তিনটি কৃষক বিরোধী অধ্যাদেশ/বিল এর বিরুদ্ধে কৃষকরা ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যদিও মোদির সরকার ও তাদের প্রচারযন্ত্র এই তিনটে বিলকে “কৃষক-দরদী” হিসাবে দাবি করছে। গোটা দেশ জুড়ে বিশেষত পাঞ্জাব,হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশে তীব্র সংগ্রামের ফলে যে চাপ তৈরি হয় তাতে বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প মন্ত্রী শ্রীমতি হরসিম্রাত কৌর বাদল “কৃষকবিরোধী অধ্যাদেশ ও আইন” এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। এটা লক্ষণীয় যে বিজেপির অন্যতম পুরোনো জোটসঙ্গী যারা ২০১৪ সাল থেকে ঐকবদ্ধ্য কৃষক সংগ্রাম, নোটবন্দী, ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, সিএএ / এনপিআর / এনআরসি, ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের মত সমস্ত সিদ্ধান্তেও মোদি সরকারের পাশে অবিচল ছিল সেই শিরোমণি আকালি দলের মন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সরকার তার নিকটতম রাজনৈতিক মিত্রদেরও তোয়াক্কা না করে বড় কর্পোরেট সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের লবিকে খুশি করতে ব্যস্ত। কংগ্রেস পার্টি যারা ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, “কংগ্রেস কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি আইন বাতিল করবে এবং কৃষি পণ্যের বাণিজ্য করবে রফতানি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সহ সব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাগুলিও মুক্ত করে দেবে” কিন্তু আজ তারাও অবস্থান বদল করে বর্তমান প্রতিবাদের সমর্থনে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এটি সিপিআই(এম) সহ অন্যান্য বামদলগুলির যে ধারাবাহিক অবস্থান এবং অবশ্যই সারা ভারত কৃষক সভার যে লাগাতার আন্দোলন তারই যথার্থতা কে মান্যতা প্রদান করে। যদি এই আইনগুলো ‘কৃষকদরদী’ ই হয় যেমনটা শ্রী মোদি দাবি করেছেন তাহলে কেন কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের প্রতিটি আইন দেখার এবং তাদের প্রভাবগুলি বোঝার প্রয়োজন।
রাজ্যগুলোর যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকারের ওপর আক্রমণ এবং কোম্পানি-রাজ চালুর প্রচেষ্টা
বিজেপি সরকার নির্লজ্জের মত দাবি করেছে যে ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাষ্ট ভারতের কৃষকরা স্বাধীনতা পাননি বরং ৩জুন ২০২০ এর তিনটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে, যা এখন সংসদে পাশ হয়েছে, কৃষকদের ভারতে যে কোনও জায়গায় ফসল বিক্রি করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ এই দাবিও করেছেন যে এটি কৃষির জন্য ১৯৯১ সালের মুহূর্ত; তারা মনে হচ্ছে ভুলে যাচ্ছেন যে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়নের নীতিগুলি যা তখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার ফলে মারাত্মক কৃষি সঙ্কট শুরু হয় এবং ৪ লক্ষাধিক দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকের আত্মহত্যার কারণ হয়েছে। ‘কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ)বিল ২০২০’,’কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তির মূল্য নিশ্চিতকরণ ও খামার পরিষেবাদি বিল, ২০২০’ এবং ‘ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধন) বিল, ২০২০’ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিগুলোর পরিপন্থী এবং রাজ্য সরকারগুলির অধিকারের উপর আক্রমণ। কৃষিক্ষেত্র ভারতীয় সংবিধানের সপ্তম তফসিলের রাজ্য তালিকার একটি অংশ এবং কৃষিতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল রাজ্য সরকারগুলোরই রয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাজ্যগুলোকে অগ্রাহ্য করে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে লাগামহীন ছাড় দিতে চাইছে। এই আইনের ফলে কৃষকরা কৃষিব্যবসা, বড় খুচরো ব্যবসায়ী ও রফতানিকারীদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। বেসরকারি সংস্থা ও কৃষিব্যবসার ওপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দেওয়া হবে। যদিও কৃষিক্ষেত্র একটি রাজ্যের বিষয় এবং রাজ্যের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যও রাজ্যের আওতাভুক্ত, ভবিষ্যতে এই কার্যক্রমগুলির উপর রাজ্য সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।কৃষকদের দেওয়া সীমিত সুরক্ষাও অপসারণ করা হবে এবং এক অসম ক্ষেত্রে বৃহৎ কৃষিব্যবসা ও বড় ব্যবসায়ীদের শর্তের ভিত্তিতে তাদের চলাটাই নিয়ম হয়ে যাবে। এই পরিবর্তনগুলোর ফলে কৃষকদের ক্ষমতাচ্যুত করে কৃষিক্ষেত্রে কোম্পানি-রাজ কায়েম হবে।
বাজারগুলোর নিয়ন্ত্রণমুক্তির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে এমএসপি ও গণসংগ্রহকে প্রত্যাহার করা
বিজেপি সরকারের দাবি হল যে ‘কৃষিপণ্য বাণিজ্য ও বাণিজ্য (প্রসার ও সুবিধার্থ)বিল ২০২০’ আন্তঃরাজ্য ও অন্তঃরাজ্য ব্যবসা বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করবে এর ফলে রাজ্য কৃষি উৎপাদন বিপণন আইনের আওতাভুক্ত ফসলের বাস্তবিক বাজারগুলোর বাইরে ও ই-কর্মাসের দ্বারা কৃষকেরা উপকৃত হবে। এমন দাবিও করা হচ্ছে যে এই প্রথম কৃষকেরা যেখানে ইচ্ছা সেখানে তাদের ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পেতে চলেছে। এটা বাস্তবের থেকে অনেক দূরে এবং আদপে বিজেপির আকর্ষণীয় মোড়কে মিথ্যা বলার প্রবণতা ও তার জন্য জোর গলায় প্রচার।সত্য এটাই যে বছরের পর বছর ধরে কৃষকদের হাতে থাকা বেশিরভাগ বিপণনযোগ্য উদ্বৃত্ত বিক্রি হয়েছিল কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (এপিএমসি) এর বাজার চত্বরের বাইরে। সর্বশেষ পরিস্থিতি মূল্যায়ন সমীক্ষাটা দেখিয়েছে যে সমীক্ষার আওতায় থাকা ৩১ টি ফসলের মধ্যে ২৯টি ফসলের ক্ষেত্রে স্থানীয় বেসরকারী ব্যবসায়ীরা ছিল মূল ক্রেতা।শুধুমাত্র অরহর ও ছোলার ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বাজারগুলো (যার অনেকগুলোই আবার এপিএমসি আইনের আওতার বাইরে) ছিল বিক্রয়ের মুখ্য জায়গা। সোয়াবিন বাদ দিয়ে অন্য সব শস্যের ২৫% এরও কম বিক্তি হয়েছে এপিএমসি চত্বরগুলোতে (রওশন কিশোর, “Why farmers are opposing pro-farmer reforms”, হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০)। এপিএমসি বাজারবিহীন রাজ্য হিসাবে ঘন ঘন কেরালা ও বিহারের উদাহরণ টানা হয় যদিও এইদুটো রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেখানে কেরালাতে এপিএমসি বাজার না থাকলেও রাজ্য সরকার নিয়মিত কৃষকদের সমস্যা নিরসনে হস্তক্ষেপ করে সেখানে বিহারে এপিএমসি বাজার তুলে দেওয়ার ফলে ও কোনধরণের সরকারি নজরদারি না থাকায় কৃষকেরা ফসলের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়।
১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে এপিএমসি আইনগুলো চালু করা হয়েছিল বড় ব্যবসাদার ও বড় ক্রেতাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরা ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনীতি বহির্ভূত উপায় প্রয়োগ করে দরিদ্র কৃষকদের থেকে স্বল্প মূল্যে ফসল কিনে নিত। ফসলের মূল্য নির্ধারণ,বাছাই,ওজন এবং ফসলের মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকদের শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যেই এই আইনগুলো প্রনয়ন করা হয়েছিল।সর্বদা কার্যকরভাবে লাগু না হলেও এপিএমসি আইনগুলোর ফলে নিলামের মাধ্যমে ফসল বিক্রির একটা পদ্ধতি শুরু হয় যেখানে প্রতিযোগিতার একটা পরিবেশ ছিল। এইরকম ব্যবস্থার পরেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করা যায়নি। বড় ব্যবসায়ী এবং বড় ক্রেতাদের সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নথীভুক্ত বাজারের বাইরে পণ্য কেনার অনুমতি দেওয়ার অর্থ এই যে পণ্যটি কেনা হবে নিলাম ছাড়াই এবং বড় ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র কৃষকের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে। এমন একটা ব্যবস্থা মজ্জাগত ভাবেই কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী এবং তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষকেরা অনেক সময়েই তাদের ফসল অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয় ধার শোধ করার জন্য , পরিবারের খরচ চালাতে বা পরবর্তি মরসুমে বীজ বপনের খরচ জোগানের জন্য ।তারা একটা অসম ব্যবস্থার মুখোমুখি হবে যখন কোন ধরণের সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে তারা বৃহত পুঁজির সামনে পড়বে। এমনকি বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে চুক্তি চাষ চলছে কৃষকদের প্রায়শই পূর্বনির্ধারিত দাম দিতে অস্বীকার করা হয় (যা সাধারণত অযৌক্তিকভাবে কম এবং সি ২ + ৫০% মেনে চলা হয় না) গুণমান বা বাছাইয়ের বিষয়গুলি উল্লেখ করে বা এমনকি ওজন কারচুপি করে।সহায়ক মূল্য আর থাকবে না এবং কৃষকদের অনিশ্চিত বিশ্ব বাজারে ফসল দাম ওঠা পড়ার সামনে ছেড়ে দেওয়া হবে যেখানে বিশ্ব বাজারে ফসলের দাম কমলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে কিন্তু দাম বাড়লে তারা সেটা পাবে না । এপিএমসি কে দুর্বল করা গণসংগ্রহ ব্যবস্থা ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দুর্বল করার প্রথম পদক্ষেপ। এক দেশ এক করব্যবস্থার মতই এক দেশ এক বাজার এর স্লোগান ও আসলে কৃষি উৎপাদকদের অবস্থা আরো সঙ্গীন করে তুলবে। কৃষকদের হাতাশার কারণ বিপণনের বিধিনিষেধ নয় বরং উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়া ও আশ্বাসিত শস্য সংগ্রহের অভাবই মূল সমস্যা। তিনটি বিলের কোথাও সি২+৫০% হিসাবে নির্ধারিত এমসপি এর থেকে কম মূল্যে শস্য সংগ্রহ করা যাবে না এই কথার উল্লেখ নেই।
যখন তিনটি অধ্যাদেশ / বিল একসাথে পড়া হয় তখন যে কেউ পরিষ্কার করে বুঝতে পারে যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা নির্ধারিত – ভর্তুকি হ্রাস, সরকারি মজুত কমানো ইত্যাদির মত -শর্তগুলোর ভিত্তিতেই এই বিলগুলো তৈরি করা হয়েছে। শান্তাকুমার কমিটিও সংগ্রহ ও মজুত ব্যবস্থার বেসরকারীকরণের সম্পর্কে একই ধরণের পরামর্শ দিয়েছিল এবং কেন্দ্রের সরকারের ভূমিকা হ্রাসের কথা উল্লেখ করেছিল।এই কমিটির আরো প্রস্তাব ছিল যে রাজ্যগুলোর নিজস্ব গণবন্টন ব্যবস্থা(পিডিএস) ও অন্যান্য কল্যাণ প্রকল্প(ওডাব্লুএস)এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের শস্যের বাইরে অতিরিক্ত শস্য কেন্দ্রের সংগ্রহ করা উচিত নয় এবং এই কথা রাজ্যগুলোকে স্পষ্ট করে জানানো হোক এবং এমএসপি এর ওপরে কোন অতিরিক্ত বোনাস দেওয়া থেকেও বিরত থাকা উচিত। বিজেপি সরকার এই অভিমুখেই চালিত হচ্ছে। কেরালার মত রাজ্য যেখানে এলডিএফ সরকার ধান সংগ্রহ করছে ২৭৫০টাকা/কুইন্টাল দরে যা কেন্দ্রের ঠিক করা দরের থেকে ৯০০টাকা/কুইন্টাল বেশি সেখানে এই ধরণের সিদ্ধান্তে কৃষকদের জীবনে কি অভিঘাত পড়বে তা সহজেই অনুমেয়।
মজুতদারী ও কালোবাজারীর নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতা
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের (ইসিএ) সংশোধনীগুলোর ফলে খাদ্যশস্য,ডাল,ভোজ্যতেল, তেলবীজ, আলু , পেঁয়াজ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকার থেকে বাদ যাবে এটা শুধুমাত্র খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে একটা ভয়াবহ আশঙ্কা নয় এছাড়া এই আইন বদলের ফলে কৃষিবিপণন সংস্থা ও ব্যবসাদারেরা কৃষকদের থেকে সরাসরি সীমাহীন পরিমাণে শস্য কিনে মজুত করতে পারবে এমনকি জরুরি অবস্থার সময়েও তাদের এই সুযোগ থাকবে। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতির মত সঙ্কটের সময়ে এটা ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারী রোধে একমাত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এমনকি স্বাভাবিক সময়েও বড় ব্যবসাদারদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক অভ্যাস যে তারা মজুতদারী করে কৃত্রিমভাবে খুচরো বাজারে কৃষিজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ইসিএ ছিল এই ধরণের প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রধান আইনী হাতিয়ার। একদিকে বিজেপি বলছে যুদ্ধ,দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তারা খাদ্যদ্রব্যের বিপণন ও মজুতে নিয়ন্ত্রণ লাগু করবে আবার একই সাথে কৃষিবিলে স্ববিরোধী প্রস্তাব দিয়ে বলছে রফতানিকারীদের মজুতের ঊর্দ্ধসীমা বা খাদ্যশস্যের প্রক্রিয়াকরণ বা অন্যান্য ধরণের কৃষিবিপণনের সাথে যুক্তদের (value chain participants) ইতিমধ্যে স্থাপিত মজুতক্ষমতার ওপরে কোন নিয়ন্ত্রণ চাপানো হবে না। ইসিএ-এর পরিবর্তনগুলো বাস্তবে এর আইনটিকেই অপ্রয়োজনীয় করে দেয়।কৃষি বিপণন সংস্থাগুলোর ওপরে কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে গ্রাহকরা প্রভাবিত হবে,এবং আমরা কৃত্রিম ঘাটতি, মজুতদারী, কালোবাজারী, মূল্যবৃদ্ধির মত ঘটনা নিয়মিত প্রত্যক্ষ করব।১০০% প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ সহ কর্পোরেট সংস্থা ও কৃষি বিপণন সংস্থাগুলোর কৃষিক্ষেত্রে দখলদারি নিশ্চিত করতেই ইসিএ আইনের বদল আনা হয়েছে যদিও সরকারের দাবি এই বদলগুলো আনা হয়েছে শস্য সংরক্ষণের কোল্ড চেন,গুদাম,হিমঘর সহ কৃষি পরিকাঠামো ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ।বিজেপি সরকার কোভিড মহামারির পরিস্থিতিতে কৃষিতে বেসরকারি ক্ষেত্র ও এফডিআই কে আকৃষ্ট করতে উদগ্রীব একইসাথে তারা কৃষকদের জন্য সুলভে প্রাপ্য বিজ্ঞানসম্মত ফসল সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করার তাদের যে দায়িত্ব তার থেকেও সরে আসছে।ফসল সংগ্রহ,হিমঘর,ফার্মগেট ও সংগ্রহকেন্দ্রগুলোর সংযোগকারী পরিবহন কাঠামো ইত্যাদি স্থাপনের নামে ঘোষিত ১ লক্ষ কোটি টাকার কৃষি পরিকাঠামো তহবিলও দেওয়া হবে কর্পোরেট কৃষি বিপণন সংস্থাগুলোকে।
কর্পোরেট চুক্তি চাষের প্রসার
কৃষকদের তাদের পণ্য যেখানেই চাইবে গ্যারান্টিযুক্ত মূল্যে বিক্রির জন্য স্বাধীনতা দেওয়ার দাবির অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ হয় যখন আমরা ‘কৃষি পরিষেবা ও মূল্য নিশ্চয়তার জন্য কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা)চুক্তি’ বিল ২০২০ এর আকর্ষণীয় মোড়কটা উন্মোচন করি। যদিও নামের মধ্যে মূল্য নিশ্চয়তার কথা বলা আছে কিন্তু গোটা অধ্যাদেশটির কোথাও কৃষিবিপণন সংস্থা বা ব্যবসাদার এমএসপি এর কম দামে ফসল কিনতে পারবে না এমন কথা উল্লেখ করা নেই। এমনকি সি২+৫০% মানে কৃষির মোট খরচের ওপরে ৫০% বেশি এই হিসাবে ফসলের দাম নির্ধারিত হবে যেমনটা নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ২০১৪ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারও কোন উল্লেখ নেই। বাস্তবে কেন্দ্রীয় সরকার বাজারকে নিয়ন্ত্রণহীন করেছে এবং এই দুটো বিলের মাধ্যমে,যেমনটা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি,মূল্য সহায়তা ও সংগ্রহের দায়িত্ব প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখানে দাবি করা হচ্ছে যে এই বিলের ফলে কৃষকদের প্রক্রিয়াকারক,মজুতদার,পাইকারি ব্যবসাদার,বড় খুচরো ব্যবসাদার ও রফতানিকারকদের সাথে নির্ভয়ে যুক্ত হতে ক্ষমতা দেওয়া হবে এবং তাদের জন্য সাম্যের ক্ষেত্র তৈরি হবে যেখানে কোন শোষণের আশঙ্কা থাকবে না।আদানী উইলমার, পেপসিকো, ওয়ালমার্ট, রিলায়েন্স ফ্রেশ ইত্যাদি দৈতাকৃতি সংস্থার সাথে দরিদ্র ঋণভারে জর্জরিত কৃষক বা ভাড়াটে চাষীর মধ্যে সাম্যের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে এমনটা কেউ কল্পনা করতে পারে? তারা কৃষককে শেষ করে কেবল কুমিরের অশ্রু বর্ষণ করবে।বাজারের অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি কৃষকের কাছ থেকে অর্থপ্রদানকারীর দিকে স্থানান্তরিত হবে এই দাবি ভিত্তিহীন।কৃষকদের ক্ষমতায়ন করার পরিবর্তে এটি তাদের নির্মূল করার বিনিময়ে সহায়তা করবে বড় জমিদার, বড় পুঁজিপতি কৃষক এবং কৃষি ব্যবসায়ীদের। আদালতের ক্ষমতার ওপরে গিয়ে বিবাদ নিষ্পত্তির সমস্ত ক্ষমতা এসডিএমকে দেওয়া হবে।বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির সাথে বিরোধের ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষকদের নির্ভর করতে হবে আমলাতন্ত্রের দয়ার ওপরে। খাদক কৃষি ব্যবসা এবং কর্পোরেট বাহিনী কৃষকদের স্থানচ্যুত করে কৃষির দখলদারি নেবে এবং কৃষির কর্পোরেটকরণ নিশ্চিত করবে। চুক্তি চাষে জোড় দেওয়ার ফলে কৃষি ব্যবসাগুলির চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী কৃষককে চাষ করতে হবে এবং আজীবন দাসত্ব করতে হবে। এই বিলের উদ্দেশ্য যদি প্রকৃত পক্ষে ছিল কৃষকদের ক্ষমতায়ন, সুরক্ষা এবং দামের নিশ্চয়তা প্রদান তাহলে বিলে কেন মূল্য নিশ্চয়তার কোন উল্লেখ নেই?
“১৯৯১ মুহুর্ত” ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে রাষ্ট্রের ভূমিকার পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার, কৃষি ভর্তুকি ছাঁটাই,এবং কৃষিভিত্তিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার। মূল্য নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং কৃষির খরচ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে কারণ এইক্ষেত্রে একচেটিয়া বড় কর্পোরেটদের দাম নির্ধারণে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এরফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কিন্তু উৎপাদিত ফসলের দাম কমেছে । দুমুখো আক্রমণে নিষ্পেশিত কৃষকরা আর নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির মিষ্টি কথায় বা ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে বোকা বনবে না। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে সাথেই বিদ্যুত আইনে বদল এনে ভর্তুকি তুলে দেওয়া,পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন আইনে বদল আনা,ভূমি ও শ্রম আইনে বদল ঘটানো এর সবই হচ্ছে কর্পোরেটদের ইচ্ছায়। একটি মহামারী এবং লকডাউনের সময় এই আইনগুলোর রদবদলের জন্য সংসদে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো করে পেশ করা হল কৃষকদের বা রাজ্য সরকারগুলোর সাথে কোন রকম আলোচনা না করেই। এমনকি নীচের থেকে এ জাতীয় কোনও জনপ্রিয় দাবি ও ছিল না এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে বিজেপি সরকারের অনেক কিছুই গোপন করার আছে।
শ্রমিকদের সক্রিয় সংহতি সহ কৃষকদের সংঘবদ্ধ সংগ্রাম:
সমগ্র কৃষিজীবি ও শ্রমজীবি জনগণের এই অপিকল্পিত লকডাউনের ফলে আয়ের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের রোজগারের সহায়তা,ঋণ মকুব,খাদ্যশস্য সরবরাহ, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য সুবিধাদির বিষয়ে মনোনিবেশ না করে সরকার কেবল কর্পোরেটদের সীমাহীন ছাড় ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। কর্পোরেট লুটকে সুবিধা করে দেওয়া,এফডিআই এর ওপরে নির্ভর করার বদলে সরকারকে কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সমবায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমবায় চাষ নিশ্চিত করতে হবে। যা প্রয়োজন তা হল- শস্য সংগ্রহের নিশ্চয়তা সহ পারিশ্রমিক বাবদ সি২+৫০% হিসাবে সমস্ত ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া, ন্যূনতম ৬০০টাকা/দিন হিসাবে সমস্ত ক্ষেতমজুরকে মজুরি দেওয়া, আয়কর না দেওয়া সমস্ত গরীব মানুষকে ৭,৫০০টাকা/মাস হিসাবে রোজগার সহায়তা প্রদান, মনরেগার আওতায় ৩০০টাকা/দিন হিসাবে কর্মহীনদের মজুরি দেওয়া,পিএম-কিষাণ যোজনার টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে বছরে ১৮,০০০টাকা করা এবং এর আওতায় ভাড়াটে চাষীদের নিয়ে আসা এবং ভূমিহীন,ভাড়াটে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সম্পূর্ণ ঋণ মকুব করা।খাদ্য সুরক্ষা এবং ব্যাপক সামাজিক সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।
তিনটি অধ্যাদেশ এবং বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারতজুড়ে ৩০০০ টিরও বেশি কেন্দ্রে প্রতিবাদে বিলগুলোর কপি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।শ্রমিক,কৃষক,ক্ষেতমজুরদের সংঘবদ্ধ সংগ্রাম লাগাতার চলছে এবং একে আরো বিস্তৃতি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ৯অগাষ্ট ২০২০ ভারত ছাড় আন্দোলনের বার্ষিকী তে এবং৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ গোটা দেশ জুড়ে বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হয়, এর প্রতিটিতেই ২০লক্ষেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন।অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশান কমিটি তে ২৫০টিরও বেশি সংগঠন রয়েছে এবং এআইকেএস এর অন্যতম প্রধান সংগঠন এছাড়া কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এবং ‘ভূমি অধিকার আন্দোলন’ এই লড়াইয়ে সমর্থন জানিয়েছে এবং লড়াইয়ের সামনের সারিতে আছে। এআইকেএসসিসি ২৫ শে সেপ্টেম্বর ভারত জুড়ে প্রতিরোধ দিবস পালনের ডাক দিয়েছে।পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা বনধ আকারে এটি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ভারতজুড়ে কৃষকদের ব্যাপক প্রতিবাদের কর্মসূচী থাকবে।
শ্রমিক শ্রেণি ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই কর্মসূচীতে সমর্থন জানিয়েছে।ইতিমধ্যেই সংসদের বাদল অধিবেশনে তিনটে বিল পাশ করানোর জন্য পেশ করা হয়। লোকসভায় এনডিএ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তারা বিলগুলো প্রায় কোন আলোচনা ছাড়াই পাশ করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু রাজ্যসভায় তারা তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। ডেপুটি স্পিকার এর সহযোগিতায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই ধ্বনিভোটে বিল তিনটি পাশ করিয়ে নিলে বিরোধীদের তীব্র আক্রমণের মুখে পড়ে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই ঘটনা অভূতপূর্ব।বাম সদস্যরা সংসদের উভয়কক্ষে তিনটি বিলের বিরুদ্ধে সংবিধিবদ্ধ প্রস্তাবের দিকে এগিয়ে যান এবং প্রতিবাদও করেন।বিরোধীরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানালে রাজ্যসভার স্পীকার সিপিআই (এম) এর কে কে রাগেশ, এলামারাম করিম সহ আট বিরোধী সাংসদকে গোটা অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করেন।রাষ্ট্রপতির কাছে একাধিক বিরোধী দল এই তিনটি বিলে সই না করার আবেদন জানিয়েছে। যেখানে কৃষক এবং খেটে খাওয়া মানুষের বিষয়গুলো অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে সেখানে বিজেপি অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করছে। প্রতিবাদগুলো ক্রমশ তীব্র হতে চলেছে এবং যাই হোক না কেন এই কৃষকবিরোধী আইনের বিরোধিতা করা হবে।