party congress part 15

History of Party Congress (Part-XV)

২২ তম পার্টি কংগ্রেস
এপ্রিল ১৮-২২, ২০১৮, হায়দ্রাবাদ

প্রেক্ষাপট:

পার্টির ২১তম কংগ্রেসের পর থেকে ভারতের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার আরও বাড় বাড়ন্ত দেখা যায়। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে এক শোষণবাদী চার-মুখী আক্রমণ চালাতে শুরু করে:

১) নয়াউদারবাদী অর্থনীতির প্রকোপ: আগ্রাসী বেসরকারিকরণ, কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা এবং শ্রমিক-বিরোধী আইন-কানুন চাপিয়ে দেওয়া হয়।

২) সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ: ঘৃণা প্রচারণা ও বৈষম্যমূলক নীতির মাধ্যমে ধর্মীয় বিভাজন তীব্রতর করা হয়।

৩) কর্তৃত্ববাদ: সংসদীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করা হয়, ভিন্নমত দমন করা হয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আক্রমণ শানিয়ে কর্তৃত্ব ফলানো হয়।

৪)মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আনুগত্য: কৌশলগতভাবে ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুজ অংশীদারে পরিণত করা হয়, যা জাতীয় সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করে।

ভারতের শাসক শ্রেণি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে দেশের ও জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। এই বিশ্ব পরিস্থিতি ভারতের রাজনৈতিক পরিসরকে সরাসরি প্রভাবিত করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে, সার্বিক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক মূল্যায়ন শুরু হয় ২২ তম পার্টি কংগ্রেসে।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি:

২১তম কংগ্রেসের পর থেকে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট অব্যাহত থাকলেও বিশ্ব অর্থনীতিতে স্বল্প মাত্রার ঘুরে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

বিশ্বজুড়ে এই সংকটের ফলে শ্রমজীবী মানুষ ব্যাপক শোষণের মুখে পড়ে। দমনমূলক অর্থনীতিকে হাতিয়ার করে মজুরি হ্রাস, শ্রমিক অধিকার খর্ব করা ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায় আঘাত নামিয়ে আনা হয়। ফলে বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ ও আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। এই সংকট ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যকে আরও তীব্র করে তোলে। যেখানে বিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে সম্পদের সিংহভাগ কুক্ষিগত হতে থাকে, অন্যদিকে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হতে হয়।

এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব আধিপত্য শক্তিশালী করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে। লাতিন আমেরিকায় মার্কিন সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ইউরোপে দক্ষিণপন্থী, চরমপন্থী ও নয়া-ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান লক্ষ করা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া বিশ্ব রাজনীতির ডানদিকে সরে যাওয়ার প্রবণতাকে আরও জোরদার করে তোলে।

এই সময়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বের পুনরুত্থান। বিশেষত, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য গভীরতর হতে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বহুমেরুত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে ধারা ছিল, তা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়।

বিশ্ব পুঁজিবাদ ২০শ শতকের শেষ দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের ধারেকাছে পৌছতে অক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির প্রভাবে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন জোরদার হতে থাকে এবং জোরপূর্বক সম্পদ আত্মসাৎ ও শ্রমিক শ্রেণির উপর ব্যাপক শোষণ অব্যাহত থাকে। উন্নত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের হার কিছুটা বাড়লেও, মজুরি বৃদ্ধির হার আগের মত বাড়তে পারে নি। ‘শ্রম বাজারের অনিশ্চয়তা’র নামে চুক্তিভিত্তিক, কম মজুরির কাজ বাড়ানো হয়, যা শ্রমিকদের আরও দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেয়।

অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্স প্রযুক্তির বিকাশ কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। কর্পোরেট মালিকপক্ষ শ্রমিকদের আরও কম খরচে প্রতিস্থাপনের সুযোগ পেয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে বিপুল পরিমাণ মূলধন জমা থাকলেও, চাহিদার অভাবে তা বিনিয়োগের জন্য বাজারে আসে নি, যা নতুন সংকটের অশনিসংকেত।

ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ২০১৭ সালের ক্রেডিট সুইস রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের মাত্র ২.৭% মানুষ বৈশ্বিক সম্পদের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যদিকে ৮৫.৬% মানুষের হাতে মজুদ মাত্র ৮.৬% সম্পদ।

এই পরিস্থিতিতে জনগণের প্রতিবাদ আন্দোলন বাড়তে থাকে, যা রক্ষণাত্মক হলেও ভবিষ্যতে বৃহত্তর পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ভিত গড়ে দিচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ায় বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর পুনরুত্থান লক্ষ করা যায়।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য বজায় রাখতে সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে চলে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষায় ৭০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। দক্ষিণ চীন সাগরকে কেন্দ্র করে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন কৌশলগত অবস্থান আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে।

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাম ও শ্রমজীবী আন্দোলনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে সংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামকে জোরদার করাই অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী বিভাজন ও সংঘাত

বিশ্বব্যাপী দীর্ঘায়িত পুঁজিবাদী সংকট ও নতুন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পরস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির নেতৃত্বে বিশ্বায়নের যে সংহতি আগে দেখা গিয়েছিল, তাতে ভাঙন ধরে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও জাপানের দ্বন্দ্ব গভীরতর হয়।

ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি, বিশেষত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপ, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকার প্রত্যাহার এবং ইরান পারমাণবিক চুক্তি বাতিল হওায় ইউরোপীয় মিত্রশক্তির সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে জনগণের ওপর অর্থনৈতিক শোষণ বাড়ানোর প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি একত্রে কাজ করতে থাকে। আভ্যন্তরীণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব ক্রমেই তীব্র হতে থাকে, যা ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের জন্ম দেবে বলে মনে করা হয়।

সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট সংহতি ও সংগ্রাম

বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট ও শ্রমজীবী দলগুলোর আন্তর্জাতিক সংহতি দৃঢ় হতে থাকে। ২০১৭ সালে রাশিয়ায় মহান অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট দলগুলোর নেতৃত্বে জনবিক্ষোভ বাড়তে শুরু করে। পুঁজিবাদের বিকল্প শক্তি গড়ে তুলে শ্রেণি-সংগ্রাম তীব্রতর না করা পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বন্ধ করা অসম্ভব বলে পার্টি ব্যক্ত করে।

ভারতে শক্তি বৃদ্ধি করে জনগণের লড়াইকে আরও সুসংহত করার দায়িত্ব নেয় পার্টি। বিজেপি সরকারের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালিয়ে দেশকে এই অধীনতার বন্ধন থেকে মুক্ত করার আহ্বান দেওয়া হয়। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্তাইনের সংগ্রামকে পার্টি পূর্ণ সমর্থন জানায় এবং মার্কিন-ইসরায়েল-ভারত আঁতাতের বিরোধিতা করে।

সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে পার্টি দৃঢ় অবস্থান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও লাওসের সমাজতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংহতি জানানো হয়। দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার বামপন্থী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গেও সংযোগ আরও গভীর করতে পার্টি উদ্যোগী হয়।

বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, জলবায়ুর প্রতি ন্যায়ের দাবি নিয়ে ও মার্কিন সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে ঐক্যবদ্ধ করে বৃহত্তর বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান রাখা হয়।

জাতীয় পরস্থিতি:

মোদি সরকার: স্বৈরতন্ত্র ও হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন

প্রায় চার বছরের মোদি শাসন ভারতকে দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দেয়। নয়াউদারবাদী অর্থনীতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের উপর আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বিপন্ন করে তোলে। সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর হামলা এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতা জোরদার হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্র হিসেবে ভারতের অধীনতামূলক ভূমিকা আরও মজবুত হয়।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ৩১% ভোট পেয়েও বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যা নয়াউদারবাদী নীতি ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের দ্বৈত আক্রমণের ক্ষেত্র তৈরি করে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে খর্ব করে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে মোদি সরকার কর্তৃত্ববাদী কাঠামো নির্মাণে সচেষ্ট ভূমিকা নেয়।

প্রস্তাবে নিম্নলিখিত মূল বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হয়:

(i) “বিজেপি সরকারের এগারো মাস চিহ্নিত হয়েছে নয়াউদারবাদী আগ্রাসী নীতির দ্বারা। অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজির প্রবেশ বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত করা হয়েছে। শ্রম আইন ও ভূমি অধিগ্রহণ আইন শিথিল করা হয়েছে।”

(ii) “জনগণের বিরুদ্ধে এই সর্বাত্মক আক্রমণ শাসক শ্রেণির জন্য কর্তৃত্ববাদকে আবশ্যক করে তুলেছে।”

(iii) “বিজেপি সরকারে থাকার ফলে পরিস্থিতি একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে এবং আরএসএস-এর পরিকল্পনা কার্যকর করা হচ্ছে।”

(iv) “যে হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলছে, তা এগিয়ে নিয়ে যেতে বহুমুখী প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

(v) “মোদি সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করেছে।”

(vi) “ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এবং নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে।”

অর্থনৈতিক সংকট:

মোদি সরকারের চার বছরে নয়া উদারবাদের ধ্বংসযজ্ঞ

মোদি সরকারের চার বছরে ভারতীয় অর্থনীতি গভীর সংকটের মুখে পড়ে। সরকার পরিসংখ্যান জালিয়াতি করে। প্রকৃত চিত্র লুকোতে চাইলেও আদতে তা সম্ভব হয় নি। সংশোধিত জিডিপি পরিসংখ্যানেও প্রবৃদ্ধি ২০১৫-১৬ সালের ৮ শতাংশ থেকে ২০১৭-১৮ সালে ৬.৫ শতাংশে নেমে আসে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কর্মসংস্থান কমে।

কৃষি ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়, যেখানে বছরে গড় বৃদ্ধি মাত্র ১.৭ শতাংশে নেমে আসে। সরকারি ব্যয়ের কাটছাঁট, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কমানো, সরকারি ক্রয় হ্রাস ও উৎপাদন সামগ্রীতে ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির ফলে কৃষকদের আয় ধুলিসাৎ হয়। বীমা ব্যবস্থাকে কর্পোরেট লুটের অস্ত্র বানিয়ে দেওয়া হয়, অথচ কৃষকদের ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

উৎপাদন খাতে তথ্যবিভ্রান্তি থেকে যায়, যা অর্থনৈতিক দুরবস্থা লুকোনোর প্রমাণ দেয়। নোটবন্দি ও জিএসটি বাস্তবায়নের ফলে বেসরকারি শিল্প বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্র, ধ্বংস হয়। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপের পরিমাণ ২০১৪ সালের ২.৬ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ২০১৭ সালে ৮.৩৭ লক্ষ কোটিতে পৌঁছায়। বড় কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের রক্ষা করা হয়।

নোটবন্দি ও জিএসটির ধ্বংসাত্মক প্রভাব

নোটবন্দির লক্ষ্য ছিল কালো টাকা নির্মূল করা। কিন্তু বাস্তবে ৯৮.৯৬ শতাংশ বাতিলকৃত নোট ফেরত চলে আস, ফলে সরকারের দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এটি আসলে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থে ডিজিটাল অর্থনীতি চাপিয়ে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র ছিল। যার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক ও অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে।

জিএসটি মূলত কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার নীতি ছিল, যা কেন্দ্র-রাজ্যের অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এটি ছোট ব্যবসা, কৃষি ও পরিষেবা খেত্রকে সংকটে ফেলে এবং মূল্যস্ফীতি ঘটে।

ব্যাংক ও বেসরকারিকরণ

মোদি সরকারের আমলে ২.২৯ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মাফ করা হয়, যা কর্পোরেট লুটের দৃষ্টান্ত। নতুন ব্যাংক আইন জমাকারীদের টাকা লুটের সুযোগ করে দিতে থাকে।

বেসরকারিকরণের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা, রেল, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে বাজারের পণ্যে পরিণত করা হয়, যা নয়া উদারবাদী ধ্বংসযজ্ঞকেই ত্বরান্বিত করে।

ভারতের কৃষি সংকট: মোদি সরকারের নীতির ধ্বংসাত্মক প্রভাব

মোদি সরকারের নীতির ফলে ভারতের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি চরম সংকটে পড়ে। নোটবন্দির ধাক্কা, গবাদিপশু ব্যবসায় বিধিনিষেধ, চাষের ব্যয়বৃদ্ধি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) স্থবির হয়ে যাওয়া কৃষকদের সংকট আরও তীব্র করে তোলে। WTO-র চাপে সরকারি ক্রয় কমিয়ে খাদ্য নিগম (FCI) বেসরকারিকরণের দিকে এগোতে থাকে। কৃষিঋণ নীতিতে কর্পোরেটদের সুবিধা দেওয়া হলেও সাধারণ কৃষকের ঋণের বোঝা বাড়ে।

পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিকে দুর্বল করে খনি, শিল্প ও পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত অনুমোদন দেওয়া হয়। বনাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকায় কর্পোরেটদের লুটের জন্য পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করা হয়। রাজ্য সরকারকে পরিবেশ বিষয়ে অনুমোদনের ক্ষমতা দিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ দুর্বল করা হয়। এভাবে কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থ উপেক্ষা করে সরকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

মোদি শাসনে বেকারত্ব, বৈষম্য ও নারীদের অধিকার সংকট:

মোদি সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা বেকারত্ব বৃদ্ধি। ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে ১৫ লাখ মানুষ কাজ হারায়, আর প্রতি মাসে নতুন ১০ লাখ কর্মপ্রার্থী শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও অধিকাংশই চাকরি পেতে অক্ষম হয়। নোটবন্দির পর কাজে অংশগ্রহণের হার ব্যাপকভাবে কমতে থাকে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে, MNREGA-তে কাজের দিন কমানোয় সংকট আরও বাড়ে। এমনকি IT সেক্টরেও গণহারে ছাঁটাই হয়।

অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে পৌঁছায়। ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের মোট সম্পদের ২৮% কেবলমাত্র ১% ধনীদের দখলে ছিল। ২০১৭ সালে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত সম্পদের ৭৩% এর উপর ১% জনগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। আয় ও সম্পদ বৈষম্যে শহর ও গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই দরিদ্ররা পিছিয়ে পড়তে থাকে।

খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। আধার বাধ্যতামূলক করায় রেশন থেকে বহু দরিদ্র পরিবার বঞ্চিত হয়, যার ফলে ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। ডিজেলের শুল্ক বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে।

শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করে বিজেপি সরকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে উৎসাহী হয়। শ্রম আইন সংশোধন করে সংগঠিত ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে জোর দেয়। অধিকাংশ চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক মাত্র ৫০০০ টাকার কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, শ্রমিকদের সাংগঠনিক অধিকার হরণ করা হয়।

নারীদের অবস্থা আরও অবনতির দিকে চলে যায়। কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণ কমে, কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা বৃদ্ধি পায়, ন্যায়বিচারের হার নিম্নমুখী হয়। নারীবিরোধী হিন্দুত্ববাদী প্ররোচনা, ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’ গঠন, পারিবারিক নির্যাতন আইনের শিথিলতা নারীদের নিরাপত্তা আরও দুর্বল করে তোলে। মুসলমান নারীদের অধিকারের বিষয়ে বিজেপি ভণ্ডামি করে, অথচ অনার কিলিং ঠেকাতে কোনো আইন আনেনি তারা।

মোদি সরকার নারীদের সংরক্ষণ বিল কার্যকর করেনি। সমগ্র শাসন ব্যবস্থাই কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে সাধারণ মানুষ বিশেষত শ্রমিক, কৃষক ও নারীরা ক্রমেই বঞ্চিত হতে থাকে।

সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আন্দোলনের বিস্তার

মোদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা ও কর্তৃত্ববাদী দমননীতির বিরুদ্ধে দেশে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, শ্রমিকদের ধর্মঘট, ছাত্রদের প্রতিবাদ এবং দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করে। গণঐক্য ও গণঅধিকার আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করে। বিজেপি সরকার কর্পোরেট স্বার্থে জনগণের ওপর শোষণ বাড়ায়। অন্যদিকে এই দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধেই গণবিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির দায়িত্ব এই আন্দোলনকে আরও সুসংহত করে মোদি সরকারের নয়া উদারবাদী ও সাম্প্রদায়িক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয়তা

ভারতে বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি হল পার্টির স্বতন্ত্র শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার পরাজয় এবং কেরালা ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যে অগ্রগতির অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, জনগণের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন, শ্রেণি ও গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পার্টির ভিত্তি সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে পার্টি মনে করে।

শাসকশ্রেণির আদর্শ ও রাজনীতির মোকাবিলায় আদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রচারাভিযান জোরদার করার শপথ নেয় পার্টি। বাম ঐক্যকে দৃঢ় করতে হলে সাধারণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে একত্রিত হওয়া জরুরি। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরার বাইরেও তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ু, আসাম ও পাঞ্জাবে বাম দলগুলোর যৌথ কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। তবে জাতীয় পর্যায়ে এই আন্দোলন আরও শক্তিশালী করার কথা বলে পার্টি।

বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্টই প্রকৃত বিকল্প, যা শোষিত-নিপীড়িত জনগণের স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষক সংগঠন, নারী, দলিত ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় একত্রিত করে বাম-গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে সামনে আনার ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শাসকশ্রেণির নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করা এবং জাতীয় স্তরে বাম বিকল্পকে প্রতিষ্ঠা করাই অগ্রাধিকার বলে পার্টি মনে করে।

বিজেপির প্রতিরোধে বামপন্থীদের করণীয়

মোদী সরকারের চার বছরের শাসনকালে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জনবিরোধী অর্থনীতির বিরুদ্ধে লড়াই অপরিহার্য। বিজেপিকে পরাজিত করতে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি, তবে কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক জোট নয় বলেই পার্টি মনে করে। পার্টি মনে করে সংসদে ন্যূনতম বোঝাপড়ার ভিত্তিতে যৌথ পদক্ষেপ নেওয়া এবং সংসদের বাইরে বৃহত্তর গণঐক্য গড়ে তোলা প্রধান কাজ ।

বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে ব্যাপক গণসংগঠন গড়ে তোলা এবং বিজেপির নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার আন্দোলন জোরদার করার কথা পার্টি জানায়। একইসঙ্গে, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জনগণের ঐক্যকে তৃণমূল পর্যায়ে সুসংহত করতে পার্টি বদ্ধপরিকর হয়।

সংগঠনের প্রসারে যুবসমাজকে আকৃষ্ট করা এবং পার্টির গণভিত্তি শক্তিশালী করাকে অগ্রাধিকার দেয়। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্পকে প্রতিষ্ঠা করার শপথ নেওয়া হয়। কলকাতা প্লেনামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাম আন্দোলনকে আরও সুসংগঠিত করে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই জোরদার করাই একমাত্র পথ বলে পার্টি মনে করে।

সম্মেলন শেষে:

পার্টি কংগ্রেসে উঠে আসে কিভাবে পার্টির স্বাধীন ভূমিকা ও কর্মসূচী জোরদার করা যায়। নয়াউদারবাদী নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যায়। কংগ্রেস ও ইউপিএ সরকারকে পরাজিত করতে এবং বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করতে একটি বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

রাজনৈতিক-কৌশলগত পর্যালোচনায় বামপন্থী শক্তিগুলির ঐক্য সুসংহত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়। এটি শুধুমাত্র নির্বাচনী কৌশলের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং সিপিআই(এম)-এর স্বাধীন শক্তি ও হস্তক্ষেপের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার অপরিহার্যতা লক্ষ্য করা যায়।

২২তম কংগ্রেসে ৯৫-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয় যার মধ্যে একটি পদ পরবর্তীর জন্য ফাঁকা রাখা হয়। নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি ১৭-সদস্যের পলিট ব্যুরো গঠন করে। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন।


তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

Spread the word

Leave a Reply