Comrade Jyoti Basu: A Memoir

বিমান বসু

কমরেড জ্যোতি বসু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অবিসংবাদী নেতা ছিলেন তিনি বিদেশে পড়াশোনা করার সময় ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং লন্ডনে মূলত বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য বা গবেষণা করার জন্য যারা যেতেন তাদের নিয়ে গঠিত সংগঠন লন্ডন মজলিশের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে তিনি মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে দেখা করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির একজন সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৪০ সালে তার কাজের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় রেল শ্রমিক কর্মচারীদের সংগঠিত করার এবং এ বছরই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি শ্রমিক আন্দোলনের বিশেষত রেলশ্রমিক কর্মচারীদের সংগঠিত করার কাজে বঙ্গ প্রদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এমনকি নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারের কাজেও অংশ নেওয়ার জন্য খুবই পরিশ্রম করতেন। লক্ষ্য করা যায় যে ধীরে ধীরে তিনি রেল শ্রমিক কর্মচারীদের একজন প্রিয়সংগঠক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ছয়বছরের মধ্যে ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় শ্রমিক কর্মচারীদের ইলেক্টোরাল ক্ষেত্র থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি জয়যুক্ত হন এবং পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

Jyoti Basu while movement

উল্লেখ্য ১৯৪৬ সালেই বঙ্গপ্রদেশে অপর দু’টি ইলেকটোরাল ক্ষেত্র— কৃষি ক্ষেত্র ও  শ্রমিক ক্ষেত্র থেকে কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসাবে কমরেড রূপনারায়ণ রায়ও কমরেড রতন লাল ব্রাহ্মণ জয়ী হয়েছিলেন। জ্যোতি বসু তৎকালীন ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে একদিকে যেমন রেল শ্রমিক কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে এবং বাংলার গণআন্দোলনকে বিকশিত করতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করা শুরু করেন, অপরদিকে ব্যবস্থাপক সভার অভ্যন্তরে ১৯৪৬ সালে ঐতিহাসিক নৌবিদ্রোহ, ডাক-তার-শ্রমিক কর্মচারীদের সর্বভারতীয় সংগ্রাম এবং বঙ্গ প্রদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে  দুর্জয় তেভাগা কৃষক সংগ্রামের কথা প্রতিধ্বনিত করেছেন ব্যবস্থাপক সভার অভ্যন্তরে এবং মাঠে ময়দানে।

১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জ্যোতিবাবু শ্রমজীবী মানুষ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের বিশেষ করে বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মচারী এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের সংগ্রাম আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে ধীরে ধীরে একজন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা ও জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। স্বাধীন দেশে ভারতের সংবিধানের নিয়ম কানুন অনুযায়ী প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে ২৪ পরগনার বরানগর কেন্দ্র থেকে কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন। আবার এই সময়েই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৫৩-৫৪ সালের সম্মেলন থেকে তিনি রাজ্য পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। একদিকে রাজ্য সম্পাদক এবং বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা হয়ে কাজ করতে তার ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে তা তিনি বারবার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে অর্থাৎ কাকাবাবুকে জানাতেন। কাকাবাবু তাঁকে বলতেন সময়মতো আপনাকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এখন একটু অতিরিক্ত কষ্ট হলেও আপনাকে উভয়দায়িত্বই পালন করতে হবে। জ্যোতিবাবু আমাকে একসময় বলেছিলেন, ‘দেখো কাকাবাবুর কথা আমার অপছন্দ হলেও আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল।’ হয়তো নিয়ম-শৃঙ্খলার কথা বোঝাতেই তিনি এই ধরনের কথা আমাকে বলেছিলেন।

স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জ্যোতিবাবু বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন। কেবলমাত্র ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস জনিত কারণে জ্যোতি বাবুকে বিধান সভার বাইরে থাকতে হয়েছিল। ওই সময় নির্বাচনে জাল জুয়াচুরি দেখে জ্যোতি বাবু সকাল ১১ টার পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে  গণনার সময়ও তার কোনও কাউন্টিং এজেন্ট ছিল না। ১৯৭৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে রাজ্যের বামফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হলে জ্যোতিবাবু রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। অবশ্য স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভারও তিনি ছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী।

বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে অধুনা যে যাই বলুক না কেন বা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোন পর্যবেক্ষক এর বিচার যেভাবেই করুক না কেন অন্য রাজ্যের আর পাঁচটা অকংগ্রেসি সরকারের থেকে বামফ্রন্ট সরকার ছিল একটু ভিন্নধাঁচের। তার ফলশ্রুতিতেই বামফ্রন্ট সরকার সারা ভারতে আইনি চৌহদ্দির মধ্যে থেকে সাংবিধানিক যেটুকু ক্ষমতা ছিল তাকে ব্যবহার করে সর্বপ্রথম পশ্চিমবাংলায় সফলভাবে ভূমি সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ করেছিল। সম্ভবপর হয়েছিল নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলে গ্রামীণ সরকার প্রতিষ্ঠা করার কাজ। এ রাজ্যের পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থাই পরবর্তী সময়ে দেশের সংবিধান সংশোধন করে সারাদেশে গড়ে তোলা হয়েছিল। ভুলে গেলে চলবে না পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই গ্রামীণ অর্থনীতির পুর্নবিন্যাস ও তার উন্নয়ন সাধনের কাজ সম্ভবপর হয়েছিল। ভূমি সংস্কার সফলভাবে রূপায়িত করা ও পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালু থাকার ফলশ্রুতিতে রাজ্যের কৃষি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল।  কৃষিজ উৎপাদনেও সর্বকালীন রেকর্ড তৈরি করেছিল। রাজ্যে শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল অসংখ্য প্রাথমিক স্কুল স্থাপন। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তা উন্নীত করার কাজ। শিক্ষার প্রসার জনিত কারণে অসংখ্য নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে তা জ্যোতি বাবু বারবার উল্লেখও করতেন। একথা অবশ্যই বলা যায় যে, এইভাবে সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্র সহ বিদ্যুতায়নের কাজও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে মানুষের উন্নত জীবনবোধ গড়ে ওঠার লক্ষ্যে জ্যোতি বসু পথ চলেছিলেন এবং কর্মসূচির রূপায়ণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ।

আজ জ্যোতি বাবুর ১৫ তম প্রয়াণ দিবসে কমরেড প্রকাশ কারাতের  শোকবার্তা থেকে ছোট্ট দু’টি কথা উল্লেখ করছি। কমরেড প্রকাশ কারাত জ্যোতিবাবুর জীবনাবসানের পরে এক বার্তায় লিখেছিলেন ‘‘যদিও জ্যোতিবাবুর বয়স হয়েছিল ৯৬, তবু এক তীব্র বেদনা যন্ত্রণায় আজ আমরা ক্ষতবিক্ষত, কারণ কোনোদিন আর কেউ জ্যোতি বসু হবেন না। তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গেই অবসান ঘটল একটি যুগের।

১৯৬৪তে যে সময়ে সিপিআই(এম) গঠিত হয়েছিল সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ছিল না পার্টির শক্তিশালী ইউনিট। এটা পরে তৈরি হয়েছিল সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করার কারণে, যাতে প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে জ্যোতি বসু পালন করেছিলেন মুখ্য ভূমিকা। ইটের উপর ইট গেঁথে যদি প্রমোদ দাশগুপ্ত পার্টি সংগঠন গড়ে তুলে থাকেন তবে জ্যোতি বসু ছিলেন রাজনৈতিক প্রচার অভিযান গণআন্দোলন এবং আইনসভায় নেতৃত্বে।

 পলিটব্যুরোতে অধিকাংশই তার অভাব বোধ করবে, প্রায় ৪৫ বছর যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। আমাদের কাছে আমরা যারা তিন দশক এবং তার পরে পার্টি নেতৃত্বে এসেছি তাদের অনেক কিছু শেখার আছে তাঁর থেকে।’’

‘জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’ গড়ে উঠেছিল ২০১০ সালে জ্যোতিবাবুর জীবনাবসানের পরে। যার কাজ গত কয়েক বছর ধরে শুরু হয়েছে। এ বছর তাঁর প্রয়াণ দিবসে দু’টি মনোগ্রাফ প্রকাশিত হবে যার একটি ‘গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক বঞ্চনা’ এবং অপরটি ‘পশ্চিমবাংলার জীবনজীবিকার সঙ্কট ও কর্মহীনতা’ নিয়ে। আজ জেবিসিএসএসআর-এর পক্ষ থেকে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানে উক্ত মনোগ্রাফ প্রকাশিত হবে যেখানে কমরেড প্রকাশ করাত উপস্থিত থাকবেন।

কমরেড জ্যোতি বসুর স্নেহ ভালবাসা ও তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে আমি গর্বিত এ কথা বলতে আমার কোনও কুণ্ঠা নেই। কমরেড জ্যোতি বসু সমাজের যে কোনও অংশের মানুষকে আকৃষ্ট করার এক অদ্ভুত দক্ষতা দেখিয়েছেন। কমরেড প্রকাশ কারাতের মূল্যায়ন ‘আর কেউ জ্যোতি বসু হবেন না’— এই কথাটি প্রাসঙ্গিক। আমার বিচারেও কমরেড জ্যোতি বসু ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ও অদ্ভুত ক্ষমতা সম্পন্ন একজন সত্যিকারের জননেতা। কমরেড জ্যোতি বসুকে জানাই লাল সেলাম।

Spread the word

Leave a Reply