সুজন চক্রবর্তী
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তখন নতুন নতুন ঘটনা। গণতন্ত্রের চিন্তা এগিয়ে চলেছে। শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের মধ্যে তখন উৎসাহের অন্ত নেই। মুক্তির স্বপ্ন মানুষের মনে। স্বাধীনতার শপথ রক্ষার ঘোষনা করলেন পন্ডিত নেহেরু। মধ্যরাত্রের বক্তৃতায় স্বাধীনতার লক্ষ্য হিসাবে বললেন— ‘To bring freedom and opportunity to the common man, to the peasants and workers of India; to fight and end poverty and ignorance and disease; to build up a prosperous, democratic and progressive nation, and to create social, economic and political institution which will ensure justice and fullness of life to every man and woman.’ আধুনিক ভারত গড়ে তোলার লক্ষ্যে মানুষের জীবন, অধিকার এবং ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দিলেন।
হিন্দুরাষ্ট্র নয়, আধুনিক ভারত গড়ার পূর্বশর্ত হিসাবে ঘোষিত হল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি। ঘোষিত হল মিশ্র অর্থনীতি এবং জোটনিরপেক্ষতার নীতি। নেহেরু জোর দিলেন বিজ্ঞান চেতনা প্রসারের। এগুলি সদর্থক, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘ভারতের ধারনা’ কে কার্যকরী করতে গেলে রাজনৈতিক সাম্যের ঘোষণাই যথেষ্ট নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক অসাম্যকে দূর করতে হবে। দেশের ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য তার পক্ষে মানুষের সমাবেশ ক্রমশ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু সে পথে দেশকে পরিচালিত করতে পারবে কি কংগ্রেস? তাহলে স্বাধীন ভারতকে তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে গাঁটছড়া বাধা চলবে না। একচেটিয়া পুঁজি এবং সামন্ততন্ত্রের আধিপত্য ভাঙতে হবে। পারবে কী? স্বাধীনতা সংগ্রামকে তার স্বাভাবিক পরিনতিতে নিয়ে যাবার যে ঘোষনা করা হয়েছে, তার অপারগতাই স্বাধীন ভারতে পরিচালনার নীতিতে বরাবরই কংগ্রেস এবং বাম শক্তির মধ্যে বিরোধ-বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতার পর বুর্জোয়াশ্রেণীর দ্বৈত চরিত্র প্রকাশিত হয় সাম্রাজ্যবাদের সাথে দ্বন্দ ও আঁতাতের মাধ্যমে। তারা বিদেশী একচেটিয়ার সঙ্গে জোরদার সম্পর্ক তৈরী করেছে। সামন্ততন্ত্রের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র অর্থনৈতিক বেসরকারীকরণের দাবীর প্রধান হোতা এরাই। অর্থনীতি এবং সমাজজীবনের প্রতিটিক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। আর একারণেই, বরাবরই সংগ্রামের পথে থেকে বামপন্থী শক্তি দেশের অনাগত বিপদ সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে সতর্কবার্তা দিয়েছে দেশের পরিচালকদের।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই, দেশে তখন সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যেও নানা ধরনের দোলাচল। আর.এস.এসের হাতে খুন হলেন মহাত্মা গান্ধী। বেআইনি ঘোষিত হল আর.এস.এস। পরে আবার মুচলেকা দিয়ে, বল্লভ ভাই প্যাটেলের সহায়তায় আইনি হল। তৈরী হল জনসংঘ। সর্বোচ্চ শক্তি নিয়েই বামপন্থীরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন।
অধিকারের দাবীতে কৃষক সংগ্রাম দেশের নানান প্রান্তে। সরকার তাঁদের উপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। রুখে দাঁড়ালেন বামপন্থীরা। কৃষক আন্দোলনের গতি ক্রমশ বেগবান হতে থাকলো।
দেশের অর্থনীতিতে পাঁচ সালা পরিকল্পনা, বীমা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয়করণ, রাষ্ট্রয়ত্ত শিল্প গঠনের প্রকল্প— বিভিন্ন বিতর্ক সত্ত্বেও সমর্থন দিলেন বামপন্থীরা। স্বাধীন দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করবার এই লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কখনোই সাহায্য করেনি, বরং পূর্ন শক্তি নিয়ে পাশে দাড়িয়েছে সোভিয়েত। এহেন সত্য ভুলে যাবার কোন কারণ ঘটেনি।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আমলে, কংগ্রেসের সাথে আমাদের প্রচন্ড বিরোধ। কিন্তু ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মত কর্মসূচীকে কমিউনিস্টরা পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। আবার, সত্তরের দশকে পশ্চিমবাংলায় কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জারি হল আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। সিপিআই(এম) কর্মীদের বিরুদ্ধে সীমাহীন আক্রমণ অত্যাচার, রাজ্যজুড়ে গণতন্ত্রের নিধণ । কিংবা ১৯৭৫ এর জরুরি অবস্থা। দেশজুড়ে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি করলো কেন্দ্রীয় সরকার। সাংসদরা পর্যন্ত জেলে। বিনা বিচারে আটক। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে দেশজুড়ে প্রবল বিরোধিতা। লোকসভায় সিপিআই(এম) নেতা কমরেড এ.কে গোপালন স্পষ্টতই জানিয়ে দিলেন যে গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার এবং স্বার্থরক্ষার যেকোনো সংগ্রামে পার্টি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার লড়াই চালিয়ে যাবে। “Our party considers its foremost task to awaken and organize the people against the grave peril they are facing and throw them into struggles for the withdrawal of the emergency….’