Site icon CPI(M)

GDP & Emplyoment- The Reality

GDP Cover

অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত

‘…আধুনিক অর্থনীতি এই সত্য বিস্মৃত হয়েছে যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাধারণ পরিমাপক, গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি), নিছক অর্থনীতির আকার পরিমাপ করে এবং এই পরিমাপকে দেশের জীবনযাত্রার মানের কোনও প্রতিফলন হয় না।…স্বল্প মেয়াদী অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পরিমাপের জন্য জিডিপি জরুরি হলেও, জাতীয় উন্নতির সূচক হিসেবে এটি একেবারেই ত্রুটিপূর্ণ’।

এই অবধি পড়ে নিশ্চয়ই অনেকেই গজ গজ করছেন – “আবার সেই বাম-মার্কা আবোল তাবোল কথা ? এইরকম আবোল তাবোল বলেই তো বামেরা শূন্য !” ঠিকই তো, এমন কথা কারোর আবোল তাবোল লাগলে দোষ দেওয়া যায় না। অষ্টপ্রহর যেখানে সকল সংবাদমাধ্যম দেশের অর্থনীতির নাড়ি দেখছে জিডিপি দিয়ে, যেখানে নয়া দিল্লির উনিজি এবং কলকাতার ইনিজি রীতিমত আম্বানি আর গোয়েঙ্কার সামনে বুক চাপড়ে কে কত জিডিপি বাড়িয়েছেন তা বলতে পারেন তার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, সেখানে এমন কথা তো আবোল তাবোলই। সমস্যা হল, উপরের কথাটি কোনও বামপন্থী পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। এটি হাভার্ড বিজনেস রিভিউ-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের অংশ।

পশ্চিমে জিডিপি নিয়ে একটি সংশয় মধ্য বিংশ শতকেই শুরু হয়েছিল। মার্কিন দেশে এই প্রসঙ্গে রবার্ট কেনেডির ১৯৬৮ সালে ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ভাষণ তো এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে মাঝখানে নব্য-উদারনীতির বিজয়ল্লাস ও ওয়াশিংটন কন্সেনসাস-এর প্রবল দুন্দুভি এই সংশয়কে চাপা দিয়ে দিয়েছিল। ২০০৮-৯-এর অর্থনৈতিক সংকট এই সংশয়কে ফিরিয়ে আনা প্রবল বেগে। এর পর থেকেই অর্থনীতির পরিমাপক হিসেবে জিডিপি ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই বিতর্কটি মূলধারার আলোচনায় প্রবেশ করেছে পৃথিবীর সর্বত্র।

অধিকাংশ অগ্রগামী অর্থনীতিতে এই বিতর্ক ক্রমশঃ জোরালো হলেও এখনও ভারতে গণ-আলোচনায় এর কোনও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এর একটি কারণ হয়ত ২০০৮-৯-এর সংকট আমাদের দেশ তৎকালীন অর্থনৈতিক নীতির কারণে সসম্মানেই উৎরে গেছিল। কারণ যাই-ই হোক, জিডিপি বৃদ্ধি আদৌ দেশের উন্নতি মাপার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সূচক কিনা এই বিতর্কের অভাব এখন আমরা টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। এরই সুযোগ নিয়েই একদিকে নয়া দিল্লিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুক ঠুকে ৮.৪% জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করছেন এবং কলকাতায় মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী গ্লোবাল বিজনেস সামিটে মুকেশ আম্বানি আর সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সামনে ৮%-এর অধিক জিডিপি বৃদ্ধির খতিয়ান দিচ্ছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অর্থনীতির উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে মানুষের মনে ‘জিডিপি’ এত গভীরে প্রবেশ করে গেছে, যে এই খতিয়ানকে অনেকেই যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে গ্রহণও করছেন। এই গ্রহণযোগ্যতাকে চূর্ণ করা ভীষণ জরুরি।

এই চূর্ণ করার হাতিয়ার কিন্তু রয়েছে সরকারি বা সরকার স্বীকৃত বিবিধ পরিসংখ্যানের মধ্যেই। জিডিপি নিয়ে নয়া দিল্লি আর কলকাতার লম্ফঝম্প করলেও এই কথা তাঁরা কেউই উল্লেখ করছেন না, যে অর্থনীতির কতগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ সূচকে তাঁদের এই জিডিপি বৃদ্ধির কোনও প্রভাব দেখা যায়নি। তার মধ্যে অন্যতম হল বেকারত্ব। CMIE বা Center for Monitoring Indian Economy-এর তথ্য অনুসারে দেশে গত ডিসেম্বরে বেকারত্বের পরিসংখ্যান ছিল প্রায় ৮.৩%। সরকার অতিমারির দোহাই দিলেও পরিসংখ্যানে স্পষ্ট এমনকি ২০১৮ সালে, যখন অতিমারি ছিল না তখনও বেকারত্ব, বিশেষ করে যুব বেকারত্ব আকাশ ছুঁয়েছিল। বিগত এক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।

২০১২ সালে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ১৯.২% এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ২১.৩%। এও যথেষ্ট বেশিই ছিল। কিন্তু বেশি ছিল বলেই তো শিক্ষিত বেকাররা যাঁরা রাজ্যে ‘ডবল ডবল চাকরি হবে’ বলেন অথবা বছরে ২ কোটি চাকরির ‘মোদি কা গ্যারেন্টি’ বলে বাজখাই গলায় জনসভায় ভাষণ দেন তাঁদের বিশ্বাস করে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁরা কি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন ? সরকারী পরিসংখ্যান বলছে, আদৌ করেননি। এখন দাঁড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ৩৫.৮% আর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার স্পর্শ করেছে প্রায় ৩৬.২%। এ যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বেড়াল আর মাংসের গল্প। সত্যজিৎ রায় কর্তৃক অনুদিত সেই অনবদ্য গল্পটিতে নাসিরুদ্দিন গিন্নিকে প্রশ্ন করেছিলেন – ‘এটা যদি বেড়াল হয়, তাহলে মাংসটা কোথায় ?’। আমাদের সরকারকে একই সুরে প্রশ্ন করতে হবে – ‘এটা যদি অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয় মশাই, তাহলে চাকরিটা কোথায় ?’   

আসলে চাকরিটা হবে কোথায় ? Centre for Economic Data and Analysis (CEDA)-এর পরিসংখ্যান বলছে ২০২০-২১ সালে শিল্প ক্ষেত্রে চাকরির পরিমাণ বিগত পাঁচ বছরের অর্ধেক হয়ে গেছে। এর একটা কারণ অবশ্যই অতিমারি। কিন্তু অতিমারি কেটে গেলেও এই ক্ষেত্রে কোনও উন্নতি হয়নি। কারণ সরকারী সাহায্য আর ভর্তুকি মুলতঃ চালিত হয়েছে সরকারের নির্বাচিত স্বল্প সংখ্যাক পুঁজিপতিদের উদ্যোগের সমর্থনে। প্রথমে নোটবাতিল, পরে জিএসটি এবং সবশেষে অতিমারির ধাক্কা সামলাতে না পেরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাই লক্ষ লক্ষ শ্রমিক যারা অতিমারির সময় গ্রামে ফিরে গেছিলেন, তারা সেখানেই থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন এবং এখন তারা অনেকেই গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ চাইছেন, আসলে বাঁচতে চাইছেন। আশঙ্কাজনক হল, ভারতের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান আগের চাইতে বেশি হয়েছে। একই পর্বে পাল্লা দিয়ে কমেছে অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান। শুধু অর্থমূল্যের বিচারে নয়, বহুজনের কর্মসংস্থানমুখী শ্রমনিবিড়তার কারনেও। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এই যে, শিল্পায়নের মাধ্যমে, বিশেষ করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উপর ভর করেই একটি উন্নত অর্থনীতিতে নাগরিকদের জন্য ব্যাপক সংখ্যায় কৃষি বহির্ভূত কাজের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভারত সেই পথ থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। অর্থনীতির আরেক ক্ষেত্র, যা একুশ শতকের শুরুতে ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে ভয়ংকর গুরুত্ব রাখত এবং এখনও রাখে, সেই পরিষেবা ক্ষেত্রও কার্যত ধুঁকছে। সেখানেও সংকোচন ও ছাঁটাই অব্যহত। যদিও এই ক্ষেত্র চাঙ্গা হলেও ভারতের বিপুল সংখ্যক নিম্নবিত্ত মানুষের কোনও লাভ নেই। তাদের উন্নতি একমাত্র সম্ভব মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পদ্যোগের বিকাশের মাধ্যমে, যা নিয়ে কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারেরই কোনও মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না। ঠিক, মাঝে মধ্যে এই বিষয়ে তাঁরা ভাষণ দিয়ে থাকেন – কিন্তু ‘Action speaks lowder than words’। আমরা এই কারণেই দেখি যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পুঁজি-নিবিড় (Capital-Intensive) শিল্পের পেছনে সরকার খরচ করে– হয় ভর্তুকির মাধ্যমে নয়তো কর ছাড়ের মাধ্যমে, তার ভগ্নাংশও মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পদ্যোগের উন্নতিতে ব্যয় করা হয় না। এর ফলাফল হয় এই, খাতায় কলমে জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হয় না। এই পরিস্থিতি অনেকটা দশজনের মোট আয়ের হিসাবে একজনের আয় বেড়ে যাওয়ায় সকলের গড় আয় বেড়ে যাওয়ার মতো। এমন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দ্বারা লাভবান হতে থাকে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু শ্রেণি আর সিংহভাগ সংখ্যক জিডিপি আসলে কি সেসব কার্যত না জানা মানুষকে ভোলানোর চেষ্টা হয় পরিসংখ্যানগত কারসাজির মাধ্যমে।

এমন নয় যে জিডিপির কোনও গুরুত্ব নেই, আছে। কিন্তু জিডিপি অর্থনীতির বহু সূচকের মধ্যে একটি সূচক মাত্র– তা দ্বারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জটিল চিত্রের ধারণা সহজে লাভ করা যায় না। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, জিডিপির হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে মানব উন্নয়নের, কল্যাণের এবং অতি অবশ্যই কর্ম-সংস্থানের প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই। অর্থনীতির কোনও একটি সুচক বাড়লেই শুধু হয় না, কিভাবে বাড়ল, অমন বৃদ্ধিতে কাদের সুবিধা হল – সেসব বিবেচনাও সমানভাবে জরুরি। এহেন বৃদ্ধির দ্বারা আদৌ মানবোন্নয়ন হচ্ছে কিনা, সমাজের কোন কোন অংশ তার দ্বারা লাভবান হচ্ছে, বৃদ্ধি থেকে কোন দিকে, কতটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এসবই গুরুতর আলোচনার বিষয়। এই দেশের ও রাজ্যের অধিকাংশ সূচকেই স্পষ্ট তথাকথিত এই কর্মসংস্থানহীন কাগুজে বৃদ্ধি উপরোক্ত কোনও বিষয়েরই উন্নতি ঘটায়নি। না এই বৃদ্ধির দ্বারা মানবোন্নয়ন হয়েছে (বাংলার ৩৪% শিশু অপুষ্টির শিকার আর দেশ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫ টি দেশের মধ্যে ১১১-তম) না সমাজের সকল অংশ লাভবান হয়েছে (দেশের ৭৭% সম্পদই ১০% উচ্চবিত্তের হাতে কেন্দ্রীভূত) না কর্মসংস্থান হয়েছে (প্রায় ২০% যুবক বেকার, গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি প্রাপ্তদের মধ্যে বেকার প্রায় ৩৫%)।

শুধুমাত্র জিডিপির বৃদ্ধির হার দেখিয়ে এই সকল বাকি পরিসংখ্যান ঢাকা দেওয়া তাই আদতে শাসককুলের একপ্রকার চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল। তাঁরা জানেন জীবনযুদ্ধে অনবরত সংগ্রামরত এই দেশের মানুষের সেই অর্থনৈতিক সাক্ষরতা নেই যে জিডিপি ঠিক কি মাপে আর কি মাপে না সেই সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা থাকবে। এই অজ্ঞানতার সুযোগই তারা নেওয়ার চেষ্টা করেন বারংবার। তাদের এই প্রচেষ্টা বামপন্থীরাই দৃঢ় ভাবে প্রতিরোধ করবেন। আর সেটা হবে সর্বত্র– পাড়ার চায়ের দোকানের আসর থেকে লোকসভার অন্দর অবধি। জিডিপি বৃদ্ধির গপ্পো যে আসলে ‘মায়াজাল’ তাকে ছিন্ন করার ক্ষমতা আর কারোর আগেও ছিল না, আজও নেই।  

Spread the word