী ভাষণ ছিল,”সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মৃত্যুর কোনও সীমানা নেই।” তিনি বলেছিলেন “পৃথিবীর কোথাও কোনও প্রান্তে কোনও ঘটনা সম্পর্কে আমরা মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারি না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনও দেশের বিজয় মানে, আমাদের জয়, ঠিক যেমন কোনও দেশের পরাজয় মানে, আমাদের পরাজয়। সবর্হারার আন্তর্জাতিকতাবাদের এই অনুশীলন তাই আরও উন্নত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মানুষের জন্য শুধু একটি কর্তব্য নয়, অনিবার্য বাধ্যবাধকতা।”

বিশ্ববন্দিত নোবেল জয়ী সাহিত্যিক মার্কেজ চে-কে নিয়ে একসময় বলেছিলেন “আফ্রিকায় চে যে বীজবপন করে এসেছেন,তা ধ্বংস করা অসম্ভব।”সেই সময়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের লড়াই তাঁকে উদ্দীপিত করেছিল।বলিভিয়া থেকে ভিয়েতনামের উদ্দেশ্যে তাঁর সেই বিখ্যাত বার্তা ‘ভিয়েতনামই পথ’।সর্বহারার আন্তর্জাতিক লড়াই বারংবার প্রেরণা জুগিয়েছে তাঁকে।

বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া তাঁকে বারংবার অন্য ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছে আমাদের সামনে। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে ইয়াঙ্কী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস।ম্যাডোনার বহুল প্রচলিত সিডির কভারে তার মুখ।মার্সিডিজ বেঞ্চে তাঁর মুখ। মাইক টাইসনের উল্কি থেকে শুরু করে ব্রাজিলিয় মডেলের বিকিনির ডিজাইনে তাঁর মুখ। দামি জুতোর কোম্পানির ব্র‍্যান্ডিং থেকে শুরু করে নাইট ক্লাবের দেওয়ালের গ্রাফিতি তে আপনি খুঁজে পাবেন ওঁর মুখ। যেনো ভোগবাদী জীবন।আমোদ প্রমোদের আইকন তিনি। লম্বা উস্কখুস্ক চুল, মুখে চুরুট মাথায় পাঁচ তারা টুপি,আপন মনে বেড়ে ওঠা ছবি তে চে যেনো সেক্স সিম্বল। এই দেখাতে চায় পুঁজিবাদী দুনিয়া।

মৃত্যু যখন শিয়রে। যখন বলিভিয়ার স্কুল বাড়ি তে নিরস্ত্র চে কে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হবে। সে সময়ে একজন সেনাকর্তা তাঁকে জিজ্ঞেস করছে ” আপনি কি ভেবেছিলেন আপনি অমর থেকে যাবেন?”
সেই সময়ে মৃত্যুকে যেনো চুমু খেয়ে আলিঙ্গন করছেন তিনি। আর উত্তর দিচ্ছেন “আমি জানি তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছো। ভয় পেয়োনা গুলি করো। তোমরা শুধুই হত্যা করতে এসেছ একজন মানুষ কে।”
আসলে তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন “মতাদর্শকে হত্যা করা যায়না”।

এটাই শিক্ষা আমাদের। আমরা যারা একবিংশ শতকের ভারতবর্ষে সমাজ পাল্টানোর লড়াই করছি। লড়াই করছি বিপ্লবী রাজনীতির পক্ষে দাঁড়িয়ে। বিপ্লবী মতাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। তীব্রতর করতে হবে শ্রেণীসংগ্রাম। তীব্র শ্রেণী সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন হবে বর্তমান শ্রেণী ভারসাম্যের।
এটাই কমানদান্তের শিক্ষা। যা ফুটে উঠেছিল তাঁর পঞ্চাশতম মৃত্যু বার্ষিকীতে তাঁর কমরেড, তাঁর বহু লড়াই এর সাথী কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোর কথায়…


“সে ছিল সেই ফুলের মতো, ফোটার আগেই বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া একটি ফুল। এক ব্যতিক্রমী যোদ্ধা…”।

তথ্য সূত্র:
১।প্রেয়সী যার বিপ্লব।

২।চে গুয়েভারার ডায়েরী।

৩। https://www.marxists.org/archive/guevara/biography/econ-ministry.htm

Spread the word