এসকোবার-স্করপিয়ন কিক এবং ‘ক্যাম্বিয়া লা হিস্টোরিয়া’ -ঋজুরেখ দাশগুপ্ত

২৬ জুন , ২০২২ (রবিবার )

এই প্রজন্মের অনেকেরই কলম্বিয়ার সঙ্গে পরিচয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওয়েব সিরিজের এপিসোডে। মেডেলিন কারটেল, ক্যালি কারটেলের ড্রাগপাচারের কাহিনী আর তার সঙ্গে পাবলো এসকোবার। অনেকের কাছে, এক বাক্যে এটাই কলম্বিয়ার উপাখ্যান। প্রৌঢ়-মধ্য প্রৌঢ়দের জিজ্ঞেস করলে তাদের হয়তো মনে পড়বে রেনে হিগুয়েতার স্করপিয়ন কিক। তবে, ড্রাগপাচারের গল্প নিয়ে ওয়েব সিরিজ বা জাতীয় দলের গোলকিপারের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছাড়াও আমাদের কাছে হাজির হয়ে গেলো ‘‘ক্যাম্বিয়া লা হিস্টোরিয়া’’ অর্থাৎ ‘‘চেঞ্জ দ্য হিস্টোরি।’’কারণ? আমাদের কাছে জানার, শিক্ষণীয় আরেকটা কলম্বিয়াও আছে, যাকে ওয়াশিংটন পোস্ট বা বিবিসিতে দেখা যায় না। যার প্রতিটি বস্তির প্রতিটি রাত ক্লেদাক্ত হয় মানুষের কান্নায়। ওয়াশিংটনের স্যাটেলাইট সেন্টার হয়েও যেখানে শতকরা ৪২.৫ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। যেখানে ধনীতম মাত্র ২০ভাগ মানুষ কুক্ষিগত করেছেন প্রায় ৫৭ ভাগ সম্পত্তি। যেখানে প্রায় ৫০ভাগ মহিলা খাদ্যাভাবে ভোগেন। ১০০০জনের মধ্যে ১২জন শিশু মারা যায় এক বছর বয়স পূর্ণ করার আগেই। যেখানে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী ও ড্রাগ মাফিয়াদের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী যৌথভাবে নির্বিচারে খুনজখম চালিয়ে গেছে প্রায় অর্ধশতক ধরে। ২.৫ লক্ষ মানুষ আসলে খুন হয়েছেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে।


২০০২-০৮’ পর্যন্ত ‘অনেক এফএআরসি সদস্য খুন করেছি’- এটা বোঝানোর জন্য ৬৪০২ জন কৃষকের গায়ে এফএআরসি- র ইউিনিফর্ম চাপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইয়াঙ্কি পরিকল্পিত ‘কলম্বিয়া প্ল্যান‘ কার্যকর করার জন্য আমেরিকা খরচ করেছে ৫ বিলিয়ন ডলার। ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারকে বিব্রত ও ভঙ্গুর করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে কলম্বিয়া-ভেনেজুয়েলার দীর্ঘ সীমানাকে। কলম্বিয়া কাজ করে গেছে ‘ব্যানানা রিপাবলিক’-র সবচেয়ে ভরসাযোগ্য মার্কিন উঠোন হিসেবে।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইভান ডুক


প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ইভান ডুকের জামানায় আর্থিক বৈষম্য, বেকারত্ব পৌঁছেছে কলম্বিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ মাত্রায়। সরকারবিরোধী মানুষের জমায়েতও আছড়ে পড়েছে বোগোতা থেকে মেডেলিন — সর্বত্র। জেগে উঠেছেন গ্রামের মানুষও। ২০১৩-১৪ সালের মহান কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব এখন গুস্তাভো পেত্রো নেতৃত্বাধীন ‘প্যাক্টো হিস্টোরিকো’-র অংশ। খুব সম্ভবত তারা সরকার পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও থাকবেন। ইভান ডুকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ চেয়েছিলেন। তার ‘অস্টারিটি’ (মিতব্যয়ী) বাজেট ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ আর কৃষকদের আন্দোলন সম্পৃক্ত হয়েছে লড়াইয়ের ময়দানে, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ছাত্ররাও — তাদের দাবি নিখরচায় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলত, এই জনরোষই ‘প্যাক্টো হিস্টোরিকো’র প্রধান রসদাগার। নয়া উদারবাদের ছোবলে আক্রান্ত মহিলা, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, জনজাতিভুক্ত মানুষ, পরিবেশকর্মী, কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি, গেরিলা বাহিনী এফএআরসি-র রাজনৈতিক গ্রুপ কমিউন, গুস্তাভো পেত্রোর কলম্বিয়া হুমানা পার্টি — এরা সকলে মিলে এই ঐক্য গড়েছেন। এবং এখনও পর্যন্ত যা আশা তাতে, তারা কলম্বিয়াকে মুক্ত করেছেন ইয়াঙ্কি তাবেদারির শৃঙ্খল থেকে। এই নির্বাচনেও দক্ষিণপন্থীদের জয়যুক্ত করার জন্য লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে গেছে ওয়াশিংটন। ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ কুখ্যাত ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড এ বছর ফেব্রুয়ারিতেই পৌঁছে যান বোগোতায়। ফ্রেডেরিকো গুতিয়েরেজকে টপকে দক্ষিণপন্থী শিবিরের সর্বোচ্চ ভোট প্রাপক হন ‘টিকটক স্টার’ রুডল্‌ফো হার্নান্ডেজ। যাকে অনেকে দক্ষিণ আমেরিকার ‘ট্রাম্প’ নামে অভিহিত করেন। এই হার্নান্ডেজই হিটলারকে ‘মহান জার্মান দার্শনিক’ বলে প্রশংসায় ভূষিত করেছেন।


কিন্তু সবকিছুর পরেও পরাজিত হয়েছে উদারবাদ। পরাজিত হয়েছে তাদের প্রথম পরীক্ষাগার চিলিতে, পরাজিত হল তাদের লাতিন স্যাটেলাইট সেন্টার কলম্বিয়ায়, খুব সম্ভবত এ বছরের শেষেই পরাজিত হতে চলেছে ব্রাজিলে। ‘এন্ড অফ হিস্টোরি’ যে পুঁজিবাদের অলীক কল্পনা, তা আজ গোটা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট। এই ব্যবস্থাটা পচাগলা আকার ধারণ করেছে এবং সম্পূর্ণ ভঙ্গুর- এ ব্যাপারেও সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। বিগত দশকের মন্দার পরেই শোনা গেছিলো- ‘Marx is back & back with a bang!’ লাতিন আমেরিকা বুঝিয়ে দিচ্ছে শুধু বিশ্লেষণ-বিতর্কের মঞ্চে নয়, বামপন্থীরা ফিরছেন — ফিরছেন উদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে।


চিলির পর কলম্বিয়াও আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অনেককিছু। কলম্বিয়ার নবনির্বাচিত উপরাষ্ট্রপতি কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ফ্রান্সিয়া মার্কেইজ। ‘সিঙ্গেল মাদার’ ফ্রান্সিয়া আগে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কলম্বিয়ার ছাত্রসমাজের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো যোগসূত্র গড়ে তুলতে পেরেছেন ফ্রান্সিয়াই।


গুস্তাভো পেত্রোর চারপাশে রয়েছেন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী, কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব, ছাত্রনেতা এবং অবশ্যই ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বও। মার্তা হার্নেকার বরাবরই বলতেন তাঁর সারাজীবনের অধ্যয়নের প্রধান রেফারেন্স কমরেড লেনিন — কৌশল নির্বাচন ও রাজনৈতিক হাতিয়ার তৈরির লেনিনীয় পদ্ধতি। নয়া উদারবাদে আক্রান্ত সমাজে শ্রেণীসংগ্রামকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করার কথা বারেবারে ফুটে উঠেছে মার্তার লেখায়। গণচেতনা নির্মাণে সামাজিক অনুশীলনের গুরুত্ব অনুধাবন করা, এমন সংগঠন তৈরি যা শুধু সমাজেই মিশে থাকবে, জনপ্রিয় আন্দোলনের সঙ্গে আন্তরিক সাহায্যকারীসুলভ সম্পর্ক স্থাপন এবং অবশ্যই এমন সংগঠন যা হবে আগামী সমাজের প্রতিচ্ছবি- এই কথাগুলো মার্তা লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘রিবিল্ডিং দ্য লেফ্‌ট’ বইতে।
সর্বত্র লাতিন পথটাই পথ — এমন কথা বললে আসলে তা হয়ে যাবে লাতিন পথের বিরোধী। কিন্তু, পথ নির্বাচনের লাতিন পদ্ধতির প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়াটা উদারবাদবিরোধী লড়াইয়ে অন্যতম কর্তব্য। কৃষ্ণাঙ্গ-শেতাঙ্গ মেরুকরণ, সমগ্র গণমাধ্যমকে উদারবাদের অনুগতয় পরিণত করা, নানান পপুলিস্ট স্টান্ট — এ সবের বিরুদ্ধেই লাতিন আমেরিকা লড়ছে নতুন করে। স্বয়ং গুস্তাভো পেত্রো কলম্বিয়ার এম-১৯ গেরিলা গ্রুপের প্রাক্তন সদস্য। ১৭ বছর বয়স থেকে বন্দুক হাতে দীর্ঘ লড়াই করেছেন ড্রাগমাফিয়া ও সরকারের অঘোষিত যৌথ সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। আজ তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির চেয়েও বড় কথা, ২০১৮-১৯ থেকে চোখে দেখতে পাওয়া আমেরিকার দাসত্ববিরোধী গণসমাবেশের তিনি নেতা। ২০১৬’য় হাভানা শহরে এফএআরসি ও কলম্বিয়ান সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় শান্তিচুক্তি। সে শান্তিচুক্তি বারংবার লঙ্ঘন করেছে কলম্বিয়ান সরকার। কলম্বিয়ার ইতিহাসে বামপন্থী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে হত্যা করেছে ড্রাগমাফিয়াদের সশস্ত্র বাহিনী। তারপরেও গুস্তাভো পেত্রোরা গণচেতনা নির্মাণের ধারাবাহিক অনুশীলনের রাস্তা ছাড়েননি। তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অপরিশোধিত তেল ও কয়লার রপ্তানিতে নতুন আর কোনো আমেরিকান কোম্পানিকে জায়গা দেওয়া হবে না। তাঁরা বলেছেন নিখরচায় বিশ্ববিদ্যালয় অবধি পড়াশুনার বন্দোবস্ত করবে সরকার। জনজাতিভুক্ত মানুষের অধিকার রক্ষা, মহিলাদের আয় বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা, শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন- এই কথাগুলোকে সামনে রেখেই নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে ‘প্যাক্টো হিস্টোরিকো।’
এখন খোলা মনে দেখা, বোঝার সময়। আগামী দিন বলবে — কোন পথে এগোবে কলম্বিয়া! তবে, আমেরিকার দাসত্ব, নয়া উদারবাদের বধ্যভূমি হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে গণক্ষোভের চেহারাটা পরিষ্কার। মানুষ বিকল্প খুঁজছেন তাও স্পষ্ট। নয়া উদারবাদ যে শেষ কথা বলবে না — তাও আরেকবার প্রমাণ করে দিল কলম্বিয়া।

Spread the word

Leave a Reply