১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর রাশিয়ার বিপ্লব। ১০৬ বছর আগের বিপ্লবের ঘটনা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাইছি কেন; বিশেষত যখন সেই দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসানের পরেও প্রায় সাড়ে ৩ দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে?
ফুকুয়ামার ঘোষণায় পরিবর্তন
প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ১৯৯২ সালে ‘The End of History and the Last Man’ লেখা বইয়ে পুঁজিবাদের অমরত্ব এবং সমাজতন্ত্রের মৃত্যু নিশ্চিত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই বই লেখার মাত্র ২৬ বছরের মধ্যে, ২০১৮ সালের ১৭ই অক্টোবর একটি মার্কিন পত্রিকা New Statesman-এর রাজনৈতিক সম্পাদক জর্জ ইটন’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – “আজকের এই যুগসন্ধিক্ষণে, আমার মনে হচ্ছে কার্ল মার্কসের কয়েকটি কথা অত্যন্ত সত্য। তিনি অতিরিক্ত উৎপাদনের সঙ্কট প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন ; এর ফলে শ্রমিক শ্রেণীর দূরাবস্থা আরও বাড়বে এবং বাজারে চাহিদাও অনেক কমবে – তা সত্য বলেই প্রমাণিত হচ্ছে আজ ”। সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে ঐ সাক্ষাৎকারেই তিনি আরও বলেছিলেন – “বর্তমানে আয় এবং সম্পদের যে ভয়ংকর অসাম্য দেখা দিয়েছে; বন্টন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করার প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেবলমাত্র ফিরে আসতে পারে তাই নয়, এটা অবশ্যই ফিরে আসা দরকার। রেগান-থ্যাচার যে অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণাকে সামনে রেখে, যা এখনও চলছে, সেটা আজ নানাভাবে এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে গেছে।”
ঐ একই সাক্ষাৎকারে তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন – “সামাজিক সাম্যের প্রশ্নে বর্তমান বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ভীষণভাবে দুর্বল করেছে, যার ফলে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমেছে এবং এক শ্রেণীর ধনিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে সর্বত্র, যারা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যত নিয়ন্ত্রন করছে।”
মার্কসের সন্ধানে
মার্কসের মৃত্যুর ১৪০ বছর পরেও পুঁজিবাদী দার্শনিকরা পুঁজিবাদের আভ্যন্তরীন সংকট বোঝবার জন্য কার্ল মার্কসেরই শরণাপন্ন হচ্ছেন কেন? কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস পুঁজিবাদের আবশ্যম্ভাবি সংকট সম্পর্কে কোন্ দিক-নির্দেশের কথা এবং বিকল্প সমাজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা নিয়ে এখনও পৃথিবী জুড়ে আলোচনা চলছে – এটা প্রাথমিকভাবে বোঝার উদ্দেশ্যেই ছোট্ট এই নিবন্ধ। একইভাবে মার্কস-এঙ্গেলস-র পথ নির্দেশকে হাতিয়ার করে লেনিনের নেতৃত্বে ১০৬ বছর আগে যাত্রা শুরু করে, ৭দশক ধরে গড়ে ওঠা ও পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, যার আয় এবং সম্পদ বন্টন নীতিকে কেন নতুন করে প্রয়োগ করতে চাইছে এমনকি বাজার অর্থনীতির প্রবল প্রবক্তারাও – এটাও অনুসন্ধান করা দরকার।
আজকের বিতর্ক
আবার এর বিপরীতে অনেক রকমের প্রচার চলছে পৃথিবী জুড়ে। প্রচার চলছে – ‘বামপন্থা এবং দক্ষিণপন্থার মধ্যে বিভাজন এখন অতীতের বিষয়, এখন তরুণ প্রজন্ম কোনও নির্দিষ্ট মতবাদে বিশ্বাস করে না। মার্কসবাদ যা সমাজ ও জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছে, তা আজকের যুগে চলে না।‘ এই কথার উত্তরে হয়ত আমরা বলতে পারি, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের পতনের জন্য মানব সভ্যতার বিশ্লেষণে ‘সমাজ ও জগতকে সামগ্রিকভাবে দেখা’র যুগ পেরিয়ে আসেনি, কারণ আজও পৃথিবী জুড়ে ভয়ংকর অসাম্য-দারিদ্র-অপুষ্টি-দুর্দশা শুধু রয়েছে তাই নয়, এগুলো বেড়েই চলেছে। ফলে সমাজ ও জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি।
কিন্তু এই উত্তর আজকের দিনের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আরও অনেকগুলি প্রশ্ন তৈরী করে দিতে পারে। কারণ মার্কসবাদীরা ছাড়াও এমন অনেক সংগঠন আছে যারা দারিদ্র-ক্ষুধা-অপুষ্টি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে, এমনকি নয়া উদারনীতির যুগেও অনেকগুলি রাষ্ট্র অনেক রকম জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী চালায়। আমাদের দেশেও ১০০ দিনের কাজ গ্রামীন শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নিশ্চিত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। খাদ্য নিরাপত্তা আইন ক্ষুধার বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী, যা এখনও আমাদের দেশের সরকার চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য বিজেপি সরকার এই প্রকল্পগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করার রাস্তাতেই হাঁটছে এখন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও দারিদ্র-ক্ষুধা-অপুষ্টি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিছু কর্মসূচী গৃহীত হয়। তাই বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রশ্ন তুলছে – যদি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই দারিদ্র-ক্ষুধা-অপুষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করার সুযোগ যথেষ্ট থাকে, তাহলে পুঁজিবাদ ভাঙ্গার দরকার কি?
আবার সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের থেকে অনেক ভালো কাজ করেছে দারিদ্র-ক্ষুধা-অপুষ্টি দূর করার প্রশ্নে এটা সত্য, কিন্তু শুধুমাত্র এই কথার মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তরুণতর প্রজন্মকে যুক্তি দিয়ে আকৃষ্ট করা যায়না। সমাজতন্ত্রের অর্থ, মানুষের শান্তি-মর্যাদা-স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকার ভবিষ্যত। সমাজতন্ত্র খাদ্য-শিক্ষা-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-কাজ এই মৌলিক চাহিদাগুলোকে ‘দয়ার দান’ বা অনুকম্পা প্রদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনা, এগুলো সব মানুষের মৌলিক অধিকারের দৃষ্টিতেই দেখে – এই বিকল্প ভাষ্য এলমাত্র মার্কসবাদেই পাওয়া যায়।
এই মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্যই লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বলেছিলেন – প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর সামনে দুটো বিকল্প উপস্থিত করেছে – হয় তারা তাদের বন্ধু শ্রমিকদের হত্যা করবে অথবা যে ব্যবস্থা তাদের এই অবস্থায় আসতে বাধ্য করেছে, তার বিরুদ্ধে বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে। সমাজতন্ত্র অশিক্ষা-দারিদ্র-অপুষ্টি-ক্ষুধা দূরীকরণের ব্যবস্থার সাথে এমন একটা সামগ্রিক মানব সভ্যতার ভবিষ্যত তৈরি করতে চায় – যেখানে মানুষ শান্তি-মর্যাদা-স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারে।
পুঁজিবাদের বিশ্লেষণই হলো মার্কসবাদ, তাই যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন তার প্রাসঙ্গিকতা স্বাভাবিকভাবেই থাকবে। তাহলে পুঁজিবাদ শেষ হবার সাথে সাথেই মার্কস-এঙ্গেলস-এর মতবাদ কি প্রাসঙ্গিকতা হারাবে? এই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। মার্কস-এঙ্গেলস কেবলমাত্র পুঁজিবাদকে ভেঙ্গে ফেলার মধ্যেই তাঁদের মতবাদকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি, পরবর্তী উন্নতর ব্যবস্থা সম্পর্কেও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
তাহলে প্রথমত বিচার করে দেখা দরকার পুঁজিবাদ মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথে সর্বশেষ, সর্বোন্নত এবং বিকল্পহীন এক অনিবার্য ব্যবস্থা কিনা। দ্বিতীয়ত এটাও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন সমাজতন্ত্র মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথে পুঁজিবাদের তুলনায় উন্নত এবং বাস্তব সম্মত একটি সমাজ ব্যবস্থা কিনা, বিশেষত ১৯৯১ পরবর্তী পৃথিবীতে।
পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত পৃথিবী – লাভ কার?
‘End of Socialism’ এই তত্ত্বের প্রচার চলেছিল পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকদের পক্ষ থেকে, বিশেষত ১৯৯১ সালের ২১শে ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবলুপ্তির পরে। ‘পুঁজিবাদই সভ্যতার শেষ কথা’- এই প্রচার চালানো হয়েছিলো। সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে পৃথিবীর কি কি লাভ হবে তাও প্রচার করা হয়েছিল –
১) সোভিয়েত অবলুপ্তিতে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হওয়ায় যুদ্ধের জন্য আর খরচ হবে না; মানব কল্যানে সেই অর্থ ব্যয়িত হবে।
২) পৃথিবীতে পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি হবে এবং বাজার স্থিতিশীল হবে।
৩) পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগোবে।
৪) বামপন্থী আন্দোলন এবং কমিউনিস্টদের অস্তিত্ব শেষ। পুঁজিবাদই মানবসভ্যতার শেষ শব্দ।
যুদ্ধ কি বন্ধ হ’লো?
১৯৯১ এর পরবর্তীতে আমেরিকা ১৫টি বড় যুদ্ধে অংশ নিয়েছে সরাসরি। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা – সব মহাদেশেই সম্পদ দখলের জন্য একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সম্প্রতি ইউক্রেন, প্যালেস্তাইন যুদ্ধ এর জ্বাজ্বল্যমান প্রমান। মার্কিন-ন্যাটো জোটের প্রত্যক্ষ মদতে, সমগ্র প্যালেস্তাইন থেকে প্যালেস্তিনী সহ আরব জনগণকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে ইজরায়েলের অতি দক্ষিণপন্থী জায়নবাদী সরকার।
যুদ্ধের খরচ কমলো?
ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ কমিয়ে মানবকল্যাণ খাতে খরচ বৃদ্ধির দাবী কতটা অসাড়, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির প্রতিরক্ষা বাজেটের দিকে নজর রাখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ২৯৯.৩৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮০০.৬৭ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯০-৯১ সালে সমগ্র পৃথিবীতে যেখানে সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ ছিল ৯৫০ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর সব দেশ মিলে প্রতিরক্ষা খাতে যা ব্যয় বরাদ্দ করে, তার ৪০%ই একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তাহলে যুদ্ধ তো কমলোই না, বরং যুদ্ধ খাতে খরচ বাড়ল আড়াই গুণ। ফলে মানুষের সমৃদ্ধি শিকেয় উঠেছে।
মানুষের কল্যানে খরচ বাড়লো?
বিশ্ব জনসংখ্যার সবচেয়ে দরিদ্র ৫০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সমতা (Purchase Power Parity) €২৯০০ (ইউরো), যেখানে শীর্ষে থাকা ১০% অতি ধনীর ক্রয়ক্ষমতা সমতার পরিমাপ ওদের চাইতে ১৯০গুণ বেশি। আয়ের বৈষম্য ভয়ঙ্কর প্রকট। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১০% আজ সমগ্র পৃথিবীর আয়ের ৫২% শতাংশ ভোগ করছে। দরিদ্রতম, যারা বিশ্ব জনসংখ্যার ৫০%, তারা মাত্র ৮.৫ শতাংশ পায়। (IMF Report on Global Inequality March, 2022) পৃথিবীর মাত্র ৮১ জন বিলিওনারের সম্মিলিত সম্পত্তির পরিমান পৃথিবীর মোট সম্পদের ৫০%। অপরদিকে ৮২.৪ কোটি মানুষ অভুক্ত। (Oxfam Report 2022) জনসংখ্যার ৪৫% বসবাস করে এমন দেশগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক মোট আভ্যন্তরীন উৎপাদনের চাইতে বেশি, অতি ধনী ৮১জন বিলিওনারের সম্পত্তির পরিমান। জনসংখ্যার এই পরিমানটা প্রায় ৩৬০ কোটি।
১৯৯৫-২০০৫ এই ১০ বছরে আমিরিকার কর্পোরেটগুলির মুনাফা বেড়েছিল ২%-র বেশি অপর দিকে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। বর্তমানে শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত আয় কার্যত ১৯৭০ সালের সমতুল্য। বেড়েছে অসংগঠিত শ্রমিক।(OECD Report, 11 September, 2023) প্রাক্ কোভিড পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে বিশ্বের অর্দ্ধেক মানুষেরই ন্যূনতম চিকিৎসার সুযোগ ছিলনা। স্বাস্থ্য খাতে সরকারী ব্যয় বরাদ্দ কমানোর কারণে যে বিপুল খরচ বৃদ্ধি হয়েছে তার ফলে ১কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে প্রতি বছরে। ঐ একই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল ঐ ১কোটি মানুষ জীবন ধারণের জন্য মাত্র ১.৯০ মার্কিন ডলার খরচ করতে পারে। (WB & WHO Report, 13 December, 2017)
বাজার স্থিতিশীল হওয়ার পরিবর্তে মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ইদানিং সময়কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে মার্কিন মুলুকে এর হার ছিল ৮%, ইংল্যান্ডে এই বছর মে মাসে ছিল ৬.৫%। এর ফলে ইউরোপের দেশে দেশে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারবার।
কোভিডে বেআব্রু পুঁজিবাদ
পৃথিবীর উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল পরিস্থিতি বেআব্রু হয়ে গেছে কোভিড পরিস্থিতিতে। সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন, যেখানে নাকি কোভিড সংক্রমণের সূত্রপাত হয়েছিল, সেখানে ৯,৯৩,১৬,৯৩২ জন কোভিড আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১,২১,৭৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০,৯১,৮০,৯৫১ জন কোভিড আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ১১,৮১,১৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় সমসংখ্যক রোগী কোভিড সংক্রমণে আক্রান্ত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের তুলনায় প্রায় সাড়ে ৯গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এক সমাজতান্ত্রিক দেশ ভিয়েতনামে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১,১৬,২৪,০০০। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৩,২০৬ জনের। পুঁজিবাদের আর এক স্বর্গরাজ্য ইংল্যান্ডে (UK) কোভিড আক্রান্ত ২,৪৭,৮৯,৪৮৮ জন রোগীর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২,৩০,৬৬৯ জনের। এখানেও স্পষ্ট সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামে কোভিড আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটোই ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেক কম। (Worldometer, 2November, 2023) এই দু:খজনক মৃত্যুর মূল কারণ, মূলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দেশগুলো মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের হাতে তাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে।
সমাজতন্ত্রের ধারণা কি অবলুপ্ত?
বামপন্থী এবং কমিউনিস্টদের ভবিষ্যত নেই এই প্রচারও ধীরে হ’লেও ক্রমেই অসত্যে পরিণত হচ্ছে। রাশিয়া সহ বহু দেশেই পূর্বতন কমিউনিস্টরা শক্তি ফিরে পাচ্ছে। ৪৫০ সদস্য বিশিষ্ট রাশিয়ার জাতীয় সংসদ ডুমাতে সেখানকার প্রধান কমিউনিস্ট দল CPRF ৫৭টি আসন জিতেছে। আঞ্চলিক সংসদে ৪৪৯টি আসন এরা জিতেছে। সমগ্র লাতিন আমেরিকার নানা দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সরকার গঠনে মূখ্য ভুমিকায় আছে বামপন্থীরাই। বামপন্থীদের জনকল্যানমুখী দাবীগুলো নিয়ে লড়াইতে মার্কিন মুলুকে বার্ণি স্যান্ডার্স ও ইংল্যান্ডে জেরেমি করবীন-এর প্রচার মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে প্রবলভাবেই। জার্মানীতে কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভীত সরকার ২০২১ সালের ৮ই জুলাই কমিউনিস্টদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে ১৯৯০ পূর্ববর্তী অবস্থায় সমাজতন্ত্রীরা নেই, কিন্তু পুঁজিবাদের ক্রমবর্দ্ধমান সঙ্কটে জেরবার মানুষ বিকল্পের সন্ধানে আছে।
কি হবে ৮০০ কোটি মানুষের?
জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৮০০ কোটি। এই সংখ্যা ২১৫ বছর আগেও ছিল মাত্র ১০০ কোটি। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭০০ কোটি। অনুমান আগামী ২১ বছরের মধ্যেই এই সংখ্যা হবে ৯০০ কোটি আর তার ১৬/১৭ বছরের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারে ১০০০ কোটিতে। এদিকে ভূপৃষ্ঠে স্থলভাগ কি বাড়ছে? না বাড়ছে। তাহলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের বাসস্থান কোথায় হবে? এদের খাওয়ার যোগান দেওয়ার চাষের জমি কোথায় পাওয়া যাবে? এদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়ি, বস্ত্র, কাজের সংস্থান করার জন্য পৃথিবী কি প্রস্তুত?
তাহলে বিকল্প কি? পুঁজিবাদ বিকল্প নয়, এটা আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। সমাজতন্ত্র কি পারছে বিকল্প উপস্থিত করতে?
বিকল্প একুশ শতকের সমাজতন্ত্র
প্রখ্যাত মার্কিন নিউজ উইক পত্রিকা তাদের সর্বশেষ সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশ করে জানিয়েছে – ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের সেন্টার ফর ফিউচার অব ডেমোক্রেসির এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৬২ শতাংশ মানুষই চীনকে সমর্থন করছে। অন্যদিকে বিশ্বে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছে ৬১ শতাংশ মানুষ।
বিশ্বজুড়ে নিজেদের দখলে রাখা সংবাদমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে প্রচারের ঝড় তোলার পরেও মানুষের আস্থা ক্রমশঃই সাম্রাজ্যবাদের প্রতি কমছে, সমাজতন্ত্রের প্রতি বাড়ছে। কেন এই আস্থা চীনের ব্যবস্থা সম্পর্কে? বিশ্বজুড়ে ওদের দেশের সরকার তো কার্যত কোনও প্রচারই করে না নিজেদের পক্ষে। তাহলেও এই আস্থা কেন?
আমাদের দেশের স্বাধীনতা (১৯৪৭) আর চীনের বিপ্লব(১৯৪৯) প্রায় একই সময়ে। আমরা সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদের মিশ্রণে কিছু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সমণ্বয়ে মূলত পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত পথেই বিগত ৭৬ বছর ধরে চলেছি। অপরদিকে চীন প্রথম থেকেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পথেই চলছে বিগত ৭৪ বছর ধরে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। এখন কে কোথায় দাঁড়িয়ে? সংখ্যাতত্ত্বে ভারাক্রান্ত করে লাভ নেই, কারণ সবই এখন ইন্টারনেটের দৌলতে সবার নাগালের মধ্যেই।
চীনের অগ্রগতির পথ নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। কতটা সমাজতন্ত্র কতটা পুঁজিবাদ – এই নিয়ে অনেকে কূটতর্কও করেন। সমাজতন্ত্রের কি কোনও ধরাবাঁধা রাস্তা আছে? কোনও ফর্মুলা আছে এর? না নেই। বিংশ শতাব্দীতে যে রাস্তায় সমাজতন্ত্র এগিয়েছিল, আজ রাস্তা একই রকম হবে, তার কোনও মানে নেই।
বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই ১৯১৭ সালেই এই প্রসঙ্গে লেনিন বলেছিলেন – “আমরা কখনই একথা দাবী করি না যে মার্কস অথবা মার্কসবাদীরা সমাজতন্ত্রের রাস্তা শেষ পর্যন্ত সব খুঁটিনাটি জানে। এধরণের দাবী একেবারেই অবান্তর। আমরা এই রাস্তার অভিমুখ কি এবং কোন্ কোন্ শ্রেণী আমাদের সাথে থাকবে, তা জানি। এর বিস্তারিত কি হবে জানা তখনই সম্ভব হবে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে নিজেদের হাতে তা বাস্তবায়িত করতে করতে এগিয়ে যাবে।”
অসাম্য বা দারিদ্র দূরীকরণে, সমাজের কল্যাণে, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের যে মডেল সাফল্য দেখিয়েছিল, সেই একই মডেল আজও কাজ করবে? তা কখনই নয়। বিগত এক শতাব্দীতে সমাজ, অর্থনীতি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, চাহিদা, প্রযুক্তি সবই পালটে গেছে অনেক। তার সাথে সাযুজ্য বজায় রেখেই সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারণা অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে বিগত এক শতাব্দীতে।
ভুল ছিল প্রয়োগে, তত্ত্বে নয়
সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর অনেকেই বলেছিলেন, মার্কসের মতবাদ ও সমাজতন্ত্র অচল, সেটা এই বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়েই প্রমানিত হয়েছে। এই ধরনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক বলেছিলেন – তাজমহল ভেঙে গেলে কি পৃথিবীর থেকে ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে? এটা হয় না। বিজ্ঞানে প্রয়োগের ব্যর্থতায় তত্ত্ব বাতিল হয় না। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা তো তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে, এমনকি কোভিড ১৯ সংক্রমণের সময়েও। এখন ব্যাপক ছাঁটাই চলছে আমেরিকা ইউরোপের অনেক তথাকথিত উন্নত অর্থনীতির পুঁজিবাদী দেশে। কিন্তু এমন ঘটনা তো এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে না। মজুরিও কমাচ্ছে পুঁজিবাদী দেশগুলো ব্যক্তি মালিকদের মুনাফা আরও বাড়াবার জন্য। কিন্তু তাও তো তেমনভাবে ঘটছে না চীন, ভিয়েতনাম, কিউবায়।
আজকের বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও ব্যক্তির লাগামহীন মুনাফা বৃদ্ধির বিপরীত রাস্তায় হেঁটে অসাম্য, দারিদ্র দূরীকরণ, সকলের জন্য সমান শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে পথ দেখাচ্ছে তো এই গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশই। লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশ আবার তেল, খনি, ভূমি সংস্কারের মতো বামপন্থার অনুসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, বিশ্ব লগ্নিপুঁজির উদারীকরণের রাস্তা ছেড়ে।
প্রশ্ন ‘বাজার’ কার নিয়ন্ত্রণে চলবে?
‘বাজার’ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও থাকে। ‘বাজার’ না থাকলে কোনও দ্রব্যের কত চাহিদা, কত যোগানের প্রয়োজন, তা মাপা যাবে কি ভাবে? পণ্যের মূল্যই বা নির্ধারণ করা যাবে কি ভাবে? যদিও পণ্যের মুল্য নির্ধারণে শ্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন মার্কস। আধুনিক অর্থনীতিতে ‘বাজার’ই এইসব মাপকাঠি নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করে। এখন প্রশ্ন হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে – নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটা মাত্র ধনী পুঁজিপতি? না কি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে সমাজের প্রয়োজনে ‘বাজার’ পরিচালিত হবে? সমাজতন্ত্রে ‘বাজার’ পরিচালিত হয় মূলত সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য, কেবলমাত্র কয়েকজন শিল্পপতির মুনাফার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নয়। চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম এই নীতির ভিত্তিতেই বাজার সাজাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ঘেরাটোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা যায়?
বিশ্ব লগ্নিপুঁজিকে ঢুকতে না দিয়ে বা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচা তো সম্ভব নয়। তাই তাদের লাগবে, কিন্তু সাথে সতর্কও থাকতে হয় প্রতিপদেই, কে কাকে কতটা ব্যবহার করতে পারবে। কতটা ছাড়বে জমি, কোথায় ছাড়বে জায়গা – এটার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা হয় না। চলতে চলতে নিজেদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতির বিচারেই নির্ধারণ করতে হয় – কোন্ সমঝোতায় কতটা লাভ, কতটা ক্ষতি দেশের সাধারণ মানুষের। এই লড়াই নিরন্তর চালিয়ে যেতে হয়।
আজকের ৩/৪টে মাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশকে ঘিরে রেখেছে বিশ্ব লগ্নিপুঁজি নিয়ন্ত্রিত দেশগুলো। আজকের লগ্নিপুঁজির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এরা রাতারাতি পুঁজির স্থানান্তর ঘটিয়ে যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিতে পারে এক রাতেই। তাই চাইলেও ইচ্ছেমতো নিজস্ব নিয়মের নিগড়ে এদের বেঁধে রাখা খুবই দুঃসাধ্য। বাঁধতে গেলেই এরা পুঁজিপাটা নিয়ে পাততাড়ি গোটায়, বিপদে পড়ে সেই দেশের অর্থনীতি। তাই দর কষাকষির কাজটা শুধু দক্ষতা দিয়ে হয় না, তার জন্য দরকার সমাজতন্ত্রিক অর্থনীতির মজবুত বুনিয়াদ, আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লাগাতার লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি। দ্বিতীয় কাজটা না করা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম একটা কারণ।
বিকল্পের লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা নভেম্বর বিপ্লব
এখন প্রশ্ন এই মুষ্টিমেয় ধনিক গোষ্ঠীর হাতে পৃথিবীকে ছেড়ে দেওয়া হবে, না কি এদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াই চলবে? বিকল্প আছে পুঁজিবাদের – আর সেই বিকল্প হলো একুশ শতকের সমাজবাদ। যতদিন শোষণ বঞ্চনা অসাম্য থাকবে ততদিন মুক্তির লড়াই চলবেই আর মুক্তির লড়াইয়ের অন্যতম প্রেরণা রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব।