তৃতীয় পর্ব
‘৬ ঋষি’ ভেঙে পড়েন,
কাটমানির এত জোর
কপালময় ছিল চন্দন। তারই মাঝে উজ্বল ছিল রক্তবর্ণ টিকা।গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, পরণে ছিল শ্বেতবস্ত্র। গত অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নে ‘মহাকাল লোক করিডোর’ উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
৮৫০ কোটি টাকার প্রকল্পের লক্ষ্য জীর্ণ মহাকাল মন্দির ঘিরে পরিকাঠামোর উন্নয়ন। পাঁচ মাস পুরো পার হতে পারল না। গত মার্চে এক ঝোড়ো হাওয়ার দিনে ভেঙে গেল সেই প্রকল্পের অংশ। মহাকাল লোক করিডোরের উপর বসানো হয়েছিল সাতটি মূর্তি — ‘সপ্তর্ষি’র। সেই সাত ঋষির ছটি মূর্তিই উপড়ে পড়েগেছিল। ভেঙে গেছে কারও হাত, কার মুখ, কারও পা। ১০ থেকে ২৫ ফুটের মূর্তিগুলির তৈরি এবং অন্যান্য নির্মাণ কাজে ব্যাপক লুট হয়ে বলে অভিযোগ। ৮৫০ কোটি টাকার একাংশ বিজেপি-র নেতাদের পকেটে ঢুকেছে বলেই অভিযোগ। নির্মাণকারী সংস্থা আবার মূর্তিগুলি গড়ে দেবে বলেছিল। কিন্তু নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকা মধ্যপ্রদেশে এই কান্ড বেশ সোরগোল ফেলেছে।
এই বিজেপি কী ভাবে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দুর্নীতির তদন্ত করবে? জনগনের টাকা নয়ছয় করা তৃণমূল নেতাদের শাস্তির ব্যবস্থা কী করে করবে মোদী সরকারের আওতায় থাকা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি?
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। অর্থাৎ তিনি ঘুষ খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না। কিন্তু কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল ‘৪০% কমিশন’ নেওয়ার।
সরকারি কাজে ৪০% কমিশন না নিয়ে বিজেপি-শাসনে কর্ণাটকে কোনও সরকারি প্রকল্পের কাজ করা যেত না, অভিযোগের সার এটিই। মধ্যপ্রদেশেও এক অভিযোগ। সেখানে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ‘৫০% কমিশন’ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কমিশন, কাটমানির এই দুনিয়ায় তৃণমূল এবং বিজেপি যেন পরস্পরের পথপ্রদর্শক।
গত আগস্টে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা টুইটারে অভিযোগ তুলেছিলেন যে, মধ্যপ্রদেশের ঠিকাদারদের সংগঠন মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছে, রাজ্য সরকারের কাজ করলে পাওনার ৫০ শতাংশ অর্থ কমিশন বা ঘুষ দিলে তবেই টাকা মেলে। এরপরই প্রিয়ঙ্কা, মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ এবং কংগ্রেস নেতা অরুণ যাদবের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট যাঁরা দেখভাল করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রথমে ইন্দোরে পুলিশ এফআইআর দায়ের করে। তার পরে রাজ্য জুড়ে মোট ৪১টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার জন্য তৃণমূল, বিজেপি-র পদ্ধতিতেও অনেক সাদৃশ্য।
ইতিমধ্যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে আটটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল(সিএজি)।
গত আগস্টে সিএজি-র একাধিক রিপোর্ট সংসদে পেশ হয়েছিল। ‘চুপ্পি তোড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীজি’ স্লোগান তুলে কংগ্রেস সহ বিরোধীরা দাবি তুলেছিল, নরেন্দ্র মোদীকে এ নিয়ে মুখ খুলতে হবে। যদিও তৃণমূল বিশেষ রা কাড়েনি।
কোন কোন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে?
প্রথমত, ভারতমালা প্রকল্প। এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৩৪ হাজার কিমি রাস্তা তৈরি করতে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু বরাত দেওয়া হয়েছে কত? প্রায় ৮ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকার। তাতে ২৬ হাজার কিমি রাস্তা তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দের তুলনায় টাকা বেশি। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সড়কের দৈর্ঘ্য কম। পশ্চিমবঙ্গের মতই ঠিকাদারদের লাভের দিকে লক্ষ্য রেখেই এই কাজ করা হয়েছে। তা থেকে কমিশন নিচ্ছেন বিজেপি-র নেতারা — সেই আশঙ্কাও আছে।
দ্বিতীয়ত, দিল্লির দ্বারকা থেকে গুরুগ্রামের মধ্যে দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিমি নির্মাণের জন্য ১৮ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, প্রতি কিমি-র জন্য ২৫০ কোটি টাকা খরচের টেন্ডার দেওয়া হয়েছে। বিরোধীদের চাপে মুখ খুলতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট সড়ক দপ্তরকে। মন্ত্রকের সাফাই, ওই রাস্তা তৈরির খরচ প্রতি কিমি ১৮ কোটি টাকা থেকে ২৫০ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছে বলাটা ঠিক নয়। আসলে প্রতি কিমি ২০৬ কোটি টাকা খরচের বরাদ্দ হয়েছে। ৮ লেনের ‘এলিভেটেড’ অংশের জন্য প্রতি কিমি ১৫০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। বাকিটা মাটির উপরে ছয় লেনের রাস্তার জন্য। এই ধরনের বিশেষ প্রকল্পে বাড়তি খরচ হয়ই। অথচ প্রকল্প তৈরির সময় তা হিসাবে ধরা হয়নি!
তৃতীয়ত, ভারতমালা প্রকল্পে বরাত দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই অনিয়ম রয়েছে বলে সিএজি মন্তব্য করেছে।
চতুর্থত, জাতীয় সড়কে টোল আদায়ের যাবতীয় নিয়ম ভেঙে যাত্রীদের থেকে ১৫৪ কোটি টাকা টোল আদায় করা হয়েছে।
পঞ্চমত, ‘আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য প্রকল্প’ নরেন্দ্র মোদীর একটি বহুঘোষিত প্রকল্প। সেখানে একটি মোবাইল নম্বরের সঙ্গে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের নাম যুক্ত করা হয়েছে। সিএজি জানাচ্ছে, সেই সাড়ে সাত লক্ষের মধ্যে অনেক মৃতও রয়েছেন। তাঁদের নামে স্বাস্থ্য বিমায় চিকিৎসার অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। লাভ কার? বেসরকারি বিমা সংস্থাগুলির।
ষষ্ঠত, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক তার পেনশন প্রকল্প থেকে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা অন্য প্রকল্পের প্রচারে খরচ করেছে। যা পুরোপুরি বেআইনি। এই কাজ আমাদের রাজ্যে করে দেখিয়েছে মমতা ব্যানার্জির সরকার।
সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)-এর পদে রয়েছেন গুজরাতের আমলা গিরিশ চন্দ্র মুর্মু। তিনি বরাবরই তিনি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন বলে পরিচিত। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁকে গুজরাত থেকে দিল্লিতে বদলি করে আনা হয়। তবু সেই সিএজি-ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতির ইঙ্গিত অস্বীকার করতে পারেনি।
তবে এই ক্ষেত্রে বিজেপি-র আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠিদ্বন্দ্বে সিএজি-কে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। নিতিন গড়করী ওই দপ্তরের মন্ত্রী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একমাত্র তিনিই নরেন্দ্র মোদীর বিরোধী হিসাবে পরিচিত। যদিও তিনিও আরএসএস-রই লোক। সিএজি রিপোর্টে তাঁর মন্ত্রকের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ ওঠায় প্রশ্ন উঠেছে, মোদী কী তাঁকে চাপে ফেলতে চাইছেন? কিন্তু অন্য দপ্তরের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসছে না সিএজি রিপোর্টে।
আগামীকাল অন্তিম পর্ব প্রকাশিত হবে…