নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়েছে। ভারত সরকারের তরফে শেষ ঘোষণা অনুযায়ী সারা দেশে লকডাউন জারি রয়েছে ১৪ এপ্রিল অবধি। আমাদের রাজ্যেও এই সংক্রমণ ছড়িয়েছে – তথ্য বলছে পশ্চিমবঙ্গে এখনো অবধি এই সংক্রমনে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন ভারতীয় নাগরিক, সকলেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন – এদের মধ্যে মারা গেছেন ১ জন (সুত্রঃ Official Website of Ministry of Health and Family Welfare, Government Of India)।
চলতি মাসের ২ তারিখে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে সব সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে নির্দেশ পাঠানো হয় এই ব্যাপারে ব্যাবস্থা নিতে। সেই নির্দেশে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উপযুক্ত মানের পিপিই (Personal Protective Equipment – Recommended for Safe Injection Practices and Respiratory-Cough Etiquette), N95-FFR (Negetivity at Apporoximately 95 Milliseconds Filtering Facepiece Respirator For Invsive Measures) মাস্ক এবং Sanitizer ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছিল। সেই চিঠি পড়তে নিচের পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করুন।
রাজ্য প্রশাসনিক দপ্তরে সর্বদলীয় সভার পরে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র করোনা সংক্রমণে আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং আইশোলেশন কেন্দ্র হিসাবেই কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে ব্যাবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যা আগামীকাল ২৮ মার্চ থেকে চালু হবার কথা। কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকে চিকিৎসা এবং আইশোলেশন কেন্দ্র হিসাবে ব্যাবহার করার জন্য সেখানে ২২০০ টি বেডের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যেই অন্যান্য যে সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রাথমিক পরীক্ষা, নমুনা সংগ্রহ এবং চিকিৎসার কাজ চলছে সেখানে নতুন কোন রোগীর ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেওয়া হচ্ছে না – তাদের রেফার করা হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আমাদের রাজ্যে ১৬ টি জেলা হাসপাতাল, ৪৫ টি সাব-ডিভিশনাল হাসপাতাল এবং ২৬ টি স্টেট জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে যেগুলিতে সব মিলিয়ে ১৮০০০ বেডের ব্যাবস্থা রয়েছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান ইয়ারবুকের তথ্য অনুযায়ী আমাদের রাজ্যের প্রাথমিক এবং পরবর্তী স্তরের জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি পর্যাপ্ত কর্মী এবং পরিকাঠামোর সমস্যায় জর্জরিত (Statistical Yearbook India 2018, published by the Ministry of Statistics and Programme Implementation)। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে মোট ১৩৯২ টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের আসনের মধ্যে কাজ করছেন মাত্র ১২৫ জন, ল্যাবরেটরি কর্মীদের ক্ষেত্রেও চিত্রটা একইরকম। আমাদের রাজ্যে একজন চিকিৎসক পিছু রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০৪১১.১৫ জন, জাতীয় ক্ষেত্রে এই গড় ৯০৮৫.৯ জন। স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থায় গোটা রাজ্যজূড়ে করোনা সংক্রমণ এবং অতিমারী নিয়ন্ত্রনে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সামগ্রিকভাবে গোটা জনস্বাস্থ্য প্রকল্পে কাজ করছেন যারা তাদের উপরে কাজের চাপ এক ভয়ানক জায়গায় পৌঁছবে। এই কাজে তাদের পাশে থাকতে যথাসম্ভব বাস্তব এবং আশু প্রয়োজনীয়তাকে ভিত্তি করেই রাজ্য সরকারকে সক্রিয় হতে হবে।
আমাদের রাজ্যে গরীব-দুস্থ মানুষদের মধ্যে সংক্রমনে আক্রান্ত হবার হার যথেষ্টই। সরকারি হিসাবেই সেই রিপোর্ট রয়েছে। এই সময় তাদের সঠিক চিকিৎসার জন্যেই প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপের।
এখন কোলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা অন্য যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে উপযুক্ত পিপিই (Personal Protective Equipment)’র যথাযথ সরবরাহ। এই পিপিই (Personal Protective Equipment) ভারতে এতদিন আমদানি করা হত মূলত বিদেশি প্রস্তুতকারী (3M, DuPont এবং Honeywell) সংস্থাগুলির কাছ থেকে যা এখনকার অবস্থায় অনেকটাই থমকে রয়েছে। এই পিপিই (Personal Protective Equipment) বলতে মানুষের মাথা থেকে পা অবধি পুরোটাই ঢেকে রাখার ব্যাবস্থা বোঝানো হয়, এবং এই ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)’র তরফে নির্দিষ্ট গুনমানের সরঞ্জাম ব্যাবহার করার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ইউএস সিডিসি (Centres For Desease Control and Protection) একজন আক্রান্ত রোগীকে পরীক্ষা, চিকিৎসা অথবা শুশ্রূষার কাজে যুক্ত সব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদেরকেই পিপিই (Personal Protective Equipment) ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে নির্দেশ দিয়েছে। একজন আক্রান্তকে পরীক্ষা, চিকিৎসা অথবা শুশ্রূষার কাজ করার পরে যথাবিহিত পদ্ধতি মেনেই ব্যাবহার করা পিপিই (Personal Protective Equipment)’কে সংক্রমণমুক্ত করতে হবে অথবা বাতিল করতে হবে। প্রত্যেক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদেরকেই প্রত্যেকদিন কাজের জন্য সারাদিনে ৮ ঘন্টার হিসাবে অন্তত ৩ টি পিপিই (Personal Protective Equipment) সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। সারা দেশে মোট কর্তব্যরত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা গড় হিসাবে আনলে অন্তত ১৫ লক্ষ পিপিই (Personal Protective Equipment) প্রতিদিন প্রয়োজন। এই বিপুল সরবরাহ নিয়ে সম্প্রতি RDA (Resident’s Doctor’s Association – AIIMS)’র সভাপতি আদর্শ প্রতাপ সিংহ জানিয়েছেন আমাদের দেশে প্রত্যেক আক্রান্তকে পরীক্ষা, চিকিৎসা অথবা শুশ্রূষার কাজ করার পরে পিপিই (Personal Protective Equipment)’কে পাল্টে ফেলবার যে নির্দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দিয়েছে তার বাস্তব পরিস্থিতি নেই, সেই যোগান নেই। এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও সারা দেশের মতো আমাদের রাজ্যের প্রত্যেক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াই করছেন, নিজেরা সংক্রমণের ভয়ানক সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়েও তারা আপ্রান প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যাতে নতুন করে আর একজনকেও এই মহামারীর বলি না হতে হয়।
কর্তব্যরত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে যতটা সম্ভব উপযুক্ত পিপিই (Personal Protective Equipment) সরবরাহের দ্বায়িত্ব নিতেই হবে সরকারকে। এই অবস্থায় সংক্রমণে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা (Vulnerability) সবচেয়ে বেশি তাদেরই। রাজ্যে সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ এবং সফল চিকিৎসার সুযোগ বাড়াতে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উপযুক্ত ব্যাবস্থা গ্রহণ এখনই প্রয়োজন। এই কাজে গাফিলতি হলে বিপদ গোটা রাজ্যের।
উপযুক্ত মানের পিপিই (Personal Protective Equipment – Recommended for Safe Injection Practices and Respiratory-Cough Etiquette), N95-FFR (Negetivity at Apporoximately 95 Milliseconds Filtering Facepiece Respirator For Invsive Measures) মাস্ক এবং Sanitizer সরবরাহ করার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমাদের রাজ্যের শহর এবং জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কর্তব্যরত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষিত না করলে জনগনকেও সুরক্ষা দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই নানা সুত্রে এই বিষয়ে বর্তমান অবস্থার যে সব ছবি এবং খবর পাওয়া গেছে তা একেবারেই সন্তোষজনক নয়, বরং তার ফলে জনমানসে উদ্বেগ বাড়ছে, অকারণ আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। জনগণের একটি বিরাট অংশের কাছে N95-FFR (Negetivity at Apporoximately 95 Milliseconds Filtering Facepiece Respirator For Invasive Measures) মাস্ক রয়েছে যা তাদের অধিকাংশেরই প্রয়োজন নেই। অথচ সরকারি নির্দেশ থাকা সত্বেও চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এই মাস্ক এবং অন্যান্য পিপিই (Personal Protective Equipment – Recommended for Safe Injection Practices and Respiratory-Cough Etiquette) ব্যাবহার করতে পারছেন না, এই অবস্থা সরকারের উপর মানুষের ভরসা নষ্ট করে দিয়ে অযাচিত পরিস্থিতির জন্ম দেবে যা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় আমাদের রাজ্যকে আরও বেশি অসুবিধায় ফেলবে।
আমাদের মাথায় রাখা উচিত এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা কোন বাড়তি প্রত্যাশার মুখাপেক্ষি না হয়েই মানুষকে বাঁচানোর সংগ্রামে নেমেছেন – তাদের জন্য যথাবিহিত এবং সম্ভাব্য পেশাগত সুরক্ষা এবং সেই কাজ করতে সুবিধার কথা ( তাদের থাকার ব্যাবস্থা, যাতায়াতের জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা ইত্যাদি) সরকারের পরিকল্পনায় প্রকাশ না পেলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে – গোটা রাজ্যের মানুষের তাতে বিপদ আরও বাড়বে।