Party Congress History Part VI Cover

History of Party Congress (Part-VI)

সরিৎ মজুমদার

ষষ্ঠ কংগ্রেস

ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির শেষ কংগ্রেস

পঞ্চম কংগ্রেস এবং ষষ্ঠ কংগ্রেসের মধ্যে ঘটে যাওয়া সময়কাল ভারতে রাজনৈতিক এবং কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল।

অমৃতসর কংগ্রেসের পর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করা দুটি প্রধান ঘটনা ছিল কেরালায় সংঘটিত ঘটনা এবং ভারত-চীন সম্পর্কের অবনতি। কেরালার কমিউনিস্ট সরকার বরখাস্তের বিরুদ্ধে দল ঐক্যবদ্ধভাবে দেশব্যাপী প্রতিবাদ সংগঠিত করলেও, ভারত-চীন সম্পর্কের অবনতির ফলে পার্টির অভ্যন্তরে গুরুতর মতভেদ সৃষ্টি হয়।

কেরালার কমিউনিস্ট সরকারের বরখাস্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল পার্টির পরিচালিত সবচেয়ে বড় প্রচারাভিযান। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধের বিষয়টিকে কংগ্রেস পার্টি ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি কমিউনিস্ট পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য ব্যবহার করেছিল।

প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও কংগ্রেস পার্টির চালানো প্রবল প্রচারের পরেও, কমরেড ই. এম. এস. নাম্বুদিরিপাদের প্রতি জনগণের সমর্থন ব্যাপক ছিল এবং নির্বাচনী প্রচারের জন্য প্রত্যাশার চেয়েও বেশি অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। যদিও ১৯৬০ সালের কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে পার্টি পরাজিত হয়েছিল, তবে ভোটের শতাংশ প্রায় তিন পয়েন্ট বেড়েছিল।

এছাড়াও, পাঞ্জাবে “বেটারমেন্ট লেভি” সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তামিলনাড়ু, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ভূমির ঊর্দ্ধ সীমা ও ভূমি সংস্কার আইন সংশোধনের দাবিতে কৃষকদের সংগঠিত করা হয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্যে পদযাত্রা সংগঠিত করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সরকারের কাছ থেকে লক্ষাধিক একর জমি প্রকৃত চাষীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করাতে বাধ্য করেছিল।

পার্টি ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিল, যা দীর্ঘদিন পর শ্রমজীবী মানুষের সবচেয়ে বড় আন্দোলন ছিল। প্রথমবারের মতো সমস্ত সরকারি কর্মচারী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, যেখানে তারা মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মহার্ঘভাতা এবং ন্যূনতম জীবনযাত্রার মজুরির দাবিতে ধর্মঘটে যায়। প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল এবং রেল পরিষেবাও ব্যাহত হয়েছিল। কংগ্রেস সরকার কড়া দমন-পীড়ন চালায়— ২১,০০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয় এবং ৭ জন শ্রমিক নিহত হয়। পার্টি আত্মসমালোচনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করেছিল যে, জনগণের মধ্যে উপযুক্ত মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক প্রস্তুতির অভাবে শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল।এই তিন বছরেও বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল।

এই সংগ্রামের ফলে বিভিন্ন উপনির্বাচনে পার্টির ফলাফল ইতিবাচক ছিল। বিশেষ করে ভোপাল পৌর নির্বাচনে জয়লাভ উল্লেখযোগ্য ছিল, যেখানে সহযোগী দলগুলির সাথে মিলিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা হয়। একইভাবে, বোম্বে পৌর কর্পোরেশনেও পার্টি ১৮টি আসন জিতেছিল, যেখানে তারা সংযুক্ত মহারাষ্ট্র ফোরামের অংশ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। বোম্বেতে এই বিজয় পার্টির ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন— গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকার প্রতিফলন ছিল।

১৯৫৯ সালের মার্চ থেকে ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পার্টি ভারত-চীন সীমান্ত বিতর্ক নিয়ে দশটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয় যে, দালাই লামার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহ, যা চিয়াং কাই-শেক ও সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরিচালিত হয়েছিল, তা ভারত-চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি— যেমন হিন্দু মহাসভা, জনসঙ্ঘ, স্বতন্ত্র পার্টি এবং কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশ এই পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছিল এবং তা তাদের পশ্চাদপদ এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে ব্যবহার করেছিল।তারা বিদ্রোহীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার দাবি জানায়, যাতে তারা ভারতকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে এবং ‘তিব্বতের সরকার’ হিসেবে কাজ করার অনুমতি পায়। এসব শক্তি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিকে আক্রমণ করে এবং ভারত-চীন মধ্যে সম্পাদিত পঞ্চশীল চুক্তির বিরোধিতা করে। পার্টি উল্লেখ করে যে, এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং হিমালয় অঞ্চলে, যেখানে সীমান্ত স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল না, সেখানে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে।

পার্টি আশা প্রকাশ করে যে, সীমান্ত সংক্রান্ত সমস্ত বিতর্ক পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। এটি সতর্ক করে দেয় যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশকে তার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে এবং আফ্রো-এশীয় সংহতিকে দুর্বল করতে চাইছে। পার্টি আরও উল্লেখ করে যে, এই ঘটনাগুলি জনগণের দৃষ্টি তাদের জীবন ও জীবিকার সমস্যাগুলি থেকে সরিয়ে নেওয়া এবং দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ব্যাহত ও দমন করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। জনসঙ্ঘ ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি যখন ‘একটি নতুন পররাষ্ট্রনীতি, নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী’ দাবি করেছিল, তখন পার্টি এই দাবির বিরোধিতা করে এবং সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসনের আহ্বান জানায়। পার্টি নেহরু ও চৌ এনলাইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনাকে স্বাগত জানায়, যা দ্বন্দ্ব কমাতে সহায়তা করেছিল।

কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত ৮১টি কমিউনিস্ট পার্টির মস্কো সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে, যেখানে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি যৌথ বিবৃতি গৃহীত হয়। পার্টির প্রতিনিধিরা এই বিবৃতি প্রণয়ন এবং সম্মেলনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

এ পরিস্থিতিতেই ১৯৬১ সালের ৭-১৬ এপ্রিল বিজয়ওয়াড়ায় পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪৩৯ জন প্রতিনিধি এবং ১৭ জন পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণ করেন, যারা ১,৭৭,৫০১ সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। কংগ্রেসে উপস্থিত প্রতিনিধিদের মোট কারাদণ্ডের সময়কাল ছিল ১৪৯৪ বছর ১০ মাস ২৮ দিন, আর আত্মগোপনে থাকা সময়কাল ছিল ৯৯৮ বছর ৯ মাস। এটি পার্টির সংগ্রামী চরিত্র ও নেতৃত্বের প্রতিফলন ঘটায়।

পার্টির অভ্যন্তরে কর্মসূচিগত বিষয়, বর্তমান নীতিসমূহ এবং বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শ সংক্রান্ত প্রশ্নে গুরুতর মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। জাতীয় পরিষদ (ন্যাশনাল কাউন্সিল) দুটি কমিশন গঠন করে— একটি পার্টির কর্মসূচির খসড়া প্রস্তুতের জন্য এবং অন্যটি ষষ্ঠ কংগ্রেসে উপস্থাপনের জন্য রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য। তবে, এই দুটি কমিশন কোনো অভিন্ন মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে পার্টি কংগ্রেসে দুটি পৃথক কর্মসূচির খসড়া এবং দুটি পৃথক রাজনৈতিক প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।

পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ ষষ্ঠ কংগ্রেসে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে পার্টির ভেতরে বিরাজমান তীব্র মতপার্থক্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন- ‘এটি স্পষ্ট যে, আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে ভিন্নমত পোষণ করি:

(১) সদ্যস্বাধীন দেশগুলোর প্রেক্ষাপটে মস্কো বিবৃতির বক্তব্যগুলোর প্রকৃত অর্থ ও প্রয়োগ;

(২) আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি;

(৩) পার্টির সামনে অবিলম্বে করণীয় কাজ।

এই মতভেদ থাকার কারণে, আমাদের পক্ষে একটি অভিন্ন রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি।’

জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে রাজনৈতিক প্রস্তাব পার্টি কংগ্রেসের সামনে উপস্থাপন করেছিল, তা আপসমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ছিল। ফলে, ষষ্ঠ কংগ্রেসে পার্টি সবচেয়ে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হয়। তবে, রাজনৈতিক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এবং সাধারণ সম্পাদকের বক্তৃতাকে প্রস্তাব সংশোধনের ভিত্তি হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে বিভাজন এড়ানো সম্ভব হয়। কর্মসূচির খসড়াগুলি উপস্থাপনের পর তা স্থগিত রাখা হয় এবং পর্যালোচনার জন্য জাতীয় পরিষদের কাছে পাঠানো হয়।

কংগ্রেসে উপস্থাপিত সাংগঠনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, অমৃতসর কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজগুলোর বাস্তবায়নে ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, পার্টির শৃঙ্খলায় ব্যাপক শিথিলতা এসেছে, যা প্রধানত সংসদীয়-সাংবিধানিক পরিবেশের প্রসার এবং আংশিকভাবে যে কোনো স্তরের পার্টি ইউনিট এই বিপথগামী প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়া—এই দুটি কারণে ঘটেছে। প্রতিবেদনে ‘শুদ্ধিকরণ অভিযান’ (rectification campaign) পরিচালনার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়, যা শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, কথার ও কাজের ব্যবধান কমানো এবং সহযোদ্ধা সম্পর্ক (comradely relations) দৃঢ় করার জন্য জরুরি। এছাড়াও, সংগঠনের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি চলতে থাকা অবহেলার নিন্দা জানানো হয়।

সাংগঠনিক প্রতিবেদনে সংশোধনবাদী প্রবণতার ব্যাপক বিস্তার লক্ষ্য করে বলা হয়: ‘পার্টির শীর্ষ কমিটিগুলো ও ক্যাডারদের মধ্যে এমন একটি প্রবণতা গড়ে উঠেছে, যেখানে তারা জনগণের আস্থা অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বুর্জোয়া সংসদ ও সাংবিধানিক লড়াইয়ের কার্যকারিতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। জনগণের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ধীর কিন্তু নিশ্চিত বিকাশ ঘটবে এবং এর ফলে বামপন্থী দল ও শক্তিগুলোর একটি সংমিশ্রণের মাধ্যমে কংগ্রেস সরকারকে পর্যায়ক্রমে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে—এই ধারণাই পার্টির চিন্তা ও কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে গণসংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় কর্মকাণ্ডকে পার্টির প্রধান কার্যক্রম হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ, এটি পার্টির নেতা ও ক্যাডারদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ধীর পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা তাদের জীবন ও কাজের প্রতি প্রভাব ফেলেছে।’

প্রতিবেদনে আত্মসমালোচনামূলকভাবে স্বীকার করা হয় যে, পার্টি ১৯৫৭ সালের ১২টি পার্টির ঘোষণায় দেওয়া সতর্কবার্তাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ওই ঘোষণায় বলা হয়েছিল: ‘সংশোধনবাদীরা মার্কসবাদী বিপ্লবী চেতনাকে ধ্বংস করতে চায়, শ্রমিক শ্রেণি ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা দুর্বল করতে চায়। তারা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সময়ে সর্বহারা বিপ্লব ও সর্বহারা একনায়কত্বের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে। তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদী পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকাকে অস্বীকার করে, সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং লেনিনবাদী পার্টি সংগঠনের মৌলিক নীতি, বিশেষত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা (Democratic Centralism) পরিত্যাগ করার আহ্বান জানায়। তারা কমিউনিস্ট পার্টিকে একটি লড়াকু বিপ্লবী সংগঠন থেকে একটি বিতর্ক সংঘ (Debating Society)-তে রূপান্তরিত করতে চায়।’ প্রতিবেদনে পার্টি সংগঠনের ক্ষেত্রে সংশোধনবাদ মোকাবিলার জন্য পার্টি কংগ্রেসকে একটি ‘জোরালো আহ্বান’ জানানোর বার্তা দেওয়া হয়।

সাংগঠনিক প্রতিবেদনে তিন স্তরের কমিটি কাঠামো বজায় রাখা এবং নির্বাচনে পাওয়া ভোটের আনুপাতিক হারে পার্টির সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানানো হয়।তবে, এই সুপারিশগুলো সংশোধনবাদী প্রবণতার প্রতিফলন, যা মূলত দূর করার লক্ষ্য নিয়েই পার্টি চেষ্টা করছিল। এটি পার্টির গণআন্দোলনের বদলে সংসদীয় কার্যক্রমের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতারই ইঙ্গিত দেয়।

এই কংগ্রেস ছিল একটি আপসের কংগ্রেস। পার্টির আদর্শগত ও রাজনৈতিক মতবিরোধগুলি অমীমাংসিত থেকে যায়। শুধুমাত্র ১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য একটি সামগ্রিক কৌশল নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস থেকে কমরেড অজয় ঘোষকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পার্টি কংগ্রেসে ১০৯ সদস্যের জাতীয় পরিষদ এবং ৫ সদস্যের সম্পাদকমন্ডলী গঠিত হয়।

Jyoti Basu, Bhupesh Gupta & EMS Namboodiripad

তেনালী কনভেনশন

১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এম বাসবপুন্নাইয়া, পি সুন্দরাইয়া, এ কে গোপালন, পি রামমূর্তি সহ ১৭ জন পার্টির নেতৃত্ব ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে পার্টির বিভাজনের সম্ভাবনা কীভাবে প্রতিহত করা যায় সেই বিষয়ে এক প্রচার পত্র প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের গোড়ার দিকে সেই সময়কালের তাত্ত্বিক বিতর্ক সম্পর্কে “এ কন্ট্রিবিউশন টু আইডিওলজিক্যাল ডিবেট” যুক্তভাবে পেশ করেছিলেন কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, জগজিৎ সিং লায়েলপুরি,পি রামমূর্তি, এম আর ভেঙ্কটরামন, জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার ও নিরঞ্জন সেন। সংশোধনবাদী ভাবধারার বিরোধিতা করেই ঐ বিবৃতি পেশ করা হয়েছিল এবং তা প্রচার করা হয়েছিল।

১৯৬৪ সালের ১১ই এপ্রিল পার্টির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সভা থেকে ডাঙ্গের নেতৃত্বে পার্টির ঐক্য বিরোধী ও কমিউনিস্ট নীতি বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে ৩২ জন সদস্য কাউন্সিল সভা থেকে বেরিয়ে যান এবং ১৯৬৪ সালের ১৪ই এপ্রিল একটি যুক্ত বিবৃতি প্রচার করে পার্টির মধ্যে ঐক্য রক্ষা করার জন্য সকল পার্টি সদস্যদের কাছে আবেদন জানান। ঐ আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন- পি সুন্দরাইয়া, এম বাসবপুন্নাইয়া, টি নাগি রেড্ডি, এম হনুমান্ত রাও, ভেঙ্কটেশ্বর রাও, এন প্রসাদ রাও, জি বাপানায়া, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এ কে গোপালন, এ ভি কনামভূ, সি এইচ কানারণ, ই কে নায়ানার, ভি এস অচ্যুতনন্দন, ই কে ইমবিচিবাবা, প্রমোদ দাশগুপ্ত, মুজফ্ফর আহমদ, জ্যোতি বসু, আব্দুল হালিম, হরেকৃষ্ণ কোঙার, সরোজ মুখার্জী, পি রামমূর্তি, এম আর ভেঙ্কটরামন, এন শঙ্করাইয়া, কে রমণি, হরকিষেণ সিং সুরজিৎ জগজিৎ সি লায়েলপুরি, ডি এস তাপিয়ালা, ডাঃ ভাগ সিং, শিউ কুমার মিশ্র, আর এন উপাধ্যায়, মোহন পনামিয়া এবং আর পি সরফ। ঐ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই পার্টির বিভাজন স্থির হয়ে যায়। ঐ কনভেনশনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের তত্ত্বগত বিতর্ক প্রসঙ্গে যুক্তভাবে বক্তব্য পেশ করেন জ্যোতি বসু ও নিরঞ্জন সেন। পার্টির খসড়া কর্মসূচী সম্পর্কে একটি ধারণা উপস্থিত করেন ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ।

পাশাপাশি ডাঙ্গের সংশোধনবাদী পার্টি কর্মসূচী সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন এম বাসবপুন্নাইয়া, পি রামমূর্তি এবং হরকিষেণ সিং সুরজিৎ। ঐক্যের ভিত্তিতে পার্টি গড়ে তোলার আন্তরিক আহ্বান প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ১৯৬৪ সালের ৭ থেকে ১১ই জুলাই অন্ধ্রপ্রদেশের তেনালীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পার্টির কনভেনশন। ঐ কনভেনশনে সারা দেশ থেকে প্রায় ১ লক্ষ পার্টি সদস্যের পক্ষে প্রায় ১৪৬ জন প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। ঐ কনভেনশন থেকে সিদ্ধান্ত হয় ১৯৬৪ সালের ২৪ থেকে ৩১শে অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হবে সপ্তম পার্টি কংগ্রেস। ঐ কনভেনশন থেকে পার্টি কংগ্রেসের আলোচ্যসূচী চুড়ান্ত করা হয়। আলোচ্যসূচীতে ছিল-

১) পার্টির কর্মসূচী গ্রহণ

২) পার্টির গঠনতন্ত্রের সংশোধনাবলী গ্রহণ

৩) বিজয়ওয়াড়া পার্টি কংগ্রেসের পরবর্তীকালের রাজনৈতিক সাংগঠনিক রিপোর্ট আলোচনা এবং বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রস্তাব গ্রহণ

৪) নতুন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্বাচন

৫) কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশন নির্বাচন।

ঐ সম্মেলন মঞ্চ থেকে দৃপ্ত কণ্ঠে আহ্বান জানানো হয়েছিল- আসুন আমরা শপথ নিই যে, আগামী দিনে কোন ঝড়ঝঞ্ঝাই আমাদের গতি রুদ্ধ করতে পারবে না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অমলিন আলোকবার্তা আগামী দিনে আমাদের যাত্রাপথকে আলোকিত করবে। সম্মেলনের ঐ আহ্বান দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন জানান প্রতিনিধিগণ। ঐ কনভেনশন থেকে এম বাসবপুন্নাইয়া সম্পাদকমন্ডলীর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন এবং একই সাথে ৪১ জনের কেন্দ্রীয় আয়োজক কমিটি নির্বাচিত হয়।

At 7th Party Congress

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-র সপ্তম কংগ্রেসের ঘোষণাপত্র

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-র সপ্তম কংগ্রেস ঘোষণা করছে যে, “এই কংগ্রেসে সমবেত প্রতিনিধিগণই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সত্যকার প্রতিনিধি। ডাঙ্গে গ্রুপের নিজেদের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বলবার কোন অধিকার নেই। এই সপ্তম কংগ্রেসে যোগদানকারী ৪২২ জন প্রতিনিধি সমগ্র দেশের মোট ১ লক্ষ ৪ হাজার ৪২১ জন পার্টি সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই প্রতিনিধিগণ পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের সময়কাল মোট সদস্য তালিকার শতকরা ৬০ ভাগ সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই কংগ্রেসের পূর্বে আঞ্চলিক, জেলা ও প্রাদেশিক পর্যায়ে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কংগ্রেসের পূর্বে স্ত্রুটিনি করে দেখা গেছে যে, ১৯টি রাজ্যের ১৫টিতে যেখানে পূর্বে পার্টির অস্তিত্ব ছিল এবং সক্রিয় ছিল, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি সদস্যরা জাতীয় পরিষদের ৩২ জন সভ্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন। কট্টরা সংশোধনবাদী ও শ্রেণী সহযোগিতাকামী এবং সংগঠনের ভিতর ঐক্যনাশক কার্যকলাপ প্রচলনকারী ডাঙ্গে-গ্রুপের নেতৃত্বে যে সভায় ৩২ জন সভ্য উত্তরকালে উক্ত ৩২ জনের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। এই কংগ্রেস এই বিষয়ে জ্ঞাত আছে যে, যে সকল পার্টি সদস্য আমাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি, তাঁদের বড় রকমের একটি অংশ নিজেদের ডাঙ্গে-গ্রুপের সদস্য তালিকাভুক্তও করেননি। এই কংগ্রেস এই বিষয়ে দৃঢ়মত পোষণ করে যে, যারা ডাঙ্গে-গ্রুপের সঙ্গে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত রয়েছেন তাঁদের মধ্যে পুনর্চিন্তা ঘটবে। ডাঙ্গে-গ্রুপ কর্তৃক বুর্জোয়া সংস্কারবাদী নীতিগুলি এবং সংগঠনের ভিতর ঐক্যনাশক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এই কংগ্রেসে তার প্রথম স্তরের পরিসমাপ্তি ফল। এই কংগ্রেস এই বিষয়ে দৃঢ়মত পোষণ করে যে, যে সকল পার্টি সদস্য আজও ডাঙ্গে-গ্রুপের সঙ্গে রয়েছেন কিংবা সংযোগহীন অবস্থায় রয়েছেন, তাঁদের বিপুল সংখ্যক সংগ্রামের দ্বিতীয় স্তরে, যা পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশা করা যায়, আমাদের সঙ্গে যোগদান করবেন। ডাঙ্গে-গ্রুপ কর্তৃক অনুসৃত সংস্কারবাদ ও ঐক্যনাশক নীতিসমূহের জন্য যে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে তা চূড়ান্তভাবে অতিক্রম করা যাচ্ছে। এই কংগ্রেস, পার্টি সদস্য ও সমর্থকদের বিপুল অংশ যাঁরা ৩২ জন জাতীয় পরিষদের সভ্যের আহ্বানে চমৎকারভাবে সাড়া দিয়েছেন, তাঁদের সপ্রশংস উল্লেখ করছে এবং তাঁদের নিকট এই আবেদন করছে যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিক প্রয়োগের ভিত্তিতে তাঁরা যেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কারণ ভারতের মেহনতী মানুষ এটাই আকুলতার সঙ্গে কামনা করেন। এই ঘোষণাপত্রটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় ৭ই নভেম্বর ১৯৬৪ তারিখে সপ্তম পার্টি কংগ্রেসের অধিবেশনে”।

১৯৬৫ সালে কেরালার বিধানসভা নির্বাচনে প্রতীক পাবার প্রয়োজনে পার্টির নামকরণ হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। এবং সেই সময় থেকেই পার্টির নির্বাচনী প্রতীক হয় তারা-হাতুড়ি-কাস্তে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র প্রতিষ্ঠা

১৯৬৪ সালের ৩১শে অক্টোবর থেকে ৭ই নভেম্বর কলকাতার ত্যাগরাজ হলে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম পার্টি কংগ্রেস। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১ দশকের বেশী সময়কাল ধরে চলতে থাকা মতাদর্শগত সংগ্রামের পরিণতিতে অনুষ্ঠিত সপ্তম পার্টি কংগ্রেস নতুন পার্টি কর্মসূচী ও আশু কর্তব্য সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সপ্তম পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা দাবি করেন, তাঁরাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করছেন। ঐ কংগ্রেস থেকেই গৃহিত হয় সংশোধবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শীর্ষক দলিল। ঐ দলিলটিই ছিল সপ্তম কংগ্রেসের গৃহীত রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপোর্ট। তাছাড়া গৃহীত হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির কাজ, পার্টির স্টেটমেন্ট অব পলিসি এবং পার্টির গঠনতন্ত্র। সপ্তম কংগ্রেস থেকে গৃহীত হয় ১৭টি প্রস্তাব। ঐ কংগ্রেসের ক্রিডেনশিয়াল কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, মোট ৪২২ জন প্রতিনিধি এবং ৬৩ জন দর্শক ঐ কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সপ্তম পার্টি কংগ্রেস শুরু ঠিক আগে পার্টি নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড় করে কংগ্রেসের সরকার। উদেশ্য ছিল পার্টি কংগ্রেস বানচাল করা ও নেতৃত্বের অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা। কিন্তু পার্টি কংগ্রেস বানচাল করতে না পেরে মাত্র ৬ সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৫০০ জনের বেশী পার্টি নেতাকে ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রচার করা হয় যে ঐ সমস্ত নেতারা চীনের দালাল, পাকিস্থানের এজেন্ট ইত্যাদি কুৎসামূলক প্রচার করার পর শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ভারত সরকার। ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে এই সমস্ত নেতারা মুক্তি পান।

এই কংগ্রেসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন পি সুন্দরাইয়া।

১৯৬৪ সালে সিপিআই(এম) গড়ে ওঠার সময়ের প্রথম পলিটব্যুরোতে নির্বাচিত হয়েছিলেন পি সুন্দরাইয়া, এ কে গোপালন, প্রমোদ দাশগুপ্ত, পি রামমূর্তি, এম বাসবপুন্নাইয়া, বি টি রণদিভে, জ্যোতি বসু, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ এবং হরকিষাণ সিং সুরজিত।

The first Polit Bureau of CPI(M)

আগের পর্ব

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

৪) Reminiscences of Lenin: Nadezhda Krupskaya

৫) Communists Challange Imperialism From The Dock, Muzaffar Ahmad

National Book Agency

৬) Adivasis Revolt: The Story of Warli Peasants in Struggle

Godavari Parulekar

Spread the word

Leave a Reply