24ThPartyCongress, Communism, CPIM, CPIMWB, DimitrovDoctrine, DuttBradleyThesis, Fascism, HIstoryofCPI, KanpurBolshevikConspiracyCase, MerrutConspiracyCase, Socialism

History of Party Congress (Part-III)

সৌভিক ঘোষ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পিপল’স ওয়ার

কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেস সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফ্রন্ট গঠন ও কমিউনিস্টদের ভূমিকা প্রসঙ্গে সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাইন গৃহীত হলে ভারতে ওয়ার্কাস অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি’র কাজে ভাটা আসে। ষষ্ঠ কংগ্রেসে গৃহীত লাইন অনুসারে এগোনোর সময় ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা ভারতের মতো দেশে কমিউনিস্ট পার্টিকে দুই ফ্রন্টের লড়াই চালাতে হয়েছিল। একদিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে জাতীয় বুর্জোয়াদের আন্দোলনের বাইরে রাখার লড়াই, আরেকদিকে শ্রেণীর ভিত্তিতে দেশের জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করতে আন্দোলন সংগঠিত করা। জাতীয় বুর্জোয়াদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইতে যুক্ত করার সুযোগ ছিল, দেশের মানুষের ব্যপক সমাবেশ গড়ে সাম্রজায়বাদবিরোধী ফ্রন্ট আরও মজবুত করারও সুযোগ ছিল। এমনটা করা গেলে ব্রিটিশ শাসন এদেশের মাটিতে অনেকটাই দুর্বল হতো। এমন রণকৌশলে শত্রুকে যত বেশি সম্ভব জনবিচ্ছিন্ন করা যায়, বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে জনসাধারণের বেশিরভাগকে একজোট করা যায়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সেদিকে মনোযোগী ছিল না এমন না,  আসলে চীনের সংগ্রামে কমিউনিস্টদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতাকেই ঔপনিবেশিক শাসনাধীন যেকোনো দেশের জন্য লড়াইয়ের সাধারণ নিয়ম হিসাবে দেখা হয়েছিল। চীন ও ভারতে বাস্তব পরিস্থিতির পার্থক্যকে এড়িয়ে সাধারণ রণকৌশল নেওয়ার ভ্রান্তি ঘটেছিল।

G Dimitrov Cover

ষষ্ঠ কংগ্রেসের পরে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে আগের ভ্রান্তি শুধরে নেওয়া হলেও, ভারতে কমিউনিস্টদের একাংশের মধ্যে অনেকদিন অবধি ঐ ভুল লাইনের প্রভাব ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বসে স্তালিনের সঙ্গে বৈঠকে ভারতের কমিউনিস্টরা সে কথা স্বীকারও করেছিলেন। স্তালিন তাদের মনে করিয়ে দেন ভারতে বিপ্লবের প্রাথমিক স্তর অবশ্যই জনগণতান্ত্রিক (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রেভোলিউশন), আর তাই জমির প্রশ্নকে সবার আগে সমাধান করতে হবে, অর্থাৎ জমিদারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ। চীন তখন ঐ প্রাথমিক কর্তব্য সমাধা করে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে, তাই চীনের এগোনোর পথ ও ভারতের পথ কিছুতেই এক হতে পারে না। কৃষিবিপ্লব থেকে শুরু করে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই অবধি প্রতিটি বিষয়ে স্তালিনের পরামর্শে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। ভারতে কমিউনিস্টরা যাবতীয় লড়াই একসাথে, এক ময়দানে লড়তে নেমেছিলেন। বিপ্লবের লক্ষ্যে এই মুহূর্তের কাজ ও পরের কাজের মধ্যে কোনও পার্থক্য রাখা হয়নি। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে ভারতে বিপ্লবের স্তর’কে সমাজতান্ত্রিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। স্তালিন এ ভ্রান্তি চিহ্নিত করে বলেন এভাবে লড়াই করলে প্রতিটি ময়দানে শত্রুশিবিরের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি একজোট হয়ে যাবে, তাতে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই করতে গিয়ে জাতীয় বুর্জোয়াদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা সঠিক না, কৃষিবিপ্লবের কাজ সমাধা করতে বড় চাষিদের (বৃহৎ জমির মালিক) নিশানা করা উচিত না, এতে শত্রু শিবিরে শক্তির যোগান দেওয়া হয়। লক্ষ্য হবে প্রতিটি নির্দিষ্ট লড়াইতে প্রধান শত্রুকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে ‘একা’ (আইসোলেট) করে দেওয়া, এই উদ্দেশ্যেই কমিউনিস্টরা ফ্রন্ট গড়ে লড়াই চালান। ফ্রন্ট মানে শুধু পার্টি না, শত্রুর মুখোমুখি জনসাধারণের সর্ববৃহৎ ঐক্য। প্রত্যেক নির্দিষ্ট সংগ্রামে মূল শত্রুকে চিহ্নিত করতে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে নিজেদের একজোট করার পাশাপাশি মিত্র, এমনকি দোলাচলে থাকা অংশকেও মিত্র হিসাবে টেনে আনতে হয়। এটাই সাফল্যের পূর্বশর্ত।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শেষ হওয়ার সময়েই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বদল ঘটে। দুনিয়াজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া শুরু, প্রবল শক্তি হিসাবে উপস্থিত হয় ফ্যাসিবাদ। ঐ অবস্থায় ভারত ছাড় আন্দোলন সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য জনমানসে বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে মিত্রশক্তির অংশ হিসাবে ঘোষণা করে দেয়, যুদ্ধের খরচ যোগাতে ভারতের অর্থনীতিতে ব্যপক চাপ নেমে আসে। খাদ্য মজুতে ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা দেয়। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন। তখনকার পরিস্থিতিতে তারা যুদ্ধের সুযোগকে ব্যবহার করেই ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইকে জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, দেশজুড়ে ব্যপক গ্রেপ্তারী চলে।

এর মাঝেই ১৯৪১ সালের জুন মাসে হিটলারের বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে।

বি টি রণদিভে সহ আরও কয়েকজন তখন দেওলি জেলে বন্দী। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এহেন বদলকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জনযুদ্ধের (পিপল’স ওয়ার) চেহারা নিয়েছে বলে তারা চিহ্নিত করেন। কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি তখনও আগেকার লাইনের পরিচালিত হচ্ছিল। সর্বহারা বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত, তাই ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে দুনিয়াজুড়ে সর্বহারা শ্রেণী নিজেদের সমবেত করবে- এই ছিল পিপল’স ওয়ার সংক্রান্ত বোঝাপড়ার মূল কথা। দেওলি জেলে বসেই বি টি রণদিভে’রা কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর উদ্দেশ্যে একটি দলীল লিখে পাঠান। ঐ দলীল ‘জেল ডক্যুমেন্ট’ হিসাবে পরিচিত। দলীলে উল্লেখ ছিল- সর্বহারা রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করে নাৎসিবাদ নিজেকে সর্বহারা শ্রেণীর পয়লা নম্বর শত্রুতে রূপান্তরিত করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা প্রত্যেক সর্বহারার জন্যই নাৎসিবাদ হল প্রধান শত্রু। তাই সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি হিসাবে ভারতের কমিউনিস্টরা এ যুদ্ধে অবশ্যই ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করবে। এ যুদ্ধকে জনযুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করবে। যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা চালাবে। ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিজিবি)-র পক্ষ থেকেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধের প্রসঙ্গে লাইন বদলের জন্য দলীল পাঠানো হয়। এই প্রেক্ষিতে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্টির পলিট ব্যুরো জনযুদ্ধের হাবান ঘোষণা করে এবং উল্লেখ করে ফ্যসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের বিজয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সহায়ক হবে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল ঘোষণা হয়।

ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনযুদ্ধের প্রসঙ্গে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন আহ্বান দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব সমর্থন করেননি। বামপন্থী জাতিয়াতাবাদীরাও বিরোধিতা জানান। কমিউনিস্টদের ঐ আহ্বানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা। ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর উদ্যোগে দেশের মধ্যে ১৯৪০ সাল থেকে স্বাধীনতার জন্য ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ চলছিল। সে দাবীকে মান্যতা না দিলেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস’কে পাঠায়। ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হলে মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন, পরিস্থিতি অদ্ভুত জটিল চেহারা নেয়। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পূর্ণ স্বরাজের দাবী প্রথম কমিউনিস্টরাই তোলেন, তখন মহাত্মা গান্ধী তাকে ’অবাস্তব দাবী’ বলে অগ্রাহ্য করেছিলেন। এইবার তিনি নিজে ইংরেজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন, কমিউনিস্টরা আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে প্রাসঙ্গিক ও জরুরী বিষয় বলে তুলে ধরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দিলে তাদের ব্রিটিশদের দালাল বলা হল। এ অবস্থায় পার্টির জনভিত্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অশোক মিত্র লিখেছেন- একদিকে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে জাতীয় মুক্তির উন্মাদনা যাকে অস্বীকার করা যায় না, আরেকদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত বলে জনযুদ্ধের যে আহ্বান তাও তো ভুল নয়, কিন্তু লোককে কিছুতেই সেকথা বোঝানো যায় না। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আবহে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বরা গ্রেপ্তার হলে কমিউনিস্ট পার্টি সে গ্রেপ্তারীর বিরোধিতা সহ তৎক্ষণাৎ তাদের মুক্তির দাবী জানায়। কিন্তু ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে জাতীয় পরিস্থিতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে মিলিয়ে এগোনোর বদলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী জনরোষের প্রভাবে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।   

পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের তৎকালীন অবস্থানের মূল্যায়ন করেছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামে জনযুদ্ধের আহ্বান সঠিক ছিল। কিন্তু স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েত লাল ফৌজের জয়ী হওয়ার পরে নাৎসিবাহিনীর একের পর এক পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পর লাল ফৌজের অগ্রসর হওয়ার মধ্যে দিয়েই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ভারসাম্য বদলাতে শুরু করে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি তখনও আগেকার অবস্থানেই আটকে থাকে। দ্রুত বদলাতে থাকা পরিস্থিতির সাথে নিজেদের রণকৌশলগত অবস্থান ও স্লোগানের পরিবর্তন না ঘটানোর ফলেই জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠা যায়নি।

দত্ত-ব্র্যাডলে থিসিস

এই থিসিস আসলে ভারতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের বোঝাপড়া সংক্রান্ত দলীল। রজনী পাম দত্ত এবং বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলে একসাথে লিখেছিলেন। দলীলে ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জাতীয়মুক্তির প্রশ্নকে কমিউনিস্টদের সাধারণ লক্ষ্যের সাথে একাত্ম করা হল। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সঠিক রণকৌশল নির্ধারণের প্রসঙ্গে দত্ত-ব্র্যাডলে থিসিস কার্যত সমস্যার সমাধান করেছিল। এর জোরে জাতীয় বুর্জোয়াদের একাংশ যারা সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী নয়, তাদেরকেও জাতীয় মুক্তির লড়াইতে মিত্র বলে চিহ্নিত করা হল। সিপিআই(এম)-র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেন সিং সুরজিৎ লিখেছেন- ‘To make the anti-imperialist front effective and broad based drawing in the overwhelming majority of the people, it calls for combining the struggles of the mass organisations of the workers, peasants and other such organisations and the Congress. While stating that a clear cut programme of complete independence has to be there, it criticises the tactics of “non-violence” as a dogma being at variance with ground realities. It also points out to the ideological struggle that has to be carried on simultaneously and for the consolidation of the unity of Left in the Congress, while at the same time not forgetting the leading role to be achieved by the Party in the struggle for the united front.

This document played a very important part in the working out of the strategy and tactics of the struggle for independence at that stage. The Communist Party working on the basis of this document came to the forefront of the national struggle, influencing it. The resolutions adopted at the subsequent Congress sessions vindicates this position. Many Congress committees came into the hands of the communists, contributing to radicalising the whole movement. This document had played a big role in giving a correct orientation to the Communist movement in India enabling it to radicalising the Congress led movement as well as in developing independent class organisations of the peasantry and other sections of the toiling masses.’

দত্ত-ব্র্যাডলে থিসিস’কে কেউ কেউ মোটা দাগের কনশিলিয়েশন কর্মসূচি বলে চিহ্নিত করেন। আসলে এই দলীল ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পথ প্রসঙ্গে কমিন্টার্নের ঐতিহাসিক বোঝাপড়াকেই তুলে ধরে। ভারতে বিপ্লবের রণকৌশল প্রসঙ্গে মানবেন্দ্রনাথ রায় কমিন্টার্নে, কংগ্রেসের অধিবেশনে লেনিনের সাথে বিতর্ক করেছিলেন। রায়ের মতামতে বেশ কিছু সংশোধন সহ সে বিতর্কের সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করেন লেনিন নিজে। পরবর্তীকালে রায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে বহিষ্কৃত হন, পার্টির সাথে তার যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। এদেশে পৌঁছেও লেনিনের সাথে তার ঐ বিতর্কের মাধ্যমে নির্ধারিত সিদ্ধান্তের বদলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথার আড়ালে তিনি নিজের মতামতকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিকের অ্যাফিলিয়েশন পায় মানবেন্দ্রনাথ রায় পর্বের অনেক পরে, ১৯৩৩ সালে। তার আগে অবধি ভারতে রণনীতি-রণকৌশল প্রসঙ্গে নির্ধারিত পার্টি কর্মসূচি বলতে সেরকম কিছুই ছিল না। তাসখন্দে রায়ের সাথে একযোগে অবনী মুখার্জিরা একটি খসড়া করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে কি লেখা রয়েছে এদেশে কারোর কাছে সেই খবর ছিল না। জোসেফ স্তালিন ব্যক্তিগতভাবে সেটির একটি কপি সংগ্রহে রেখেছিলেন, অনেক বছর পরে গবেষক দেবেন্দ্র কৌশিক সেই খসড়া কর্মসূচিটি আবিষ্কার করেন। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসাবে রজনী পাম দত্ত ও বেন ব্র্যাডলে ইতিহাস নির্ধারিত কর্তব্যই পালন করেছিলেন। অতীতের ঐতিহাসিক বিতর্কই নতুন পরিস্থিতিতে সমাধা হয়- সেটাই দত্ত-ব্র্যাডলে থিসিস।

Rajani Pum Dutta

সামজিক অধিকার আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি

আজকের ভারতে যেভাবে ধর্মীয় আস্থা, জাতিভেদ ও সামাজিক পরিচিতিকে হাতিয়ার করে জনসাধারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ ঢোকানো চলছে তার প্রভাবে দিশাহারা হয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করে বসেন এদেশে কমিউনিস্টরা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি বলেই এমনটা ঘটেছে। ইতিহাস সে কথা বলে না। 

বর্ণাশ্রম, সামাজিক পরিচিতিকে আশ্রয় করে এদেশে গরীব মেহনতি মানুষের অধিকারের আন্দোলনে কমিউনিস্টরা প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন। শ্রেণীসংগ্রামের পাশাপাশি ধর্মীয় ভেদাভেদ, জাতিবিদ্বেষ, বিবিধ সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইতে অংশগ্রহণ এমনকি নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন অনেকেই পরবর্তীকালে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

বোম্বে কটন মিলে ১৯২৮’র ঐতিহাসিক ধর্মঘট চলার সময় কমিউনিস্টরাই দাবী তুলেছিলেন যে দলিত শ্রমিকদেরও কাপড়ের মিলে কাজ করার অধিকার দিতে হবে। এমন দাবীর কারণ কি? কটন মিলে তাঁত চালানোর সময় ব্যবহৃত সুতোকে জিভে ভিজিয়ে শাটলে জড়াতে হত, আর তাই দলিতদের সে কাজ দেওয়া হত না। ঐ আন্দোলন দলিত শ্রমজীবীদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির মজবুত ভিত গড়ে দেয়। সেই ধারা বয়েই ডক্টর বি আর আম্বেদকরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আর বি মোরে ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। কল-কারখানায় নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে ধর্মঘট ও অন্যান্য আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলমান-দলিত’দের ঐক্যবদ্ধ লড়াই তাকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তিনি কঙ্কণী এলাকায় খেতমজুরদের আন্দোলন সংগঠিত করেন, একটা সময় তার গোটা পরিবারই পার্টির কাজে যুক্ত হয়। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশন চলার সময় তাদের ‘রেড ফ্যামিলি’ বলে উল্লেখ করা হয়।

স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন বি টি রণদিভে দলিত ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার হওয়া পরিবার থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের বইপত্র সহ বিভিন্ন জরুরী সামগ্রী জোগাড় করতে নিজের পরিবার ও বন্ধুদের থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতেন। একাজের জন্য তাকে উচ্চবর্ণের সহপাঠীরা পাথর ছুঁড়ে মারত। দলিত ও মহিলাদের উপরে চলা নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন। বর্ণাশ্রম’কে ধর্মের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হিসাবে বিবেচনা করেও মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’দের অধিকারের কথা বলতেন, এহেন দ্বিচারিতা প্রসঙ্গে ছোট থাকতেই রণদিভে’র অবস্থান স্পষ্ট ছিল।

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এ কে গোপালন এবং পি রামমুর্তির মতো এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বেরা প্রত্যেকেই সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, দলিত আদিবাসীদের সমানাধিকারের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন। ই এম এস নামুদিরিপাদ’কে এমন কাজের জন্য তার পরিবারের তরফে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়। ঐতিহাসিকভাবেই নাম্বুদিরি পরিবার ছিল গোঁড়া প্রকৃতির রক্ষণশীল, ই এম এস’কে ঘরে বাইরে লড়াই চালাতে হয়। এ কে গোপালন কেরালায় গোয়ারভায়ুর মন্দিরে দলিতদের প্রবেশের অধিকার দেওয়ার দাবীতে সত্যাগ্রহ করেন। উচ্চবর্ণের কর্তাব্যক্তিরা তার উপর শারীরিক আক্রমণ চালায়, পুলিশ তাকে  গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী রাখে। এই লড়াইয়ের সংবাদ দেশজুড়ে শোরগোল তুলে দেয়। বৈষ্ণব মন্দিরে দলিতদের প্রবেশের অধিকারের লড়াই চালানোর সময় পি রামমূর্তি দলিত মানুষদের পুজায় উচ্চারিত মন্ত্র শিখিয়ে দিতেন, ভক্তিমূলক সঙ্গীত শিক্ষা অবধি দিয়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় রামমূর্তি বেনারসে নওজওয়ান ভারত সভার কাজের সাথে পরিচিত হন। বৈষ্ণব মন্দিরের ট্রাস্টি নির্বাচনের সময় ২০০জন দলিতকে নির্বাচকমণ্ডলীর তালিকায় নথিভুক্ত করানোর সময় তিনি তাদের হাতে শঙ্খ ও চক্রের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। এ মামলা হাইকোর্ট অবধি পৌঁছায়, জজের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার কাজেও তিনি তাদের সহযোগিতা করেন। আদালতের রায় অনেকাংশেই দলিতদের দাবি’র পক্ষে যায়।  

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, এ কে গোপালন এবং পি রামমুর্তি সকলেই যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন তাঁর নাম পি সুন্দরাইয়া। অন্ধ্রপ্রদেশের এক রক্ষণশীল ও বনেদী পরিবারের সন্তান, পি সুন্দরাইয়া মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কলেজে পড়ার সময় রীতিমত একনিষ্ঠ গান্ধিবাদী হিসাবে সুপরিচিত হন। নিজস্ব নেটওয়ার্ক মারফৎ সুন্দরাইয়া সম্পর্কে ‘খোঁজ’ পান এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা আমীর হায়দার খান। তাঁরই প্রভাবে পি সুন্দরাইয়া কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন। আমরা  অনেকেই তাকে তেলেঙ্গানায় কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা হিসাবেই শুধু চিনি। মনে রাখা উচিত সুন্দরাইয়া ছিলেন এদেশে খেতমজুর আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক। সে কাজ করার সময়ই তিনি ‘সহপংক্তি ভোজন’ (বর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে সকলে একসাথে বসে আহার করা) শুরু করেন। সে সময় খেতমজুর’দের এক বিরাট অংশই ছিল দলিত। সমানাধিকারের দাবীতে আন্দোলনের পাশাপাশি দলিতদের জন্য ‘ফেয়ার প্রাইস শপ’ অবধি চালু করেছিলেন তিনি। পি সুন্দরাইয়া ও এম বাসবপুন্নাইয়া’র কাজের সুবাদে অন্ধ্রপ্রদেশের সাধারণ মানুষ কমিউনিস্ট পার্টিকে দলিতদের পার্টি বলে উল্লেখ করত।

আরও একজনের কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতেই হয়। তিনি মহারাষ্ট্রের প্রথম মহিলা ল-গ্র্যাজ্যুয়েট। বনেদী পরিবারের সন্তান গোদাবরী গোখলে কলেজে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন, পরবর্তীকালে শ্যামদাস পারুলেকর’কে বিবাহ করার সুবাদে তার পদবী হয় পারুলেকর। এদেশে আদিবাসী অধিকারের লড়াইয়ের ইতিহাসে কমিউনিস্ট নেত্রী হিসাবে গোদাবরী পারুলেকরের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ছোট থেকে এমন সমৃদ্ধির মধ্যে বড় হয়েছিলেন যাতে বাড়িতে থাকতে কোনোদিন জল গড়িয়ে খেতে হয়নি, সেই তিনিই মহারাষ্ট্রের ওয়রলি, দহানু, উম্বরগাঁও এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসববাসকারী আদিবাসী মানুষদের উপরে চলা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নির্মম, নৃশংস জমিদার শাসনের ভিত নড়িয়ে দেন, কার্যত উচ্ছেদ করেন। দিনের পর দিন আদিবাসী গ্রামে তাদের সঙ্গেই থেকেছেন, তারা যেটুকু যোগাড় করে আনে সেই খাবার খেয়েছেন। জমিদার শাসনে আদিবাসি শ্রমিক কাজের শেষে মজদুরি চাইতে এলে কয়লার ভাঁটিতে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হত, বেগার খাটাই ছিল দস্তুর। রাজী না হলে চাষের কাজে হালের একদিকে গবাদি পশু আরেকদিকে আদিবাসী পুরুষকে বেঁধে চাবুক মারতে মারতে মারতে কাজ করানো হত। আদিবাসী মহিলাদের যখন তখন ধর্ষণ করা চলত, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেই জমিদার বাড়িতে কাজ করতে যেতে হত। এসবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে গোদাবরীই ছিলেন নেতৃত্ব। এদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস মনে রাখার সময় এমন কীর্তি ভুলে যাওয়া উচিত না। সেই সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি যা করেছিলেন তা শুধু গোদাবরীর মহিলা পরিচয়ের জন্যই উল্লেখযোগ্য না, কমিউনিস্ট সংগঠক বলতে আসলে কি বোঝায় তা বুঝতে আজও অন্যতম উদাহরণ। তার লেখা স্মৃতিকথাটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের নতুন প্রজন্মের জন্য অবশ্যপাঠ্য বিবেচিত হওয়া উচিত।  

ভারতের মাটিতে একদিকে শ্রেণী আন্দোলন আরেকদিকে সামাজিক আন্দোলন পরিচালনায় কমিউনিস্ট পার্টির অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। সেই প্রভাবকে অকার্যকর করার লক্ষ্যেই নতুন পরিস্থিততে পরিচিতি সত্ত্বার আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের শ্রমজীবী জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে দুর্বল করার যেকোনো মতাদর্শ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি আগেও লড়াই করেছে এখনও করছে, করবে।

২০১২, পার্টির ২০তম কংগ্রেসের রাজনৈতিক দলীলে বলা হয়েছে-

‘ধর্মীয় আস্থা, জাতিগত পরিচয়, প্রাদেশিকতার মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি আমাদের দেশে নিজেকে ক্রমশ বিস্তৃত করছে। এর সাথে দেশীয় বিভিন্ন জনজাতির নিজস্ব বৈশিষ্টকেও বিভাজনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।  এহেন রাজনীতি বামপন্থার বিকাশে এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যেই দেশীয় শাসক শ্রেণি এবং সাম্রাজ্যবাদী লগ্নী পুঁজি এই রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থবাহী বলে চিহ্নিত করেছে। জনসাধারণের ঐক্য বিনষ্টকারী এই রাজনীতির প্রসার ঘটলে বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্র এবং পুঁজি উভয়েরই স্বার্থ রক্ষিত হয় বলেই তারা একে মদত যোগাচ্ছে।

যে সকল সামাজিক গোষ্ঠী আমাদের দেশে বহুবিধ সামাজিক বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার তাদের মধ্যেই এই রাজনীতির প্রসার ঘটেছে। জনসাধারণের সেই সব অংশ যারা জাতিভেদ, উপজাতীয় পরিচিতি কিংবা লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন তারাই এই রাজনীতির দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ছেন। শ্রেণি রাজনীতি ও শ্রেণি ভিত্তিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে কিছু এনজিও এবং সংকীর্ণমণা গোষ্ঠী পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির ধারণাকে সমর্থন জানায় ও সেই উদ্দেশ্যে অর্থেরও যোগান দেয়।

এই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে শ্রেণি আন্দোলনের সাধারণ মঞ্চ গড়েই লড়াই চালাবে সিপিআই(এম)। এর পাশাপাশি আমাদের দেশে সমাজের বিভিন্ন অংশকে জাতি, সামাজিক পরিচয় ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে যেভাবে বিহুবিধ নিপীড়নের শিকার হতে হয় তার বিরুদ্ধেও পার্টি সক্রিয় প্রচার, আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালনা করবে।’      

H K S Surjit & EMS Namboodiripad at the Party Congress Chennai in 1992

প্রথম পার্টি কংগ্রেস

প্রথম কংগ্রেস আয়োজিত হয় স্বাধীনতার চার বছর আগে, ১৯৪৩ সালে।

ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে কমিউনিস্টদের তিনটি গণসংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কাজও শুরু করেছে।

প্রথমটি কিষাণ সভা। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি’র সর্বভারতীয় সম্মেলনেই দাবী উঠেছিল কৃষকদের সর্বভারতীয় সংগঠন চাই। ১৯৩৬ সালে লখনৌ’তে সর্বভারতীয় সম্মেলনে সেই কাজ সম্পন্ন হল।

দ্বিতীয়টি ছাত্র সংগঠন। ভগৎ সিং’র নওজওয়ান ভারত সভা’র ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েই ১৯৩৬-এ প্রতিষ্ঠিত হয় এআইএসএফ। প্রথম সম্মলনের সভাপতি ছিলেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ, উদ্বোধনী বক্তৃতা দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। ঐ একই বছর কমিউনিস্টদের উদ্যোগে লখনৌ’র সম্মেলন থেকে প্রগতি লেখক সংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মেলনের প্রতি নিজের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। উদ্বোধনী ভাষণে প্রেমচন্দ বলেন- মানুষের আবেগ ও চিন্তাভাবনাকে সঠিক দিশায় পৌঁছে দেওয়াই ভাষার উদ্দেশ্য। সংগঠনের ইশতেহারে উল্লিখিত হয়- ‘To combat literary tends reflecting communalism, racial antagonism and exploitation of man by man’, সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিভেদ ও মানুষের উপরে মানুষের শোষণ যে সাহিত্যের আধার তার প্রতিপক্ষ হিসাবে মোকাবিলা করাই আমাদের লক্ষ্য।

এ প্রেক্ষাপটেই বোম্বে’তে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস আয়োজিত হয়।

১৯৪৩ সালের ২৩ মে থেকে ১ জুন অবধি চলে অধিবেশন। গোটা দেশে তখন মোট পার্টি সদস্য  ১৫,৫৬৩ জন। প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ১৩৯ জন, এর মধ্যে ৩০জন বাংলার। এ সম্মেলনে বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়। ১৯৪১ সালে গদর-কীর্তি গ্রুপ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মিশে যায়, এদের নেতা বাবা সোহান সিং ভাকনা প্রথম পার্টি কংগ্রেসে অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন।

প্রথম কংগ্রেসের রিপোর্টে উল্লেখ আছে যে সেইসময় সারা দেশে মোট ২,৬৩৭ জন সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। ১৩৯জন প্রতিনিধিদের মধ্যে ২২ জন শ্রমিক, ২৫ জন কৃষক এবং ৮৬ জন বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের অভিজ্ঞতালব্ধ ছিলেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে ৩জন জমিদার, ২জন ছোট আকারের সামন্ত ও ১জন ব্যবসায়ীও ছিলেন।

কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে সরকারের নিষেধাজ্ঞা বাতিল হওয়ার পরেও পার্টি কংগ্রেসের সময় ৬৯৫ জন পার্টি সদস্য তখনও জেলবন্দী ছিলেন। এদের মধ্যে ১০৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছিল। উপস্থিত প্রতিনিধিদের ৭০ শতাংশ জেলবন্দী হিসাবে মোট ৪১১বছর কাটিয়েছিলেন। কল্পনা দত্ত, কমলা চ্যাটার্জির মতো আরও অনেকের জীবনের অর্ধেকই জেলে বন্দী অবস্থায় কেটেছে। উল্লেখযোগ্য এ কংগ্রেসের উপস্থিত প্রতিনিধিদের ৬৮ শতাংশের বয়স ছিল ৩৫ বছরের কম। শিল্পী চিত্তপ্রসাদের আঁকা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন ও স্তালিনের ছবি দিয়ে সম্মেলনের এলাকা সাজানো হয়েছিল।  

অধিবেশনে রাজনৈতিক খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন পূরণচাঁদ যোশী, তিনি নিজের আলোচনায় ৯ঘন্টা সময় নেন। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা অবধি আলোচনা চলেছিল।        

সভাপতিমন্ডলীতে ছিলেন কমরেড মুজফ্‌ফর আহমেদ, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, ভাইয়াজি কুলকার্নি, কৃষ্ণ পিল্লাই, মণিকুন্তলা সেন, ডিএস বৈদ্য এবং নার্গিস বাটলিওয়ালা (ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন)। পার্টি কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি। শহীদদের উদ্দেশ্যে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাবা সোহান সিং ভাকনা। ‘শ্রমিক শ্রেণী এবং মাতৃভূমি রক্ষা’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বি টি রণদিভে। গ্রেট ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, কিউবা এবং কানাডার কমিউনিস্ট পার্টির তরফে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসকে শুভেচ্ছা বার্তা এসেছিল। শ্রীলঙ্কা এবং বার্মার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। এ সম্মেলন থেকে ১৪জনের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। পি সি জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী, বি টি রণদিভে এই তিনজন পলিট ব্যুরো সদস্য হন, সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পূরণচাঁদ যোশী’ই নির্বাচিত হন।

সম্মেলনের অন্তিম পর্যায়ে জবাবী ভাষণ দেন মুজফফর আহমদ।

সে ভাষণ শেষ হয় এই বলে-

কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস শেষ হয়েছে।

সর্বোত্তম এক লক্ষ্যকে নিজের কাজ হিসাবে পার্টি নিজেই নির্ধারণ করেছে।

আসুন, আমরা সকলে একসাথে সেই লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলি।

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

৪) Reminiscences of Lenin: Nadezhda Krupskaya

৫) Communists Challange Imperialism From The Dock, Muzaffar Ahmad

National Book Agency

৬) Adivasis Revolt: The Story of Warli Peasants in Struggle

Godavari Parulekar

Spread the word

Leave a Reply