জ্যোতি বসু
১৯৭৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত ভাষণ
মহান চীন বিপ্লবের, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ও চীনের মহান জনগণের অবিসংবাদিত নেতা কমরেড মাও সে তুঙ-র জীবনাবসান হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রগতিশীল মানুষের সঙ্গে আমরাও এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।
কমরেড মাও সে তুঙ কৈশোরকালেই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন, রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে স্বেচ্ছাসৈনিকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নূতন প্রগতিশীল চিন্তাধারা প্রচারের কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন ও এর মধ্য দিয়েই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শকে গ্রহণ করেন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম পর্যায় কেটেছে তাঁর নিজ প্রদেশ হুনানে। ১৯১৭-১৯ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে কিছুদিন কাজ করার সময়টুকু বাদ দিয়ে, এখানে তিনি বিভিন্ন সমিতি ও পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ-র বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর এই কাজ বহু ছাত্র ও তরুণ বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করে। অপর দিকে তিনি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্তরেও অত্যাচারী শোষক শ্রেণীগুলির বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই দুই ধরনের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে হুনান প্রদেশের প্রথম কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি গড়ে তোলেন। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এই ধরনের কয়েকটি গ্রুপের ১২ জন প্রতিনিধি ১৯২১ সালে মিলিত হন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। মাও সে তুঙ সেই ১২ জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে ছিলেন। দুই বৎসরের মধ্যেই তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি এই পার্টির রাজনৈতিক, আদর্শগত ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। পার্টির নেতা হিসাবে প্রথম থেকেই মাও সে তুঙ আদর্শগত কাজকর্ম কমিউনিস্ট শিক্ষা ও ক্যাডার গড়ে তোলার কাজের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি ১৯২৩ সাল থেকেই পার্টির সাংগঠনিক দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন। এই সময়ে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সাংগঠনিক দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন। এই সময়ে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক হিসাবে দক্ষতার পরিচয় দেন।
পার্টি গড়ার যুগে পার্টির অভ্যন্তরে তাকে দক্ষিণ ও বাম উভয় ধরনের সুবিধাবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই সংগ্রামে তিনি জয়ী হতে পেরেছিলেন তার কারণ তিনিই চীনের বাস্তব পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শিক্ষাগুলিকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার পথ দেখিয়েছিলেন। চীনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিজ্ঞান সম্মত অনুশীলন ও বিশ্লেষণে এবং সেই পরিস্থিতির বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর কাজে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রয়োগে তাঁর সাফল্য তাকে পার্টি ও জনগণের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
চীনে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রামকে যে কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সাফল্যের দিকে এগোতে হয়েছে, তার প্রতিটি বাঁক ও মোড়ে সামনে দাঁড়িয়ে মাও সে তুঙ-র নেতৃত্বে চীনের পার্টি অবিচলিতভাবে সঠিক পথ খুঁজে নিতে পেরেছিল, কারণ পরিস্থিতি ও কর্তব্য সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ বৈজ্ঞানিক ধারণা ছিল, তিনি সঠিকভাবে চীনের শ্রেণী বিশ্লেষণ ও বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করেছিলেন এবং কালোপযোগী রণনীতি ও রণকৌশল রচনার কাজে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সৃষ্টিশীল প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। সোভিয়েত বিপ্লব থেকে প্রেরণা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “অক্টোবর বিপ্লবের কামানের গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়েই আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ শিখলাম”। কিন্তু নিজ দেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সেই শিক্ষাকে প্রয়োগ করায় তিনি বিরাট দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মূল্যায়নে ও মতাদর্শগত প্রশ্নে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যান্য শরিক, এমনকি কমিনটার্নের সঙ্গেও কোনো কোনো সময় তাঁর মতপার্থক্য হয়েছে। বিপ্লবের আগে ও পরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মতাদর্শগত বিতর্কের তিনি অন্যতম অংশীদার। কিন্তু চীনের বিপ্লবের নেতা হিসাবে তার সাফল্য ও নহর সমস্ত প্রশ্নের অতীত।
গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর চীন যখন সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়েছে তখনও জাতীয় পুনর্গঠনের বিরাট কর্মকাণ্ডে তাঁর নেতৃত্বের ভূমিকা যথার্থই গৌরবোজ্জ্বল। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দুই বৎসর পর চীনের মানুষ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাদের মুক্তি অর্জন করেন। তারপর তিন দশকেরও কম সময়ের মধ্যে কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-বিদ্যা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে চীনের বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে ও সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি পিছিয়ে পড়া জনবহুল দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কতদূর উন্নত করা যায় সে বিষয়ে নতুন দৃষ্টান্ত রচিত হয়েছে। চীনের। সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্যের অন্যতম শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল স্বনির্ভরতা। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও দীর্ঘমেয়াদী বৈদেশিক সাহায্য বাদ দিয়েই চীনের জনগণ তাদের নতুন নতুন বিজয় অর্জন করছেন। এই সমস্ত সাফল্যের ক্ষেত্রেই মাও সে তুঙ নেতা ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। দৃঢ় প্রত্যয় ও জনগণের ওপর বিশ্বাস নিয়ে চললে পশ্চাৎপদতাকে অতিক্রম করা যায় কমরেড মাও তা দেখিয়েছেন। চীনের এই সাফল্য মার্কসবাদ লেনিনবাদের সর্বজনীনতা ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব নতুন করে প্রমাণ করেছে।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম উভয় ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের আদর্শকে কমরেড মাও সে তুঙ প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছেন। চীনের বিপ্লবের স্তর নির্ধারণ করতে গিয়ে মাও সে তুঙ পুরনো ধরনের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবর্তে নয়া গণতন্ত্রের প্রাম্ভিক ধারণার অবতারণা করেছেন ও তার বাস্তব প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কৃষি বিপ্লবই এই স্তরের বিপ্লবের চাবিকাঠি এবং উপনিবেশ, আধা উপনিবেশগুলিতে নয়া গণতন্ত্রের বিপ্লবী রণনীতি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু একথা সব সময়ে মনে রাখতে হবে যে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব প্রলেতারীয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ, কেননা এই বিপ্লব দৃঢ়ভাবে সাম্রাজ্যবাদের অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের বিরোধিতা করছে। এই নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে প্রোলেতারিয়েতের নেতৃত্বে ব্যাপক জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও সামন্ততন্ত্র বিরোধী বিপ্লব। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্ত্বিক ধারণার ক্ষেত্রে মাও সে তুও মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সমৃদ্ধ করেছেন।
কমরেড মাও সে তুঙ বলেছিলেন যে চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণকৌশলগত মূল কথা হলো যুক্তফ্রন্ট ও সশস্ত্র সংগ্রাম। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৭ সালে বিভিন্ন অভ্যুত্থান, ১৯২৭-৩৭ সালের কৃষি বিপ্লবের সংগ্রাম ও চিয়াংকাইশেকের ঘিরে ফেলা অভিযানের বিরুদ্ধে লড়াই, ১৯৩৭-৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ ও ১৯৪৬-৪৯ সালের চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি পর্যায়ের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে কিভাবে যুক্তফ্রন্টের গড়ার কাজ চলেছে এবং বিপ্লবী শক্তিগুলিকে কখন কি ধরনের ঐক্য গড়ে তুলতে হয়েছে, এ সব বিষয়ে কমরেড মাও সঠিক ব্যাখ্যা ও নির্দেশ দিয়েছেন, যা খুবই শিক্ষণীয় ও মূল্যবান। কমরেড মাও খুব দৃঢ়ভাবে বার বার একথা বলেছেন যে শ্রমিক- কৃষকের মৈত্রীই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে ও সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কিরকম নমনীয়ভাবে পরিস্থিতি অনুযায়ী এই কৌশল প্রয়োগ করা যায়, মাও সে তুঙ তার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কৃষি। বিপ্লব বা ভূমি বিপ্লবকেই কমরেড মাও সে তুঙ চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চাবিকাঠি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাই বিপ্লবের প্রস্তুতির স্তরে বা সাফল্যের পরেও কৃষকদের জমির সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানের প্রশ্নটিতে তিনি সব সময়েই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। একটি কৃষি প্রধান দেশ এই প্রশ্নটির সমাধানে তাঁর পথনির্দেশ অনুরূপ ও তুলনীয় পরিস্থিতিতে কর্মরত সমস্ত কমিউনিস্টদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের বাস্তব পরিস্থিতিতে সশস্ত্র প্রতিবিপ্লবী শক্তির বিরুদ্ধে চীনের জনগণকে বিপ্লবের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী ও নিষ্ঠুর শত্রুর বিরুদ্ধে এই লড়াই ছিল ঐতিহাসিক কারণেই দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র লড়াই। সেজন্য চীন বিপ্লবের নেতা কমরেড মাও সে তুঙ-কে এই লড়াইয়ের কৌশলগত তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে হয়েছে। চীনা প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের লড়াই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই রচিত হলো সমর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কমরেড মাও সে তুং-র অবদান— গেরিলা যুদ্ধ, চলমান যুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের নির্দেশাবলী।
বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকাগুলি সম্পর্কে মাও সে তুঙ বলেছিলেন, যেহেতু দেশের মূল শহরগুলি সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসর চীনা প্রতিক্রিয়াশীলদের ককায় ছিল সেহেতু বিপ্লবী শক্তিগুলির অপরিহার্য দায়িত্ব ছিল পশ্চাৎপদ গ্রামাঞ্চলের বিপ্লবের সুসংহত অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে পরিণত করা, এগুলিতে এমন ধরনের সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুর্গ হিসাবে গড়ে তোলা, যার ওপর ভিত্তি করেই দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিপ্লব জয়যুক্ত হলো। কিন্তু এই সশস্ত্র সংগ্রামের অর্থ কখনই এটা ছিল না যে সংগ্রামের অন্যান্য রূপগুলিকে দাম দিতে হবে। সংগ্রামের সকল রূপের সমন্বয় ঘটানোই হলো মূল কথা। গ্রামের কয়েকটি অগ্রবর্তী ঘাঁটি গড়তে গিয়ে শত্রুকবলিত অন্যান্য গ্রামে ও সমস্ত শহরগুলিতে বিপ্লবী শক্তির কাজকর্মকে কখনও অবহেলা করা চলে না- অবহেলা করার অর্থ হলো বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকাগুলিকে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল করে ফেলা ও জনগণের বিরাট অংশের বিপ্লবী ভূমিকা অস্বীকার করা।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাফল্যের অব্যবহিত পরেই চীনের জনগণকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও কমিউনিজমের প্রসার রোধের স্লোগানের আড়ালে চীনকে অবরোধ করার সাম্রাজ্যবাদী রণনীতির মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতিবেশী কোরিয়ার জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ইন্দোচীনের জনগণের যুগান্তকারী সংগ্রামে চীনের রাজনৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য উল্লেখযোগ্য।
চীনের বিপ্লবের নেতা হিসাবে কমরেড মাও সে তুঙ বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ পুস্তক রচনা করেছেন। এই রচনাগুলিকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্বের আলোকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। কেবলমাত্র উদ্ধৃতির উপর নির্ভর না করে মাও সে তুঙ-র রচনাবলীর শিক্ষণীয় বিষয়গুলি আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহু প্রশ্নে, বিশেষ করে মতাদর্শগত প্রশ্নে মাও সে তুঙ ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য ও ভূমিকা বিতর্কিত। ভারতের বিপ্লবের স্তর ও পরিস্থিতি, প্রয়োজনীয় রণকৌশল, বিভিন্ন মতাদর্শগত প্রশ্ন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি ও কর্তব্য সম্পর্কে চীনের পার্টির সঙ্গে আমাদের পার্টির ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মতপার্থক্য বহু আলোচিত। আজকের সভায় সে বিষয় অবতারণার কোন প্রয়োজন নেই। কমরেড মাও সে তুঙ-র বিচার-বিশ্লেষণের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে না পারলেও, একজন মহান বিপ্লবী, চীনের বিপ্লবের ও বিপ্লবোত্তর গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের পথপ্রদর্শক, চীনের পার্টির ও জনগণের সংগঠক ও দেশের বিশিষ্ট দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও সমরবিদ হিসাবে তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা জানাবো। বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর স্থান সুপ্রতিষ্ঠিত, বিভিন্ন প্রকার কুৎসা ও হীন প্রচারে বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা, উদ্ভাবনী শক্তি ও বিরাট অবদানকে আমরা স্মরণ করব। পৃথিবীর সমস্ত বিপ্লবী দেশগুলিকে যে সকল ব্যক্তিত্ব অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন, কমরেড মাও সে তুঙ তাঁদের অন্যতম।
[সি পি আই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাংস্কৃতিক মুখপত্র ‘নন্দন’ পত্রিকায় বসুর এই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের (খ্রীষ্টাব্দ ১৯৭৬) অগ্রহায়ণ-পৌষ: চতুর্দশ বর্ষ: অষ্টম-নবম সংখ্যায় (পৃষ্ঠা ৭২১-৭৩৩)। এই লেখা আসলে ১৯৭৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার রেমব্রাউন ইনস্টিটিউটে মাও সে তুঙ স্মরণসভায় জ্যোতি বসুর ভাষা। উল্লেখ্য, ঐ সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে মাও’র মৃত্যু হয়।]