History of Party Congress (Part-XIV)

২০তম পার্টি কংগ্রেস, ২০১২
কোঝিকোড়, কেরালা, এপ্রিল ৪-৯, ২০১২

কৃষ্ণায়ন ঘোষ

প্রেক্ষাপট:

২০তম কংগ্রেসের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পুঁজিবাদী দেশগুলো গভীর সংকটে ডুবে যায়। সারা বিশ্বে মানুষ তাদের অধিকার ও জীবিকা রক্ষার জন্য লড়াই চালাতে থাকে। তিউনিসিয়া ও মিশরে গণঅভ্যুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী স্বৈরাচারী সরকারগুলিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই আন্দোলনগুলিকে ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবাহিত করে।

আন্দোলনগুলিকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। ল্যাটিন আমেরিকায় বামপন্থী শক্তির অগ্রগতি অব্যাহত থাকে।
ভারতে, সিপিআই(এম) ইনদো-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। কিন্তু সরকার অন্য দলের নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ দেয় ও দলত্যাগে প্ররোচিত করে। ফলে তারা ক্ষমতায় টিকে যায়। ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর ইউপিএ-২ সরকার বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নীকরণের নীতি জোরদার করে এবং উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি তীব্রতর হয়। সেই সাথে, সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে।

পশ্চিমবঙ্গে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বামফ্রন্ট সরকার পরাজিত হয় এবং পার্টি প্রচণ্ড আক্রমণের শিকার হয়। ৫৭০ জন পার্টির সদস্য ও সমর্থক শহীদ হন পশ্চিমবঙ্গে।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

১৯তম কংগ্রেসের পর থেকে বিশ্ব পুঁজিবাদ গভীর সংকটে পড়ে। ১৯৩০-এর মহামন্দার পর যা বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট। এই সংকটের মূল কারণ নয়াউদারবাদী অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির আধিপত্য। বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার ফলে উন্নত দেশগুলোতে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক নিরাপত্তা হ্রাস পায়। ফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

বিশ্ব পুঁজিবাদ ও সংকট

২০০৭-০৮ সালে নিয়ন্ত্রণহীন ঋণদান ও আর্থিক জালিয়াতির ফলে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বড় বড় ব্যাংক ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে করদাতাদের অর্থ দিয়ে রক্ষা করা হলেও, পরবর্তীকালে সরকারগুলি জনগণের ওপর ব্যয়সংকোচন নীতি চাপিয়ে দেয়। কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়া, বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করা এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধার কাটছাঁট হওয়ার ফলে ব্যাপক সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়।

ইউরোজোন ঋণ সংকট

ইউরোপে সার্বভৌম ঋণ সংকটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভঙ্গুর অবস্থা প্রকাশ পায়। অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্পোরেটের দেউলিয়া অবস্থার কারণে সরকারগুলোর ঋণ বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে গ্রীস, স্পেন, ইতালি ও পর্তুগালে এই সংকট আরও গভীর হয়। ঋণ সংক্রান্ত কঠোর শর্ত আরোপের ফলে গ্রীসের অর্থনীতি মন্দায় ডুবে যায়। এদিকে, ফ্রান্স ও জার্মানির নেতৃত্বে একটি আর্থিক সংহতি চুক্তি গৃহীত হয়, যা সদস্য দেশগুলোর আর্থিক সার্বভৌমত্ব খর্ব করে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষত, ব্রিকস (BRICS) দেশগুলোর অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক শক্তি ভারসাম্যে পরিবর্তন আসে, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নতুন বৈষম্য তৈরি করে।

সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ ও সামরিক আগ্রাসন

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ তাদের আর্থিক দুর্বলতা সত্ত্বেও সামরিক আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপ কোনো দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিতে পারেনি। লিবিয়ার পর সিরিয়া ও ইরান নতুন লক্ষ্য হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি কর এবং চীনকে প্রতিহত করার জন্য জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে জোটে টানার চেষ্টা করে। ওবামার প্রশাসন ন্যাটোকে ব্যবহার করে একাধিক সামরিক অভিযান চালায় এবং বিভিন্ন দেশে শাসন কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এই পরিস্থিতিতে, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প খুঁজে বের করাই সারা বিশ্বে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তির প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে পার্টি মনে করে।

মিশরে মুবারকের পতনের ফলে প্যালেস্তাইন আন্দোলনে প্রভাব পড়ে এবং ফাতাহ-হামাস সম্পর্ক উন্নত হয়। প্যালেস্তাইন জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্য সমর্থন লাভ করলেও ইসরায়েল বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখে, যা শান্তি আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি করে। ইসরায়েলে জীবনযাত্রার মানের অবনতির কারণে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়, অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করে ইসরায়েল।

পুঁজিবাদের সংকটের ফলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত দেশে গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রিসে ধারাবাহিক ধর্মঘট ও স্পেনে যুব প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন কর্পোরেট লোভ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। ইউরোপে সামাজিক সুবিধা কমানোয় ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, যার সুযোগ নিয়ে ডানপন্থী শক্তিগুলো অভিবাসী ও ইসলামবিদ্বেষ উসকে দিতে শুরু করে।

সমাজতন্ত্রী দেশগুলির অবস্থান:

লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী সরকারগুলো মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে নীতি গ্রহণ করে। ভেনিজুয়েলা ও বলিভিয়া রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, ভূমি সংস্কার ও সামাজিক কল্যাণে জোর দেয়। সেলাক (CELAC) গঠনের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো মার্কিন প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে।

দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও চীনে আয় বৈষম্য, দুর্নীতি এবং আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ভিয়েতনাম দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে সাফল্য পায়, কিউবা অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ দেওয়া শুরু করে।

বিশ্বশক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে ব্রিকস, সেলাক ও সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের মতো জোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব আঞ্চলিক জোট বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

জাতীয় পরিস্থিতি:

ইউপিএ সরকার মূলত বড় ব্যবসা ও বিদেশি পুঁজির স্বার্থে কাজ করে যায়, যা ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে উঠে আসে। পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় যে, নয়াউদারবাদী নীতির বিরোধিতা অব্যাহত রাখতে হবে এবং স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করলেও সরকারকে সমর্থন দিতে হবে। পাশাপাশি, বিজেপি ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর পুনরুত্থান রোধ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত জোটের বিরোধিতা করে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে গণসংগঠনের আহ্বান জানানো হয়।

পার্টি কংগ্রেসের তিন মাসের মধ্যে বামপন্থীরা ইউপিএ সরকারের সমর্থন প্রত্যাহার করে, কারণ তারা মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যায়। ইউপিএ সরকার অনৈতিকভাবে টাকা ও দলত্যাগকে উৎসাহিত করে আস্থা ভোটে জয়ী হয়। পরবর্তীতে ইউপিএ-২ সরকার আগের চেয়েও আগ্রাসীভাবে একই অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করে। এই সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাপক দুর্নীতি, মার্কিন নীতি অনুসরণ এবং শ্রমজীবী মানুষের ওপর দমন-পীড়ন তীব্র আকার নেয়।

নয়াউদারবাদী নীতির প্রভাব:

ইউপিএ-২ সরকার নয়াউদারবাদী নীতিগুলোকে ত্বরান্বিত করতে চায়। বামপন্থীদের বিরোধিতার কারণে পূর্ববর্তী মেয়াদে তা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল সরকারি ক্ষেত্রকে দুর্বল করা এবং দেশীয় ও বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর মুনাফার সুযোগ বৃদ্ধি করা। ২০০৯ সাল থেকে ৪৭,৫০০ কোটি টাকারও বেশি সরকারি শেয়ার বেসরকারি মালিকানার অধীনে বিক্রি করা হয়।

সরকারের ভূমিকা কমাতে তেল, গ্যাস, কয়লা ও খনিজ সম্পদ বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিদেশি বিনিয়োগের সীমা বাড়িয়ে বিমা, ব্যাংক, পেনশন ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর প্রবেশ সহজতর করা হতে থাকে। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো ভারতীয় বাজার দখল করে ওষুধের দাম বাড়ায়। বহুজাতিক খুচরা বাণিজ্যে ৫১% এফডিআই চালুর সিদ্ধান্তে সরকার ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এছাড়া, ২০১২ সালের খসড়া জাতীয় জল নীতি জলসেবা বেসরকারীকরণে উৎসাহিত করে, যা সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জল পাওয়া কঠিন করে তোলে।

মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক স্লথতা ও খাদ্য সুরক্ষা:

ইউপিএ সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ২০০৮-১১ সালের মধ্যে খাদ্যদ্রব্যে মূল্যস্ফীতির হার ১০% এর ওপরে ছিল, যা স্বাধীনতা পরবর্তীতে নজিরবিহীন। সরকারের নয়াউদারবাদী নীতির ফলে খাদ্য মজুদদারি, অপ্রয়োজনীয় রপ্তানি ও কর্পোরেটদের দখলদারিত্ব খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পেট্রোল, ডিজেল, এলপিজি ও সারের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলায় কৃষি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে।

খাদ্য নিরাপত্তা আইন দরিদ্রদের প্রকৃত সহায়তা না দিয়ে পিডিএস ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর খাদ্যব্যবসায় প্রবেশ সহজ হয়ে ওঠে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০১১-১২ সালে জিডিপি বৃদ্ধি কমে ৭% হয়, যা কর্মসংস্থান সংকটকে তীব্র করে তোলে। সরকারি ব্যয় সংকুচিত হওয়ায় বিনিয়োগ কমে যায়, ফলে অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়। সরকার ধনীদের উপর কর বৃদ্ধি না করে কর্পোরেট কর ছাড় দিতে থাকে, যা রাজস্ব ঘাটতি বাড়িয়ে তোলে। পার্টি সার্বজনীন পিডিএস পুনর্বহাল ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দাবি জানায়।

কৃষি:

ভারতের ৬০% জনগণ কৃষির উপর নির্ভরশীল হলেও কৃষি বৃদ্ধির হার পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। খাদ্যশস্যের যোগান কমে যায়, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়। ঋণের চাপে ১৯৯৫-২০১০ সালের মধ্যে ২.৫৭ লক্ষেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেন, যা মূলত উচ্চ ব্যয়বহুল কৃষি সামগ্রী, অপ্রতুল সহায়তা মূল্য ও ঋণ পাওয়ার অসুবিধার কারণে হয়।

সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। ভূমিহীন কৃষক ও চাষিরা শোষণের শিকার হয়। চুক্তি চাষ ও কর্পোরেটদের কৃষি ক্ষেত্রে প্রবেশ কৃষকদের আরও সংকটে ফেলে। কৃষি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা খর্ব হয়, এবং মনরেগা প্রকল্প দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারী সহায়তার অভাবে কৃষকরা দারিদ্র্যের মুখে পড়ে ভিটেমাটি বিক্রি করতে বাধ্য হন। সিপিআই(এম) ভূমি সংস্কার, কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং কর্পোরেটদের কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ রোধের পক্ষে সোচ্চার হয়।

বৃহৎ পুঁজি ও শ্রমীকের অধিকার:

নয়াউদারনীতি মূলত বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। পার্টি কংগ্রেস পূর্ববর্তি দুই দশকে ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সম্পদ বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়, এবং দেশীয় সংস্থাগুলি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতীয় কর্পোরেট সংস্থাগুলি বিদেশে বড় সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ করতে শুরু করে এবং কৃষি ব্যবসায় যুক্ত সংস্থাগুলি আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও পূর্ব এশিয়ায় বিপুল পরিমাণ জমি কেনে।

অপরদিকে, শ্রমিকদের শোষণ বেড়ে চলে। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হ্রাস প্যাঁয়, এবং স্থায়ী কর্মীদের বদলে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ বাড়ে। ফলে চাকরির নিরাপত্তা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে। মজুরি হ্রাসের পাশাপাশি, মুনাফার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অধিকাংশ শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে, যেখানে শ্রম অধিকার রক্ষা হয় না। স্বনির্ভর কাজ এবং অনিশ্চিত আয়ের ফলে শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক মন্দা এবং মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর।

দুর্নিতি প্রসঙ্গে:

ইউপিএ সরকারের শাসনকাল ব্যাপক দুর্নীতির প্রতীক হয়ে ওঠে। 2G স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতি, কেজি বেসিন গ্যাস কেলেঙ্কারি, অবৈধ খনন দুর্নীতিগুলি তার মধ্যে অন্যতম। এই দুর্নীতি প্রমাণ করে শাসক দল, কর্পোরেট এবং আমলাতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভারতের অবৈধ অর্থপাচার ২৩ লাখ কোটি টাকার বেশি বলে এক সমীক্ষায় উঠে আসে। কালো টাকা উদ্ধারে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।

আন্না হাজারের নেতৃত্বে লোকপাল বিলের দাবিতে আন্দোলন জনসমর্থন পেলেও সরকার বিল পাস করার চেষ্টা করে। বামপন্থীরা স্বাধীন তদন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী লোকপালের দাবি জানায় এবং বিচার ও নির্বাচনী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়।

এছাড়া, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের নামে মুসলিমদের নিশানা বানাতে শুরু করে। বিভিন্ন রাজ্যে দাঙ্গা ছড়ায় এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলে, যা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পটভূমি তৈরি করে দেয়।

পরমাণু চুক্তি:

ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি প্রমাণ করে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। চুক্তির মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি লাভের যে দাবি করা হয়েছিল, তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। কারণ পারমাণবিক প্রজুক্তি সরবরাহকারী গোষ্ঠী (NSG) নতুন নির্দেশিকা জারি ক’রে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও সমৃদ্ধকরণ প্রযুক্তি ভারতকে দিতে অস্বীকার করে। ফল হিসাবে ভারত শুধু ব্যয়বহুল পরমাণু চুল্লি ও জ্বালানি কিনতে পারে, কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির সহায়তা পায় নি।

ইউপিএ সরকার মার্কিন সংস্থাগুলোর দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছিল, যা ভারতের নাগরিকদের নিরাপত্তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছিল। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়। অপ্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তির ব্যয়বহুল ফরাসি চুল্লি জয়তাপুরে বসানোর পরিকল্পনা তার একটি উদাহরণ।

কুডানকুলামের রাশিয়ান চুল্লি নিয়ে স্থানীয়দের উদ্বেগকেও গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। পার্টি দাবি করে, যাতে সব পরমাণু প্রকল্প স্থগিত রেখে স্বাধীন নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা হয় এবং সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসিত পরমাণু নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করা হয়।

নারীসুরক্ষা:

ইউপিএ সরকার নারী অধিকার প্রশ্নে দ্বিচারিতা প্রদর্শন করে। লোকসভায় নারী সংরক্ষণ বিল পাস করতে ব্যর্থ হয়। লিঙ্গ অসমতার কারণে ২০১১ সালে বিশ্বসূচকে ভারতের অবনতি ঘটে, এবং কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রবণতা বাড়তে থাকে। এমজিএনরেগায় নারীদের অংশগ্রহণ মূলত দারিদ্র্যের প্রতিফলন দর্শায়। চুক্তিভিত্তিক ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে সরকার নিজেই অঙ্গনওয়াড়ি, আশা কর্মীদের শোষণ করে। ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ সুদের কারণে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীদের প্রতি হিংসা, সাইবার অপরাধ ও সম্মান হত্যার বিরুদ্ধে কার্যকর আইন প্রণয়নে সরকার ব্যর্থ হয়। পার্টি কংগ্রেসে নারী আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গণমাধ্যম:

ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) নিম্ন অবস্থান, শিক্ষায় সরকারি ব্যয় সংকোচ এবং নারী নিরক্ষরতার উচ্চ হার দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করতে থাকে। শিক্ষার অধিকার আইন প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে সরকারের নীতি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ঘটে। উচ্চশিক্ষায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রবেশ এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য শিক্ষাকে মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবসায় পরিণত করে। শিক্ষায় সংরক্ষণ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কার্যকর হয়নি।বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ব্যাপক আকার নেয়।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় জিডিপি’র মাত্র ১.২% তে দাঁড়ায়। ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মানুষ বেসরকারি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সরকারি স্বাস্থ্য বিমাগুলি অপ্রতুল হয়ে পড়ে এবং কর্পোরেট হাসপাতালগুলিকে সুবিধা করে দেওয়া হয়। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হলে দরিদ্র মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। বড় ওষুধ কোম্পানিগুলি অনৈতিকভাবে ভারতের মানুষদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালায়।

গণমাধ্যম কর্পোরেট মালিকানাধীন হয়ে পড়ে এবং মুনাফার জন্য বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করে। বিদেশি বিনিয়োগের ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থাগুলির প্রভাব বেড়ে যায়। কর্পোরেট ও সরকারের হাত থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ে। সিপিআই(এম) শিক্ষার সার্বজনীন অধিকার, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন ও গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে।

বামশক্তির ভূমিকা ও আগামীর কাজ:

ভারতে বাম দলগুলির ঐক্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান, বিশেষত ইউপিএ-১ সরকারের সময় এটি আরও জোরদার হয়। যদিও কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থেকে যায়, যেমন তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন। তবে জাতীয় স্তরে বাম দলগুলির যৌথ অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর বাম ঐক্য রক্ষা করা জরুরি ছিল, কারণ একমাত্র বাম দলগুলিই নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়। এছাড়া, বামপন্থী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের একত্রিত করা প্রয়োজন বলে পার্টি মনে করে।

বাম ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি সংস্কার, জাতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, কর্পোরেট আধিপত্য প্রতিরোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা সংরক্ষণ, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষার ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার, পরিবেশ রক্ষা এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিশ্চিত করার দাবি তোলা হয় পার্টি কংগ্রেসে। উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি রোধ এবং নির্বাচন সংস্কারও জরুরি বলে পার্টি মনে করে।

নয়াউদারবাদী নীতির ফলে কৃষক, শ্রমিক, স্বল্প বেতনভোগী কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের জীবনমানের অবনতি ঘটে। এই নীতির বিরুদ্ধে স্থানীয়, প্রাদেশিক ও জাতীয় স্তরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বিশেষত আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়। একইসঙ্গে সংখ্যালঘু চরমপন্থাও রুখতে সতর্কতা বজায় রাখার কথা বলা হয়।

ভারত-মার্কিন কৌশলগত জোট ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে দুর্বল করে ফেলে, যা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন ছিল। দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও নারীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম বাম আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে পরিগণিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রতিহত করে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।

সিপিআই(এম) নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে জনগণের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানায়।

সম্মেলন শেষে:

পার্টি কংগ্রেসে উঠে আসে কিভাবে পার্টির স্বাধীন ভূমিকা ও কর্মসূচী জোরদার করা যায়। নয়াউদারবাদী নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যায়। কংগ্রেস ও ইউপিএ সরকারকে পরাজিত করতে এবং বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করতে একটি বাম ও গণতান্ত্রিক বিকল্প গঠনের আহ্বান জানানো হয়।

পার্টি কংগ্রেসে “আদর্শগত বিষয় সম্পর্কিত প্রস্তাব” নিয়ে আলোচনা হয়। সমাজতন্ত্রের পথে রূপান্তরের ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের ও শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা স্থির হয়।

পার্টির গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় স্তরের সম্পাদকদের পদের মেয়াদ ৩ বারে সীমিত করা হয়।
নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৮৯ জন সদস্য নির্বাচিত হন (যার মধ্যে দুটি পদ খালি রাখা হয়) এবং কমরেড প্রকাশ কারাত সর্বসম্মতভাবে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন। নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ১৫ সদস্যের পলিট ব্যুরো নির্বাচিত করে।


২১তম পার্টি কংগ্রেস
১৪ থেকে ১৯ এপ্রিল ২০১৫,বিশাখাপত্তনম

প্রেক্ষাপট:

দেশে ২০ তম পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে যায়। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে ইউপিএ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। বিজেপি’র আগমন ভারতের রাজনীতিতে ডানপন্থী প্রবণতার আরও দৃঢ় করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহই ছিল না। এই সরকার স্বাভাবিকভাবেই নয়াউদারবাদী নীতি, হিন্দুত্ববাদী আদর্শ এবং সাম্রাজ্যবাদ-পন্থী অবস্থানের সমন্বয়ে পরিচালিত।

বিজেপির প্রভাব ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়— বড় কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে নগ্নভাবে পক্ষপাতদুষ্ট নীতিগুলি তারা বাস্তবায়িত করতে শুরু করে। সামাজিক বৈষম্য আরও গভীর হতে থাকে এবং শ্রমজীবী মানুষের উপর শোষণ আরও তীব্র হয়।

এর সাথে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির আগ্রাসন যুক্ত হয়ে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষে শ্রেণীশক্তির ভারসাম্য বদলের লক্ষ্যে নতুন, গুরুতর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে শুরু করে।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

২০ তম পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে। ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকটের পরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক হস্তক্ষেপ এবং বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চায়, যার ফলে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে বিপর্যয় নেমে আসে, উগ্রপন্থা বাড়তে থাকে। ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে পড়ে।

একদিকে এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন কৌশলগত তৎপরতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার হয়, BRICS দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়তে শুরু করে এবং লাতিন আমেরিকায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে বহুমেরুকরণ মজবুত হয়। ইউরোপে কঠোর আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ দৃঢ় হয়। নতুন বামপন্থী আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ভেনেজুয়েলায় সাম্রাজ্যবাদী নীতির সামনে নতিস্বীকার না করে বামপন্থী সরকার বিকল্পনীতির পক্ষে লড়াই চালাতে সক্ষম হয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চলতে থাকা সংকট মূলত ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সংকট। ২০০৭-০৮ সালের সংকট থেকে বের হতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে ব্যাংক ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা পায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া নতুন সংকট তৈরি করে। ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার খর্ব হতে থাকে, যা ভবিষ্যৎ সংকটের ভিত্তি তৈরি করে।

বিশ্বব্যাপী শিল্পোৎপাদন নিম্নমুখী হয়ে পড়ে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। ধনী-গরিবের বৈষম্য চরমে পৌঁছায়। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির হার উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় বহুলাংশে কম। ফলে, ভবিষ্যতে বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৃদ্ধি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য রক্ষার প্রচেষ্টা ও বৈশ্বিক পরিবর্তন

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে থাকে। ইরাকসহ পশ্চিম এশিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হয়। রাশিয়া ও চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে। যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমী মিত্রদের সঙ্গে ন্যাটো সম্প্রসারণ ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র “পিভট টু এশিয়া” নীতির মাধ্যমে চীনের উত্থান প্রতিরোধের চেষ্টা করে। বাণিজ্যিক আধিপত্য বজায় রাখতে TPP ও TTIP-এর মতো বাণিজ্য চুক্তি করা হয়। পাশাপাশি, জাপানের সামরিক শক্তি বাড়াতে এবং ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করে যুক্তরাষ্ট্র।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ফলে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর উত্থান ঘটে। ইয়েমেনে মার্কিন-সমর্থিত সৌদি হস্তক্ষেপ চলতে থাকে এবং প্যালেস্তাইনে ইসরায়েলের বর্বর হামলা অব্যাহত থাকে।

বিশ্বশক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়; ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO), CELAC ও AIIB-এর মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলো বিকশিত হতে শুরু করে।

একই সঙ্গে, উগ্র ডানপন্থী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর উত্থান ঘটে। আইএস, বোকো হারাম, তালিবান, মায়ানমারে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী ও ইউরোপে নয়া নাৎসিবাদের উত্থান বিশ্বের স্থিতিশীলতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

জাতীয় পরিস্থিতি

ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও দক্ষিণপন্থী আক্রমণ

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রথমবার সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যদিও তারা মাত্র ৩১% ভোট পেয়েছিল। ফলস্বরূপ হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-নেতৃত্বাধীন বিজেপি, সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা ও উদারনৈতিক অর্থনীতি সংস্কারের পথে পরিচালিত হয়।

কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকার দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের কারণে ব্যাপক জনঅসন্তোষের মুখে পড়ে। বিজেপি ও কর্পোরেট মিডিয়ার সমর্থনে নরেন্দ্র মোদিকে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। নির্বাচনের আগে সংঘ পরিবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়ে মেরুকরণ সৃষ্টি করে, বিশেষত উত্তর প্রদেশে।

বিজেপি সরকার কর্পোরেট স্বার্থে কাজ করছে—বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম আইন ও ভূমি অধিগ্রহণ আইন শিথিলকরণসহ বেসরকারিকরণ ত্বরান্বিত হয়েছে। একইসঙ্গে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা জোরদার হচ্ছে, যা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।
সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে, শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু ও নারীরা সবচেয়ে বেশি শোষিত হচ্ছে। নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর ঐক্যবদ্ধ লড়াই তীব্র হয়, যার চূড়ান্ত রূপ ছিল ২০১৩ সালের ঐতিহাসিক দু’দিনের সাধারণ ধর্মঘট। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ওপর তৃণমূলের দমনপীড়ন চললেও, সিপিআই(এম) ও বামশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

নয়াউদারবাদী নীতির ফলে ভারতের অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ে। ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ সালে জিডিপি বৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে যায়। ফলে শিল্পক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্মাণ ও পরিসেবাক্ষেত্রেও মন্দা দেখা দেয়। বিশেষত উৎপাদন শিল্প প্রায় ৪০ মাস ধরে বৃদ্ধিহীন অবস্থায় থাকে।

ইউপিএ সরকার কর্পোরেট ও বিদেশি বিনিয়োগকে সুবিধা দিতে নানা সংস্কার চালু করে, যেমন বহুজাতিক সংস্থার খুচরো বাণিজ্যে ৫১% এফডিআই অনুমোদন, পেনশন ফান্ডে বিদেশি বিনিয়োগ, ওষুধ মূল্যে নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ ইত্যাদি। বিজেপি সরকারও একই পথ অনুসরণ করে। রেল, প্রতিরক্ষা ও বীমা ক্ষেত্রে এফডিআই বাড়ায় এবং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হ্রাস করে। জাতীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে, যা পরিবেশ ও আদিবাসীদের অধিকার বিপন্ন করেছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ২০১৪-১৫ সালে ৮.৬৩% হারে বৃদ্ধি পায়, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্য ৫৫% কমলেও, মোদি সরকার কর বসিয়ে তেলের দাম কমতে দেয়নি।

বেকারত্ব বাড়ে, বিশেষত ১৫-২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ১৩.৩% বেকারত্ব দেখা যায়। চাকরির সুযোগ কমে যাওয়ায় কম বেতনের অনিশ্চিত চাকরির সংখ্যা বেড়ে চলে।

কৃষিক্ষেত্রে সংকট আরও গভীর হয়। চাষীদের আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও ফসলের দাম স্থির বা নিম্নমুখী হতে থাকে। সরকার সরকারি কৃষিজাত পণ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা বাতিল করতে তৎপর হয়। ফলে বহুজাতিক কর্পোরেটদের সুবিধা হয়ে যায়। কৃষিঋণ মূলত বড় কর্পোরেট ও ধনী কৃষকদের দিকেই ঝুঁকে যায়। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা মহাজনের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয়।

মোদি সরকার জমি অধিগ্রহণ আইনে সংশোধন এনে কৃষকদের সম্মতি ছাড়াই জমি দখলের সুবিধা দেয়, যা কৃষকদের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করে। সামগ্রিকভাবে, কর্পোরেটদের স্বার্থে জনসাধারণের ওপর আরও বোঝা চাপানো হয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্রতর হতে থাকে।

হিন্দুত্ব প্রকল্প: ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি

বিজেপির লোকসভা নির্বাচনে জয়ের আগে সংঘপরিবারের বিভিন্ন সংগঠন পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক প্রচার চালায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সৃষ্টি করা হয়। ২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা বৃদ্ধি পায়, বিশেষত মুজাফফরনগর দাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। বিজেপি সরকার গঠনের পরও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা অব্যাহত থাকে।

বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আরএসএসের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিক্ষা ক্ষেত্রকে বিশেষ লক্ষ্যে পরিণত করা হয়; পাঠ্যক্রম পরিবর্তন, ইতিহাস পুনর্লিখন, সংস্কৃতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিজ্ঞানমনস্ক চেতনার পরিবর্তে কুসংস্কারকে উৎসাহিত করা শুরু হয়।

হিন্দুত্ব প্রকল্পের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জোরদার হয়। নাথুরাম গডসের প্রশংসা, ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা, অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবি ইত্যাদি এর কিছু অংশ মাত্র। বিজেপি জাতপাতের বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে চায় ও নারীদের অধীকার খর্ব করতে প্ররোচনামূলক প্রচার চালাতে শুরু করে। সরকার আরএসএসকে অর্থ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তা দেওয়া শুরু করে। বিশেষত দলিত ও আদিবাসীদের হিন্দুত্বের প্রতি আশক্ত করতে উদ্যোগী হয়।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে, নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে প্রয়াস গ্রহণের কথা বলা হয় পার্টি কংগ্রেসে। বিজেপির আর্থ-সামাজিক নীতির ফলে শ্রমজীবী মানুষের ওপর যে বোঝা চাপানো চলতে থাকে, তা তুলে ধরে গণআন্দোলন গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মৌলবাদী প্রবণতাকেও প্রতিহত করার প্রস্তাব আসে, কারণ তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরও শক্তিশালী করে।

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য রাজনৈতিক, আদর্শগত, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও কর্মসূচী নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করে প্রচার চালানোর কথা বলা হয়। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ প্রচারের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দলিত ও আদিবাসীদের মধ্যে সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আরএসএসের প্রভাব প্রতিহত করার কথা উল্লেখ করা হয়।

গণসংগ্রাম ও গণআন্দোলন

সিপিআই(এম) ও বাম দলসমূহ খাদ্য নিরাপত্তার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করে। ২০১২ সালের জুলাই-আগস্টে দিল্লিতে পাঁচ দিনের ধরনা, সেপ্টেম্বরে গণঅবরোধ এবং সর্বজনীন গণবণ্টন ব্যবস্থা চালুর দাবিতে ৩.৫ কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। এফডিআই ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সংগঠিত করা হয়। ২০১৩ সালে সংগঠিত ‘সংগ্রাম বার্তা যাত্রা’ ১১,০০০ কিলোমিটার জুড়ে প্রচার চালিয়ে জনসমাবেশের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
আগামী দিনে গণআন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, আদিবাসী ও দলিতদের মধ্যে আন্দোলনের প্রসার ঘটিয়ে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির স্বাধীন ভিত্তি সুদৃঢ় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
শ্রমিক আন্দোলন
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে ঐতিহাসিক দুই দিনের ধর্মঘট সংঘটিত হয়। শ্রম আইন সংকোচন, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার কথা উঠে আসে। নতুন শিল্প ও পরিসেবা খাতে সংগঠন বিস্তার করা এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক, বিশেষত মহিলাদের সংগঠিত করার উপর জোর দেওয়া হয়। শ্রমিক এলাকাগুলোতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়া হয়।

কৃষক আন্দোলন

কৃষক ও গ্রামীণ দরিদ্রদের স্বার্থ রক্ষায় ভূমি সংস্কার, বনাধিকার, ভূমিহীন কৃষকের অধিকার, কর্পোরেটের কৃষিজমি দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কৃষিজ পণ্যের ন্যায্য মূল্য ও কৃষি ঋণের প্রসার নিয়ে আন্দোলন জারি রাখার কথা উঠে আসে। নয়া উদারবাদী নীতির প্রভাব মোকাবিলায় একজোট হয়ে সংগ্রামের পথে হাঁটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

কৃষি শ্রমিক আন্দোলন

কৃষি শ্রমিকদের মজুরি, মনরেগা, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, বাসস্থানের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার উপর পার্টি জোর দেয়। জাতিগত বৈষম্য ও নারীদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসে।

নারী আন্দোলন

নারীদের ওপর হিংসা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর নারীবিরোধী মতাদর্শের মোকাবিলা প্রয়োজন। নয়া উদারনৈতিক নীতির মাধ্যমে নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় আরও আন্দোলন গড়ে তুলতে পার্টি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যুবতী নারীদের মধ্যে সচেতনতা ও আন্দোলন বাড়ানোর কথা বলা হয়। এছাড়া আইনসভায় ৩৩% নারীর সংরক্ষণের দাবিও জোরদার করতে বলা হয়।

যুব আন্দোলন

বেকারত্ব, কর্মসংস্থানের অভাব, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক সুযোগের অভাব মোকাবিলা করতে যুব সমাজকে সংগঠিত করার কথা বলা হয়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব যুব সংগঠণের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়।

ছাত্র আন্দোলন

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনকে জোরদার করতে বলা হয়। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ও শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হতে বলা হয়। বিশেষত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র আন্দোলন বিস্তৃত করা দরকার একথা পার্টি উল্লেখ করে।
এই গণসংগ্রাম ও গণআন্দোলনগুলোর মাধ্যমে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির ভিত্তি আরও মজবুত করে সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে প্রয়াসী হতে বলা হয়।

রাজনৈতিক লাইন ও বামপন্থী আন্দোলন

সিপিআই(এম)-এর প্রধান রাজনৈতিক লাইন হল বিজেপি এবং মোদি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা। বিজেপি-আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক ও অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তোলার পাশাপাশি, নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করা। তবে, কংগ্রেসেরও বিরোধিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি আসে, কারণ পার্টি মনে করে তাদের দুর্নীতি ও জনবিরোধী নীতিই বিজেপিকে শক্তিশালী করেছে।

বাম ঐক্য ও আন্দোলন

সাম্প্রতিক সময়ে বাম ঐক্যকে বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে ১৭টি বাম দল একসঙ্গে কাজ করে, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে ১১টি বাম দল যৌথ আন্দোলন গড়ে তোলে। মহারাষ্ট্রে কৃষক ও শ্রমিক পার্টি পুনরায় সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই ঐক্যকে আরও সুসংগঠিত করার প্রয়াস নেয় পার্টি।

বাম ঘাঁটি ও চ্যালেঞ্জ

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের দমন-পীড়ন ও হিংসার বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) গণসংগ্রাম চালায়। কেরালায় এলডিএফ সরকারের সাফল্য ধরে রাখতে, এবং ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকারের শক্তি আরও সংহত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় পার্টি।

দলকে শক্তিশালীকরণ ও সম্প্রসারণ

স্বাধীন রাজনৈতিক উদ্যোগ ও শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে পার্টির শক্তি বাড়ানোর কথা বলা হয়। সাংগঠনিক দিক থেকে দলকে পুনর্গঠিত করতে তৎপরতা প্রয়োজন হয়। আদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম আরও সুসংহত করতেও পার্টি এগিয়ে চলার কথা বলে।

বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট

বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্টই বিজেপি ও কংগ্রেসের বিকল্প। শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, আদিবাসী, দলিত ও সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় একটি শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নেয় পার্টি।

বামশক্তির ভূমিকা ও আগামীর কাজ:

পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তীর কাজগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে নীচে দেওয়া হল।

১. ডানপন্থী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই
বিজেপি সরকারের নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের ওপর পড়া প্রতিটি আঘাতের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
২. হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার বিরোধিতা
বিজেপি-আরএসএস-এর সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চালাতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে একত্রিত করে সাম্প্রদায়িকতাবাদ মোকাবিলা করা হবে।
৩. সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত সম্পর্ক এবং শাসক শ্রেণির আপসের নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো হবে।
৪. সামাজিকভাবে নিপীড়িতদের অধিকার রক্ষা
দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। নারীদের ওপর বেড়ে চলা আক্রমণের বিরুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে।
৫. গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর লাগাতার আক্রমণের বিরুদ্ধে বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৬. পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় প্রচার চালাতে হবে। ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের শত্রুতা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে।
৭. দলের শক্তি ও সংগঠনের সম্প্রসারণ
স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একত্রিত আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষকদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে।
৮. বাম ঐক্যকে সুসংহতকরণ
বিভিন্ন শ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বামপন্থী গণতান্ত্রিক কর্মসূচির প্রচার করে বৃহত্তর বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

সম্মেলন শেষে:

সিপিআই(এম)-এর পার্টি কংগ্রেসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গৃহীত হয়— রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনের পর্যালোচনা এবং রাজনৈতিক প্রস্তাবনা।

রাজনৈতিক-কৌশলগত পর্যালোচনায় বামপন্থী শক্তিগুলির ঐক্য সুসংহত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়। এটি শুধুমাত্র নির্বাচনী কৌশলের মাধ্যমে সম্ভব নয়; বরং সিপিআই(এম)-এর স্বাধীন শক্তি ও হস্তক্ষেপের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।
কংগ্রেসের পর কলকাতায় সংগঠন প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সিপিআই(এম)-কে একটি বিপ্লবী দল হিসেবে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার ভিত্তি হবে গণসংগ্রাম।

২১তম কংগ্রেস ঘোষণা করে যে ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে তিনটি বড় হুমকির বিরুদ্ধে দল আপসহীনভাবে লড়াই চালাবে—
এই কংগ্রেসে ৯১-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়, যা ১৩-সদস্যের পলিট ব্যুরো গঠন করে। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।


তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

Spread the word

Leave a Reply