১৮বছর আগে এক ২৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল গুজরাট ‘দাঙ্গা’, যা আসলে ছিল গণহত্যাই। দিল্লিতে গত তিন দিন ধরে যা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে দেখে তার সঙ্গে গুজরাটের অনেক মিলই খুঁজে পাওয়া যায়।
সেদিন ৭২ ঘণ্টা আমেদাবাদ ও অন্যান্য জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে দলবদ্ধ আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, মহিলাদের ওপরে আক্রমণ। ওপরতলার নির্দেশ ছাড়া এমন নিষ্ক্রিয়তা হতে পারত না। পরে, পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু দাঙ্গাকারীদের দিকেও গুলি চলেছিল, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু জনতাই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু তা অনেক পরে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাবার পরে। সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামানো হয়নি। সেনারা এলেও স্থানীয় প্রশাসন তাদের মোতায়েন করেনি। এ সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হলো মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উচ্চপর্যায়ের পুলিশ ও প্রশাসনিক অফিসারদের যে সভা ডেকেছিলেন সেখানেই ঠিক হয়ে যায় আপাতত কিছু করা হবে না। গোধরায় ট্রেনে করসেবকদের পুড়িয়ে হত্যাকে সামনে রেখে বলা হয় ‘জনতাকে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেওয়া হোক’। এই সভায় ঠিক কী কথা হয়েছিল তার লিখিত-পড়িত প্রমাণ নেই। কিন্তু নানা সূত্র বারংবার এই খবর দিয়েছে।
আমার নিজের মনে আছে ২৭ ফেব্রুয়ারি আমি পেশাগত কারণেই মন্ত্রীদের সঙ্গে ছিলাম। এক বরিষ্ঠ মন্ত্রী একের পর এক ফোন করে দলের কর্মীদের বলছিলেন, প্রস্তুত হও, লোক জড়ো করো, প্রতিশোধ নাও। তিনি স্পষ্টতই আক্রমণের নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
গান্ধীনগরে কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির হত্যাকান্ডের খবর পেলাম। প্রথমে খবর পেয়ে কংগ্রেসের নেতা অমর সিং চৌধুরিকে ফোন করে সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করি। তিনি বলেন, একটু পরে খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি। আমি রাস্তায় থাকা অবস্থায় চৌধুরি ফোন করে জানান খবর ঠিকই। আমি সোজা সচিবালয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এক সচিবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, এমন কোনও খবর তাঁর জানা নেই। খবর জানার কোনও ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। আমি অনুরোধ করি, পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, মুখ্যমন্ত্রীকে বলুন টেলিভিশনে শান্তির আবেদন করতে। তিনি আমাকে তাঁর সিনিয়রের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই সিনিয়র ছিলেন পি কে মিশ্র, যিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সচিব। মিশ্র বলেন, ওই রকম কিছুই ঘটেনি। আমাকে বলেন, ‘লিখে নিন আমেদাবাদ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক’। ‘স্বাভাবিক’ কথাটা তার পর থেকে শুনলেই আমার সেদিনের কথা মনে পড়ে। দিল্লিতেও কেউ কেউ পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ বা প্রায় স্বাভাবিক বলে দেখানোর চেষ্টা করছেন।
গুজরাটে আক্রমণের একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নজর টেনেছিল। বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের দোকান, বাড়ি, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা মুসলিমদের সম্পত্তি এই তালিকা তারা পেয়েছিল কোথা থেকে? এলাকার বাইরের হাঙ্গামাকারীরা এসে তালিকা ধরে ধরে আক্রমণ করেছিল। এই তালিকা ছিল পৌরসভার, সরকারের। আমেদাবাদের মতো বড় শহরে সব দোকানের নাম দেখে নিশ্চয়ই বোঝা যায় না কোনটা কার। বিশেষ করে আমেদাবাদেই এইভাবে নির্দিষ্ট আক্রমণ হয়েছিল। এ থেকে স্পষ্টই অনেক আগে থেকেই এই আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল। মোটেই তা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ নয়। গোধরার প্রতিক্রিয়ায় আপনা থেকেই আক্রমণ হয়েছে, তেমন নয়। দিল্লিতেও যা হচ্ছে তা স্বতঃস্ফূর্ত নয়। প্ররোচনা যে ছড়ানো হয়েছে, তা তো সকলেই দেখেছেন।
(লেখক গুজরাতের পরিচিত সাংবাদিক)