2

Freedom Struggle And The Communists: Part II

সুজন চক্রবর্তী

দেশের সংবিধান সভায় সংবিধান গৃহীত হল ১৯৪৯ এর ২৬শে নভেম্বর। কার্যকরী হলো ১৯৫০ এর ২৬শে জানুয়ারি থেকে। স্বাধীনতার পর প্রায় আড়াই বছর দেশ পরিচালিত হয়েছে বৃটিশের তৈরী করা Indian Independence Act, 1947 অনুযায়ী। পার্টি কর্মসূচীর ৩.২৭ ধারায় বলা হচ্ছে— ‘১৯৫০ সালে গৃহীত ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের সংবিধান রাষ্ট্রের জন্য একগুচ্ছ নির্দেশক নীতি প্রণয়ন করেছিল। এর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের জীবনধারনের যথাযথ উপাদান ও কাজের অধিকার, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা সম্পদকে মুষ্টিমেয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত করবে না, শিক্ষার অধিকার ও শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার সুযোগ, শ্রমিকদের জন্য জীবনধারণের উপযোগী মজুরি এবং পুরুষ ও মহিলাদের সমকাজে সম মজুরি। বাস্তবে একটি নীতিও প্রয়োগ হয় নি। সাংবিধানিক ধ্যানধারনা ও বুর্জোয়া শাসকদের মধ্যে প্রকট ফারাক স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া জমিদার ব্যবস্থাকে চুড়ান্তভাবে অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাড় করাচ্ছে।’

স্বাধীনতা পরবর্তী ‘ভারতের ধারণা’ (Idea of India) তিনটি ভিন্ন ভিন্ন চিন্তার ধারাবাহিক লড়াই এর মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে। কংগ্রেস তখন একটা মঞ্চ। তাঁদের মূল মনোভাব ছিল স্বাধীন ভারত একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে উঠবে। বামপন্থীরা এই মূল লক্ষ্যের সাথে একমত হয়েও, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করার ধারনা থেকেই সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য যুক্ত করতে চায়। এই দুটি ধারণার বিপরীতে তৃতীয় ধারণাটি মানুষের ধর্মীয় আনুগত্যের বিবেচনায় ‘ভারতের ধারনা’ পোষন করে। মুসলিম লিগের ধারনায় ইসলামিক স্টেট, আর.এস.এস এর ধারনায় হিন্দুরাষ্ট্র। তার দুর্ভাগ্যজনক পরিনতিতে দেশভাগ। ইসলামিক রাষ্ট্র হলো পাকিস্তান। কিন্তু ধর্ম তাঁকে এক জায়গায় রাখতে পারে নি। ভাষার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গঠিত হয়। আর উল্টোদিকে, যে আর.এস.এস কখনোই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, বা বৃটিশের সাথে বারে বারেই আপোষ করে এসেছে, তারা হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে বস্তুতপক্ষে দেশের স্বাধীনতা, সংবিধানের মর্মবস্তুকে বানচাল করে চলেছে।

১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হবার পরে ১৯২১ সাল থেকেই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে সোচ্চার কমিউনিস্টরা। কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীর পাশাপাশি কমিউনিস্টরা ইস্তেহার বিলি করতো। ১৯২১ সালে আহমেদাবাদ অধিবেশনে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা এম.এন.রায় চিঠি দিয়ে বললেন— ‘The congress must have the workers and peasants behind it. If the congress wants to have the nation behind it, let it not be blinded by the interest of a small class, let it not be guided by the invisible hands of the merchants and the manufacturers.’ শুধু ব্যাবসায়ী এবং উৎপাদকদের নয়, কংগ্রেসের পিছনে শ্রমিক-কৃষকের জমায়েতের গুরুত্ব বোঝালেন। এই সতর্কবার্তা কংগ্রেস কে ক্রমশ বুঝতে হয়েছে। কমিউনিস্টরা শ্রমিক, কৃষক সহ নানা অংশের মধ্যে তখন কাজ করছেন। মানুষের দাবী ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। বিশের দশকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বৃটিশের ষড়যন্ত্র মামলা শোরগোল তুলেছে। ৮বছর পর ১৯২৯ এর লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস শেষমেশ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী গ্রহন করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৩০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে বিপ্লবের উদ্দেশ্য ঘোষনাসহ ‘ড্রাফট প্ল্যাটফর্ম অফ অ্যাকশন’ গ্রহণ করে পার্টির লক্ষ্য স্পষ্ট করে। বৃটিশ সরকারকে উৎখাত এবং ব্যাঙ্ক-রেল-বন্দর সহ বৃটিশের মালিকানাধীন কারখানা জাতীয়করণ, ঋণ মকুব, মজুরি বৃদ্ধি, মানুষের সমানাধিকার সহ জনগণের দাবী ঘোষনা করে। শ্রমিক-কৃষক-যুবকেরা ক্রমশই বাম মনোভাবের দিকে ঝুঁকছে।

জাতীয় আন্দোলনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলির গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। বিপ্লববাদী আন্দোলন বিকশিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ ঘটে গেছে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটেই কংগ্রেস ১৯৩১ সালে করাচি অধিবেশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এখানেই কংগ্রেস তার ‘ভারতের ধারনা’ এর একটি রূপরেখা হাজির করে। স্বাধীন ভারতের মানুষের মৌলিক অধিকার, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, মজুরি, কাজের সময়সীমা ইত্যাদি। ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে কংগ্রেস পাঁচ সালা পরিকল্পনার একটি প্রাথমিক খসড়া উপস্থিত করেন। স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো কী হবে তারও ধারনা দিলেন তিনি। এমনকি ভাবী স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষেধক রূপে তিনি বহুদলের কথা বললেন। গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মেনে নিলেন। জাতীয় পরিকল্পনার উপর জোর দিলেন এবং দেশের দারিদ্র দূর করতে ভূমি ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, জমিদারি প্রথার বিলোপ, কৃষি ঋণ মকুব, গ্রামীণ অর্থনীতি মজবুত করতে সস্তা মূলধণের ব্যবস্থা, সমবায় প্রথার বিস্তার, বৈজ্ঞানিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা স্থান পেয়েছিল তার রূপরেখায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম সঞ্জাত এই নানাবিধ ভাবনার প্রেক্ষাপটেই ‘ভারতের ধারনা’। তাঁকে মূল সূত্র রেখেই ভারতের সংবিধান। স্বাধীন ভারতের প্রাথমিক কাজ এই সংবিধানকে রক্ষা করা এবং সংবিধানের নির্দেশকে কার্যকরী করা। অতীতের মতই সেক্ষেত্রে বামপন্থী শক্তিকে ধারাবাহিকভাবে লড়াই জারি রাখতে হয়েছে।

Spread the word

Leave a Reply