ELectoral Bond

Electoral Bond and its Criminal Underpinnings

নীলোৎপল বসু

গত দশ বছর ধরে মোদী সরকার নিজেরাই নিজেদের ঢাক পিটিয়ে চলেছে যে তারা নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তারা ক্ষমতায় এলেই দুর্নীতি নিবারণে অতীতের যাবতীয় বাধা ভেঙে সামনে এগোনো যাবে এমন একটা কথাও বুক বাজিয়ে বলা হত। পাঠকের নিশ্চই মনে থাকবে, না খাউংগা না খানে দুঙ্গা ( নিজেও খাব না, কাউকে খেতেও দেব না) এই ছিল প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের লবজ। এর পরে ব্যাপারটাকে আরও বাড়িয়ে দেখাতে চৌকিদার শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। বিজেপির প্রচারযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা দেখাতে চায় দুর্নীতির প্রতিরোধের প্রশ্নে বিজেপি সরকার কত একনিষ্ঠ।

অবশ্য আজকের দুনিয়ায় দুর্নীতি কোথায়, কিভাবে কত গভীরে পৌঁছে গেছে তাকে আড়াল করতেই এমনসব প্রচার চলে। নয়া উদারবাদী জমানায় রাষ্ট্র নিজেরই নাগরিকদের সমীপে জবাবদিহি করতে কোনরকম দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে চায় না। মোদী সরকারের বিভিন্ন আচরণের বুনিয়াদি ভিত্তি সেটাই। আর তাই দেশের সরকারের একমাত্র চিন্তা কিভাবে বাজার এবং সেই বাজারের অন্তর্গত নিজেদের পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট গোষ্ঠীর শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। একথা ঠিকই যে এমন কর্পোরেট বান্ধব পরিস্থিতির নির্মাণে রাষ্ট্রের তরফে বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। আর তাই এর ঠিক বিপরীতে দুর্নীতি বিরোধী যেকোনও লড়াই জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামকে এড়িয়ে গিয়ে  অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রধানমন্ত্রীর বয়ান তখন ছিল তিনি হার্ভার্ড কিংবা মেধাবৃত্তির অমন কিছুর উল্টোদিকে হার্ড ওয়ার্কে ভরসা করেন। এসবই আসলে কর্পোরেট স্বার্থে নিয়োজিত থাকার ফিকির।

আজকের ভারতে কর্পোরেটদের এমন কায়দায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে যা সমাজে বৈষম্যকে ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মোদী সরকার অনুসৃত ক্যুইড প্রো ক্যুও নীতির পর্যালোচনা করে স্পষ্টই বোঝা যায় যে বিজেপি ও তার সঙ্গী সাথীদের সমৃদ্ধি ঘটানোই একমাত্র উদ্দেশ্য। এই নীতির সহজ কথা – ন্যূনতম সরকারী নিয়ন্ত্রন, অথচ সর্ব্বোচ সরকারী কর্তৃত্ব। ইংরেজিতে মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নেন্স। এতে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে একদিকে করের বোঝা থেকে রিলিফ, আরেকদিকে তাদের মুনাফা লুটে নেওয়ার স্বাধীনতা দুইই দেওয়া হয়। সেই উদ্দেশ্যেই নির্বাচনী বন্ডের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা আসলে নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্পনসর জুটিয়ে নেওয়ার ফন্দি। আমরা প্রথম দিন থেকে বলে এসেছি নির্বাচনী বন্ড হল রাজনৈতিক দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ারই নামান্তর। আজ যখন এই প্রসঙ্গে একের পর এক তথ্য সামনে আসছে তখন একথা নিশ্চই আনন্দের যে এহেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালাতে গিয়ে আমরা যা কিছু বলেছিলাম প্রতিদিন সেসবই প্রমাণিত হচ্ছে। বন্ড কেনার মালিক ও সেইসব বন্ড পকেটস্থ করা দলের দুই তালিকাকে মিলিয়ে দেখতে জরুরী আলফানিউমেরিক কোডের তালিকা প্রকাশ করতে বলে সুপ্রিম কোর্টের রায় আগামীদিনে যাবতীয় জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটাবে।

কী কী জানা গেছে?

নির্বাচনী বন্ডকে কার্যকরী করার সময় সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে আগ্রাসী কৌশলে কাজে লাগানো হয় যাতে কোনো বাধা না আসে। একসময় যেমনটি দাবী করা হত যে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ নাকি নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ করে তুলছে, তুলবে সেসব কথাবার্তা আজ আর কেউ উচ্চারণ করছে না। এই বন্ড আসলে কি, এর সংজ্ঞা ঠিক কি হবে এসব প্রশ্নকে কার্যত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোনরকম নিয়ন্ত্রন ব্যতিরেকে, তহবিলে সংগৃহীত অর্থের শিকড় কোথায় তার উপরে নজরদারির যেকোনও ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে নিজেদের ইচ্ছামত সংগৃহীত অর্থের চূড়ান্ত অপব্যবহার করার উদেশ্যেই এসব ঘটেছিল। এর বিরুদ্ধে যেকোনও সমালোচনাকে স্তব্ধ করতে বুলডোজারের কায়দায় অবরোধ তৈরি করা হয়েছিল।

এমন পরিস্থিতিতে যে বা যারা এই অপরাধমূলক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তাদের জন্য একটাই পথ খোলা ছিল, সেটাই সুপ্রিম কোর্ট, দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মামলার সওয়াল জবাব চলার সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকারের একমাত্র উদ্যেশ্য ছিল যেন তেন প্রকারেন এই সম্পর্কে কোনরকম তথ্যই জনসাধারণের থেকে আড়াল করে রাখা। বন্ডের খরিদ্দার ও প্রাপক দুয়েরই পরিচিতি গোপন রাখার কৌশল ( ঐ আলফানিউমেরিক কায়দা) থেকেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। এমন সিদ্ধান্তে জনসাধারণের তথ্য জানার অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়। এখন বোঝা যাচ্ছে কে কাকে কত অর্থ সাহায্য করেছে। আরও দুটি তথ্য সামনে এসেছে। এক, বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য কোনও স্বতস্ফূর্ত দানের ব্যবস্থা নয়। জনসাধারণের সামনে বিষয়টি গোপন রাখা হচ্ছিল সেই কারণেই। দুই, কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক দলের তহবিলে যথেচ্ছ দানের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে যে বিবিধ অর্থনৈতিক দুর্নীতিকে আড়াল করা যেত, স্বচ্ছ নির্বাচনী বন্দোবস্তের নামে আসলে এটা নিজেই এক বিরাট দুর্নীতি।

এই বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষনায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়কে এই প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। তথ্য জানতে জনসাধারণের সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষেই এই রায়। সুপ্রিম কোর্ট কার্যত সংবিধানের বুনিয়াদি ভাবনাকেই সুরক্ষিত রেখেছে, তাকেই তুলে ধরেছে। এই কারণেই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে আসার রায় হয়েছে। রায় ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বিজেপি বেকায়দায় পড়েছে। এই বন্ডকে কার্যকরী করার প্রধান ব্যাক্তিটি ছিলেন অমিত শাহ। তিনি মরিয়া হয়ে কিছু মনগড়া হিসাবনিকাশ করেছেন এবং প্রচার করতে চাইছেন এর মাধ্যমে নাকি বিরোধীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। এসব কথাবার্তার পিছনে একটাই উদ্যেশ্য। নির্বাচনী বন্ডের সুবাদে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বিজেপি – এই সহজ সত্যটি আড়াল করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দেশে নির্বাচনী আইনে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার বিধি রয়েছে। অথচ নির্বাচনী বন্ডে সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছে বিজেপি। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল নিজের দিকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা টেনে আনতে পারে। এমন বন্দোবস্ত অবশ্যই অসাংবিধানিক। নির্বাচনের ময়দানে সকল পক্ষকে সমান সুযোগ দেওয়ার মৌলিক অধিকারকেই এর মাধ্যমে অকেজো করে দেওয়া হয়।

এই ঐতিহাসিক রায়ের পর নির্বাচনে বিজেপি যে কায়দায় নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব জারী রাখতে চেয়েছিল সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। বন্ডের তথ্য সামনে আসার পরে যা দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট গোটা ব্যাপারটাই আগাগোড়া প্রতারণা বৈ আর কিছু নয়। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াকে সেই প্রতারণার জাল বিস্তারে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি রায় ঘোষণার পরেও অর্থ সাহায্যের দাতা ও গ্রহীতার পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করার কাজে এসবিআইকে দিয়ে ইচ্ছাকৃত দেরি করানো হয়েছে। এমন আচরণ কার্যত আদালত অবমাননার সমান। ১৫ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তাকে আইন মোতাবেক কার্যকরী করতে দেশের সর্ব্বোচ আদালতকে আরও দুবার হস্তক্ষেপ করতে হল।

এই বন্ডের মাধ্যমে মোটের উপরে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে সেকথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কতিপয় খুঁটিনাটিগুলি এখনও উপলব্ধি করতে হবে। কি কি বোঝা যাচ্ছে? এই বন্ড কার্যত বেআইনি অর্থ পাচারের কাজে ব্যবহৃত হতে পারত। আয়কর বিভাগ, ইডি, সিবিআই এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ হিসাবে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে পারতো। যাবতীয় আর্থিক দুর্নীতিকে প্রশ্যয় ও আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি যাবতীয় সুযোগসুবিধাকে একদিকে টেনে রাখার জন্য এমন বন্দোবস্ত কার্যকরী হত। এক কথায় বলা চলে গত এক দশক যাবত মোদী সরকার যা কিছু করতে চেয়েছে তারই একটি সুসংহত ও ঘনীভূত চিত্র হল নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা।

আর্থিক দুর্নীতি প্রসঙ্গে

দেশের আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের তহবিলে কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের মুনাফার সর্বোচ্চ ৭.৫ শতাংশ অবধি দান করতে পারে। এই আইনকে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যথেচ্ছ অর্থসাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোনও বৈদেশিক ব্যবসায়ী সংস্থা দেশের নির্বাচনে পয়সা খরচ করতে পারে না। অথচ দেখা যাচ্ছে নিজেদের ভারতীয় সহায়ক গোষ্ঠী মারফত বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থা অর্থসাহায্য করেছে। কোনও কোনও কর্পোরেট সংস্থার পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে এমন রায়ে কর্পোরেটদের নিরুৎসাহিত করবে, এমন দাবী যে আসলে ভন্ডামী সেকথা সহজেই বোঝা যায়। কর্পোরেট সংস্থাগুলি আগেই নিজেদের মুনাফার ৭.৫ শতাংশ দান করতে পারতো, মুনাফার বাদবাকি অংশ দিয়ে সংস্থার নিজের এবং শেয়ার হোল্ডারদের সমৃদ্ধ করার, লাভবান হওয়ার সুযোগ দিতে পারতো। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমেই তাদের কার্যত শুষে নেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। এমন কায়দা আসলে যেন তেন প্রকারেন টাকা বের করে নেওয়ার কৌশল।

বিপুল লোকসান সত্তেও বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সাহায্যকারী সংস্থাগুলি-

সংস্থার নামমোট কত টাকার বন্ড কিনেছে২০১৯ থেকে এখনও অবধি তাদের লোকসানের পরিমাণ (কোটি)
ভারতী এয়ারটেল লিমিটেড১৯৮৬৫,২৩৯
পি আর এল ডেভেলপার্স২০১১৩৯
ব্রাইট স্তারা ইনভেস্ট প্রাইভেট লিমিটেড১০৫৭৪
পেগাসাস প্রপার্টি প্রাইভেট লিমিটেড১০৬০
প্রেস্টিজ প্রজেক্টস১০১৬
চন্দ্রজ্যোতি এস্টেট ডেভেলপার্স১০১২
এ বি এন এল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড১০১০
ইন্টার গ্লোব অ্যাভিয়েশন লিমিটেড১২৫৬৬
এনএসএল রিনিউয়েবেল পাওয়ার লিমিটেড২৮৫
গ্রিনকো রায়েলা উইন্ড পাওয়ার প্রাইভেট লিমিটেড৬৮

হফতা ওসুলি – পয়সা লুটের গুটিকয় নিকৃষ্ট উদাহরন

স্টেট ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে প্রাথমিক তথ্য প্রদান করা হয়েছে এবং যা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছেন, মোদী শাসনের সময়কালের সুনির্দিষ্ট ভাবে আইটি/ইডি/সিবিআই অভিযানের বিষয়টি দেখলেই নির্বাচনী বন্ডের ক্রয় ও অর্থ সাহায্যের কালানুক্রম বোঝা যায়। ধাঁচ অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সংস্থার অভিযান চালায় আর তার ফলে বন্ড গুলি একের পর এক ক্রয় করা শুরু হয় এবং কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ক্রমশঃ নীরব হয়ে যায়। তাদের কাছে, বন্ড কেনার ও অর্থ সাহায্যের অর্থ হলো কেন্দ্রীয় সংস্থার তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ।

ইলেক্টোরাল বন্ডের সবথেকে বড় ক্রেতা হলো ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেলস প্রাইভেট লিমিটেড, যাঁরা ১৩৬৮ কোটি টাকা খরচ করেছে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ২০২৪ এর মধ্যে। ২০১৯ সালে ইডি এই কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে এবং তাঁদের সম্পত্তি এক্ষেত্রে যুক্ত হয় এপ্রিল ২০২২ থেকে ২০২৩ এর মে মাসের মধ্যে। ২০২২ সালের এপ্রিল ও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তারা নির্বাচনী বন্ড ক্রয় করে। অভিযান পরিচালিত হয় তাঁদের যে সব সম্পত্তি প্রোমোটার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় দ্বারা অধিকৃত সেগুলোর ওপরেও মূলত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ এপ্রিল মাসের মধ্যে। এই সময়কালেও তাঁরা ৩০৩ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে।

ক্যুইড প্রো ক্যুও

বন্ড কেনা সংক্রান্ত প্রাপ্ত তথ্য দ্বারা তুলে ধরেছে ক্যুইড প্রো ক্যুও ধাঁচের প্রশ্নের কিছু সুনির্দিষ্ট যোগ সম্পর্কে, সরকারের থেকে প্রকাশিত ঠিকা ও মেরামতি ক্ষেত্র সুনিশ্চিত করতে যে নীতি আছে তাও বেশ কিছু পরিমাণে বন্ড ক্রয় করার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।

পরিকাঠামো ও নির্মাণের ক্ষেত্র উঠে এসেছে নির্বাচনী বন্ড ক্রয় করার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় ক্রেতা হিসেবে। মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাচার লিমিটেড অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা বন্ডের। তারা প্রচুর পরিমাণে সরকারি প্রকল্প পেয়েছে। তার মধ্যে তেলেঙ্গানার কালীশ্বরম লিফ্ট ইরিগেশন প্রকল্প যেখানে ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের কিক সাপ্লাই চেন প্রাইভেট লিমিটেড ৪১০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যারা কিছু রিলায়েন্স গ্রুপ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। হলদিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এনার্জি লিমিটেড কিনেছে ৩৯৫ কোটি টাকার বন্ড। যেখানে অনিল আগারওয়ালের বেদান্ত লিমিটেড কিনেছে ৩৮৬ কোটি টাকার বন্ড। এরা সকলেই বড় সরকারি প্রকল্প পেয়েছে।

জনগণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে ছেলে খেলা করা সম্ভবত সবথেকে ভয়ঙ্কর দিক এই নির্বাচনী বন্ডের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যার মাধ্যমে ফার্মাসিউটিকাল শিল্প সরকার থেকে অনেক ছাড় পেয়েছে। ৩৫টি ভারতীয় ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি প্রায় ১০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। এরমধ্যে ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে যখন তদন্ত চলছে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে বিক্রির জন্য তখনই তারা বন্ড কিনেছে। ওষুধের বাজার অন্যতম একটি বিষয় যেখানে কোম্পানি গুলি সরকারের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। ফার্ম গুলো স্বল্প মূল্যে জমি, করছাড়, সুবিধাজনক নীতি, প্রাইস ক্যাপ তুলে দেওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে থাকে সর্বদা। হেটেরো ল্যাবস অ্যান্ড হেটেরো হেলথ কেয়ার ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ৩৯ কোটি টাকার বন্ড কেনে। তার আগের মাসেই মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ৬টি নোটিশ বের করে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছাড়ার জন্য। এর মধ্যে তিনটি হলো কোভিড -১৯ এর জন্য ব্যাপক পরিমাণে ব্যবহৃত অ্যান্টি ভাইরাল Remedesivir নামক ওষুধ।

টরেন্ট ফার্মা ২০১৯ এর মে থেকে ২০২৪ এর জানুয়ারির মধ্যে ৭৭.৫ কোটি টাকার বন্ড কেনে। তাদের ওষুধও ড্রাগ কোয়ালিটি টেস্টে ব্যর্থ হয়। Ciders হেল্থ কেয়ার ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নির্বাচনী বন্ড কিনতে ২৯ কোটি টাকা খরচ করে। তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের মানও ক্রমাগত পড়তির দিকে ছিল। গ্লেনমার্ক পাঁচটি নোটিশ পেয়েছিল ২০২২ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে নিম্ন মানের ওষুধ উৎপাদনের জন্য। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিটি  ৯.৭৫ কোটি টাকা খরচ করেছে বন্ডের পিছনে। সিপলা চারটি শো কজ পেয়েছে ২০১৮ থেকে ২০২২ এর মধ্যে। ২০১৯ থেকে তারা বন্ড কিনতে খরচ করেছে ৩৯.২ কোটি টাকা। তালিকা আরও বাড়ানোই যায়। যদি অজ্ঞাত স্থান থেকে দান  কোন বিষয় হয়, তবে এর থেকে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না।

কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক আঁতাত

তিনটি অ্যাপেক্স বডি FICCI, CII ও Assocham এর যৌথ আবেদনের জন্য একটি বিষয় সুপ্রিম কোর্টে যায় যা কোর্ট আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবেদনটি হলো বন্ড স্কিম মারফৎ অনুদানকারীদের পরিচয় যেন প্রকাশ না করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল একটি বিশেষ যুক্তির পিছনে নিজেদের পরিচয় গোপন করা আর সেই যুক্তিটি হলো পরিচয় প্রকাশ পেলে ব্যবসায়িক গোপনীয়তা আহত হবে। ঘটনা হলো এই প্রশ্নের সমাধান হয় সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ যুক্তি প্রতিযুক্তির মাধ্যমে ১৫ই ফেব্রুয়ারি এবং রায় বেরোয় কর্পোরেটদের শীর্ষ সংস্থার কোনও পৃথক ছাড় নেই। এমনকি তাঁদের এই পরিচয় গোপন রাখার আবেদন সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে। এই যৌথ আবেদনটি তথ্যের মৌলিক অধিকার এবং নির্বাচনী স্তরে অনৈতিক খেলায়   যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে সে সম্পর্কে তাদের অজ্ঞাত ও তীব্র অস্বস্তিই কেবল চিহ্নিত করেছে।

শিল্প সংস্থাগুলির পাশাপাশি আরএসএসও সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই বিরুদ্ধে অবস্থান করছে এবং নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাইছে। আরএসএস এর সাধারন সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে যুক্তি দিয়েছেন যে এই নিয়ম একটা পরীক্ষামাত্র এবং যে কোনো নতুন বিষয় এলে নানারকম প্রশ্ন ওঠেই।

যা এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট তা হলো এই কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সরকারি স্কিম কে বাঁচানোর মরিয়া প্রচেষ্টা, রাজনৈতিক তহবিলের পরিচ্ছন্নতার বিপরীতে অবস্থান করে যা চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক ভাবে শুধু বিজেপির পক্ষেই লাভজনক। এর ফলে যা হবে তা সবরকমের আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। এই মরিয়া প্রচেষ্টা আসলে দেখিয়ে দেয় যে কিভাবে করপোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাত নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপের ফলে ধাক্কা খেয়েছে।

আগামী দিনের রাস্তা

কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাতের দ্বারা জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুপ্রীম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় নিশ্চিৎভাবেই এক বিরাট মঞ্চের সামনে দেশের মানুষকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। ঐ মঞ্চ হল সেই পীঠস্তান যাকে আমরা সাংবিধানিক অধিকার বলে চিনি, জানি। ভোটাধিকারের মাধ্যমে নিজেদের সরকার বেছে নেওয়ার রাজনৈতিক অধিকার একমাত্র ভারতের জনগণের, এটাই নির্বাচনী আইনে সকলের জন্য সমান সুযোগের ভিত্তি। কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাত দ্বারা পরিচালিত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার যেভাবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রনের অপচেষ্টা চালাচ্ছিল ১৫ই ফেব্রুয়ারির ঐ যুগান্তকারী রায় তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে।

বিজেপি অবশ্য ইতিমধ্যেই নতুন কৌশল অনুসরণ করা শুরু করেছে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মূলধারার মিডিয়া এবং অবশ্যই, সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা সৃষ্ট নিজেদের ঝুটা আধিপত্যকে পুনরায় কায়েম করার উদ্দেশ্যে ভোটারদের অস্পষ্ট এবং ভুল তথ্য পরিবেশিত করা শুরু হয়েছে। সমাজের উপর থেকে নিচ অবধি সুপ্রীম কোর্টের রায়কে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এটাই বিজেপি বিরোধিতার অন্যতম একটি কর্তব্য। এমনটা না করা অবধি সংবিধানের মৌলিক নীতির স্বপক্ষে তিলমাত্র জয়কেও সুসংহত করা যাবে না। আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোর জন্য জনগণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় চ্যালেঞ্জ।

সুত্রঃ গনশক্তি

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

Spread the word

Leave a Reply