Gender Discrimination : A Construction of Thought – Didithi Roy

এবছর আমরা শ্রমজীবী নারী দিবস “উদযাপন” করতে চলেছি সন্দেশখালির ঘটনার আবহের মধ্যে। ফেসবুকে নিউজ ফিড স্ক্রল করতে করতে ভেসে ওঠে ৮ ই মার্চ বিউটি প্রোডাক্টস এ ১০% ছাড়। ফোনে মেসেজ আসে জুতোর কোম্পানি প্রদত্ত বিশেষ অফার কেবল মহিলাদের জন্যই। সুইগি, জোমাটো থেকে শুরু করে রাস্তার চারদিকে হোর্ডিং-এ মহিলাদের জন্য আকর্ষণীয় নানা অফার – যেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’! আমাদের এই প্রজন্মের চোখে, মগজে, মননে নির্মীত হয়েছে অরাজনৈতিক “ওমেন্স ডে” ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার পিছনের ইতিহাস, লড়াই, আন্দোলনকে। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস নানা বিনির্মানের সারণি বেয়ে হয়ে উঠেছে ” নারী দিবস”।


তাই আজকের দিনে মূল আলোচনায় আসার আগে আমাদের এই দিনের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে ঐতিহাসিক দায়িত্ববোধ থেকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কাজের ঘন্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে রাষ্ট্রের লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন।সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সোশ্যালিস্ট পার্টিরা। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।সেখান থেকে এই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস এর পথ চলা শুরু।
পৃথিবীর আদিমতম শ্রম বিভাজন হয়েছিল লিঙ্গভিত্তিক। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি লিঙ্গবৈষম্য এর মাত্রা। পুঁজিবাদী স্তরে মুনাফাকে আরো শক্তিশালী করতে শ্রমের আরো বিষয়ভিত্তিক বিভাজন ঘটেছে। তার সাথে শিক্ষার যোগাযোগ ওতপ্রত। তাই শ্রম বিভাজনের উপযোগী কম মাইনের দক্ষ শ্রমিক তৈরী করতেই স্পেশালাইজেশন এসেছে নানা কোর্সে। যার সাথে সাথেই লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের সুনিবিড় সুতীব্র যোগাযোগ।


বর্তমানে শিক্ষানীতি তৈরী হয় শাসকের পক্ষে জনমত তৈরীর জন্য। তাই বিজেপি আরো নির্দিষ্ট করে বললে আর এস এস পরিচালিত কেন্দ্রের সরকার নিজেদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে জোরদার করতে, দেশের আগামী ভবিষ্যতদের মগজে নিজেদের মতাদর্শকে প্রোথিত করতেই নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে এসেছে। এই শিক্ষানীতি শিক্ষার বেসরকারিকরণ এবং সাম্প্রদায়িকীকরনের ব্লু প্রিন্ট।
আমরা এই শিক্ষানীতি ২০২০ কে যদি “জেন্ডার লেন্স” এর তলায় রেখে বিচার করি তাহলে কয়েকটা বিষয় উঠে আসবে।আর এস এস এর ওয়েবসাইট কেউ যদি চেক করে তাহলে বোঝা যাবে, একজন মহিলাও আর এস এস এর সদস্য হতে পারে না। তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি- এই সংগঠনের মূল স্লোগান হল “মাতৃত্ব, কর্তব্য, নেতৃত্ব”। অর্থাৎ মহিলাদের প্রথম কাজই হল মা হওয়া এবং তার সাথে সাথেই ঘরের কাজ করা। মোহন ভাগবত এর মত সরসঙ্ঘচালকরা নাগপুরে বসে শুধু শুধু বলে দেননা মহিলারা ঘরের অন্দরমহলে থাক। এর পিছনে এদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তারা প্রথম থেকেই নারীবিদ্বেষী। এবং মনুসংহিতাকে তারা মূল প্রতিপাদ্য হিসাবে প্রচার করতে চায়।তাই বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সমর্থনে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে এবং মহিলাদের অজ্ঞান করে ধর্ষণ করে বা কবর থেকে তুলে এনে মৃত মহিলাকে ধর্ষণ করার হুমকি দেয়। এখান থেকেই স্পষ্টত বোঝা যায় আর এস এস এর মহিলাদের সম্পর্কে ভাবধারা। আলোচ্য শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে বিজেপি এবং আরো পরিষ্কার করে বললে আর এস এস লিঙ্গবৈষম্যকেই প্রকট করতে চায় ,পুরুষতান্ত্রিকতাকেই বৈধতা দিতে চায়। যতই আর এস এস -বিজেপি প্রচার করুক এই শিক্ষানীতি আসলে ছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা করছে,কিন্তু আসলে এই শিক্ষানীতি ছাত্রী এবং এলজিবিটিকিউআইএ প্লাস কমিউনিটির স্টুডেন্টদের এক্সক্লুড করতে চাইছে।


NEP ২০২০ এর মূল যে স্কুল ক্লাস্টার গড়ে তোলার বিষয় তার ফলে চার পাঁচটা স্কুল তুলে দিয়ে তার বদলে একটা স্কুল তৈরী হবে। অতীতের শিক্ষানীতি গুলোর যে ব্লক ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো ছিলো তাতে প্রায় প্রতি ছাত্রছাত্রীর বাসস্থানের ১-১.৫ কিমি ব্যাসার্ধেই স্কুল ছিল। কিন্তু এই ক্লাস্টারের ফলে স্কুলের দূরত্ব যেভাবে বাড়বে তার ফলশ্রুতিতে ব্যাপক হারে ড্রপ আউট হবে। এবং এর সরাসরি প্রভাব পরবে ছাত্রী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ছাত্রদের উপর।
গত অন্তর্বর্তীকালীন বাজেটে শিক্ষাখাতে যেভাবে বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে, এবং শিক্ষানীতি শিক্ষায় যেভাবে সরাসরি প্রাইভেট ফিলানথ্রপিক ইনভেস্টরদের বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে তাতে শিক্ষা আরো এক্সক্লুসিভ হয়ে উঠছে। এবং সমীক্ষা বলছে, অভিভাবকদের মধ্যে মেয়েদের সরকারি স্কুলে এবং ছেলেদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করার প্রবণতা বাড়ছে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার বদলে গজিয়ে উঠছে টিচ ফর ইন্ডিয়ার মত এন জি ও বেসড বিভিন্ন সেন্টার। সামগ্রিক দেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এইভাবে সরকারি বরাদ্দ কমার জন্য এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার জন্য দলিত, আদিবাসী ছাত্রদের ব্যাপক ড্রপআউট যার মূল অংশই ছাত্রীরা। ২০১৮ সালে NCPCR রিপোর্টে উঠে এসেছিল মোট ছাত্রীসংখ্যার ৩৯.৪% ছাত্রীরা শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরে। মাধ্যমিকের পর ৫৭% ছাত্রীরা আর পড়ালেখা করে না। লকডাউনের পর প্রায় ১০ মিলিয়ন ছাত্রীরা ড্রপ আউটের শিকার।
শুধুমাত্র ড্রপ আউট না। শিক্ষানীতির কোথাও নেই ক্যাম্পাসে জেন্ডার হ্যারাসমেন্ট এর অভিযোগ জানানোর সেল চালু করার কথা। নেই লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক কোনো পরিকল্পনা।


আর এস এস মূল আক্রমণ করেছে শিক্ষার সিলেবাসে। যার ফলে ইতিহাস কে নিজেদের মত বিকৃত করেছে, বিজ্ঞানের বদলে গল্পগাথাকে পড়াতে চাইছে। সাহিত্য,ইতিহাস বিকৃতি,বিজ্ঞানের বিনির্মাণ এসবের মধ্য দিয়ে নারীবিদ্বেষ কে ছড়ানো হচ্ছে।
এবং এর পাশাপাশি এক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরীতে সাহায্য করে আমাদের চারপাশের বিজ্ঞাপন, সিনেমা,পোস্টার। নয়া উদারনীতির পরবর্তী সময়ে মহিলাদের পণ্যায়িত করা হয়েছে। আপাতভাবে বলিউড আমাদের দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের বিনোদনের মাধ্যম যেখানে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ হয়। সেই বলিউডে আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি নানা সিনেমাতে মহিলাদের “সত্ত্বা” নির্মাণ… একজন নারীর “ভদ্রতা” র মাপকাঠি নির্ধারিত হতে। অন্যতম ভাইরাল হওয়া এক বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছিল,ট্রাফিকের রেড সিগন্যালে একজন জনপ্রিয় মহিলা অভিনেতার মুখের অভিব্যক্তি যা আসলে মহিলাদের অবজেক্টিফাই করা। সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘জওয়ান’ সিনেমাতে দেখানো হয়েছে পাঁচজন মহিলার একটি গ্রুপের ক্যাপ্টেন শাহরুখ খান। অর্থাৎ মহিলাদের লড়াইয়ে তাদের ইস্যুকে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য একজন পুরুষ ক্যাপ্টেনকেই দরকার-কোথাও এই ধারণাকে প্রোথিত করার জন্যই এই দৃশ্যায়ন কি? ১০০০ জন মহিলার সাথে একা ‘পুরুষ’ হিসাবে শাহরুখ খানের নাচে, একজন পুরুষের ১০০০ জন নারীকে ‘কন্ট্রোল’ করার বার্তা পৌঁছাচ্ছে না তো প্যান ইন্ডিয়ার কাছে? আসলে এটা শাহরুখ খান করেনি,এটা ১০০০ জন মহিলাও করেনি,করেছে পুঁজি।


এনিমাল বা কবীর সিং সিনেমাতে যেভাবে উগ্র পুরুষত্ব তুলে ধরা হয়েছে তা আর এস এস এর আদর্শ পুরুষ এর চেয়ে খুব আলাদা নয়। আসলে আমাদের চোখের সামনে যা দেখানো হয়,কানে যা শোনানো হয় তার অভিঘাত আমাদের অবচেতনে প্রতিফলিত হয়। তা থেকে বৌদ্ধিক চেতনা নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে যেমন নারীবিদ্বেষী মনোভাব ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সচেতনভাবেই নির্মাণ হচ্ছে। এবং জাতীয় শিক্ষানীতি লাগু হওয়ার পরবর্তী সিলেবাস, বিজেপির শাসনকালে নানা গণমাধ্যমের নানা বিজ্ঞাপন আমাদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকেই প্রকট করতে চায়। তাই ৮ ই মার্চ হয়ে ওঠে শুধুমাত্র একটা “সেলিব্রেশন” এর দিন। এর পিছনে ক্লারা জেটকিনের সংগ্রামকে লঘু করে দেওয়া হয় বা প্রয়োজন পড়লে উহ্য করে দেওয়াও হয়।
চন্দ্রযানের চাঁদের মাটিতে সফল অবতরণের সময় ইসরোর যে ছবি গুলো বাইরে এসেছিল,তাতে বেশ কিছু ছবিতে মহিলা বিজ্ঞানীদের শাড়ি পরে দেখা গেছিল। বিজেপি প্রচার করেছিল এরাই আসল “নারীবাদী”, যারা সনাতনী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এটাই আসলে আর এস এস। যারা মহিলাদের পোষাকের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট জাতির বা ধর্মের মূল্যবোধকে প্রদর্শিত করতে চায়। এই সবই আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফসল।


আর এস এস মহিলাদের জন্য কেবল ঘরের অন্দরমহল টুকুই বরাদ্দ করতে চায়।নানা কাজকে পারিশ্রমিকের বদলে স্নেহ, কর্তব্য এর আবডালে মুড়ে দিতে চায়। আর এর উল্টোদিকে সোভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক বিকল্পে আমরা পড়েছি মহিলাদের এমপাওরড করার জন্য ক্রেশ, রেশনিং ব্যবস্থা। মহিলাদের পন্যায়ন রুখতে কঠোর নীতি প্রণয়ন। এই সবকটির সাথে যুক্ত আছে ক্রুপস্কায়া,কলোন্তাই দের নাম। আমাদের লড়াই আন্দোলনের সংগ্রামী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও খুবই অবাক করা বিষয় , আমাদের বামপন্থী ইকোসিস্টেমে কলকাতা জেলা বা অন্য কোনো জায়গায় ছাত্রীরা বা যুবতীরা বা মহিলারা সহজাত নেতৃত্ব হিসাবে যখন নির্বাচিত হয়, তখন এর বাইরের বুর্জোয়া সমাজমাধ্যম প্রচার করতে চায় এই প্রথম ছাত্রীরা, যুবতীরা, মহিলারা নেতৃত্ব দেবে সংগঠনকে। অথচ আমাদের ইতিহাস শুরুই হয় ক্লারা জেটকিন থেকে কল্পনা যোশী হয়ে যা আগামীতে নিরন্তর বহমান।
২০২৪ এ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস এর মূল থিম “Invest in women: Accelerate progress”. এই ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ শুধুমাত্র পুঁজির অঙ্কে হওয়া উচিত না, উচিত বৌদ্ধিক বিনিয়োগ – যা নির্মান করবে একজন সম্পুর্ণ মানুষকে। তাই দিনের শেষে রেমন্ডসের ট্যাগলাইনে ” বি আ কম্পলিট ম্যান” এর বদলে হওয়া উচিত “বি আ কমপ্লিট হিউম্যান বিইং”!
আর সেই কম্পলিট হিউম্যান বিইং হয়ে ওঠার লড়াই চলুক মতাদর্শে শাণিত হয়ে,লড়াই চলুক সরাসরি রাস্তায়।

Spread the word

Leave a Reply