ভারতে কাজের নিরাপত্তা এবং বিজেপি সরকার – ৫ম পর্ব
ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
তৃণমূলের শাসনে রাজ্যে কাজের সুযোগ ধ্বংস হয়েছে
এই ধারাবাহিকের আগের চারটি পর্বে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রণীত ৪টি নয়া শ্রম আইন এবং তার ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এই পর্বে আমরা পশ্চিমবঙ্গে কাজের সুযোগ, শ্রমিকদের অধিকার কোন অবস্থায় রয়েছে সেই নির্দিষ্ট পরিসরে আলোচনা শেষ করবো।
আমাদের রাজ্যে ন্যুনতম মজুরির সরকারী চিত্রটি দেখে নেওয়া যাক –
শ্রমিকের দক্ষতা (Class of Employment) | জোন (Zone) | একদিনের মজুরি ( Total Per Day) |
দক্ষ (Skilled) | A | ৪০৯.০০ |
অর্ধ-দক্ষ (Semi Skilled) | A | ৩৭১.০০ |
অর্ধ-দক্ষ (Semi Skilled) | B | ৩২৫.০০ |
অদক্ষ ( Unskilled ) | B | ২৯৬.০০ |
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রম দপ্তরের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে মোট ৯৩টি বিভিন্ন ক্ষেত্রের কাজে ন্যুনতম মজুরির তালিকা দেওয়া রয়েছে। ন্যুনতম মজুরির হিসাব কীভাবে হয় আমরা এই লেখার তৃতীয় পর্বে দেখেছি, আমাদের রাজ্যে সমস্যা শুধু মজুরির পরিমান নিয়ে নয়। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে যারা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত হন তাদের হাতে সেই অর্থের সবটা পৌঁছায় না, খাতায় অনেকের নাম থাকলেও আদপে অল্প লোককে কাজে যুক্ত করে বিপুল পরিমান অর্থ অন্যের হাতে চালান হয়ে যাচ্ছে – এগুলিই প্রধান অভিযোগ। অর্থাৎ সোজা কোথায় মানুষকে কাজে যুক্ত করার সুযোগকে ব্যবহার করে যথেচ্ছ দুর্নীতি শেষ দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ঘোরতর বাস্তবতা।
শপথ নেবার পরেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘর সাজানোর জন্য খরচ হয়েছিল ১৪ লক্ষ টাকা, মুখ্যমন্ত্রী দাবী করেছিলেন এই কাজে তিনি নিজে সরকারকে ২ লক্ষ টাকা দিয়েছেন – যদিও জমা হওয়া টাকা কোন তহবিলের খাতে যুক্ত হয়েছে আজ অবধি কেউ জানে না। এই ঘটনাই অশনি সংকেত ছিল।
লকডাউন সারা দেশের সাথে আমাদের রাজ্যেও কর্মসংস্থানের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। নিজের রাজ্যে কাজের, রোজগারের উপযুক্ত সুযোগ থাকলে লকডাউনের জন্য অত শ্রমিক বাইরের রাজ্যে আটকে পড়তেন না। রাজ্যে কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্পস্থাপনের বিরোধিতা করে তৃণমূল সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছিল – দশ বছর বাদে সেই সরকারের কাজের হিসাব কি বলছে? নতুন কলকারখানা একটাও হয় নি, জিন্দাল গোষ্ঠীর স্টিল প্ল্যান্ট বাতিল হবার পরে যে সিমেন্ট কারখানা হয়েছে তাতে জমিদাতাদেরই সবার চাকরি হয় নি! বন্ধ কলকারখানা একটিও খোলেনি। আধুনিক অর্থশাস্ত্রে পন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ, যারা একসময় কাজের সুযোগ তৈরি করতে শিল্পস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাকে ছোট দেখিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন এবং চাষের কাজে বিকল্প কর্মসংস্থানের গল্প শুনিয়েছিলেন তাদের আজ চুপ করে যেতে হয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে কিংবা ঋণের দায়ে কৃষকদের আত্মহত্যা রাজ্যের মানুষ ভুলে গিয়েছিল, আজকের পশ্চিমবঙ্গে সেই লজ্জাজনক ঘটনা পুনরায় ঘটছে। রাজ্য সরকার কৃষিতে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করলেও বাস্তব হল কৃষকরা সেই দাম পাচ্ছেন না, শাসকদলের নানা গোষ্ঠী, ফড়েদের হাতে তাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক প্রান্তে তৃণমূল সরকার এবং দলের বিরুদ্ধে জমে থাকা অসন্তোষের অন্যতম কারনই হল এই। এই পরিস্থিতিতে কখনো চাষের কাজে বিকল্প কর্মসংস্থান হতে পারে না এটা বুঝতে পন্ডিত হতে হয় না।
কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রামীন রোজগার প্রকল্প, MGNREGA – আমাদের রাজ্যের অবস্থা কেমন? লকডাউন ঘোষণার পরেই বামপন্থীরা দাবী করেছিল গ্রামীণ রোজগার প্রকল্পের পরিসর ১০০ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৫০ দিন করতে হবে। দাবী ছিল বাইরের রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরে এসেছেন যারা তাদের গ্রামীন রোজগার প্রকল্পে যুক্ত করার। বাস্তবতা কি? বহু মানুষ এখনও রোজগারহীন অবস্থায় চরম দুর্দশার শিকার, রেশন কার্ডের মতো জব কার্ড বিলি করা নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে।
দশ বছর ধরে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদ শুন্য রয়েছে, নিয়োগ হয়নি। যেখানে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে সেখানেই ব্যাপক হারে কাটমানি, ঘুষের অভিযোগ উঠেছে। এই সব অভিযোগই শাসক দল তৃনমূলের বিরুদ্ধে – দশ বছরে তৃনমূলের শাসন দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। শেষ সাত বছরে আপার প্রাইমারি থেকে শুরু করে নবম – দশম শ্রেণী অবধি কোন নিয়োগ হয় নি – এই সাত বছরে রাজ্যের বিভিন্ন কলেজ এবং ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পাশ করে ঘরে বসে থাকা শিক্ষিত যুবসমাজকে কর্মহীনতার, বেকারির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার। সাত বছর ধরে কতজন কাজের সুযোগ হারাচ্ছেন? ২০১২-১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিবছর আমাদের রাজ্যে গড়ে ২১৪৮৯৯ জন স্নাতক, স্নাতকোত্তর ( বিএ, বিএসসি, বি কম, বিটেক, বিবিএ, এম এ, এম কম, এম এস সি, এম টেক, এম বি এ – এবং আরও অন্যান্য) পরীক্ষা পাশ করেন! সময়মতো শুন্যপদে নিয়োগ না হলে রাজ্যে শুধু বেকারের সংখ্যা বাড়ে না, শিক্ষা শেষে কাজের সুযোগ নেই এমন একটা ধারণা জনমানসে ছড়িয়ে পড়ে – এর ফলে একদিকে শিক্ষা এবং কাজের জন্য বাইরের রাজ্যে চলে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা তৈরি হয়।
সারা রাজ্যে পৌরসভাগুলিতে অনেক পদ খালি পড়ে রয়েছে – ঘোষণা সত্বেও সেই পদ্গুলিতে নিয়োগ হচ্ছে না। লকডাউনের আগে এইসব পদে নিয়োগের জন্য বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে অনেকবার আন্দোলন করা হয়েছে, এমনকি শুন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগের দাবীতে আদালতে মামলা অবধি করা হয়েছে। তখন তৃণমূল সরকার অজুহাত দিত মামলা চলার কারনে নিয়োগ করা যাচ্ছে না, এখন তারাই লকডাউনের গল্প শোনাচ্ছে। রাজ্যের সর্বত্র একই ছবি। একদিকে সরকারী শুন্যপদে নিয়োগ নেই, বা নিয়োগ হলেও দুর্নীতিতে ভরা আরেকদিকে নতুন একটিও কলকারখানা কিংবা শিল্পস্থাপন হলনা – ফলে বেসরকারি ক্ষেত্রেও রোজগারে যুক্ত হবার সুযোগ নেই!
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বিজেপি’র প্রণীত নয়া শ্রম আইন সমূহের প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যে তৃণমূল সরকারের সংযোগ কোথায়? প্রশ্নটা একশো শতাংশ রাজনৈতিক। আমাদের বক্তব্যও তাই – তৃণমূল, বিজেপি’র মধ্যে একশো শতাংশই রাজনৈতিক সমঝোতা রয়েছে। যদি বিকল্পের সদিচ্ছা তৃণমূল সরকারের থাকত তাহলে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী’দের জন্য সরকারী শুন্যপদে নিয়োগের বন্দোবস্ত হত – বেসরকারি শিল্পস্থাপন হতো, কলকারখানা হতো। একটাও হয় নি। তৃণমূলের সেই সদিচ্ছা নেই। আমাদের রাজ্য থেকে এইসব বেকার যুবক-যুবতী’দের বাধ্য হয়ে হয় কম মজুরিতে চুক্তিভিত্তিক ছোটখাটো অস্থায়ী কাজে যুক্ত হবে, অথবা অন্য রাজ্যে চলে যেতে হবে। দুই ক্ষেত্রেই কার সুবিধা? বেকারবাহিনীর চাপ যত বেশী হবে পূঁজির ততই সুবিধা, ঐ বেকারবাহিনীর ভিড় দেখিয়েই কম পয়সায় কাজে নিয়োগ করা সহজ হয়, শ্রমিক- কর্মচারীদের বিভিন্ন ন্যায্য দাবীর লড়াই-আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মোদী সরকারের নয়া শ্রমআইন কর্পোরেট – পুঁজিবাদের মুনাফার স্বার্থে শ্রমিকদের প্রচলিত অধিকারগুলি কেড়ে নিচ্ছে – আমাদের রাজ্যে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী’দের লাইন গড়ে তোলা হচ্ছে, এর থেকে বড় সংযোগ আর কি হতে পারে! তৃণমূল – বিজেপি’র সংযোগ রাজনৈতিক – মানুষকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে সামান্য কিছু রিলিফ দিয়ে তাকেই ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থা হিসাবে দেখিয়ে জনপ্রিয় হবার রাজনীতি। মোদী বলছেন ডবল ইঞ্জিন সরকার হলে তবে উন্নয়ন হবে, তৃণমূল বেকার যুবক-যুবতী’দের নিজের দলে ভিড়িয়ে ছাপ্পা ভোটের কাজে দৈনিক মজুরি দেবার বন্দোবস্ত করছে। আসলে দুই পক্ষই পূঁজির সেবায় একে অন্যের প্রতিযোগী, সেই কারনেই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার আয়োজন। বিজেপি বিরোধিতার নামে যারা এহেন তৃনমূলকে লড়াইয়ের সাথি মনে করেন তারা হয় বিপদের মুখে আপদের থেকে সাহায্য প্রত্যাশী অবোধ শিশুসুলভ আর নয়ত মুখে বাম হয়েও কাজে একশোভাগ ডানপন্থী! মুক্তির লক্ষ্যে মানুষের লড়াইকে গুলিয়ে দেয় যারা, তাদের সম্পর্কে “এপ্রিল থিসিসে” লেনিন বলেছিলেন “It is, of course, much easier to shout, abuse, and howl than to attempt to relate, to explain.”
বিভিন্ন অভাব, অনটন এবং দুর্দশার কবলে ফেলে জনতার ঐক্যকে ভেঙে দিতে যাবতীয় নিপীড়ন এবং মাঝেমধ্যে যৎকিঞ্চিত দয়ার দান! মোদী-মমতার জমানায় দেশ এবং রাজ্যে রাজনীতির চেহারা এমনই। ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলো ম্যেকিয়াভেলি “দ্য প্রিন্স” গ্রন্থে ক্ষমতায় আসীন রাজাদের উদ্দেশ্যে নিজেদের আসন টিকিয়ে রাখতে ঠিক এমনই বুদ্ধি দিয়েছিলেন।
এরা দুই পক্ষই ভুলে যান ইতিহাসের ফিরে আসে দুইবার। প্রথমবারে ট্র্যাজিক বা দুঃখজনক – পশ্চিমবঙ্গ ২০১১ সালে সেই ঘটনার সাক্ষী। দ্বিতীয়বারে ফিরে আসে প্রহসন হিসাবে! ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল – বিজেপি’র মধ্যে সকালে বিকালে নেতা, মন্ত্রী আদানপ্রদানের নাটকে সেই প্রহসনেরই চর্চা রাজ্যসহ গোটা দেশ দেখছে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ