Party Congress History Part IV Cover

History of Party Congress (Part-IV)

সরিৎ মজুমদার

দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রথম কংগ্রেসের পাঁচ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই পাঁচ বছর পার্টির জন্য কঠিন পরীক্ষা এবং সংগ্রামের সময় ছিল। অপবাদ, বিরোধিতা এবং নৃশংস দমন-পীড়নের মধ্যেও পার্টি ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

কংগ্রেসে ৬৩২ জন প্রতিনিধি অংশ নেন, যারা ভারতের বিভিন্ন সংগ্রামক্ষেত্র থেকে সরাসরি এসেছিলেন, যেখানে শ্রমজীবী জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছিল। তারা এসেছিলেন বোম্বে, কলকাতা, কানপুর, মাদুরাই এবং কোয়েম্বাটোরের শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রগুলো থেকে, যেখানে বিশাল ধর্মঘট সংঘটিত হচ্ছিল; বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র এবং মালাবারের কৃষক সংগ্রামের এলাকা থেকে; মহারাষ্ট্রের ওর্লি অঞ্চলের কৃষকদের সংগ্রামের ময়দান থেকে, যেখানে তারা সামন্তবাদ ও জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন; এবং রাজপুতানা, মধ্য ভারতসহ প্রধানত তেলেঙ্গানার রাজ্যগুলিতে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের সংগ্রামের ময়দান থেকে। এছাড়াও বোম্বে, কলকাতা এবং কানপুরের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কংগ্রেসে ১৫ জন মহিলা প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, যারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে সংগ্রাম করছিলেন।

এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি অসংখ্য গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং এর ফলে পার্টির শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পার্টির সদস্য সংখ্যা ৫০,০০০-এ পৌঁছে যায় এবং শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র আন্দোলনে সংগঠিত শক্তিও সমানভাবে বৃদ্ধি পায়।

যখন কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলার কাজে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল, তখন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপস করছিল এবং জনগণের সংগ্রামকে ধ্বংস করছিল। এই নীতির ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগ ঘটে। পার্টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে। দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময়, বিশেষত পাঞ্জাব ও বাংলায়, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য বিরল সাহসিকতার পরিচয় দেন। কলকাতা ও দিল্লিতে পার্টির নেতারা দাঙ্গাবিরোধী বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের সংগ্রামের নেতৃত্বের কারণে কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট পার্টির উপর দমনপীড়ন চালায়। হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীকে জেলে পাঠানো হয় এবং অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু এই দমন-পীড়নের মধ্যেও পার্টি বা জনগণ দমে যায়নি।

যদিও পার্টি জনগণের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তবুও নীতিগত দোদুল্যমানতা বজায় ছিল। পার্টি ভুল করে মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনাকে সাম্রাজ্যবাদের নতুন আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় এবং জাতীয় সরকারকে জাতীয় মুক্তির কৌশলগত হাতিয়ার বলে মনে করে। এর ফলে পার্টি ‘নেহরু সরকারকে পূর্ণ সমর্থন’ এবং ‘সরকার ও জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট’ গঠনের মতো স্লোগান তোলে, যখন সেই সরকার জনগণের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছিল।

১৯৪৬ সালের জুলাই-আগস্টে কেন্দ্রীয় কমিটি ‘বিপ্লবী জাগরণের অস্তিত্ব’ চিহ্নিত করে এবং ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্জন ও জনগণের ক্ষমতা দখলের জন্য আংশিক সংগ্রাম’ গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। রেলশ্রমিক ও বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকদের ধর্মঘট সংগঠিত করা এবং বাংলায় তেভাগা আন্দোলনসহ উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে কৃষকদের আন্দোলন তীব্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি পর্যালোচনা করে এবং নতুন নীতি গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল ‘বুর্জোয়া নেতৃত্বের সহযোগিতামূলক নীতির বিরুদ্ধে বিপ্লবী প্রতিরক্ষা, গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।’ এই সভায় জাতীয় সরকারকে ‘সহযোগিতা ও আত্মসমর্পণের সরকার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং শ্রমজীবী শ্রেণিকে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তুলতে বলা হয়, যাতে প্রকৃত ক্ষমতা শ্রমজীবী জনগণের হাতে যায়।

কংগ্রেসে তিনটি প্রধান রিপোর্ট উপস্থাপিত হয়-

১. খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবনা, যা বি টি রনদিভে উপস্থাপন করেন।

২. পাকিস্তান সংক্রান্ত প্রতিবেদন, যা ভবানী সেন উপস্থাপন করেন।

৩. পার্টির পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের নীতির আত্মসমালোচনামূলক পর্যালোচনা, যা বি টি রনদিভে উপস্থাপন করেন।

B T Ranadive

রনদিভে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের লাইন মূলত সঠিক ছিল। তবে আমাদের ভুল ছিল, কারণ আমরা মনে করেছিলাম ফ্যাসিবাদের সামরিক পরাজয়ের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্যবাদও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সমস্ত জাতি মুক্ত হবে।’

তিনি কৃষিনীতি ও উৎপাদন সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনে সংগঠিত করার সময় সামন্তবাদী জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শিথিল করেছিলাম। আমরা শ্রমিকদের ধর্মঘট এড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি যে, যতক্ষণ না উৎপাদন ব্যবস্থা লুটপাটকারী পুঁজিপতিদের হাত থেকে মুক্ত হচ্ছে, প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়।’

রিপোর্টে দুইটি সংশোধনবাদী বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়:

১. সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা হ্রাস পেয়েছিল।

২. বুর্জোয়া নেতৃত্বকে বিরোধিতা করার পরিবর্তে তাদের অনুসরণ করা শুরু হয়েছিল।

বি টি রনদিভে চার ঘণ্টার বক্তৃতা করেন। তিনি শুধু পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক যোশী র সমালোচনা করেননি, বরং সমস্ত কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের, এমনকি নিজের ভুলসমূহেরও স্বীকারোক্তি করেন। যোশীও তার ভুল স্বীকার করেন এবং প্রতিবেদন সমর্থন করেন। ৩৪ জন প্রতিনিধি এ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

এই কংগ্রেস পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, যা পাকিস্তানের বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে।

কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচনের জন্য প্রবল আলোচনা হয়। ভোটের মাধ্যমে ৩১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবিত প্যানেল থেকে শুধুমাত্র যোশী  বাদ পড়েন এবং বি টি রণদিভেকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

যদিও কংগ্রেস সঠিকভাবে পূর্ববর্তী সংশোধনবাদী বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করেছিল, তবে স্রেই ভ্রান্তি সংশোধনের ক্ষেত্রে আরেক বিচ্যুতি, বামপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থান গ্রহণ করে। পার্টি কংগ্রেস ভারতের নতুন রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্রকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। এটি গণআন্দোলনের শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে বিবেচনা করে এবং কংগ্রেসের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও দেশীয় রাজাদের একীভূত করার ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেছিল।

দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে, বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পার্টির অভ্যন্তরে গভীর মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন ও কমিউনিস্ট পার্টি

ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ১৯৫২ সালে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। সর্বভারতীয় সম্মেলন শেষ হওয়ার পর, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়েও কমিউনিস্ট পার্টি এই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু সামরিক বাহিনী ও পুলিশের দমনপীড়নের কারণে পার্টির শক্ত ঘাঁটিগুলিতে ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অধিকাংশ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রচার চালাতে পারেননি। হাজার হাজার পার্টি নেতা ও কর্মী কারাবন্দী ছিলেন, এবং কংগ্রেস সরকার তাদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করে। সরকার স্বীকার করেছিল যে, তাদের শাসনের প্রথম তিন বছরে তারা প্রায় ৫০,০০০ রাজনৈতিক বিরোধীকে কারারুদ্ধ করেছে এবং প্রায় ১৩,০০০ জনকে হত্যা বা আহত করেছে। এদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই পার্টি ১৯৫২ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী ইশতেহারে কংগ্রেসকে পরাজিত করার, জনগণের প্রার্থী নির্বাচনের এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এতে কংগ্রেস সরকারকে জমিদার ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সরকার বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিভ্রান্তিকর স্লোগানে প্রভাবিত না হওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়।

ইশতেহারে বলা হয়েছিল, জনগণের গণতান্ত্রিক সরকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করবে, ব্রিটিশ পুঁজিকে বাজেয়াপ্ত করে জাতীয়করণ করবে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তির প্রতিরোধ ধ্বংস করবে। এটি জমিদার ও রাজাদের জমি ও কৃষিযন্ত্র কৃষকদের হাতে স্থানান্তর করবে এবং কৃষকদের সমস্ত ঋণ বাতিল করবে। এছাড়া কৃষি শ্রমিকদের যথাযথ মজুরি প্রদান, শিল্পায়নের প্রসার, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সংগঠিত হওয়ার অধিকার, যৌথ দর কষাকষি ও ধর্মঘটের অধিকার স্বীকৃত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

গণতান্ত্রিক সরকার জাতিভিত্তিক নিপীড়ন ও অস্পৃশ্যতাকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করবে এবং জাতিগত বৈষম্যের অবসান ঘটাবে। এটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। নারীদের সমকাজে সমমজুরি প্রদান করা হবে। জনগণের সরকারে সকল স্তরের প্রতিনিধি সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং তাদের প্রত্যাহারের অধিকার থাকবে।

নির্বাচনের পর কমিউনিস্ট পার্টি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পার্টি লোকসভায় ১৬টি আসন জিতে প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসে। এটি অন্ধ্রপ্রদেশে প্রথম স্থান অধিকার করে, কেরালায় শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে, ত্রিপুরায় ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে এবং পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও পাঞ্জাবে উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পার্টির এই উত্থানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি আতঙ্কিত হয়। মার্কিন প্রশাসন মন্তব্য করে যে, ‘ভারত কমিউনিজম থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মরিয়া লড়াই করছে’ এবং একে ঠেকাতে ‘জরুরি ও কার্যকর পদক্ষেপ’ গ্রহণের জন্যও তারা আহ্বান জানায়।

পার্টি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখতে পায় যে, যেখানে তারা সাহসিকতার সাথে গণআন্দোলন পরিচালনা করেছে, সেখানে ভালো ফল করেছে। তবে নির্বাচনী সাফল্য সব জায়গায় সমান হয়নি। ফলাফল বিশ্লেষণে বোঝা যায় যে, কংগ্রেসের শাসনের বিরুদ্ধে একটি বৃহৎ ঐক্যবদ্ধ গণফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পার্টি স্বীকার করে যে, কিছু ভুল ও বিচ্যুতি ঘটেছে এবং এগুলো সংশোধনের জন্য কাজ চলছে।

নির্বাচনের পরপরই তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি শুরু হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ধারাবাহিক বৈঠকে অন্যান্য দলগুলোর সাথে সম্পর্ক, সংসদীয় ও সংসদ বহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। ডিসেম্বর ৩০, ১৯৫২ থেকে জানুয়ারি ১০, ১৯৫৩ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এক বর্ধিত অধিবেশনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের জন্য একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবনা প্রস্তুতের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় কমিটিকে দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক বিতর্কে স্তালিনের পরামর্শ

আজকের দিনে যেকোনো কমিউনিস্ট পার্টিকে জানা-বোঝার জন্য যেভাবে পার্টি কর্মসূচিকে ব্যবহার করা যায় তেমন কোনও সাধারণ বোঝাপড়া নির্ধারিত হতে আরও বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। ইতিহাস বলছে এহেন বোঝাপড়া চুড়ান্ত করার পথে পার্টির মধ্যে বহু মতামত, চিন্তা-ভাবনা একে অন্যের সাথে গুরুতর বিতর্কে জড়িয়েছিল।

সেই সকল বিতর্কের মূল কয়েকটি প্রশ্নে অনেক চেষ্টা করেও কমিউনিস্ট সুলভ ‘চিন্তার ঐক্য’ গড়ে উঠছিল না, ফলে ‘কাজের ঐক্য’-এ পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে উঠছিল। দেশের স্বাধীনতার পরেও সে বিতর্ক চলেছে। ইতিমধ্যে ভ্রান্ত লাইনের দায়ে সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশী’কে প্রথমে শো কজ করা হল, দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে তাকে সরেও যেতে হল। তেলেঙ্গানায় কৃষকদের সশস্ত্র লড়াইতে পার্টির ভূমিকাকে কেন্দ্র করে মূল বিতর্কগুলি সামনে আসে। দেশে বিপ্লব সমাধা করার জন্য সঠিক রণকৌশল কি হবে এধরণের আরও কয়েকটি বিষয়ও ছিল।

দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বি টি রণদিভে’কে বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করে সরে যেতে হয়। ইতিমধ্যে কমিনফর্মের তরফে প্রকাশিত পত্রিকা ফর আ লাস্টিং পিস, ফর আ পিপলস ডেমোক্র্যাসি’র সম্পাদকীয়তে উল্লিখিত হয় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক পথে চলছে না। এর পরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি রাজেশ্বর রাও’কে সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়। ততদিনে পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয়েছে, গ্রেপ্তার, ধর-পাকড় চলছে। দমন-নিপীড়নের সেই পরিস্থিতির মধ্যেই নিজেদের মধ্যেকার মতপার্থক্যের একান্ত জরুরী প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে তৎকালীন পার্টি নেতৃত্বের তরফে কয়েকজন গোপনে রাশিয়ায় পৌঁছলেন। এরা হলেন রাজেশ্বর রাও, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, অজয় ঘোষ ও এম বাসবপুন্নাইয়া।

ভারতের প্রতিনিধি দলের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বের আলোচনা হয়েছিল দুটি পর্যায়ে। প্রথম আলোচনায় সোভিয়েতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জি এম ম্যালেনকভ, এম এ সুসলভ, পি এফ ইয়ুদিন এবং ভি জি গ্রিগোরিয়ান- বৈঠকের তারিখ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১। পাঁচদিন পরে, ১৯৫১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি স্তালিনের সাথে আলোচনা হয়েছিল।

ভারতের প্রতিনিধিরা লিখিতভাবে স্তালিনের কাছে বিতর্কের মূল প্রশ্নগুলি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ভারতে বিপ্লবের চরিত্র কেমন হবে, সমাজতান্ত্রিক নাকি গণতান্ত্রিক?

ভারতীয় বিপ্লব কি চীনের পথ অনুসরণ করবে?

তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতাকে সারা দেশে সাধারণ রণকৌশল বিবেচনা করা কতদূর উচিত হবে?

এধরণের প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই প্রাথমিক জটিলতা ছিল। স্তালিন প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিলেন। তবে জিনোভিয়েভের নেতৃত্বে কমিন্টার্ন যেভাবে উত্তর দিত সেভাবে না, এখানেই ঐ আলোচনার গুরুত্ব ঐতিহাসিক। স্তালিন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁর উত্তর দেওয়ার ভিত্তি ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। দুনিয়ার একটি অংশে বিপ্লব সফল হয়েছে বলেই সেখানকার নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকে অন্যদের জন্য সাফল্য লাভের সাধারণ সুত্র হিসাবে বিবেচনা করা যে ভ্রান্ত তা তিনি স্পষ্ট করেছিলেন। সফল বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে নিজেদের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে যাচাই করে নিতে হয়- এই ছিল তাঁর পরামর্শ।

তিনি বলেছিলেন ভারতে বিপ্লবের প্রাথমিক স্তর অবশ্যই জনগণতান্ত্রিক (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রেভোলিউশন), আর তাই জমির প্রশ্নকে সবার আগে সমাধান করতে হবে, অর্থাৎ জমিদারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ। চীন সেই প্রাথমিক কর্তব্য সমাধা করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই চীনের এগোনোর পথ ও ভারতের পথ কিছুতেই এক হতে পারে না।

তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস

২৭ ডিসেম্বর ১৯৫৩ থেকে ৪ জানুয়ারি ১৯৫৪ পর্যন্ত মাদুরাইতে এই কংগ্রেস আয়োজিত হয়। এতে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং পার্টির কর্মসূচি ও নীতিপত্র অনুমোদিত হয়।

রাজনৈতিক প্রস্তাবনায় বলা হয়, কংগ্রেসের গণভিত্তি দুর্বল হলেও এটি এখনও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ও গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল, সেখানে সাম্প্রদায়িক দলগুলি শক্তিশালী হচ্ছে। সরকার তাদের সংকটের বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এই আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণির সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

পার্টিকে জাতিবিদ্বেষ, অস্পৃশ্যতা, এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম, চিকিৎসা সহায়তা এবং অন্যান্য সামাজিক পরিষেবা সংগঠিত করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে।

সাংগঠনিক প্রস্তাবে বলা হয়, পার্টির সম্প্রসারণের সাথে সংগঠনকেও শক্তিশালী করতে হবে। পার্টির সদস্যদের মধ্যবিত্ত স্তর থেকে আসার কারণে তারা আদর্শগতভাবে যথেষ্ট পরিপক্ক নয় এবং পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের অভাবে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চেতনা বিকাশ ঘটাতে পারছে না।

পার্টির অভ্যন্তরে ‘নেতা-অনুসারী’ প্রবণতার সমালোচনা করে বলা হয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কেবল উচ্চস্তরের কমিটিতে আলোচনা হয়, আর নিম্নস্তরের কমিটিগুলি শুধুমাত্র কার্যকরী দায়িত্ব পালন করে। এই কারণে ক্যাডারদের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

সংগঠনের পুনর্গঠনের জন্য ছয়টি মূল দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়:

১) নিয়মিত চাঁদা প্রদান;

২) ইউনিট সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ;

৩) পার্টির শৃঙ্খলা মেনে চলা ও দায়িত্ব পালন;

৪) পার্টির গোপনীয়তা রক্ষা করা;

৫) গণসংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন;

৬) কাজের প্রতিবেদন জমা দেওয়া।

পার্টি কংগ্রেস পর্যালোচনা করে দেখে যে, কংগ্রেসের সময় পার্টির সদস্যসংখ্যা ৫০,০০০ এবং প্রার্থী সদস্য সংখ্যা ২৫,০০০ ছিল। তবে, যথাযথ পার্টি কেন্দ্র না থাকায় আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারেনি।

এই কংগ্রেসে ৩৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ৯ সদস্যের পলিটব্যুরো নির্বাচিত হয়। কমরেড অজয় ঘোষ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।

আগের পর্ব

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

৪) Reminiscences of Lenin: Nadezhda Krupskaya

৫) Communists Challange Imperialism From The Dock, Muzaffar Ahmad

National Book Agency

৬) Adivasis Revolt: The Story of Warli Peasants in Struggle

Godavari Parulekar

Spread the word

Leave a Reply