Pyasaa-Cover

Guru Dutt: A Tribute

শৌনক সরকার

এক স্বপ্নদ্রষ্টাকে

ভারতের সিনেমার ইতিহাসে গুরু দত্ত এমন এক নাম, যা ইতিহাসে নয়, ভবিষ্যতেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকার দাবি রাখে। স্বাধীনতা লাভের আগে ও পরে অস্থির টালমাটাল সময়ের কথা আমরা ইতিহাসে পড়ি। কিন্তু সেই একই সময় দাঁড়িয়ে গুরু দত্ত বেছে নিয়েছিলেন মানুষের মনের অস্থির লগ্নকে। সে কথা সিনেমার ভাষায় প্রকাশ করাও একপ্রকার স্বাধীন হওয়ার লড়াই। অন্যান্য দেশে কতটা কী জানি না, কিন্তু যে দেশে প্রশ্নচিহ্ন ছাড়া ব্যক্তিস্বাধীনতা দেয় না সমাজ, সে দেশে গুরু দত্তের লেন্সের চোখে চোখ রাখার প্রয়োজন পড়ে বারবার।

শুরুর কথা

তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ জুলাই বেঙ্গালুরু শহরে। তাঁর পরিবার ছিল সংস্কৃতি-মনস্ক । বাবার চাকরি সূত্রে ছোটবেলা কেটেছে বেঙ্গালুরু, কলকাতা ও মুম্বাইয়ের মতো নানা শহরে। ছোটো থেকেই সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ও নৃত্যচর্চা তাঁর নরম মাটির মতো মনকে শিল্পীসত্তার ছাঁচে ফেলেছিল। পরবর্তীতে ‘উদয় শঙ্কর কালচারাল সেন্টার’-এ নৃত্য ও অভিনয় শেখার মধ্যে দিয়ে তাঁর শিল্প-ভবিষ্যতের ভিত শক্ত হয়। চাকরি জীবনের গণ্ডিতে প্রবেশ করলেও ‘বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর ‘, তেমনই গুরু দত্তের সত্যিকারের আসন পাতা ছিল সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্যে।

১৯৪৪ সালে‌ পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর সহকারী হিসেবে রুপোলি পর্দায় দুনিয়ায় পদার্পণ করেন। এরপর ‘বাজ’ ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং ১৯৫৪-তে ‘আর পার’ ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা পান। কিন্তু প্রকৃত শিল্পী কখনোই শুধুমাত্র বাজারগত সাফল্যের সুখী হতে পারে না বোধহয়। গুরু দত্ত ছিলেন এমন একজন নির্মাতা যাঁর কাছে সিনেমা ছিল শিল্পের চূড়ান্ত প্রকাশ। তাঁর ক্যামেরা যেমন কথা বলত, তেমনি সংলাপ ও সংগীতেও ছিল শৈল্পিক মননের ছাপ।

সমাজ ও মানুষ

গুরু দত্ত যে সময়ে কাজ শুরু করেন, তখন স্বাধীনতা-উত্তর ভারত বৈষম্যের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত । তাঁর ছবি ‘প্যায়াসা’ এক বঞ্চিত কবির জীবনের গল্প হলেও, তা আসলে এক পুঁজিবাদী সমাজের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে স্বরের জন্ম‌ দেয়। কবি বিজয়কে সমাজ ততক্ষণ অবহেলা করে, যতক্ষণ না সে মৃত বলে ঘোষিত হয়—তখনই শুরু হয় মূল্যায়ন ও ভক্তির প্রতীকীকরণ। আজও কী আশ্চর্যজনক ভাবে এই একই বিষয় ঘটতে দেখি সমাজে। শিল্পীকে, বলা ভালো যে মানুষ চিন্তা করে, তার কদর করে না সমাজ। বরং তাকে সমাজের গুডবুকে ফেলতে চায়।

এক গভীর বাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরেন কাব্যিক ভাষায়। তাঁর ছবিতে দরিদ্র, নিঃস্ব, একাকী মানুষদের স্থান হয়, যাঁরা জীবন যুদ্ধে হার মানলেও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেন না। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এ জমিদার শ্রেণির পতনের পাশাপাশি দেখানো হয় সেই প্রান্তিক নারীর জীবন, যিনি স্বামীর ভালবাসা পেতে আত্মধ্বংসের পথ বেছে নেন। এমন চরিত্র আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় এক নিস্পৃহ সমাজের সঙ্গে। সহানুভূতি ভিক্ষা নয়, তাঁর চরিত্রেরা সমানুভূতির দাবি রাখে।

সৃজনশীলতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব

শিল্পীর জীবন যেমন বাহ্যিক সাফল্যে ভরপুর, তেমনি ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে গভীর এক সংঘাত। গুরু দত্তের ‘কাগজ কে ফুল’ এই অন্তর্দ্বন্দ্বের রূপক বলা চলে । এখানে পরিচালক সুরেশের চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন শিল্প ও বাণিজ্যের চূড়ান্ত সংঘাত, সৃষ্টির জন্য ভালোবাসা ও তার সামাজিক পতন ।

এই ছবিতে ভি. কে. মূর্তির আলো ও ছায়ার কারিগরি যেন এক ধ্রুপদী অর্কেস্ট্রার রূপ দেয় । প্রতিটি শট, প্রতিটি দৃশ্য গভীর অর্থ বহন করে। গুরু দত্ত নিজেই ছবির শিল্প নির্দেশনা ও চিত্রনাট্যে যুক্ত থাকতেন। তাঁর আত্মজৈবনিক ছায়া এই ছবিতে এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে দর্শক বুঝতে পারেন, এই চলচ্চিত্র কোনও কল্পনা নয়, বরং শিল্পীর আত্মার নির্যাস।

নারীর মুক্তি পুরুষের চোখে

গুরু দত্তের ছবিতে নারী কেবল প্রেমিকা বা গৃহিণী ছিলেন না—তাঁরা ছিলেন জীবনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ব্যক্তিত্ব। তাঁদের চরিত্রের মধ্যে অনুভূতিগত স্বনির্ভরতা ছিল। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এর ছোট বউ এক নিঃসঙ্গা নারী, যিনি স্বামীর উপেক্ষায় নেশার আশ্রয় নেন। এই চরিত্র নিছক দুঃখিনী নারী নয়, বরং এক নীরব প্রতিবাদী চরিত্র।

‘চৌধভি কা চাঁদ’-এর মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেন মুসলিম সমাজের নারীর অন্তর্দ্বন্দ্ব। গুরু দত্ত নারীর চোখে সমাজকে দেখানোর সাহসী চিত্রকর। তাঁর নারী চরিত্ররা আত্মসম্মানবোধসম্পন্না, বুদ্ধিমতী এবং প্রায়শই সমাজের অবজ্ঞা ও শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে আধুনিক সময়ের ফেমিনিস্ট নির্মাতার পূর্বসূরী করে তোলে।‌ সে যুগে তিনি মেয়েদের ‘সাইড রোল’- এ রেখেও করে তুলেছিলেন মুখ্য চরিত্র।

সঙ্গীতের অনবদ্য ব্যবহার

গুরু দত্তের সিনেমা মানেই সংগীত ও চিত্রায়নের অপূর্ব সমন্বয়। তাঁর ছবির গানগুলো শুধু আবহ নয়—এগুলো চরিত্র ও পরিস্থিতির অন্তর্গত ভাষ্য। ‘প্যায়াসা’-র “ইয়ে দুনিয়া…” বা ‘কাগজ কে ফুল’-এর “ওয়াক্ত নে কিয়া…” গানগুলি বেদনার প্রতীক হয়ে ওঠে।

এস.ডি. বর্মণ, ও.পি. নায়ার, সাহির লুধিয়ানভি—এই প্রতিভাধরদের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা সিনেমাকে রূপ দিয়েছে কবিতায়। তিনি জানতেন কোন মুহূর্তে গান শুরু হবে, ক্যামেরা কোথায় ঘুরবে, মুখাবয়বের উপর আলো কেমন পড়বে। তাঁর গানের মাধ্যমে দর্শক চরিত্রের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করে, যা সেই সময়ের বলিউডে বিরল।

একাকিত্ব ও মলিন শেষের দিনগুলি

অসাধারণ প্রতিভার পাশাপাশি গুরু দত্তের জীবনে ছিল তীব্র নিঃসঙ্গতা। পারিবারিক কলহ, মানসিক অবসাদ ও শিল্পীসত্তার সঙ্গে আসা মানসিক চাপে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। গীতা দত্তের সঙ্গে বিচ্ছেদ, প্রযোজনা সংক্রান্ত আর্থিক চাপ ও ব্যক্তিগত সংকটের মধ্য দিয়ে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

১৯৬৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে তিনি রহস্যজনকভাবে মারা যান । কেউ বলেন এটি আত্মহত্যা, কেউ বলেন ওষুধের ওভারডোজ। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যু ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক অনন্য কণ্ঠের নিঃশব্দ অবসান ঘটায়।এই প্রস্থান যেন শিল্পের প্রতি সমাজের অবহেলার এক করুণ দলিল।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা

গুরু দত্ত কখনো সরাসরি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ না করলেও তাঁর প্রতিটি ছবির ভিত ছিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তিনি বুঝতে শিখিয়েছেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কী সূক্ষ্ম রাজনীতি ঘাপটি মেরে থাকে। রাষ্ট্রের গাফিলতি, শ্রেণিবৈষম্য, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং সৃষ্টিশীলতার প্রতি সমাজের উদাসীনতা তাঁর ছবিতে প্রবলভাবে উপস্থিত।

‘প্যায়াসা’ কিংবা ‘কাগজ কে ফুল’-এ আমরা দেখি একটি প্রতিবাদী জীবনের আকুতি, যা কোনও ব্যানারের আওতায় নয়, বরং মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় সমাজে মধ্যবিত্তের হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভাঙন এসবই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রতীকী ও নাটকীয় ভঙ্গিতে।

শতবর্ষের স্মরণ: আজকের দৃষ্টিতে

২০২৫ সালে গুরু দত্তের জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করা মানে কেবল একজন পরিচালকের জন্মদিন পালন নয়—বরং এক চেতনাকে সম্মান জানানো। তাঁর চলচ্চিত্র ছিল সমাজের প্রতি দায়িত্ববান এক শিল্পীর কণ্ঠস্বর, যিনি বিনোদনের আবরণে সমাজের গভীরতম অসঙ্গতিগুলি তুলে ধরেছেন।

আজকের সময়ে যখন বাণিজ্যিকতা, দর্শকসংখ্যা আর প্রযুক্তির ঝলসানিতে ‘সত্যি’ হারিয়ে যেতে বসেছে, তখন গুরু দত্তের মত নির্মাতার প্রয়োজন আরও বেশি। তাঁর চলচ্চিত্র কেবল অতীত নয়, বরং ভবিষ্যতের পথনির্দেশ। গুরু দত্ত আমাদের শেখান—সত্যিকারের শিল্প কখনও পুরস্কার বা সাফল্যের অপেক্ষায় থাকে না, সে জন্মায় গভীর আত্মবিশ্বাস, সামাজিক চেতনা ও নান্দনিক নিষ্ঠা থেকে।

তাঁর শতবর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কখনও কখনও নিঃসঙ্গতার মধ্যেই জন্ম নেয় চিরন্তন আলো।

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word

Leave a Reply