Corporate Communal Nexus

Corporate Communal Nexus in Governance

কে এন উমেশ

কেন্দ্রীয় সরকার এমপ্লয়মেন্ট লিংকড ইনসেনটিভ স্কিম (ইএলআই) নামের প্রকল্প চালু করেছে। এ প্রকল্পের আর্থিক যোগান হিসাবে ২০২৪-২৫ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ২লক্ষ কোটি টাকার সংস্থানের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার অন্তর্গত তিনটি প্ল্যানের ( প্ল্যান এ, প্ল্যান বি এবং প্ল্যান সি ) প্রতিটির জন্য ১.০৭ লক্ষ কোটি টাকার সংস্থান করা হয়েছে। এছাড়াও ১ কোটি যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানের জন্য ৬৩০০০ কোটি টাকার ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (আই টি আই)- গুলির উন্নতিকল্পে ৩০০০০ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ নির্ধারিত হয়েছে।

কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে গৃহিত প্রধানমন্ত্রী ইন্টার্নশিপ যোজনা নামের প্রকল্প অনুসারে ২১ থেকে ২৪ বয়সী ১ কোটি যুবক-যুবতীরা ৫০০টি সর্বোৎকৃষ্ট কোম্পানিতে ৫বছর ইন্টার্নরূপে কাজের সুযোগ পাবেন। এ কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তাদের প্রতি মাসে ৫০০০টাকা স্টাইপেন্ড এবং এককালীন ৬০০০টাকা সহায়তা বৃত্তি দেওয়া হবে। এই পাঁচ বছর কাজের মেয়াদ চলাকালীন কর্পোরেট কোম্পানিগুলি চাইলে ইন্টার্নদের ট্রেনিংয়ের জন্য নিজেদের কোম্পানির নিয়ম মোতাবেক সামাজিক সুরক্ষা তহবিল থেকে আরও অর্থ ব্যয় করতে পারে। পাঁচ বছরে এক কোটি যুবক যুবতীকে ট্রেনিং দেওয়ার অর্থ ৫০০ টি কোম্পানিতে প্রতি বছর গড়ে ২০ লক্ষ যুবক-যুবতীর কাজের সুযোগ পাওয়া। অর্থাৎ প্রতিটি কোম্পানিতে প্রতি বছর চার হাজার যুবক-যুবতী কাজ পাবেন। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ এর জন্য ১.২৫ লক্ষ যুবক যুবতীকে কাজের সুযোগ দিতে কেন্দ্রীয় সরকার ২রা ডিসেম্বর থেকেই পাইলট প্রজেক্টের কথা ঘোষণা করেছে, এই খাতে ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দও হয়েছে।

প্ল্যান এ, বি, সি তে কি রয়েছে? প্রথম প্ল্যান অনুসারে কর্মচারী ভবিষ্যনিধি প্রকল্পে (এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন বা সংক্ষেপে ইপিএফও) নতুন নথিভুক্ত প্রত্যেক কর্মচারীর জন্য সরকারের তরফ থেকে ১৫০০০ টাকা দেওয়া হবে। প্ল্যান বি মোতাবেক মালিক ও কর্মচারীর থেকে ইপিএফও’তে বেতনখাত বাবদ নির্ধারিত অর্থ উৎপাদনী শিল্পে (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) বিনিয়োগ করা হবে। এহেন বিনিয়োগের হিসাব হল প্রথম দুবছর বেতন খাতে জমা মোট অংশের ২৪ শতাংশ করে এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে যথাক্রমে ১৬ ও ৮ শতাংশ ধার্য হবে। অবশ্য এহেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি শর্ত রয়েছে। এমনটা হবে যদি কোনও কোম্পানিতে ৫০ জন নতুন কর্মচারী কাজে যুক্ত হয়ে থাকেন অথবা বিনিয়োগ বর্ষের আগের বছরের হিসাব অনুযায়ী মোট কর্মচারীদের ২৫ শতাংশ ইপিএফও’তে নথিভুক্ত হন। প্ল্যান সি টি কেমন? এই পরিকল্পনা অনুযায়ী যে কোনও কোম্পানির জন্য ইপিএফও’তে মালিকপক্ষের জন্য নির্ধারিত খাতে প্রতি বছর সরকারের তরফ থেকে প্রত্যেক কর্মচারী পিছু ৩০০০টাকা দেওয়া হবে। এরও শর্ত আছে, যদি ৫০ জনের কম কর্মচারী রয়েছে এমন কোনও কোম্পানিতে অন্তত ২জন কর্মচারী কাজে যুক্ত হন অথবা ৫০ জনের বেশি কর্মচারী রয়েছে এমন কোম্পানি অন্তত ৫জন নতুন কর্মচারী নিয়োগ করে তবেই তারা প্ল্যান সি অনুসারে সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। প্ল্যান বি ও প্ল্যান সির অন্তর্ভুক্ত হওয়া যেকোনো কোম্পানিই প্ল্যান এর অন্তর্ভুক্ত সুযোগসুবিধা পাবে।

২০১৯-২০ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রোডাকশন লিংকড ইনসেনটিভ স্কিম (পিএলআই) ঘোষিত হয়েছিল। তার আর্থিক মূল্য ছিল ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার। কথা ছিল পরবর্তী পাঁচ বছর যাবত ১৪ টি কোম্পানিতে ঐ পরিকল্পনা অনুসারে কর্মসংস্থানের সুযোগ মিলবে। সেই প্রকল্পই এবছর ২০২৪-২৫ কেন্দ্রীয় বাজেটে আরো বড় আকারে ১৬টি কোম্পানির জন্য নির্ধারিত হয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে প্রকল্পের ভিত্তিবর্ষের নিরিখে কোম্পানিগুলির ক্রমবর্ধমান বার্ষিক মোট যোগানের মাত্রা (নেট অ্যাডিশনাল ইয়ার অন ইয়ার ইনক্রিমেন্টল সেলস)-র উপরে নির্ভর করে ৩ থেকে ২০ শতাংশ অবধি ইনসেনটিভ দেওয়া হবে। এমন প্রকল্পের পিছনে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল এতে উৎপাদনী শিল্প খাতে (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) উৎসাহের যোগান আসবে, আমদানি কমিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র বাবদ জাতীয় জিডিপিতে অন্তত ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে।

পিএলআই প্রকল্পে কারা লাভবান হয়েছে? চুক্তিভিত্তিক  উৎপাদন সংস্থা (কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারার) হিসাবে এতে সুযোগ পেয়েছিল আইফোন-উইস্ট্রন (বর্তমানে টিআইএসএস টাটার অন্তর্ভুক্ত), ফক্সকন, পেগাট্রন এবং স্যামসাং। গাড়ি নির্মাণ সংস্থা হিসাবে সুযোগ পেয়েছিল সুজুকি, টয়োটা, টাটা মোটর্স, কেআইএ, অশোক লেল্যান্ড, মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা, মিৎসুবিশি, এলচার ইত্যাদি। অটো কম্পার্টমেন্ট সংস্থা হিসাবে ছিল বশ, টয়োটা গ্রুপ ইন্ডাস্ট্রি সহ আরো কিছু জন। এছাড়াও ছিল এলবিট (হার্মিস ৯০০ ড্রোন মিসাইল ম্যানুফ্যাকচারার), এদের দেশীয় পার্টনার হিসাবে আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড এরোস্পেস কোম্পানি যাদের সাথে আরও দশটি কোম্পানি যারা বিভিন্ন যন্ত্রাংশের যোগান দিত। এলবিট কোম্পানির নির্মিত সেই ড্রোনই ইজরায়েল গাজায় বোমা ফেলার জন্য ব্যবহার করে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনও একে ব্যবহার করেছে।

প্রোডাকশন লিংকড ইনসেনটিভ বা পিএলআই ও সাম্প্রতিক এমপ্লয়মেন্ট লিংকড ইনসেনটিভ বা ইএলআই ছাড়াও একইরকম আরও দুটি প্রকল্প ছিল। একটির নাম ডিজাইন লিংকড ইনসেনটিভ বা ডিএলআই স্কিম এবং দ্বিতীয়টি ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট এক্সপেন্ডিচার ইনসেনটিভ বা ক্যাপেক্স ইনসেনটিভ। এগুলি সবই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য নির্ধারিত ছিল। ক্যাপেক্স ইনসেনটিভ ১.০-র প্রথম পর্যায়ে ৭৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ হয়েছিল যার মধ্যে ৪৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল গুজরাটের সানন্দে গড়ে ওঠা কারখানা (প্ল্যান্ট)-র জন্য। অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড টেস্টিং প্ল্যান্টের জন্য মূলধনী বিনিয়োগ ব্যয় খাতে (ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট এক্সপেন্ডিচার) সাধারণ প্যাকেঞ্জিংয়ের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ এবং অ্যাডভান্সড প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ৪০ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৫০ শতাংশ হারে ইনসেনটিভ দেওয়ার কথাও বলা হয়।

এহেন ক্যাপেক্স ইনসেনটিভের সুবিধা পেয়েছিল কারা? তাইওয়ানের কোম্পানি ও তাদের ভারতীয় সহযোগী টাটা’রা, জাপানের সংস্থা রেনেসাঁ তাদের সহযোগী হিসাবে মুরেগাপ্পা সি জি পাওয়ার সংস্থা, কেইনস সেমিকন্ডাক্টর এবং আমেরিকান মাইক্রন টেকনোলজিস। এই মাইক্রন কোম্পানির তরফে আমাদের দেশে মোট বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই ছিল আসলে সরকারি ভর্তুকি। এদের কোম্পানিতে একেকটি কর্মসংস্থানের জন্য মাথাপিছু ৩.২ কোটি টাকা সেই ভর্তুকি বাবদ খরচ হয়েছিল।

সেমিকন্ডাক্টর ও চিপের জন্য অন্যান্য উপাদান নির্মাণ খাতে এই প্রকল্প (স্কিম) এখনও চলছে, এখন নাম হয়েছে ক্যাপেক্স ২.০। বর্তমানে এই প্রকল্প বাবদ বরাদ্দ হয়েছে ১.২৬ লক্ষ কোটি টাকা। ইলেকট্রনিক্স কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য পিএলআই ১.০ প্রকল্প বাবদ প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থাগুলি ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা অবধি নিজেদের আমদানি খরচ কমিয়ে নিয়েছে।

পিএলআই প্রকল্পের (স্কিম) সুবিধা ভোগ করেছে ১৪০টি কোম্পানি। মেক ইন ইন্ডিয়ার এক দশক পূর্তি উপলক্ষে এবছর ২৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রক দ্বারা একটি সভার আয়োজন করা হয়। ইতিমধ্যে পিএলআই প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপ্ত সবকটি সংস্থাই সে সভায় উপস্থিত ছিল। সরকারের সাথে আলোচনায় তারা জানিয়েছে ২০২৪-২৫ সালে পিএলআই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ১.৪৬ লক্ষ কোটি টাকা তারা ইতিমধ্যে খরচ করে ফেলেছে। এর সাথে ক্যাপেক্স ইনসেনটিভ বাবদ প্রাপ্ত ৭৬ হাজার কোটি টাকাও নিঃশেষিত। দেশের মাটিতে উৎপাদনকে আরও বিস্তৃত করার জন্য এবার তাদের আবদার হল পাবলিক প্রকিওরমেন্ট সংক্রান্ত নিয়ম-বিধিগুলিকে খারিজ করে সবটাই খোলা বাজারের আওতায় নিয়ে আসা হোক। এখন তারা চাইছে সরকারী ইনসেনটিভ প্রকল্পের অধীনে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থা দ্বারা নির্মিত সামগ্রীসমূহ সরকারই নিজেদের খরচে কিনে নিক।

এইসকল কর্পোরেট সংস্থাগুলির তরফে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে যাতে উৎপাদনী ক্ষেত্রের বদ্ধাবস্থা কাটিয়ে তুলতে চীনের প্রযুক্তিবিদদের কাজে যুক্ত করার সুযোগ পাওয়া যায়। মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে র  মাত্র ২০ শতাংশই দেশীয় উৎপাদন হয়, বাকি পুরোটাই চীন থেকে আমদানি করা হয়, তারা চায় সেই আমদানি খরচ কমাতে সরকার যেন ইলেকট্রনিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে চীনা সংস্থাগুলিকে মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ দেয়।

এরই মাঝে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি ( সিএমআইই) -র তরফে জানানো হয়েছে ২০১৪-২৪ এই দশ বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ হিসাবে মোট ৯২.৩৩ ট্রিলিয়ন টাকার ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে সেই  টাকার মাত্র ২৬.৩৩ শতাংশ অর্থাৎ ২৪.২২ ট্রিলিয়ন টাকাই খরচ হয়েছে। আর্থিক বর্ষের শেষে মালিকের হাতে মোট যত পুঁজি জমা হতে পারে সেই হিসাবকে গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন বলে। এই হিসাবের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের হার থেকে বোঝা যায় কোনটি কমছে কোনটি বাড়ছে। মেশিনপত্র ইত্যাদি হল একধরনের উৎপাদনশীল সম্পদ (প্রোডাক্টিভ অ্যাসেট)। ২০২২-২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফার্মেশনে মেশিনারি খাতের অংশগ্রহণ ছিল ৩৫.৮ শতাংশ, এখন তা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩.৯ শতাংশ। বাসস্থান ও গৃহস্থালী নির্মাণের অন্যান্য সামগ্রীর খাত বেড়েছে, আগে ছিল ৫৩ শতাংশ এখন হয়েছে ৫৫.৪ শতাংশ। বেসরকারি মূলধনী বিনিয়োগের পরিমাণের চাইতে জনস্বার্থ খাতে কেন্দ্রের সরকারি ব্যয় (পাবলিক ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার) বেশি হয়েছে। অথচ এই সময়কালে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপেক্স এর খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসমূহ যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকে তারা সেন্ট্রাল পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজ (সিপিএসই) এর আওতাভুক্ত হয়। দ্রুত গতিতে ক্যাপেক্স খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাওয়া এবং সিপিএসই খাতে বরাদ্দ অনেকটাই কমে যাওয়ার ফলে ২০২০ অর্থবর্ষে জিডিপির ৪.৯ শতাংশে থাকা ক্যাপেক্স ২০২৪ সালের হিসাবে তা কমে হয়েছে ৩.৯ শতাংশ।

দুনিয়াজুড়ে বিনিয়োগ সংক্রান্ত ২০২৪ সালের প্রতিবেদন (গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট) প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) খাতে পুঁজি বরাদ্দের হার (রেট অফ ইনফ্লো) ছিল ৬.৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে সেই হার কমে হয়েছে ২.১ শতাংশ। মনে রাখতে হবে ১৯৯o নাগাদ এফডিআই বাবদ বিনিয়োগের হার ছিল ৫০.১ শতাংশ। এর এক দশক পরে ২০০০ নাগাদ তা কমে হয় ৩০.৭ শতাংশ, আরও দশ বছর পরে ২০১০ সালে তা পৌঁছায় ৪.৬ শতাংশে। সবুজায়নের জন্য ২০২২ সালেও মোট বরাদ্দ ছিল ৪৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩ এ তা কমে হয়েছে ২৮ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউ টি ও) সারা পৃথিবী জুড়ে ব্যবসা বাণিজ্যের হালহকিকত সংক্রান্ত পরিসংখ্যান (ট্রেড আউটলুক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স) প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে দুনিয়াজুড়ে মোট রপ্তানির মাত্র ১.৮ শতাংশই ভারত থেকে হয়। এই হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালেই ভারতের রপ্তানী কমেছে ৪.৭ শতাংশ। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) জানাচ্ছে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ভারতের আমদানি রপ্তানির মোট হার কমেছে ২.৬ শতাংশ।

দেশের জিডিপিতে উৎপাদনী শিল্পক্ষেত্র (ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর) বাবদ যোগান ছিল ২০১০ সালে ১৭ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেই হার ১৩ শতাংশে নেমে আসে। উৎপাদন শিল্পে শ্রমশক্তির আনুপাতিক অংশগ্রহণ ২০১৮-১৯ সালে ছিল ১২.১ শতাংশ, ২০২৩-২৪ সালে তা আরও কমে হয় ১১.৪ শতাংশ, এই হিসাব করেছে পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে। ভারতীয় কলকারখানায় উৎপাদনের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে নেট ভ্যালু অ্যাডিশনের নিরিখে ২০২২- ২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী মজুরির অংশ ছিল ১৫.৯৭ শতাংশ অথচ ঐ একই সময়ে মুনাফার হার ৫১.৯২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা (ইকোনমিক সার্ভে) অনুযায়ী ভারতে কর্মহীন যুবক-যুবতীদের বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের জন্য ৭৮.৫ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করতে হবে।

কর্মসংস্থানের এহেন হতাশাজনক অবস্থা, চুক্তিভিত্তিক আমদানি-রপ্তানী হ্রাস, পূর্বঘোষিত বেসরকারী উদ্যোগসমূহের আংশিক কিংবা সম্পূর্ণতা প্রাপ্তি, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ খাতে পুঁজি কমতে থাকা, জিডিপি’তে উৎপাদনী শিল্পের আনুপাতিক অংশগ্রহণ কমে যাওয়া এসবই আসলে প্রমাণ করে দেয় পিএলআই, ডিএলআই ও ক্যাপেক্সের মতো ইনসেনটিভ ভিত্তিক প্রকল্পগুলির সুবাদে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার কোনও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। উল্টে দেখা যাচ্ছে সেইসব প্রকল্পে পুনরায় ক্যাপেক্স মারফত বিনিয়োগের জন্য মূলধনের যোগান দিতে হচ্ছে, পিএলআই মারফত উৎপাদনী খরচ এবং ডিএলআই বাবদ প্রাপ্ত অর্থে নতুন কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত ইএলআই প্রকল্প, ক্যাপেক্স ইনসেনটিভ ২.০ কিংবা পিএলআই ২.০ সবকটি পরিকল্পনাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য কোটি কোটি টাকা সাইফনের মতো করে বের করে দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য কর্পোরেটদের উৎসাহ দেওয়ার নাম করে মোদী সরকার এর আগেও এভাবেই তাদের হাতে বিপুল অর্থের যোগান দিয়ে এসেছে।

ইএলআই প্রকল্পের ফলাফল কী? বলা হচ্ছে এর সুবাদে কর্মসংস্থান হবে। কার্যত সরকারি অর্থে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে দক্ষ শ্রমিকদের বিশাল বেকারবাহিনী তৈরি করা হবে এবং কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারি কোষাগার থেকে বরাদ্দকে কাজে লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্যের মালিক হয়ে বসবে।

এইসকল প্রকল্প বা পরিকল্পনার আসল উদ্দেশ্য হল সরকারি কোষাগার থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলির জন্য গোপনে অর্থ যোগানের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। সেই কারণেই যাবতীয় পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় বাজেটের অন্তর্গত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। নয়া উদারবাদী জমানায় পুঁজি আত্মসাৎ করার এক জঘন্য কৌশল ব্যতীত একে আর কিছুই বলা চলে না। আমাদের দেশে কর্পোরেট পুঁজির সাথে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গাঁটছড়া (কর্পোরেট কমিউনাল নেক্সাস) সে উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।

Spread the word

Leave a Reply