সুদীপ দত্ত
ভোট আসছে, লোকসভা ভোট। টিভির পর্দা থেকে মেট্রো রেলের দেওয়ালে, সকালের খবরের কাগজ থেকে রাস্তার হোর্ডিং-এ অনবরত ঝলসে উঠছে নির্লজ্জ ব্যক্তিপ্রচার–‘গ্যারান্টি, মোদি গ্যারান্টি’। খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান সহ বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোতে নাকি আর ভারতবাসীর কোনও সমস্যা নেই! বিকশিত ভারত নাকি মানুষের দোরগোড়ায়! সবই মোদি ম্যাজিক!
মোদির ‘খাদ্য-গ্যারান্টি’ মানে ‘ক্ষুধার গ্যারান্টি’
দেশের জনগণের পুষ্টি, স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা নিয়ে সর্বশেষ সরকারি সমীক্ষা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে হয়েছিল ২০১৯-২১ সালে। তাতে কি আছে?
পুষ্টির দশা: ২০১৮ সালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘পোষণ অভিযান’ শুরু হয়। দাবি করা হয় দেশে শিশু, যুবতী ও গর্ভবতী মহিলাদের অপুষ্টি নির্মূল হয়ে যাবে। ৩ বছর পর ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের তিন ভাগের এক ভাগের (৩৫.৫%) উচ্চতা বাড়ছে না অপুষ্টির কারণে, পাঁচ ভাগের এক ভাগের (১৯.৩%) বাড়েনি ওজন । ১৮.৭% মহিলা আর ১৬.২% পুরুষ অপুষ্টির শিকার।
রক্তাল্পতা: মোদি সরকারের ‘অ্যানিমিয়া মুক্ত ভারত’ প্রকল্পের ফল কি? সরকারি সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২১-এর মধ্যে রক্তাল্পতায় ভোগা শিশুদের সংখ্যা ৫৮.৭% থেকে বেড়ে ৬৭.১% হয়েছে। যুবতী মেয়েদের মধ্যে এই সময়ে রক্তাল্পতার হার ৫৪.১% থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৯.১%, গর্ভধারণে সক্ষম মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫৩.১% থেকে হয়েছে ৫৭.২%। গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫০.৪% থেকে বেড়ে হয়েছে ৫২.২%। আমাদের দেশে রক্তাল্পতার হার এমনকি পাকিস্তান, বাংলাদেশের থেকেও বেশি, আর দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মোদির মডেল রাজ্য গুজরাটের ।
পরিস্থিতি পরিবর্তনে দ্রুততার সাথে কিছু পদক্ষেপ কি নিল সরকার? সরকার সিদ্ধান্ত নিল- ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের পরের ধাপের সমীক্ষায় অ্যানিমিয়ার তথ্যই প্রকাশ করা হবে না। অর্থাৎ ‘অ্যানিমিয়া মুক্ত ভারত’ নয়, ‘অ্যানিমিয়ার তথ্য মুক্ত ভারত’ই হলো মোদি গ্যারান্টি ।
অপুষ্টির কারণ: দারিদ্রের কারণেই কমেছে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিসের পক্ষ থেকে শেষ হাউসহোল্ড কনসাম্পশন সার্ভে করা হয়েছিল ২০২২ আগস্ট থেকে ২০২৩-এর জুলাই মাসের মধ্যে। তাতে দেখা যায় যে, দেশে অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে নিচের দিকে থাকা ২০% মানুষের খাওয়াদাওয়া, জামাকাপড়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাস, যাতায়াত, বিদ্যুৎ, উৎসব, বয়সকালের সঞ্চয়- এই সমস্ত কিছু মিলে মাসে খরচের ক্ষমতা গ্রামে ২,১১২ টাকা আর শহরে ৩,১৫৭ টাকা। মানে গ্রামে দিনে ৭০ টাকা আর শহরে ১০০ টাকা!
আর ইউনাইটেড নেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের রিপোর্ট আরও মারাত্মক। দেশের ২৩ কোটি (১৬% প্রায়) মানুষের গ্রামে মাসিক আয় ১,০৮৯ টাকা আর শহরে ১,২৬৮ টাকা। নিঃসন্দেহে এই সমস্ত রিপোর্ট থেকেও বাস্তব অবস্থা আরও দুর্বিষহ !
বাড়ছে ঘোষণা, কমছে খাদ্যে ভরতুকি
নির্বাচনের আগে চতুর্দিকে তুঙ্গে প্রচার, ৮০ কোটি লোককে মাসে ৫ কেজি করে চাল দেওয়ার প্রকল্প ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ (পিএমজেকেওয়াই) এনে দেবে খাদ্যের গ্যারান্টি। ভয়ানক ব্যাপার হলো ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্যে ভরতুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৫,৪১,৩৩০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২,০৫,২৫০ কোটি টাকা। নিশ্চিতভাবেই সরকারি গোডাউনে যে জমা শস্য ছিল, তাতে হাত পড়েছে আর সরকারের শস্য সঞ্চয় ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে খাদ্য মানে তো শুধু চাল, গম নয়। ন্যূনতম বেতনের হিসাব-নিকেশ করার সরকারি মাপকাঠি অনুযায়ীও অপুষ্টি রুখতে, দিনে কমপক্ষে ৪৭৫ গ্রাম চাল/গম, ৮০ গ্রাম ডাল, ২০০ গ্রাম শাক-সবজি, ১২০ গ্রাম ফল, ২০০ মিলি দুধ, ৫৫ গ্রাম চিনি/গুড়, ৪০ গ্রাম তেল আর তার সাথে নিয়মিত খেতে হবে মাছ, মাংস ও ডিম। ক্রাইসিল সংস্থার সার্ভে অনুযায়ী ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে দিনে একবার আমিষ খাবার খেতে খরচ হতো ৬৭ টাকার একটু বেশি। যদি ৩০ দিন দু’বেলা করে খেতে হয়, তাহলে খরচ হবে মাথাপিছু ৪,০২০ টাকা। ৫ কেজি চালের সরকারি দাম ১০০-১২৫ টাকা, অর্থাৎ পাওয়া যাচ্ছে দিনে ৪ টাকার ভরতুকি। সহজ হিসাবেই বোঝা যায় ‘মোদি গ্যারান্টি’ দিয়ে খাদ্য সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
রান্নার গ্যাস কেনাও দায়! কাঁচা আনাজ, শাক-সবজির পরে আসে রান্নার গ্যাস কেনা। ‘প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা’ দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, দেশে আর কোনও ঘরে রান্নার গ্যাসের সমস্যা নেই। একটা আরটিআই’র তথ্যে প্রকাশিত হয় যে, ২০২২-২৩ সালে ৯.৫৮ কোটি উজ্জ্বলা যোজনা পরিবারের মধ্যে ১.৮ কোটি বছরে একবারও গ্যাস ভরাননি, ১.৫১ কোটি পরিবার ভরিয়েছেন মাত্র ১ বার। পরিষ্কার যে রান্নার গ্যাসের আকাশছোঁয়া দামই হলো আসলে মোদি গ্যারান্টি ।
স্বাস্থ্যের হাল বেহাল মোদি জমানায়
মোদি সরকারের বিশ্বগুরু নাটকের অশ্লীল প্রচারের মাঝে শুধু ফুটে উঠেছিল কোভিড মহামারীর সময়ে দেশের প্রকৃত চিত্র। দেশজুড়ে মৃত্যু মিছিল, হাসপাতালে অক্সিজেন, বেড, ভেন্টিলেটরের হাহাকার।সাড়ে পাঁচ লক্ষ নাগরিকের মৃত্যু, গঙ্গার বুকে ভেসে বেড়ানো লাশের সারি আর মোদিজির থালা বাজানো, বাতি নেভানো – মোদির চিকিৎসা প্রণালী।
স্বাস্থ্যে দেশের দশা কী? আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকারি স্বাস্থ্য বাজেট ভয়ানকভাবে কম, জিডিপি’র ০.৩০%। উন্নত দেশ যেমন ফ্রান্সে তা ১১.৩%, ব্রিটেনে ১০%, এমনকি উন্নয়নশীল দেশ ব্রাজিলে ৯.৫%, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮.৩% ব্যয় হয় স্বাস্থ্য খাতে। ২০১৭ সালে মোদি সরকার দাবি করেছিল স্বাস্থ্য খাতে সরকারি খরচা জিডিপি’র ২.৫% করা হবে দ্রুত। এটা আর একটা মোদি জুমলার নিদর্শন।
চিকিৎসার খরচ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে দারিদ্রের দিকে
২০২২ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের দেশে স্বাস্থ্য বাবদ মোট খরচ হয় ৫,৪০,২৪৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ধরা রয়েছে পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি, ওষুধ, ডাক্তার, নার্স সহ সমস্ত খরচের হিসাব। এই বিপুল খরচের ৫৩% সরাসরি বহন করতে হয় আপনাকে, আমাকে, নিজেদের পকেট থেকেই। আর তার ফলে প্রতি বছর ৫.৫ কোটি ভারতীয় শুধুমাত্র চিকিৎসায় খরচ করতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। ২০১৯ সালে ভারতীয়দের মাসিক খরচের ৫৫% চলে গেছে শুধুমাত্র চিকিৎসা খাতে !
কি হাল মোদি জমানায় সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর? মোদি সরকার দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা ওষুধ কোম্পানির পক্ষ থেকে বিজেপি’র পকেটে জমা হওয়া।
অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৮ সালে মোদি সরকার ঘোষণা করে ‘আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য প্রকল্প’। তারপরে গ্রামীণ স্বাস্থ্যের কী দশা? উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র হলো প্রাথমিক চিকিৎসার প্রথম ধাপ। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন ধাত্রী, একজন করে মহিলা ও পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা। কিন্তু গোটা দেশে প্রায় ৫০% উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই সংখ্যক কর্মী নেই। উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরের ধাপ হলো প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, যেখানে সেন্টার পিছু কমপক্ষে একজন ডাক্তার থাকার কথা। এক্ষেত্রেও কর্মী ঘাটতিতে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গে ঘাটতি রয়েছে ৫৮% কেন্দ্রে, উত্তর প্রদেশে ঘাটতি ৫১% কেন্দ্রে। সমস্ত ক্ষেত্রেই এমনকি ২০০৫ সালের থেকেও কর্মী সঙ্কোচন করা হয়েছে। ৪ টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র মিলে একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে কমপক্ষে ৪ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার কথা। সেক্ষেত্রেও গোটা দেশজুড়ে কোনও রাজ্যে ৪৩%, কোনও রাজ্যে ৫২%, এমনকি কোথাও ৯৪% ঘাটতি রয়েছে।
২০২১ সালের কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার সংখ্যার গড় ঘাটতি দেশজুড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০%। এটা ২০০৫ সালে ছিল ৪৫%। দেশের জনসংখ্যার ৬৮.৮% মানুষ গ্রামে থাকেন, আর সেখানে মাত্র ২৭% ক্ষেত্রে ডাক্তার পাওয়া যায়। মোদি সরকারের গ্যারান্টি ছিল প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনার মাধ্যমে দেশ জুড়ে ২২ টি নতুন এইমস করার। কিন্তু ১০ বছরের মোদি রাজের পরে দেশে ৭ টি এইমস কার্যকরীভাবে চলছে, যার সবকটিই এই বিজেপি সরকারের আগের আমলে তৈরি। এই ১০ বছরে কার্যত একটি এইমসও নতুন করে তৈরি হয়নি। ফলে মোদি গ্যারান্টি মানে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার গ্যারান্টি।
আয়ুষ্মান ভারত প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা: প্রাইভেট কোম্পানিকে স্বাস্থ্যখাতে টাকা চালান করার সবেচেয়ে ভালো বন্দোবস্ত এই প্রকল্প। আয়ুষ্মান ভারতই হোক বা স্বাস্থ্যসাথী– সমস্ত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের মূল কথা হলো, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করার জন্য সরকার টাকা দেবে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম টাকা বিনিয়োগ করে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করবে না! উলটোদিকে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ সরকারি হাসপাতাল থেকে গড়ে ৭ গুণ বেশি। তাও সবাই কি সুবিধা পাচ্ছে? সরকারি হিসাব অনুযায়ী গ্রামের ৮৬% লোক ও শহরের ৮০% লোক কোনও ধরনের স্বাস্থ্যবিমাতে নথিভুক্তই নন। তার ওপরে রয়েছে দুর্নীতি। এক সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে দেখা গেছে, একটি ফোন নাম্বার দেখিয়ে ৭.৫ লক্ষ ব্যক্তির নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং এই ৭.৫ লক্ষ ব্যক্তির নামেই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এই প্রকল্প থেকে টাকা তোলা হয়েছে। এ হলো সরকারি ছত্রছায়ায় লুটের রাজ তৈরির গ্যারান্টি।
সরকারি হিসাবে আমাদের দেশে প্রতি হাজারে ৩৫ টি শিশু জন্মের সময় মারা যায়, চিকিৎসার অভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সে হারিয়ে যায় আরও ৪২টি প্রাণ। আর শুধু কোভিডের সময়ে বিজেপি-কে শয়ে শয়ে কোটি টাকা নির্বাচন বন্ডে চাঁদা দেওয়া ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা হয়েছে আকাশছোঁয়া। এদের মোট সম্পত্তি ৪.৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রাণের বিনিময়ে লুটের গ্যারান্টি, মোদি গ্যারান্টি।
সকল ভারতবাসীর আবাস থাকার গ্যারান্টি গেল কোথায়
২০১৪ সালে সরকারে এসেই মোদিজী ঘোষণা করেছিলেন ২০২২ সালের মধ্যে সব ভারতবাসীর থাকবে নিজস্ব বাড়ি। পুরানো ইন্দিরা আবাস যোজনাকে নতুন নাম দিয়ে ঘোষণা করা হলো ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’ (রুরাল ও আরবান) প্রকল্প । লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলো যে, শহরে ১.১২ কোটি ও গ্রামে ২.৯৪ কোটি আবাস বানানো হবে । ২০২২ সালে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় ২০২৪ পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে এই প্রকল্পের। শেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ এর মার্চ মাস পর্যন্ত শহরে ১.১২ কোটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ৩২ লক্ষ ঘরের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, গ্রামে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এখনো কাজই শুরু হয়নি ৩৬ লক্ষ ঘরের ।
আরও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়ছিল ২০১১ সালের আর্থ-সামাজিক জনগণনা অনুযায়ী। শহরে আবাসের চাহিদা ২০১২ সালে যা ছিল তার থেকে ১৫৯% বেড়ে ২০১৮ সালে হয়েছে ২.৯ কোটি। যদি সঠিকভাবে গণনা করা যায়, ২০২০ সালে শহরে ঘরের চাহিদা হওয়া উচিত ৫ কোটির বেশি, অর্থাৎ শহরে ৫০% লোকেরই নিজস্ব বাড়িঘর নেই। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হাউসিং ও ল্যান্ড রাইট নেটওয়ার্কের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৭.৫ কোটি লোক শহরে অস্থায়ী বন্দোবস্তে থাকেন।
দুর্নীতি আর স্বজনপোষণ প্রকল্পগুলোতে
এর ওপরে রয়েছে দুর্নীতি। গ্রামীণ বিকাশ ও পঞ্চায়েতি রাজ বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আবাস যোজনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়ি পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে হয় বা রাজনৈতিক দলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো পশ্চিমবঙ্গের আবাস যোজনা, যাকে তৃণমূল কংগ্রেস ভোট লুটের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। যে বিপিএল তালিকাভুক্তদের ঘরগুলো তৈরি হচ্ছে তার প্রায় ৫০%-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তিপিছু বরাদ্দ জায়গা ৬০ স্কোয়ার ফুটেরও কম। নেই বিবাহিতদের জন্য আলাদা ঘর। ৫০% আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের জন্য বানানো ঘরে আদপেই পাকা ছাদ নেই। ২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী দেশের ৪৫.৬ কোটি লোক পরিযায়ী হিসাবে কাজ করছেন। কোভিড মহামারী গোটা পৃথিবীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এদের ভয়াবহ অবস্থা। এদের না আছে নিজের ঘর, আর না আছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঘর চাওয়ার জন্য কোনও প্রকল্প।
ঘর কেড়ে নেওয়ার গ্যারান্টি
হাউজিং ও ল্যান্ড রাইট নেটওয়ার্কের রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে শুধুমাত্র ২০২৩ সালে সরকারিভাবে ১,০৭,৪৪৯টি বাড়ি ভেঙে দিয়ে ৫,১৫,৭৫২ জন লোককে উচ্ছেদ করা হয়েছে বস্তি পরিষ্কার বা সৌন্দর্যায়নের নামে। প্রতিদিন ২৫৮টি বাড়ি ভাঙা হয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় ৫৮ জন ব্যক্তি ঘর হারিয়েছেন। দেশে প্রায় ১.৭ কোটি লোক প্রতি মুহুর্তে উচ্ছেদের ভয়ে দিন কাটান। ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য ঘর ভেঙে ফেলা হয় বহু মানুষের । নৃশংস বুলডোজার রাজ হলো– ঘর কেড়ে নেওয়ার মোদি গ্যারান্টি।
খাদ্য, স্বাস্থ্য বা বাসস্থান, যেকোনও ক্ষেত্রেই এই যে সমস্ত প্রকল্পগুলো, সবই চলছে কিন্তু জনগণের করের টাকায়। দেশের ১% অতি ধনী দেশের ৪০%-এর বেশি সম্পদের মালিক, অথচ দেশের ৫০% গরিব লোক মোট জিএসটি’র ৬৫% বোঝা বহন করে। তথ্য দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে প্রচারের বহু আতশবাজি সত্ত্বেও এই প্রকল্পগুলো জনগণের দুর্দশার সমাধান করতে পারছে না। বাড়ছে অসাম্য, বেকারি, জিনিসপত্রের দাম, কমছে আয় আর লড়াইয়ের অধিকার । জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সামাজিক পরিকাঠামো, প্রতিষ্ঠান, ব্যবস্থা আর অধিকারমূলক আইনের নির্মাণ । যার প্রেক্ষাপট রাজনৈতিক ভাবে যৌথ অধিকারের ভিত্তি ও লড়াইয়ের পরিবেশ বাঁচিয়ে রেখেছিল।
নয়া-উদারবাদের সঙ্কটের এই সময়ে রাষ্ট্র সরাসরি ব্যক্তিকে সাহায্য দেওয়ার প্রকল্প চালাচ্ছে, যা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী করে, অধিকারকে করুণায় রূপান্তরিত করে, আর সামগ্রিক সমাজের ধারণাকে নস্যাৎ করে। এই প্রকল্পগুলির পাশাপাশি কর্পোরেটকে অবাধ লুট ও শ্রম আইন সংক্রান্ত সকল বিধি তুলে দেওয়ার আর শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি নির্ভর করে ফেলার গ্যারান্টিই হলো মোদি গ্যারান্টি। আর তাই, গ্যারান্টিতে লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ হলেও মানুষের জীবনের কোনও মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়নি। সমস্ত গ্যারান্টিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ মোদি সরকার। মূল্যবৃদ্ধির চাপে জীবন দুর্বিষহ হয়েছে সাধারণ মানুষের। এই সময়ে বেঁচে থাকার একমাত্র গ্যারান্টি হলো জনগণের ঐক্যবদ্ধভাবে নয়া উদারবাদী নীতি বদলের লড়াই, এই সরকার, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই– আসছে নির্বাচনে আর তার পরেও।