প্রভাত পট্টনায়েক
বেনিয়াবাদী’রা (মার্কেন্টাইলিস্টস) একটি দেশের সমৃদ্ধিকে মূল্যবান ধাতুর পরিমাণের মাধ্যমে এবং দেশের প্রগতিকে মূল্যবান ধাতুর পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করেছিল। মূল্যবান ধাতুর পরিমাণ বাড়ানোর জন্য একটি দেশের পণ্য ও সেবার বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকা প্রয়োজন (অর্থাৎ এমন অবস্থা যখন রপ্তানির পরিমাণ আমদানিকে ছাড়িয়ে যাবে), যার বিনিময়ে মূল্যবান ধাতু- বিশেষত সোনা আমদানি করা হবে, ফলে দেশের সোনার মজুত বাড়বে।
অ্যাডাম স্মিথ তাঁর মহাগ্রন্থ ‘দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস’ রচনার সময় ঐ বেনিয়াবাদীদেরই নিশানা করেছিলেন। স্মিথের অবস্থান ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একচেটিয়া বণিক সংস্থাগুলির দাবি অনুযায়ী মূল্যবান ধাতুর মজুত নয়, বরং একটি দেশের পুঁজির পরিমাণই তার সম্পদ নির্ধারণ করে। তাই প্রগতির অর্থ ক্রমবর্ধমান হারে পুঁজি সঞ্চয়, যার জন্য সবচেয়ে অনুকূল অবস্থা তৈরি হয় বাজার ও পুঁজির কার্যকারিতার উপর রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত যাবতীয় বিধিনিষেধ অপসারণের মাধ্যমে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে মুক্ত-বাণিজ্যনীতির শর্তটি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এমনটি ঘটবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত একচেটিয়া বেনিয়া সংস্থাগুলির তরফে বাজারের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে অপসারণ করেই এমনটি ঘটানো সম্ভব ছিল। স্মিথের অবস্থানের লক্ষণীয় দিক হল অর্থনীতিশাস্ত্রের পূর্ববর্তী ধারণাগুলির সাথে তাঁর মতামত বৈপ্লবিক দিক থেকে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতির মূল ধারনাটি তখনও জনগণের বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ার বদলে দেশের প্রসঙ্গেই কেন্দ্রীভূত ছিল। কোনও দেশের সম্পদ যাকে জনগণের ঊর্ধ্বে একটি সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয় ক্রমাগত তার ধারণা বদলে যেতে থাকে। প্রথমে সোনা পরে রূপা এবং পরবর্তীকালে পুঁজি মজুতের পরিমাণের মাধ্যমে সম্পদ নির্ধারিত হতে থাকে। কিন্তু আগেও যার সম্পদের কথা বলা হচ্ছিল সেই সত্তার ধারণাটি কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলায়নি। ‘জনগণ’ থেকে পৃথক ও তাদের ঊর্ধ্বে অবস্থিত দেশের এই ধারণা ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের একটি বৈশিষ্ট্য যা ইউরোপে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তিচুক্তি-র পরই উদ্ভব হয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের অধীনে ঐ ধারণা এক চরম মাত্রায় পৌঁছলেও এখনও ধারণাটি বুর্জোয়া চিন্তাধারার সমগ্র পর্যায়ের একটি সাধারণ বিষয় হিসাবেই রয়েছে।

অবশ্য দেশের অবস্থান যখন জনগণের ঊর্ধ্বে তুলে ধরার সময় ‘জাতীয় স্বার্থ’কে বকলমে নির্দিষ্টভাবে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সঙ্গেই শনাক্ত করা হত। তাই অর্থনিতির অভিমুখ বেনিয়াবাদ থেকে অ্যাডাম স্মিথের দিকে সরে আসার অর্থ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একচেটিয়া বণিক সংস্থাগুলির স্বার্থকে ‘জাতীয় স্বার্থ’-র সমার্থক হিসাবে আর মহিমান্বিত না করে উদীয়মান উৎপাদনশীল বুর্জোয়াদের স্বার্থকেই ‘জাতীয় স্বার্থ’-র মূর্তরূপ হিসেবে বিবেচনা করা। বুর্জোয়াদের এই শেষোক্ত অংশের স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়াই তখন দেশের স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দেশ সম্পর্কিত সেই ধারণাকে আঁকড়ে ধরেই এমন পরিবর্তন ঘটে। সম্পদ হল সেই সত্তা যার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে হবে এবং যা জনগণ থেকে পৃথক ও তাদের ঊর্ধ্বে অবস্থিত।
প্রগতি সম্পর্কে ডেভিড রিকার্ডোর ধারণাটি প্রায় অ্যাডাম স্মিথের মতোই, অর্থাৎ দেশের অধিকারে থাকা পুঁজি সঞ্চয়ের তত্ত্ব। তার আশঙ্কা ছিল ঐ বন্দোবস্ত এমন এক স্থিতাবস্থার দিকে এগিয়ে যাবে যখন পুঁজির সঞ্চয় বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধারণা থেকেই উদ্ভূত হয় পুঁজির মজুতই হল দেশের সম্পদ, পুঁজির সঞ্চয় বন্ধ হওয়া মানে প্রগতির সমাপ্তি। জন স্টুয়ার্ট মিল নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে একজন ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি দাবি করলেন যে স্থিতাবস্থা নিয়ে তিনি ততক্ষণ অবধি চিন্তিত নন যদি শ্রমিকরা অর্থনীতির আগেকার অবস্থা অর্থাৎ পুঁজি সঞ্চয় হওয়ার সময়ের চাইতে ভালো থাকেন। অর্থাৎ স্মিথ ও রিকার্ডোর মতোই পূর্ববর্তী অর্থশাস্ত্রীদের অবস্থান থেকে তিনি সরে আসেন। তিনি শ্রমিকদের কল্যাণকে পুঁজি সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতি (পলিটিক্যাল ইকোনমি)-র অবস্থান থেকে তাঁর এহেন বিচ্যুতির আসল কারন তাঁর স্ত্রী। হ্যারিয়েটের প্রভাবেই মিল এক নির্দিষ্ট সমাজতান্ত্রিক অবস্থানের দিকে এগোচ্ছিলেন।
তবে পুঁজি মজুতের পরিমাণকে (এবং তার দ্বারা উৎপাদিত উৎপাদনের পরিমাণকে) প্রধান কাম্য হিসেবে বিবেচনা করার জন্য, সেই কর্মযজ্ঞে কর্মরত জনগণের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ না করার জন্য স্মিথ ও রিকার্ডোর মতো ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রীদের খুব বেশি কড়া সমালোচনা করা উচিত নয়। শ্রমিকদের জন্য তাঁদের অনেক সহানুভূতি ছিল কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে জীবনের বস্তুগত অবস্থার উন্নতি হলেই শ্রমিকরা দ্রুত প্রজনন করতে থাকে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের প্রভাবেই এমন ধারণা গড়ে ওঠে। যদি প্রকৃত মজুরি জীবিকার স্তরের উপরে উঠে গেলে জনসংখ্যা বাড়বে এবং তখন শ্রমের জোগান বৃদ্ধি পেয়ে প্রকৃত মজুরিকে পুনরায় জীবিকার স্তরে ফিরিয়ে আনবে। এর থেকে বোঝা যায় শ্রমিকদের জীবনের অবস্থার উন্নতি কেবল তাদের নিজেদের উপরই নির্ভর করে। শ্রমিকদেরই জীবনযাপনের অভ্যাস বদলাতে হবে, নিজেদের সংখ্যাবৃদ্ধি রোধ করতে হবে। জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নতি সাধনের সময়েই তারা নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া যেকোনো উন্নয়নকে স্থিত রাখতে পারে। যেহেতু অর্থনীতি এ বিষয়ে তেমন কিছুই করতে পারে না তাই অর্থশাস্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে মোট পুঁজির মজুত বৃদ্ধির উপরই। উৎপাদন বৃদ্ধির উপরেও অর্থনীতিকে নির্ভরশীল থাকতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি হলে তবেই সবার জন্য উপলব্ধ সম্পদের মোট পরিমাণ বাড়বে। এর সুবাদে শ্রমিকরাও নিজেদের চিরাচরিত অভ্যাস বদলে নেওয়ার ফল হিসাবে আগের চাইতে অনেক বেশি কিছু পাবে।
তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গে স্মিথ ও রিকার্ডোকে ক্ষমা করা গেলেও পরবর্তীকালের তথাকথিত ‘মূলধারা’র বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রীদের বেলায় কিছুতেই তেমনটা করা চলে না। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বটির প্রতি যাবতীয় বিশ্বাস অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছিল। মার্কস ঐ ধারণাকে ‘মানবসভ্যতার উপর অপবাদ’ হিসাবে বর্ণনা করেন। মার্কসের ঐ বক্তব্য আজ সাধারণভাবে স্বীকৃত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়তেও অবস্থা এতটা ভাল ছিল না। এসব স্বত্বেও ‘মূলধারা’র বুর্জোয়া তত্ত্ব এখনও কোনও দেশের মোট উৎপাদন (জিডিপি)-র মাত্রাকে একটি ‘নেশন’-র সমৃদ্ধির সূচক হিসাবে এবং সেই জিডিপি বৃদ্ধির হারকেই প্রগতির সূচক হিসেবে ধরে রেখেছে। এমন তত্ত্বের অর্থ হল ‘প্রগতি’ কেবলমাত্র পুঁজিপতিদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। ঐ তত্ত্ব বিশ্বাস করে পুঁজিপতিদের তুষ্ট করেই দেশের নিমিত্তে সবচেয়ে ভাল কাজ করা সম্ভব। এই উদ্দেশ্যেই মূলধারার অর্থনীতি বুর্জোয়াদের বাণিজ্যে উৎসাহের যোগান দেয়, তাদের স্বার্থকে এগিয়ে রাখে এবং তাদেরকে বিশেষ আলোকপ্রাপ্ত হিসাবেও বিবেচনা করে। স্মিথ ও রিকার্ডো এমন অবস্থান নিয়েছিলেন কারণ তারা (যদিও ভুলক্রমে) ভেবেছিলেন যে শ্রমিকরা নিজেদের চিরাচরিত অভ্যাস বদলানো পর্যন্ত এর বেশি আর কিছুই করা যায় না। কিন্তু সে যুগ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও অর্থশাস্ত্রীদের অতীতের অবস্থানকে ধরে রাখার অর্থ তারা মতাদর্শগতভাবেই জনগনের এক নির্দিষ্ট অংশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।
নীতি আয়োগের সিইও ঘোষণা করেছেন ৪ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের জিডিপির ভিত্তিতে ভারত এখন জাপানকে পিছনে ফেলে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ঐ পক্ষপাতের সর্বশেষ উদাহরণ এটাই। কোনও কাকতালীয় পরিস্থিতির ভিত্তিতে এমন দাবী করা হয়নি, দেশের এক বিরাট অর্জন হিসাবেই নীতি আয়োগের সিইও ঐ বিবৃতি দিয়েছেন। আর তাই ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসায়িক মহল এহেন উন্নয়নকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ভারতের জনসংখ্যা জাপানের জনসংখ্যার চেয়ে দশ গুণ বেশি। বিবৃতি দেওয়ার সময় সিইও মহাশয় এই সত্যটি উল্লেখ করেননি। কিছুদিন আগেই মোদি মন্তব্য করেছিলেন ভারত শীঘ্রই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি অর্জন করবে। নীতি আয়োগের তরফে ঐ বিবৃতি আসলে সেই মন্তব্যের পিছনে ভোঁ দেওয়ার মতো। জাপান ও ভারতের মতো দুটি দেশের আকারগত ফারাকের প্রশ্নকে একপাশে সরিয়ে রেখে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির সাথে নিজেদের জিডিপির পরিমাণকে তুলনা করার মতো দাবি তখনই অর্থহীন হয়ে ওঠে যখন আমরা জিডিপির উপর মনোনিবেশ করার মতো একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করি। জিডিপি’র ভিত্তিতে প্রগতির মাত্রাকে নির্ধারণের এহেন তত্ত্ব যে শুধু এক বাতিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পুনরাবৃত্তি যা আসলে ম্যালথাসের সেই প্রখ্যাত যুক্তিকে বিশ্বাস করে গড়ে ওঠে তাই নয়, একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে এমন অর্থনৈতিক অবস্থান একেবারেই বেমানান। গণতন্ত্রে জনগণের জীবনযাত্রার অবস্থাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জীবনযাত্রার কতদূর উন্নতি হচ্ছে তারই ভিত্তিতে প্রগতিকে নির্ধারণ করতে হয়।
ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও এমন যুক্তি খাপ খায় না। জাপানকে জিডিপির নিরিখে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাকে উদযাপনের বিষয় হিসাবে যারা বিবেচনা করে সেই দেশ হল জনগণের ঊর্ধ্বে অবস্থিত এমন এক সত্তা যার ‘গৌরবময়’ যাবতীয় অর্জন আসলে জনগণের জীবনযাত্রার অবস্থার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন। যে ‘দেশ’ একসময় সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামকে জনগণের মুক্তির সমার্থক হিসাবে বিবেচনা করেছিল সেই ভূখণ্ডে এমন চিন্তাধারাউপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে নির্মিত চেতনার ঠিক বিপরীত, আগেকার অবস্থানের বিরোধী।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতে জনগণের অবস্থা প্রায় একইরকম শোচনীয় রয়ে গেছে। ২০২৪ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তালিকায় ১২৭টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১০৫, কিন্তু আমাদের দেশে এমনই এক সরকার রয়েছে যারা এহেন মর্মান্তিক সত্যের জন্য লজ্জিত হওয়ার বদলে জিডিপি-র আকার প্রসঙ্গে গর্বের সঙ্গে প্রচার করে চলেছে।
পিপলস ডেমোক্রেসি, ২৬ মে – ১ জুন, ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত
ভাষান্তরঃ অঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সৌভিক ঘোষ
ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত