Bijan Bhattacharya Profile

‘Here I Stand, I Cannot Do Otherwise’: A Tribute To Bijan Bhattacharya

প্রিয়াংকা কাঞ্জিলাল

বিগত শতাব্দী বিস্ময়ের শতাব্দী ভারতের কাছে, বাংলার কাছে। পুঁজির আন্তর্জাতিক  আগ্রাসী সংঘাতে বিদীর্ণ হয়েছে  বিশ্ব মানবতা। ঔপনিবেশিক শেকলে বাঁধা দেশের মানুষেরা প্রভুর  আধিপত্য কায়েমের স্বার্থে-অচেনা মানুষকে মেরেছে অথবা মরেছে ‘যুদ্ধের’ নামে, এরই মাঝে সভ্যতার চাকা গড়িয়ে নিয়ে যায় যারা, যাদের মেহনতের মোবিলে চলে রাষ্ট্র যন্ত্র অথচ তাদেরই  জোটে নিপীড়ন, শোষন সেই জনতা, মেহনতী জনতা রুশ দেশে বিপ্লব করেছে, তৈরি হয়েছে সোভিয়েত। সারা পৃথিবীর  সঙ্গে ভারতে, বাংলায় এসে পরেছে বীজমন্ত্র। বঞ্চনার হিসাব নেওয়ার ইস্তেহার তৈরি হচ্ছে সাময়িক পত্রে, কবিতায়, সদ্য গঠিত কমিউনিষ্ট পার্টির লড়াইতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও অমলিন ইউরোপে ত্রিশ দশক থেকে মাথা চাড়া  দিলো ফ্যাসিষ্ট শক্তি। জার্মানির হিটলার, জাপানির তোজো গ্রীসের রাজা এবং স্পেনের ফ্রাঙ্কো একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলেছেন। গণতান্ত্রিক মানুষের স্বাধীনতা নষ্ট হচ্ছে। স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের কন্ঠ রোধ করে ফ্যাসিষ্ট শক্তি সাম্রাজ্যবাদী লিপ্সা অধিপত্য সম্প্রসারনের দখলদারী শুরু করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য একত্রিত হলেন প্রগতিশীল চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবিরা। আইনস্টাইন, রমা এলাঁ, গোর্কি, বার্নড’শ প্রমুখরা ফ্যাসিজিমের প্রত্যক্ষ বিরোধীতা করছেন। ১৯৩২ সালে রমাঁ রলাঁর নেতৃত্ব তৈরী হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস এগেইনস্ট ফ্যাসিজিম এন্ড ওয়ার।’ ১৯৩৫-এর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেস আহ্বান জানানো হল ধনতান্ত্রিক দুনিয়াতে ফ্যাসি বিরোধী গণফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে এবং উপনিবেশ ও নির্ভরশীল দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংযুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে। এইসব বিশ্বরাজনীতির নানা ঘটনা প্রভাবের যোগসূত্রে ১৯৩৬ সালে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ তৈরী হয়। তাদের ম্যানিফেস্টোতে লেখা হয় ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি তার সামরিক স্পর্ধায় মানুষের ক্ষুধার আর্তনাদকে বন্দুকের গুলিতে স্তদ্ধ করে দিতে চাইছে এবং শক্তির উন্মত্ততায় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে।’ ম্যানিফেস্টোতে সই দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপরই ১৯৩৭ সনে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত হলো ‘লীগ এগেইনষ্ট ফ্যাসিইজম অ্যান্ড ওয়ার’-এর ভারতীয় কমিটি, রবীন্দ্রনাথ সভাপতি। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার তরুনরা একত্রিত হচ্ছে, ছাত্র ফেডারেশন পথে নামছে, কমিউনিস্টরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিচ্ছেন।

১৯১৫ সালে ফরিদপুরে জন্মানো বিজন ভট্টাচার্য এই আবহে বড় হচ্ছেন। শিক্ষক পিতা ক্ষীরোদ ভট্টাচার্যের কর্মসূত্রের কারণে অবিভক্ত বাংলার নানা প্রান্তের সাথে পরিচিতির সূত্রে তিনি গ্রাম বাংলার জীবন, উপভাষা, লোকাচার, লোকায়ত সংস্কৃতির সবটুকু নিজের করে নিচ্ছেন, হয়ে উঠছেন তাদেরই একজন। এর সাথে চলেছে পারিবারিক সম্মিলনে ধ্রুপদী নাটক চর্চা, শেক্সপীয়র চর্চা।স্কুল জীবন কেটেছে ২৪ পরগনায় বসিরহাটে, কলেজ আশুতোষ কলেজ,রিপণ কলেজ। এরই মধ্যে ছাত্র ফেডারেশনের যুক্ত হওয়ার সূত্র ধরে বাম রাজনীতির কাছাকাছি আসা। ১৯৩৮ এ আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি। অথম রেবতি বর্মনের বুক রিভিউ লিখতে গিয়ে মার্কসবাদ সম্পর্কে আগ্রহী হলেন এবং বিজন ভট্টাচার্যের রেবতি বর্মনের বুক রিভিউ পড়ে মুজফ্ফর আহমদ তাঁর সাথে দেখা করেন, এবং এই মুলাকাতের পরিণতিতে ১৯৪২ সালে বিজন ভটাচার্য চাকরি ছেড়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হলেন। সমান্তরালে চলছিল লেখক জীবন। গল্প, স্কেচ, পুস্তক সমালোচনা এই সব। ‘অরনী’ পত্রিকায় লিখছেন। এই পত্রিকায় তার প্রথম গল্প  ‘জালসত্ত্ব’ (১৯৪০) প্রকাশিত হয়। ১৯৪২-এ যখন ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ তৈরী হয় তখন বিজন ভট্টাচার্য এতে যোগ দেন লেখক হিসাবে। তখন মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকটে গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছ। ক্ষুধার্ত মানুষ ভিটে ছাড়ছে অন্নের খোঁজে আসছে কলকাতায়। শহরের রাজপথে নিরন্ন মানুষের হাহাকার, ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও’ প্রতিফলিত হচ্ছে শহর জুড়ে, খোলামকুচির মতো পড়ে আছে  কঙ্কালসার দেহ, মৃত দেহ। বিজন ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন- ‘আপিস থেকে ফিরবার পথে রোজই ভাবি, এই সবকিছু নিয়ে লিখতে হবে। কিন্তু কীভাবে লিখব? ভয় করে, গল্প লিখতে গেলে যে বড়ো সেন্টিমেন্টাল প্যানপেনে হয়ে যাবে। একদিন ফেরার পথে কানে এল, পার্কের রেলিঙে উপরে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজোপার্বনের গল্প, ভাববার চেষ্টা করছে, তাদের অবর্তমানে গ্রামে এখন কী হচ্ছে। আমি আমার ফর্ম পেয়ে গেলাম। নাটকে ওরা নিজেরাই নিজেদের ব্যথা বলবে।’

দুর্ভিক্ষপীড়িত, ক্ষুধাতাড়িত মানুষ কথা বলছে।  যন্ত্রনার কথা নয়, ক্ষুধার তাড়নার ধারাভাষ্য নয়, চোখের সামনে যে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে তার কথাও নয় বরং অতীতে গ্রামের নবান্নের উৎসবের কথা, আনন্দের কথা, জীবনের কথা। এ কথা লেখকের জবানীতে বিবৃত হলে তা সেন্টিমেন্টাল হবে, বাস্তবরহিতও হতে পারে। কিন্তু কথাগুলো তো বলা প্রয়োজন। এ কথ যাদের কথা তারাই বললে ভালো। তাই নাটক বাস্তবের অবহেলিত, শোষিত মানুষগুলো যেভাবে বেঁচে থাকার সংলাপ আউড়ায়, সেইভাবেই রঙ্গমঞ্চের নাটকে চরিত্ররা হবেন সেই মানুষ, তারা বলবেন তাদের বেঁচে থাকা, বাঁচতে চাওয়া, বাঁচার জন্য  লড়াই এই সবের সংলাপ। বিজন বাবু ফর্ম পেলেন নাটক কে আর তৎকালীন বাংলা নাট্যমঞ্চ পেলো ফর্ম ভাঙা এক নাট্যকারকে।

থিয়েটারের উত্তারাধিকার বাঙালি পেয়েছে তার ঔপনিবেশিক প্রভুর কাছ থেকে। সেই থিয়েটারে ফর্ম বিলাতী কায়দায় বজ্র আঁটুনিতে বাঁধা। সাম্রাজ্যের আধিপত্যকে আরও মজবুত করার জন্য পঞ্চাঙ্ক নাটক, তার মাপজোঁক সমস্ত বেঁধে দেওয়ার দরকার পরেছে। কারণ নানা মানুষ যারা রাষ্ট্রের মাপে হিসাব মিলিয়ে কথা বলতে পারে না, নিজের জীবন চর্যা থেকে উঠে আসা মুক্তির কথা নিজের মতো করে বলার চেষ্টা  করে, তারা নিজস্ব ফর্মে রঙ্গমঞ্চে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আসলে অধিপত্যবাদীরাও যুগ নির্বিশেষে সারসত্য বোঝেন যে সংস্কৃতি কখনই স্থির নয়- এটি শ্রেনী সংঘাতের মাঠ। যেমন Subaltern’রা তাদের লোকসংস্কৃতি, গান বা কথনের মাধ্যমে আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই সংস্কৃতির কন্টেন্ট আর ফর্ম নির্দিষ্ট করতেও দায় থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রের। আর তাকে ভাঙলেই তা হয় নিপাতনে সিদ্ধ, কৌলিন্যহীন। ঔপনিবেশিক জঠরজাত থিয়েটার খইতে খইতে যখন গতানুগতিক আর্বতে সরণ শূন্য পাক খাচ্ছে তখন বাংলা নাটকের ‘প্রমিথিউস’ বিজন রঙ্গমঞ্চে আনলেন ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’ তার মহড়ামাত্র আর আগামীর ইস্তেহার প্রকাশিত হলো ‘নবান্ন’-এ। বিজন যেন ব্রেশট কে মনে করিয়ে দেন, যেন বিজন ব্রেশটের মতো করেই বলতে চেয়েছেন- ‘our audience must not hear only how Prometheus was set free  but also train themselves in the pleasure of freeing him.’ বাংলা নাটক নতুন বাঁকে এসে দাঁড়াল। লেখক বিজন ভট্টাচার্য বিবর্তিত হলেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথায়: ‘বিজন ভট্টাচার্য এসেছিলেন গল্প লেখক হিসাবে পরে দল ভেঙে তিনি গন নাটকের শিল্পীদের দলে ভিড়ে গেছেন।’ ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসের মঞ্চেই পি.সি. যোশীর উদ্যোগে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার থেকে যে ন’জন প্রতিনধিত্ব করেন তাঁর মধ্যে বাংলা গন নাট্যের সর্বকালের সেরা নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য। বাবুদের শখের নাট্যশালা থেকে বের হয়ে পেশাদার নাট্যশালা তৈরী হলেও তা ছিলো মূলতঃ ভাঙা সামন্ততন্ত্রের শহুরে বাবুদের পৃষ্টপোষকতায় চালিত। কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে অধিকাংশই সামাজিক, ভক্তিবাদ আর ঐতিহাসিক চরিত্রের তলোয়ার ঝনঝনানির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সামন্ততন্ত্রের অর্থ গৌরবকে ম্লান করে রঙ্গমঞ্চের আধিপত্য নিলো বুর্জোয়া আভিজাত্য যা মেকেলের ভাষায় ‘Indian in blood and colour but english in test, in opinion, in morals and in intellect’ স্থূলতার জায়গায় সূক্ষ্ণ রুচি এলো তবে তাও সেই ধর্ম; আবেগসর্বস্ব জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবপ্রবনতার তরল আবেগে বাংলা নাটক মজেছিল।  গিরিশ থকে শিশির নাট্যজগতের সবল মহারথীরা ফোকাস লাইট শুধু নিজেদের উপর ফেলতে ব্যস্ত ছিলেন। নাট্যপ্রয়োগ ছিলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক; ‘শিষ্টের পালন দুষ্টের দমন’ সবই ব্যক্তি আবর্তিত। বাকিরা নাটকের অসহায় সহায়ক। নাট্যশিল্পকে এই মঞ্চ  দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেন বিজন ভট্টাচার্য। প্রথাগত একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণমানুষই নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো।

কিন্তু পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের নাট্য সংস্কারের জন্য বিজন ভট্টাচার্য নাটকের স্পষ্ট ভোল বদলে গেলেন তা তো নয়, তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক,শোষিত মানুষের রাজনীতি, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে Subaltern-দের প্রতিরোধের রাজনীতি, প্রলেতারিয়েতের রাজনীতি, মার্কসীয় চেতনা জারিত শ্রেনীর রাজনীতি। এই রাজনীতিই অজীবন বিজন কে কম্পাসের মতো দিক নির্দেশ করে গেছে, তাড়িত করে গেছে তার শিল্পধর্ম, কমিউনিষ্ট পার্টির সভ্যপদ ছাড়ার পরেও তিনি মার্কসীয় দর্শনেই আস্থা রেখেছেন। ‘আগুন’ ছিলো ক্ষুদ্র দৃশ্যের স্কেচ জাতীয় একাঙ্ক। নাটকের প্রচলিত রীতির বাইরে বের হলেন কেন তাই  নিয়ে নাট্যকারের কৈফিয়ৎ নাটকের গ্রামার পড়ে লিখব এ কোনদিন মাথায় আসেনি। খবরটা দেওয়ার দরকার এটুকুই মাথায় ছিলো। এবং বলেছেন ‘এই শহরের উপর যুদ্ধের ভয়ংকর ছায়াপাতের একটা লক্ষণ দেখেছিলাম কিউইং এর মধ্যে জলের কিউ, চালের কিউ। বয়দের যেন একটা শ্রেনী গড়ে উঠেছিল, এ ব্যাপারটা খন্ড কয়েকটি চিত্রে করেছিলাম।’ I.P.T.A এর পথ চলা শুরু ১৯৪৩ এর যে সম্মেলনে সেখানে অভিনীত হয়েছিল বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’। এ নাটকে মন্বন্তরের পটভূমিকায় কালোবাজারি, চোরাকারবার, মহাজনের অত্যাচার স্কেচে ধরা পরে এবং শেষে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে উৎপীড়িতের সংঘবদ্ধ হওয়ারই সচেতন প্রয়াস গণনাট্যের এজেন্ডাকে সার্থক করে। সাধারণ মানুষের এই সচেতন প্রয়াস ‘জবানবন্দী’ নাটকে এসে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার রূপ নিচ্ছে। এ কাহিনীও মন্বন্তরের ভাষ্য। গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে বাধ্য হওয়া কৃষক, ক্ষুধার জ্বালায় শিশু মৃত্যু, নিজের শরীরটুকুকে পন্যের মতো বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না কৃষক বধূর। মানবিকতার বদলে নগদই হয়ে ওঠে নির্ধারক শক্তি। মনে করিয়ে দেয় মার্কসের ভাবনা : ‘The bourgeoisie has left remaining no other nexus between man and man than naked self-interest, than callous ‘Cash Payment’।

‘জবানবন্দী’ বিজন ভট্টাচার্যের সবচেয়ে বেশী অভিনীত নাটক। ‘জবানবন্দী’ বাংলার গন্ডী ছড়িয়ে সারা ভারত জুড়ে অভিনীত হয়, হিন্দিতে অনুদিত হয় “অন্তিম অভিলাষা” নামে, গুজরাটিতেও অনুদিত হয়। বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য পিপলস রিলিফ কমিটির সাংস্কৃতিক স্বোয়াড সারা ভারত জুড়ে অর্থ সংগ্রহ করে এই নাটকগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে। এরপর রচিত হয় “নবান্ন” (১৯৪৪)। শুধুমাত্র গণনাট্য আন্দোলনের ধারায় নয় বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম দৃষ্টান্ত  সৃষ্টিকারী নাটক, বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক নবান্ন। ‘এটি দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে ট্রিলজির -শেষ নাটক।’ মন্বন্তরের শিকার কৃষক  কালো-বাজারী, মহাজনের সর্বগ্রাসী শোষণের তাড়নায় আশ্রয়ের খোঁজে, খাবারের খোঁজে শহরমুখী। একদিকে কালোবাজারির কালা ধনের অশ্লীল আস্ফালন আরেকদিকে কুকুর মানুষে খাদ্যের জন্য জান্তব লড়াই  সহস্রাব্দের সভ্যতার মুখে এক মুঠো ছাই দিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। শহরের প্রেক্ষাপট সচেতন ভাবে বেছে নিয়েছেন নাট্যকার।নির্মমতা, পেশার ধান্দা, অমানবিকতা, লুণ্ঠন করা সম্পদের উল্লাস তাই নিয়ে শহর যেন মৃত্যুর কারখানা। আবার গ্রামমুখী হয়েছে মাটির মানুষগুলো বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে, গতর খেটে চাষাবাদ শুরু ও নবান্নের উৎসব।এবং আসন্ন বিপদের সংঘবদ্ধ মোকাবিলায় প্রকাশ পায়  মানুষের অনন্ত জীবনীশক্তি আর সংঘবদ্ধতায় তার ব্যাপ্তি। প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোন বিপর্যয়েই যূথবদ্ধ জনতা একেবারে হেরে যায় না নাটকের শেষে প্রতিরোধের বার্তা দিয়ে বিজন বাবু ‘নবান্ন’কে এপিকের পর্যায়ে পৌঁছে দিলেন। নবান্ন বাংলা নাটকের পথ চলার মোড় ঘোরালো, মঞ্চসজ্জার ব্যবসায়িক চটকের বিপরীতে স্রেফ চট টাঙিয়ে বুর্জোয়া বাস্তবতার অন্তঃসার শূন্যতাকে প্রমাণ করে দিল। এ প্রসঙ্গে উৎপল দত্ত বলেছেন ‘ভারতীয় গননাট্য সংঘ চট টাঙিয়ে অভিনয় করে ঐ জীর্ন’ ব্যবসায়িকতার মৃত্যুবান হানেন। বুর্জোয়া বাস্তববাদের বিরুদ্ধে ‘নবান্ন’ ছিল শ্রেনী চেতন গননাট্য সংঘের অভিযান। এ অভিযান শুধু নাট্যজগতের  মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার রাজনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রেও ‘নবান্ন’ এক অন্য অভিঘাত নিয়ে এলো। যারা সার সার মৃতদেহ গুলো দেখে চোখ ফেরাতেন, তারা নবান্ন দেখে চোখের জল ফেলেছেন।

ইংরেজ বৈমানিক Bill Butler নবান্ন নটক দেখে বিজন ভট্টাচার্যকে চিঠি লেখেন : ‘Out of the agony of the grapes, comes the glory of the wine. Out of the agony of the people, comes the glory of the nation. These words express better than any of mine that which I saw last night. In your play. ……  The history of the greatest tragedy of this war unfolded itself before my eyes. Agony, misery) starvation, Corruption, moral collapse and death, it was all so vivid.’ শুধুমাত্র বিলের চিঠিই নয়, বাংলায় ঘটে যাওয়া মন্বন্তর নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের নীরবতা, উদাসীনতার খবর ‘নবান্ন’ এর মাধ্যমে ব্রিটেনের প্রগতিশীল মানুষের কাছে পৌঁছেছিল, কারন বিজন বাবুই বলছেন “তখন যুদ্ধের কালাকাল। বিকেল হতেই অনেকদিন দলে দলে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর ছোট ছোট দল সংঘের অফিসে ভিড় জমাত। এঁদের অনেকেই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। জনমতের চাপে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বাধ্য হলেন ১৯৪৪ এর ‘দুর্ভিক্ষ তদন্ত-কমিশন’ গড়তে। কমিশন ইংরেজ সরকারের লুন্ঠন, কৃষক হত্যানীতি, চোরাকারবারিদের মদত দেওয়াকে দায়ী করল।ঔপনিবেশিক দেশের একটি নাটক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে স্বীকার করিয়ে নিতে বাধ্য করল তাদের লুন্ঠনের কথা। গননাট্যের ভূমিকা আর ‘নবান্নের’ গণনাট্যকে সার্থক করে তোলার জন্য বিজন ভট্টাচার্যের ভূমিকা ভারতের ইতিহাসে নজিরবিহীন না হলেও অন্যতম। ‘নবান্ন’ এরপর ‘অবরোধ’। কৃষকের পর শ্রমিক, মিল-মুজদুর। শ্রমজীবি মানুষের লড়াই। সম্পূর্ণ-মার্কসীয় দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়েছে নাটকে।নাটকটি অভিনীত হয়নি। এরপর মরাচাঁদ এবং জীয়নকন্যা।  মরাচাঁদ মঞ্চসফল  নাটক। এ নাটকেও বজায় আছে নাট্যকারের দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ। অন্ধ বাউলের আর তার যুবতী স্ত্রীর মনস্তাত্ত্বিক এবং আর্থ সামজিক টানাপোড়নের মধ্যে উদ্ভূত হয় বিজন বাবুর ব্যাখায় ‘জীবনের নতুন দ্বন্দ্ব। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সংঘাত। ব্যক্তি মানুষের সুখ দুঃখ, জয় পরাজয়ের প্রশ্ন বড়ো, না শিল্পের সামগ্রিক দাবি।’ পবনের ব্যক্তি জীবনের ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে যায় তাঁর শিল্পসত্তা, যখন বউ চলে যাওয়ার পরও পবন পার্টির সভায়  বুক ফাটা আর্তনাদের পরিবর্তে ‘বুকফাটা গান গেয়ে ওঠে, বেঁচে থাকার গান। ‘জীয়নকন্যা’ রূপকধর্মী নাটক, বিজন বাবু বলছেন- ‘১৯৪৫-এ দেশভাগের আশঙ্কায় জীয়নকন্যা লিখি।’ দাঙ্গার আবহ, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ঘনীভূত হচ্ছে, বিজন ভট্টাচার্য আশ্রয় নিলেন মিথের আর তাঁর তৈরী করা মিথে সাপুড়েরা থাকবেই। এ তাঁর  নিজস্ব পরিধি ‘সাপ সম্পর্কে আমাদের পুরান কথা ঠাকুরমার কাছ থেকে শুনে, রামায়ন, মহাভারত পড়ে জেনেছিলাম। আমি সাপুড়েদের বাড়ি গিয়ে বসে থাকতাম। ভাবতাম, যে লোক এত বড়ো দুর্ধর্ষ সাপ নিয়ে খেলা করে, সে কত বড়ো মহাবলী। আমি যদি সারাদিন তাঁর কাছেই বসে থাকি; তিনি যদি আমার গায়ে হাত দেন। আমার খুব ভালো লাগবে। মানে ‘হীরো ওয়ারশিপ’ করতাম।’

তাই দেশ যখন বিপন্ন তখন বিষহরির কন্যা উলুপী আসলে ‘দেশ’-এর প্রতিরূপ হয়ে। দেশ বলতে বরাবর মাটির সাথে থাকা মানুষদেরই বুঝেছেন বিজনবাবু। উলুপীর সর্পদংশন হয়েছে। তাকে বাঁচাতে সারা দুনিয়ার বিষহরিরা সমবেত হয়েছে। তাদের আলাদা আলাদা লোকাচার, গান, মন্ত্র, তাল, ছন্দ, দোয়া সব ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে  এক সামগ্রিক সুর বেজে উঠল।সেই সামগ্রিক সুরের আহ্বানে সপির্নী এসে বিষ তুলে নেয়। উলুপী প্রান পায়। গান, লোকায়ত আচার, সংস্কৃতি সকলকে মিলিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষ হরনের মধ্যে দিয়ে দেশ কে বাঁচানোর আহ্বান করে ছিলেন নাট্যকার। দেশভাগের ঠিক আগে জীয়নকন্যা আর দেশভাগের সাথে সাথেই লিখলেন ‘গোত্রান্তর’। মধ্যবিত্তের উদ্বাস্তু যন্ত্রনা। মূল্যবোধের গরিমা,  স্বতন্ত্রতার ভাবনা সব অতিরিক্ত প্রত্যঙ্গের মতো খসে পড়তে থাকে।পূর্ববঙ্গের মাষ্টার বস্তিবাসী হয়। মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করে। সবটা মিলতে পারে না শ্রমজীবি মানুষের সাথে,বিচ্ছিন্নতা বোধ পুরোপুরি চলে যায় না।কিন্তু  যেদিন বস্তি উচ্ছেদ হয়, অস্তিত্বের শিকড়ে আবার টান পরে, সবটুকু ধুলোয় মিশে যায় সেদিন একদা মধ্যবিত্ত মাস্টার আর তার পরিবার সব হারানো মানুষগুলোর সাথে এক পংক্তিতে দাঁড়ায়, তাদের গোত্রান্তর হয়। আসলে গোত্র নয় শ্রেনী। মাষ্টার ডিক্লাসড হয়।

বিজন ভট্টচার্য পার্টি সভ্যপদ ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মার্কসীয় দৃষ্টিকোন ত্যাগ করতে পেরেছিলেন কি? তাই যদি পারতেন তাহলে তো লিখতে পারতেন না- ‘তোমার আমার বিভ্রান্তি হতে পারে কিন্তু মিছিলের কোন বিভ্রান্তি থাকতে পারে না …. আমারই মিছিল। ঠিকই। কিন্তু মিছিলেরই একান্ত আমি। বা আমিই মিছিল। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ক্ষুরধার যুক্তিবাদ এই আপাত বৈপরীত্যের সমাধা করবেই করবে।’

১৯৪৮-এ বম্বে পাড়ি দিয়েছেন। ‘নাগিনা’ বেদেদের জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র কাহিনী রচনা করেছেন। সফল হয়েছেন। রাজ কাপুর তাঁকে  ১০,০০০ টাকা চুক্তিতে চিত্রনাট্যকার নিযুক্ত করতে চেয়েছেন, প্রত্যাখান করে ফিরেছেন বাংলায়। এখানেও চলচ্চিত্রের  চিত্রনাট্য লিখেছেন-বসু পরিবার, সাড়ে ৭৪।সাড়ে চুয়াত্তরে পূর্ববঙ্গীয় ডায়লেক্টে ভানু বন্দোপাধ্যায়রের ডায়লগ” মাসিমা মালপো খামু।”-র স্রষ্টাই একদিন দয়ালকে দিয়ে বলিয়ে ছিলেন ‘জোর, জোর প্রতিরোধ…’। মানুষের জীবনের প্রতিটি শেড যত্ন করে যিনি আঁকতে পারেন তিনিই শিল্পী। বিজন ভট্টাচার্য যে কোন ফর্মে প্রমান করেছেন তাঁর শিল্পসত্তা। আবার নাটকে ফিরেছেন কলঙ্ক, গর্ভবতী জননী, আজ বসন্ত, দেবীগর্জন, ধর্মগোলা, হাস খালির হাঁস সবেতেই ফিরে ফিরে এসেছে প্রান্তিক মানুষ, তাদের লোকায়ত সংস্কৃতি, রিচুয়ালস আর এ সবের মধ্যে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ বার্তা নিয়ে। অর্থনৈতিক সামাজিক স্তর বিন্যাসে প্রান্তিক মানুষ তাদের জীবনের ধর্মীয় অনুষঙ্গের মধ্যে জীবনকে খোঁজে, জীবনের সমস্যার সমাধান খোঁজে।তাই তাদের চিত্রিত করতে গেলে তাদের রিচুয়াল দিয়েই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তাদের জীবনকে ফুটিয়ে তোলা যায়।  বিজন বাবুর ভাবনা- ‘আমি যখন নাটক লিখেছি আমি আমার রিলিজিয়াস সেনসিবিলিটিজ ‘যতদূর সম্ভব গ্রহন করেছি যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে ততক্ষণ পর্যন্ত। আমার দেশের মানুষ যতদিন ঠাকুরদেবতাগুলোকে বাঁদরের মতো নাচাবে, আমারাও ততদিন তাদের নাচাতে বাধবে না।’

খান পচিঁশেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সবচেয়ে সাবলীল হয়েছেন যেখানে আছে লোক গাথা, প্রতীক, লোক সংস্কৃতির আর্কিটাইপ মাদার ইমেজ আর   মার্কসীয় ঘরনায় শ্রেনী দৃষ্টি। এসব তো ওঁনার সিগনেচার স্টেপ নাটকে। আর সিনেমায় ঋত্বিক ঘটকের। তাই ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় বিজনের উপস্থিতি স্বাভাবিক সাবলীল। ঋত্বিকের সিনেমায় বিজন প্রায়শই হয়ে উঠেছেন ঋত্বিকের মিরর ইমেজ। যে মূল্যবোধ ঋত্বিক ধারন করেছেন, যে বাংলা ভাগের যন্ত্রনা তাকে স্থিতু হতে দেয় না, যে অভিযোগ তার এই আর্থ সামাজিক কাঠামোর প্রতি তাই উচ্চারিত হয় বিজন অভিনীত চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বিজন কন্ঠে।গোত্রান্তরের হরেন্দ্র মাষ্টার ছাড়া আর কে হতে পারত মেঘে ঢাকা তারার ‘তারণ মাষ্টার’। যতবার সংকট-আসবে, মধ্যবিত্ত সত্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে  তার নৈতিকতার মাপকাঠিতে মাপতে যাবে বিপন্নতাকে এবং ব্যর্থ হয়ে ততবার শুনতে পাবে ‘তারন মাষ্টার’ ওরফে বিজন ভট্টাচার্যের সুতীক্ষ্ম স্বর ‘আই অ্যাকিউজ’।

আগুন থেকে হাঁসখালির হাঁস এই বিজন কখনও আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব হয়ে ওঠেন নি। তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন নাটক মঞ্চের সীমা অতিক্রম করবে, পথ মাঠ ঘাটে নাটক পৌঁছাবে। পৌঁছে দিতে হবে জনতার কাছে,জনতার নাটক।শিল্পের উপর অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ খতম করতে হবে।  শ্রেনীর পক্ষ নিতে তিনি বিচ্যুত হননি, তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন- ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনের সংশ্রবে না এলে, কমিউনিস্ট পার্টি’র সভ্য না হলে, আমি বিজন ভট্টাচার্য হতাম না। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তা সম্ভব হত না।’

বিশ্বায়ন পরবর্তী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে বিজন ভট্টাচার্য আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। বিশেষত যে ধর্মকেন্দ্রিক ফ্যাসিস্ট প্রবনতা তেরী হচ্ছে, সংস্কৃতির একমেরুকরণ হচ্ছে  সেখানে নাট্য সংস্কৃতিতে বিজনের ভূমিকা প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো। তিনি মাইলের পর‌ মাইল মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছেন গান, লোকাচার, লোকায়ত সংস্কৃতি, ডায়লেক্ট, খুঁজেছেন টোটেম,প্রকৃতির সাথে সহবাসকারী মানুষ, তাদের জীবনযাপন। বাংলা নাটককে ভরিয়ে দিয়েছেন মানুষের বৈচিত্র্যে। আজ ‘ইউনিফাইড সিভিল কোডে’র যক্ষপুরীতে বিজন ভট্টাচার্য নিজেই অ্যান্টি ডোট।

Spread the word

Leave a Reply