Economics or Political Economy – Dr.Tanushree Chakraborty


২০ নভেম্বর ২০২৩, সোমবার

আজকের আলোচ্য বিষয় ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা। এই আলোচনায় যাওয়ার আগে, আমাদের জানা দরকার অর্থনীতি বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি। অর্থনীতির প্রসঙ্গ এলেই, মানুষের মধ্যে একটা ভীতির ভাব তৈরি হয়। বিষয়টি জটিল ও দুর্বোধ্য, এমন একটি ধারণা অনেকের মধ্যেই বদ্ধমূল হয়ে আছে। বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানার আগেই যদি মনে হয় এটি দুর্বোধ্য তাহলে জানার আগ্রহ এবং চেষ্টা দুইই কমে যায়। সাধারণ মানুষের এই ধারণা সমাজের অনেকের পক্ষে সুবিধা জনকও বটে। আমাদের দেশে যেখানে সমাজের এক অতি ক্ষুদ্র অংশের হাতে অপরিমেয় ঐশ্বর্য জমা আছে, অন্যদিকে ব্যাপক জনগণ দরিদ্র হতে দরিদ্র হচ্ছে। এই অবস্থায় এই কার্যকরণ বিশ্লেষণ বা অনুসন্ধান সুবিধাভোগীদের কাছে অপ্রীতিকর অবাঞ্ছিত মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সমাজে সম্পদের উৎস, তার বন্টন ইত্যাদি নিয়ে যে শাস্ত্র চর্চা করে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ যত কম থাকে সমাজের কর্ণধারদের পক্ষে সেটা ততই মঙ্গলকর। বিষয়টি জটিল ও সাধারণের বোধশক্তির বাইরে এ ধারণা বজায় রাখতে পারলে, সুবিধাভোগীদের সুবিধাও বেশি।

কিন্তু যারা সমাজে এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করছে, তাদের অন্যতম দায়িত্ব হল, এই বৈষম্যের কারণ বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে তার সমাধানের পথ অনুসন্ধান করা।

সামাজিক উৎপাদন, বিনিময়, বন্টন, ভোগ এবং -এর ভিত্তিতে যে উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি হয়- এসব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে অর্থনীতি শাস্ত্র। সে কারণে মার্কস বলেছিলেন যে অর্থনীতিই সব ধরনের সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি, কারণ মানুষকে প্রথমেই তার মিলিত শ্রমে আহরিত সম্পদের বিনিময়ে, বন্টন, ভোগের ব্যবস্থা করতে হয়েছে আর এর জন্য যে নিয়ম নীতি বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় যে গড়ে তুলেছে তাকে কার্যকরী করা, সকলের নিকট তা গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি করতে হয়েছে।

ভিন্ন ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক নিয়ম ও ভিন্ন হতে বাধ্য। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা, দামব্যবস্থা, ভূমিদাস ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এর প্রত্যেকটির অর্থনীতি স্বতন্ত্র।

Communist Manifesto

ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে হলে, উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবস্থান বোঝা দরকার। ৩০০ বছর ধরে মানবসমাজ পুঁজিবাদকে দেখে আসছে। ১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছিলেন, “আগেকার সকল যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য হলো- উৎপাদনে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক পরিবেশে অব্যাহত বিশৃঙ্খলা, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা। ১৯১৬ সালে লেনিন পুঁজিবাদের পরিবর্তিত রূপকে চিহ্নিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে। এর পাঁচটি বুনিয়াদি লক্ষণের কথা বলেছিলে :

১) উৎপাদন ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন এমন একটা উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছে  যে, তা থেকে সৃষ্টি হয়েছে একচেটিয়া (Monopoly) কারবারের, এবং অর্থনৈতিক জীবনে একটা নির্ধারক ভূমিকা তারা নিয়েছে।

২) শিল্প পুঁজির সঙ্গে ব্যাংক পুঁজির মিশ্রণ এবং এই “ফিনান্স পুঁজির” -এর ভিত্তিতে ফিনান্স চক্রতন্ত্র।

৩) পণ্য রপ্তানির তুলনায় পুঁজি রপ্তানির অসাধারণ গুরুত্ব বৃদ্ধি।

৪) পুঁজিপতিদের আন্তর্জাতিক একচেটিয়া সংঘ গুলির উদ্ভব, নিজেদের মধ্যে যারা বিশ্বের বাটোয়ারা করে নিয়েছে।

৫) বৃহত্তম পুঁজিপতি শক্তি সমূহের মধ্যে বিশ্বের আঞ্চলিক বাটোয়ারার পরিসমাপ্তি”।            

সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের চরম পর্যায়ে হলেও গত ১০০ বছরে সাম্রাজ্যবাদ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। তা বিভিন্ন পর্ব অতিক্রম করে আজকের চেহারায় পৌঁছেছে।

ভারতের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। BUY ONE GET ONE FREE -এর মত মোদি সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ইতি টেনে দিয়েছে। সমাজ ও রাজনীতির উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে কর্পোরেট পুঁজির মারণ ছায়া। যার ফলস্বরূপ শ্রমিকদের অধিকারের ধারাবাহিক সংকোচন চলছে। পুরনো শ্রম আইন পরিবর্তন করে পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সুবিধার্থে তৈরি হয়েছে “শ্রমকোড”। শ্রমিকদের দরকষাকষির সুযোগ তলানিতে ঠেকেছে। আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়লেও প্রকৃত মজুরির অধগতি লক্ষণীয়। উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুনাফার অংশ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

ভারতের সংগঠিত ক্ষেত্রে নেট এডেড ভ্যালুতে মুনাফার অংশ ১৯৮১-৮২ সালে ছিল ১৮.৯ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ৩৮ শতাংশ।  অন্যদিকে মজুরির অংশ ৩০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮.৯ শতাংশ।

২০২০-২৩ -এ যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ২৩.২ শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে। নজিরবিহীন বেকারত্বের সাথে চড়ামূল্যস্ফীতি জনসাধারণের জীবন যাপনকে অসহনীয় করে তুলেছে। কৃষির ক্ষেত্রে স্থায়ী কর্ম সংস্থান  বৃদ্ধির জন্য সেচের সম্প্রসারণ এবং সারের ব্যবহার বৃদ্ধি দরকার। এই দুই ক্ষেত্রেই বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। স্বল্প বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে NREGA কে হত্যা করার মাধ্যমে লক্ষ্য লক্ষ্য দরিদ্র মানুষের জীবন রেখা মুছে দেওয়ার ব্যবস্থা চলছে। পেট্রোপণ্যের উপর ভর্তুকি হ্রাসের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে সাধারণ গরিব মানুষের জীবনে।

স্বনির্ভর গোষ্ঠী স্ব-উদ্যোগী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণের গুরুত্ব বলা হয়েছে।

কিন্তু ঋণের উৎস, সুদের হার, ঋণ কাঠামোর বিন্যাস নিয়ে বাজেটে কিছুই করা হয়নি।

adani economy

দেশের অর্থব্যবস্থার জীবনরেখা ব্যাংক এবং বীমা শিল্প। বেসরকারি ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানিগুলির সাথে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েও আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বীমা প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার সিংহভাগ দখল করে আছে এবং গড়ে তুলেছে বিশালায়তন জাতীয় সম্পদের ভান্ডার।

কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের বলগাহীন জনবিরোধী বেসরকারিকরণের নীতি এই শক্তিশালী স্তম্ভগুলোকে ধান্দাবাজ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে।

অথচ এই সময় মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের মুনাফা বেড়েছে বহুগুণ। The Economic Times ( ২২ শে মার্চ, ২০২৩) -এর তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে মুকেশ আম্বানির মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫০ শতাংশ। আদানির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১২২৫ শতাংশ। কেন্দ্রের সরকার ২০২১-২২ -এর বাজেটে ১ লক্ষ ৭৫ কোটি টাকা সংস্থান করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ও আর্থিক ক্ষেত্র বিক্রি করে। সরকারি জমি, রেললাইন, স্টেশন, বন্দর, বিমানবন্দর বিক্রির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে তৎপর মোদি সরকার। আর এইসব সম্পদ আত্মসাৎ করছে আম্বানি, আদানির মতো মুষ্টিমেয় কর্পোরেট পুঁজিপতি গোষ্ঠী। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২- ২৩ এই সময়কালে মধ্যে কর্পোরেটদের অনাদায়ী ঋণ মুকুব এর মাধ্যমে লোপাট হয়েছে ব্যাংকের ১২ লক্ষ কোটি টাকা।

একচেটিয়া পুঁজি এই নয়া গোষ্ঠী আদি পুঁজিপতিদের থেকে আলাদা। এই নয়া গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট মতবাদকে আরো জোরালো করার জন্য অনেক বেশি আগ্রাসী ও মারনাত্মক।

ভারতের পুঁজিবাদের আগ্রাসী নীতি, আদানির উন্মোচিত মুখোশ, নিরব মোদী, মেহুল চকসি -র দেশ ছাড়া কোন কিছুই মানুষের অজানা নয়।

দেশের প্রধানমন্ত্রী মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হারের প্রচার চালালেও, মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে ভারতের স্থান তলানিতে (১৪২) ঠেকেছে। দেশের সম্পদ লুট করতে উদ্দত লুটেরা পুঁজিবাদী অশুভ শক্তি। এর বিরুদ্ধে গোটা দেশের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করা কোন ঐচ্ছিক ব্যাপার নয়, বাধ্যতামূলক কাজ। লড়াইয়ের ধরন পাল্টালেও লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুকে আরো শক্তিশালী করে তোলাই সচেতন মানুষের একমাত্র দায়িত্ব।

সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। যারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয় কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে রক্তের হোলি খেলছে, তাদের সমূলে উৎপাটন সম্ভব একমাত্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে। অন্যায় যে করে তার থেকেও বেশি দোষী অন্যায় যে সহ্য করে। তাই গরিব খেটে খাওয়া মানুষের শ্মশানের চামড়া পোড়া গন্ধে হাত না সেঁকে আর মিথ্যা চোখের জল না ফেলে এই ফ্যাসিস্ট সরকার এবং তার মদতপুষ্ট কর্পোরেটদের বিনাশই একমাত্র পথ সুস্থ আর্থসামাজিক ক্ষেত্র গড়ে তোলার।

                                                         

Spread the word

Leave a Reply