কলকাতা, ২৩ মার্চ— ভয়াবহতার গুরুত্ব তিনি নিজেই বুঝে উঠতে পারেননি, সর্বদলীয় বৈঠকে কবুল করলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।
সভা চলাকালীনই মুখ্যমন্ত্রী নিজেই করোনা সংক্রমণে রাজ্যে প্রথম মৃত্যুর খবর জানান। সাত আক্রান্তের মধ্যেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেল, এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অপর্যাপ্ত জোগানের প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘আগে তো আমারা সিরিয়াসনেস টের পাইনি। আমাদের কাছে কোনও পরামর্শও ছিল না।’
হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, বিশেষ পোশাক(পিপিই) থেকে শুরু করে আক্রান্তদের লালারস পরীক্ষার জন্য কিট’র পর্যন্ত আকাল। আগামী দিনগুলিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে তা মনে করছেন বিশেজ্ঞরাও। সর্বদলীয় সভায় সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্য মিশ্র সরকারকে সাবধান করে বলেন,‘ ১০০বছর পর এমন একটি মহামারী এসেছে। যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আমরা ভালো অবস্থায় নেই। কঠিন অবস্থায় যাচ্ছে। সামনের দিন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়েছেন, ‘সংক্রমণের দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় পর্যায়ে ইন্ডিয়াতে আমরা এখনও পৌঁছাইনি। এরপর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে বিপজ্জনক।’
উল্লেখ্য, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সদের জন্য রাজ্য সরকার ৪লক্ষ বিশেষ পোশাকের বরাত দেয়। সেই বরাতের কতটা হাতে এসেছে? বৈঠকেই রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব বিবেক কুমারের কাছে বিশেষ পোশাক কত পরিমাণ রাজ্যের হাতে আছে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান। সচিব জানান,‘ এদিন পর্যন্ত ১৭হাজার ৪০০আমরা পেয়েছি। সন্ধ্যায় আরও ২০হাজার হাতে আসবে।’ এরপরই মুখ্যমন্ত্রী বলেন,‘ আমরা ৪লক্ষ অর্ডার দিয়েছিলাম। ১৭হাজার আর ২০হাজার, সবমিলিয়ে ৩৭হাজার পেয়েছি। দু’-তিন দিনের মধ্যে এই বরাত আমাদের দিতে হয়েছে। আগে তো আমারা সিরিয়াসনেস ছিল না। আমাদের কাছে কোনও অ্যাডভাইসারিও আসেনি।’
গত ডিসেম্বর থেকে বিশ্বে ছড়িয়েছে মারণ ভাইরাস। এদেশে ও রাজ্যে তার বহু পরে সংক্রমণ ঢুকেছে। ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারের কাছে পর্যাপ্ত সময় ছিল মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতির। বিপদ যখন শিয়রে, মুখ্যমন্ত্রী তখন বলেছেন, দু’-তিন দিন আগে বরাত দেওয়া হয়েছে!
মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনা সংক্রমণের সম্ভবনা তৈরি হয়েছে এরাজ্যে। গত মঙ্গলবার প্রথম করোনা সংক্রমণের হদিস মেলে কলকাতায়। আর এখন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, দু’তিন দিন আগে বরাত দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এতদিন তাহলে কী করল প্রশাসন!
নবান্ন সভাঘরে সোমবার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিল রাজ্য সরকার। ওই বৈঠকেই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার সরঞ্জামের কি অপ্রতুল জোগান তা নিজেই তুলে ধরেন মমতা ব্যানার্জি।
এমন একটা বিপর্যয়ের সময়ে এদিন সরকারের তরফ থেকে যে তথ্য সামনে আনা হয়েছে তা খুবই উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতিতে করোনা লক্ষণ ফুটে ওঠা আক্রান্তের জন্য লালারস পরীক্ষার কিট রাজ্যের হাতে আছে মাত্র ৪০টি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন,‘ টেস্ট কিট আমরা পাচ্ছি না। ৪০টা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়ার কথা। কেন্দ্র থেকে না দিলে আমরা কী করব?’ মুখ্যমন্ত্রীর সামনে বলার সময় সংক্রমণের পরীক্ষার কথা তোলেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কী করে টেস্ট করব? কিটই তো নেই। ৪০টা কিট মোটে।’
এখনও পর্যন্ত ২০০কোটি টাকা বরাদ্দ করোনা মোকাবিলায় বরাদ্দ করেছে সরকার। গত সপ্তাহ ধরে এই একই বরাদ্দের পরিমাণ জানিয়ে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। অথচ সংক্রমণ মোকাবিলায় কেরালা সরকারের বরাদ্দ ২০হাজার কোটি টাকা।
সংক্রমণ মোকাবিলায় ২০০কোটি টাকার ভাঁড়ারও শূন্য। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন, ‘২০০কোটি টাকার ফান্ড করেছি। অর্ডার দিতে গিয়েই চলে গেছে।’ সংক্রমণ মোকাবিলার পাশাপাশি গরিব মানুষের জন্য সরকারের কাছে জনধন যোজনা মারফত কেন্দ্রকে ৫হাজার টাকা ও রাজ্য সরকারকে ২হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার পরামর্শ দেন সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী। সব রাজ্যের জন্য আর্থিক প্যাকেজের দাবি জানিয়ে চিঠি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রাজ্যের ২০০০টাকার কী হবে? সরাসরি জবাব দেননি মুখ্যমন্ত্রী। তবে বলেছেন, ‘একমাসের স্যালারি কীভাবে দিতে পারব তার ঠিক নেই।সব দিয়ে দিন।’
কিট পাঠানোর কথা কেন্দ্রের। মিলছে না সংক্রমণ মোকাবিলার কিট। তার প্রভাব পড়েছে। এখনও পর্যন্ত মাত্র ১৪৭জনের লালারস নিয়ে নমুনা সমীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
কিটের মতোই আকাল মাস্কেরও। ৪লক্ষ মাস্কের অর্ডার দিয়ে এদিন পর্যন্ত সরকার হাতে পেয়েছে ১২হাজার ৯১৫টি। সন্ধ্যায় আরও ২৪হাজার পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব। গ্লাভস হাতে এসেছে মাত্র ৮হাজার।
স্যানিটাইজার তৈরির জন্য রাজ্যের হাতে আছে ১লক্ষ লিটার অ্যালকোহল। তা দিয়ে দৈনিক ১০হাজার লিটার স্যানিটাইজার তৈরি করা যাবে।
চাহিদা ও জোগানের এই বিপুল এই ফারাক বুঝিয়ে দিচ্ছে সংক্রমণ মোকাবিলায় অনেক দেরিতে নেমেছে সরকার। বাজারে চাহিদা যখন তুঙ্গে, সংক্রমণ যখন বাড়ছে তখন সরকার কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। মুখ্যমন্ত্রী তাই বলেছেন,‘ মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে না। মার্কেটের এমনই অবস্থা এখন।’ চাহিদার এই অপ্রতুলতা নিয়ে কোনও মন্তব্যে যায়নি রাজনৈতিক দলগুলি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সূর্য মিশ্র সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘সাব সেন্টার থেকে ব্লক হয়ে স্বাস্থ্য ভবনে যে তথ্য আসছে তা যেন কোনোভাবেই কমিয়ে দেখানো না হয়।’ এই অবস্থায় তথ্য গোপন রাখা হলে দুর্যোগ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
সিপিআই(এম) ছাড়াও সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস, বিজেপি, বিএসপি, এনসিপি, এসইউসিআই এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা করোনা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। কংগ্রেসের পক্ষে আবদুল মান্নান ও প্রদীপ ভট্টাচার্য দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আটকে থাকা এরাজ্যের বাসিন্দাদের সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গুজব ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রচার ঠেকাতে সরকারে কড়া হতেও বলেছেন। আরএসপি’র মনোজ ভট্টাচার্য ও অশোক ঘোষ পরামর্শ দিয়েছেন করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এরাজ্যের ইএসআই হাসপাতালের পরিকাঠামোও ব্যবহার করা হোক। সিপিআই’র স্বপন ব্যানার্জি বলেছেন, করোনা মোকাবিলার সময় গরিব মানুষকে সহায়তা ও আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে। ফরওয়ার্ড ব্লকের নরেন চ্যাটার্জি ও হাফিজ আলম সাইরানি বলেছেন, বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাড়িতে গরিব প্রান্তিক মানুষদের রাখার ব্যবস্থা করা হোক। বিজেপি’র জয়প্রকাশ মজুমদার ও সায়ন্তন বসু বলেছেন, করোনার বিপদের সময় দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। তৃণমূলের পক্ষে মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি রাজ্যের অর্থনৈতিক দুরবস্থায় কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন।