Logo

Communist Party And The Struggle: A Heritage To Carry On

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের একশো বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক যেমন লিখেছিলেন “আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি ” তাকেই একটু ঘুরিয়ে বলা চলে আজি হতে শতবর্ষ আগে কে তুমি লিখেছিলে এ অমর কবিতাখানি – ইনকিলাব জিন্দাবাদ। দুটো শব্দ। এই দুটো শব্দবন্ধ নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা। তাহলে কমিউনিস্টদের লক্ষ্য কি, উদ্দেশ্য কি, কর্মপন্থা কি সেইসব কে এই দুটি শব্দের মধ্যে প্রকাশ করলেন হসরত মোহানী।

১৯২০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হয়েছিল্ আর ১৯২১ সালে এই স্লোগান। কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে কমিউনিস্টরা পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করে – সারা দেশে সেই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল এই দাবি তুলল। যদিও সেই আবেদন তখন গৃহীত হয় নি। কিন্তু গোটা বিশের দশক ধরে এই স্লোগান যেরকম রন্ধ্বনিতে পরিণত হল, তেমনই এই পূর্ণ স্বাধীনতা কি এবং কেন এটাও আলাপ আলোচনার মধ্যে এলো, তর্ক বিতর্কের মধ্যে এলো। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ঘটনা গোটা পৃথিবীতে এবং আমাদের দেশেও একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তর করেছিল, তাদের ভিতর থেকে নাড়া দিয়েছিল। মেহনতী মানুষের একটা রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। তাহলে কমিউনিস্টরা কি চায়?

কমিউনিস্টরা চায়, এই যে শোষণ ভিত্তিক সমাজ – তাকে পাল্টানো। এই যে শাসক শ্রেণি যারা এই শোষণ চালাচ্ছে এবং মেহনতী মানুষের মেহনতের ফসলকে লুট করেছে তাকে সাম্যের ভিত্তিতে, সমতার ভিত্তিতে, সমান অধিকারের ভিত্তিতে একটা সমাজ এমনভাবেই তৈরি করতে হবে যেখানে কেউ কাউকে শোষণ করবে না, এটা হবে শোষণহীন সমাজ। মানুষের কল্পনাতে এই সমাজের আকর্ষন তীব্র হলো। মার্কস – এঙ্গেলস যখন কমিউনিস্ট ইস্তাহারে বলেছিলেন তখন অনেকেই একে কথার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু মার্কস তখনই বলেছিলেন যে এখনও অবধি দার্শনিকেরা বিভিন্নভাবে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু প্রয়োজন হল তার পরিবর্তন করা। এই পরিবর্তন সম্ভব। রুশ বিপ্লব সেই সম্ভাবনাকে তাত্বিক আলোচনার পরিসরের বাইরে এনে বাস্তবে করে দেখিয়ে দিল।

জীবদ্দশায় মার্কস নানা দেশে নির্বাসনের জীবন কাটিয়েছেন, ঘুরে বেড়িয়েছেন – কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে হয়ছিল তাকে। তার মধ্যেও বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষ, মেহনতী মানুষের সংগ্রামে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে। এঙ্গেলস ও একই ধারায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন চিরকাল। তাহলে কমিউনিজম বা মার্কসবাদ এ শুধু কোনো তত্বকথা নয়, তত্ত্ব তো বটেই – বিশ্বকে পাল্টে দেবার একটা বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানকে সুত্রায়ীত করার সময় মার্কস তার আগে অবধি মানুষের জ্ঞান ভান্ডারে যা কিছু রয়েছে দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি এই সবকিছুর প্রথমে গভীর অধ্যয়ন এবং পরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। এর পরে মানুষের সমাজের যে ঐতিহাসিক ধারা তার উপরে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটালেন। কমিউনিস্ট ইশতেহারে মার্কস যা কিছু বলেছেন সেইসব কমিউনিস্ট লীগের ইশতেহার হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ১৮৬৪ সালে তৈরি করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা নয়, প্রাপ্ত জ্ঞান ভান্ডারের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তার প্রয়োগ করা, সেই প্রয়োগ থেকে আবার শেখা।

১৯২০ সালে যখন আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হল তখন যারা বিপ্লবী আন্দোলন কিংবা শ্রমিক আন্দোলন করছেন তাদের মধ্যে পত্র পত্রিকা প্রকাশ করা, লেখা পড়ার একটা আবহাওয়া গড়ে উঠেছিল। কমিউনিস্টরা মনে করে – এবং সেইরকম মনে করেই কাজ করতে হয়, প্রচলিত ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে অথচ সেই সম্পর্কে সঠিক না জেনে, না বুঝে অতীতের জ্ঞান ভান্ডার এবং বর্তমানের কি কি ব্যবহার করতে হবে, কোনটা বর্জন করতে হবে এই নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে তা আন্দোলন সংগ্রামকে ভুল পথে চালিত করবে। সেই কারণেই আমরা সঠিক পড়াশোনার উপরে এত জোর দি, রাজনৈতিক শিক্ষা শিবির আয়োজন করি। আবার এরই সাথে সেইসব আলোচনায় যা কিছু বলা হয় তাকে প্রয়োগের ময়দানে হাতে কলমে চর্চার অভ্যাস ও করতে হয়। প্রয়োগের চর্চা ছাড়া শুধুই অধ্যয়ন কিংবা কিছু না জেনে বুঝেই ময়দানে নেমে পড়া – দুটোই ভ্রান্তি তৈরি করে। কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সৌন্দর্য এখানেই, একই সাথে অতীতের জ্ঞানের সারাংশ কে আত্মস্থ করে শিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মীরা তৈরি হবেন আবার আরেকদিকে বর্তমানের ময়দানে জনগণের মধ্যে কাজ করে নতুন জ্ঞানের দিক খুলবেন। শৃঙ্খলা এবং সৃষ্টিশীলতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্মে।

এই কারণেই ভগৎ সিং দের হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন রূপান্তরিত হলো হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে। স্বাধীনতার পরে বিদেশি শাসন দুর হলেও তাদের জায়গায় আসীন দেশের একচেটিয়া পুঁজির মালিকেরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ( রেল, খনিজ সম্পদ, ব্যাংক এবং অন্যান্য) সমুহকে ক্রমশ নিজেদের কুক্ষিগত করে চলছে। এরা স্বাধীনতার আগে দেশের মানুষের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষা করেনি। তারা এদেশের সামন্ত প্রভুদের সাথে একটা রাজনৈতিক আপোষ করলেন – এরই ফলে দেশের বিকাশ রুদ্ধ হল। এই আপোষের কারণেই দেশের বেশিরভাগ জায়গায় আজও ভূমিসংস্কার হয়নি, যে যে জায়গায় বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছিলেন সেখানেই কেবল ( কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় বামপন্থী সরকার এবং কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সরকারের আমলে এই কাজ হয়েছে) গরীব মানুষের হাতে নিজেদের জমি দেওয়া গেছে – সারা দেশে সেই কাজ করা যায়নি।

সম্প্রতি যে নতুন কৃষি আইন করা হয়েছে তাতে বাকি কোনো জায়গাতেই এই কাজ আর হবে না, কৃষকের উৎপন্ন ফসলের সবটাই চলে যাবে পুঁজিপতিদের হাতে। এর বিরুদ্ধে লড়াই জারী থাকবে। এই লড়াই ততদিন চলবে যতদিন না শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। এখন জাতির নামে বজ্জাতি চলছে, ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন চলছে – এর অবসান সম্ভব যদি রাজনীতি এবং সমাজ ধর্মভিত্তিক না হয়। কমিউনিস্টদের দাবি তাই। এই দাবির সমর্থনেই আমরা এই দেশে একশো বছর ধরে লড়াই চালাচ্ছি – এই দাবি সমূহের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে ক্রমশ আন্দোলন সংগ্রামের উন্নতি ঘটেছে, এখনও ঘটছে।

জাতি, ধর্ম, ভাষা, নারী – পুরুষ নির্বিশেষে সবার মাঝে সাম্যের ধারণার প্রতিষ্ঠাই কমিউনিস্টদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে সর্বহারা শ্রেণী হিসাবে শ্রমিকেরা লড়াই করে, সেই লড়াইতে তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে কৃষক – ক্ষেতমজুর। এই সমবেত করার কাজটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে করতে হয়। এই সমবেত শক্তি একদিকে যেমন একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করবে তেমনই আরেকদিকে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজতন্ত্রের দিকে এগোনোর একটি পূর্বশর্ত হল এই লড়াই। এই লড়াইকে অসম্পূর্ণ রেখে পরের ধাপে পৌঁছানো যায় না। এই কাজ সাহস করতে গেলে আমাদের দেশে আমরা যাকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলছি তার সমাধান করতে হবে। কারণ একথা স্পষ্ট এদেশে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে আর এই কাজ হবে না, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক – কৃষকের জোট সেই কাজ শেষ করবে।

শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগামী সদস্যেরা একজোট হবে, সংগঠিত হবে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে। মুষ্ঠিমেয় কিছু অংশ বাদ দিলে কৃষক জনতার একটি বড় অংশই এই লড়াইতে যুক্ত হবে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই লড়াইতে সাহায্য করবে। রাজনৈতিক দিক থেকে বলা যায় যে কোনো ধর্ম, জাতি কিংবা ভাষার নামে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে। একইসাথে আজকের ব্যবস্থায় ক্ষুন্ন যারা, ক্ষুব্ধ যারা তাদেরও সবাইকে এই লড়াইয়ের জোটের সঙ্গী করতে চেষ্টা করতে হবে আমাদের।

গোটা দেশে একচেটিয়া পুঁজির শাসন যখন ফ্যাসিবাদের দিকে এগোচ্ছে সেই সময় এর বিরুদ্ধে বৃহত্তর এক মানুষের জোট গড়ে তোলাই কমিউনিস্টদের কাজ। এই কাজে কতদূর আমরা সফল হতে পারলাম এরই উপরে নির্ভর করবে ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনকে এগোনোর কাজ। জনগণকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে যাতে তারা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেই লক্ষ্যেই আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সবার আগে রক্ষা করতে হবে।

Spread the word

Leave a Reply