ময়ূখ বিশ্বাস
আজকের ‘নতুন ভারতে’ তথ্য সহকারে একজন প্রগতিশীল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে চিত্রিত করা, সত্যিই কঠিন কাজ! সাম্প্রতিক কালে অনন্ত মহাদেবন পরিচালিত হিন্দি জীবনীমূলক চলচ্চিত্র ‘ফুলে’ সামাজিক সংস্কারক জ্যোতিরাও ফুলে ও সাবিত্রীবাই ফুলের জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে। এখন দেশের শাসকের কোপে পড়েছে সেই ‘ফুলে’!

মহাত্মা ফুলে তাঁর সমগ্র জীবন কাটিয়েছেন বর্ণভেদের বিরুদ্ধে এবং নারীশক্তির বিকাশের জন্য সংগ্রাম করে। তিনি মালি সমাজ থেকে উঠে এসেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বি আর আম্বেদকর, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর, পঞ্চানন বর্মা, দশরথ দেব, বেগম রোকেয়াদের মতো তিনি ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাই ফুলে সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বিশেষত সমাজের প্রান্তিক চিরবঞ্চিত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে শিক্ষার আলোর গুরুত্ব ওনারা অনুভব করেছিলেন। সাবিত্রীবাই ফুলে ছিলেন ভারতের নারী অধিকার আন্দোলনের এক অগ্রদূত। তাদের এই সমাজ সংস্কারমূলক কাজ মোটে পছন্দ করতেন না সমাজের উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল সমাজপতিরা, মূলত উচ্চতম ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা, যারা নারী স্বাধীনতা- নারী অধিকারের ঘোর বিরোধী। মনে রাখতে হবে, ঠিক একই সময় একই গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বাংলায় তখন লড়াই করছেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়রা। এই সমাজপতিরা বাধ্য করে জ্যোতিরাও ও সাবিত্রীবাঈকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে একঘরে করার। তবু হার মানেননি ফুলে দম্পতি। সেসময় তাঁরা নীচু জাতের মূলত দলিত সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের জন্যে স্কুল খুলতে বদ্ধপরিকর। মহাত্মা ফুলে ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীবাঈ কোনোও রকম চোখ রাঙানীর পরোয়া না করেই বাড়ি মহল্লা ছেড়ে চলে যান। এই সময় ফতিমা বেগম ও তার ভাই আশ্রয় দেন ফুলে দম্পতিকে এবং এই মুসলিম পরিবার ফুলেদের স্কুল চালাতেও সাহায্য করেছিলেন। অবশেষে ফুলে দম্পতি ১৮৪৮ সালে পুনেতে প্রথম মেয়েদের স্কুল খোলেন। এগুলোর বেশিরভাগই ঐতিহাসিকভাবে প্রামাণ্য তথ্য। কিন্তু এখন মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার এই বর্ণভেদের বিরুদ্ধে লড়াই বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছবিগুলো পছন্দ করে। তাই এরা উদ্যোগ নিয়েছেন ওনাদের ইতিহাস মুছে ফেলার বা অর্ধসত্য প্রচার করার। সাবিত্রী বাঈ ও ফতিমা বেগমকে আলাদা করার। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই সিনেমার ওপর কাঁচি চালানো।
প্রতীক গান্ধী ও পাত্রলেখা অভিনীত এই চলচ্চিত্রটি আগে এই বছরের ১১ এপ্রিল (জ্যোতিরাও ফুলের জন্মদিবস) মুক্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কিছু উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর প্রতিবাদের কারণে এটি পিছিয়ে দেওয়া হয়। ট্রেলার বের হওয়ার সাথে সাথে মহারাষ্ট্রের কিছু ব্রাহ্মণ্যবাদী সংগঠন (মমতা যেমন এখানে পুরোহিত সম্প্রদায়ের সাথে বসে) আওয়াজ তোলা শুরু করে। দাবি করে যে চলচ্চিত্রটি তাদের সম্প্রদায়কে অপমান করেছে। সত্যিই তো! সিনেমাটি তো আক্ষরিক অর্থেই উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত দলিত জাতিগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচারের গল্প। কীভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল এবং তাদের নির্যাতন করা হতো। সেই রামায়ণে শাস্ত্রজ্ঞ নীচু জাতের শম্বুজের কান কেটে যা মান্যতা দেওয়া! এগুলো আমরা সবাই জানি।
এখন মূলতঃ বিজেপি আরএসএস জমানায় সিনেমার সেন্সর বোর্ড (CBFC)ও আরএসএস কর্মীর মতো ভূমিকা পালন করেছে। এই Central Board of Film Certification (CBFC)-ই বর্ণভিত্তিক বৈষম্য তুলে ধরা বেশ কিছু দৃশ্য কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। এই চলচ্চিত্রটি ৭ এপ্রিল ‘U’ সার্টিফিকেট পায়, কিন্তু নির্মাতাদের ‘মাং’, ‘মহার’ ও ‘পেশোয়াই’ শব্দগুলি মুছে ফেলতে বলা হয়। ‘একজন মানুষ ঝাঁটা বহন করছে’ বা ‘ছেলেরা সাবিত্রীবাঈয়ের দিকে ব্রাক্ষণ শিশুরা গোবরের বল নিক্ষেপ করছে’ এই দৃশ্যগুলো ছেঁটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়, এবং ‘৩০০০ বছরের পুরনো গোলামি’ লাইনটিকে পরিবর্তন করতে বলা হয়। সেন্সর বোর্ড ও উচ্চবর্ণের মাতব্বরদের মতে এই চিত্রায়ণ ‘মিথ্যা এবং উচ্চবর্ণকে একমুখী নিষ্ঠুর হিসেবে চিত্রিত করে উসকানি দিচ্ছে।’ কিন্তু সাবিত্রী বাঈয়ের ওপর উচ্চবর্ণের অপমান ভীষণভাবে সত্যি এবং ইতিহাসবিদদের (অবশ্যই অক্ষয় কুমার বা কঙ্গনা রাণাওয়াতের মতো ঐতিহাসিক নন তাঁরা) দ্বারা স্বীকৃত। আসলে এই সেন্সর বোর্ড চায়, ‘ফুলে’ চলচ্চিত্র থেকে সব বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে শব্দ, দৃশ্য মুছে ফেলা হোক। কারণ ওনাদের মতে এটি উচ্চবর্ণদের ‘uncomfortable’ করে তোলে। অথচ আমাদের দেশে বর্ণভেদ-জাতিভেদ আজকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সির দুনিয়াতেও ভীষণভাবে বাস্তব। কারণ আমরা দেখি, রাজস্থানের প্রখর গ্রীষ্মে উচ্চজাতের শিক্ষকের থেকে জল খেতে গিয়ে দলিত ছাত্রকে প্রাণ হারাতে হয়। এদেশেই এলাহাবাদে একজন বিচারক তাঁর চেম্বার গঙ্গাজল দিয়ে পরিষ্কার করেন। কারণ সেই চেম্বার ও চেয়ারে আগে একজন দলিত বিচারক বসতেন। এটাই আমাদের দেশের নির্মম বাস্তব যে, দলিত পুরুষরা তাদের নিজেদের বিয়ের দিনেও ঘোড়ায় চড়তে পারে না। বৃদ্ধ চিমাওয়ারি মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে খুন হন শুধু দলিত হওয়ার অপরাধে।
এই ঘটনাগুলোর চিত্রায়ন করলেই তাই আজকের নয়া ভারতে সমস্যা। কিছুদিন আগে মালায়লম ছবি, ‘এল২:এম্পুরান’ এর ২৪টি দৃশ্য কেটে ফেলা হয়। কারণ মোহনলাল অভিনীত ওই ছবিটিতে গুজরাত দাঙ্গায় গেরুয়া কোম্পানি মুখোশ উন্মোচিত করা হক্যেছিলো। এরপর ছবিটির ‘আনকাট’ এডিশনটি গোটা কেরালায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে সিপিআই(এম)। এসব দেখে মনে হয় ‘ফুলে’ সিনেমার পরিচালক অনন্ত মহাদেবন মোগলদের গাল দিয়ে বা ‘কেরালা স্টোরি’, ‘কাশ্মীর স্টোরি’র মতো মিথ্যা রচনা লিখলে হয়তো বিজেপি শাসিত রাজ্যে ট্যাক্স ফ্রি হয়ে বক্স অফিসে রাজ করতেন।

কিন্তু সবাই শিরদাঁড়া বেচে দেয় না।
‘ফুলে’র পরিচালক অনেক কষ্ট করে সিনেমাটিতে ঐতিহাসিক বস্তনিষ্ঠ করে তুলেছেন। তাই সংঘ পরিবারের শাসককূল ও তাদের রক্ষণশীল সমাজপতি মিত্রদের চক্ষুশূল হয়েছেন। এভাবেই কমেডিয়ান থেকে পড়ুয়া, সিনেমা থেকে খেলা- সব জগতের লোকেরা শিকার হচ্ছেন নয়া ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন।
ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রয়োজন সে কারনেই।