শান্তনু দে
ইতিহাসের নতুন পাতা খুললো কলম্বিয়া।
দেশের ইতিহাসে এই প্রথম, নির্বাচিত বামপন্থা-ঘেঁষা প্রগতিশীল রাষ্ট্রপতি। বামপন্থী নির্বাচনী জোট প্যাক্টো হিস্টোরিকা (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট)-র প্রার্থী গুস্তাভো পেত্রো পেয়েছেন ৫০.৪ শতাংশ। পরাস্ত করেছেন রিয়েল এস্টেট টাইকুন, ১০ কোটি ডলার সম্পত্তির মালিক দক্ষিণপন্থী রোদোলফো হার্নান্ডেজকে, যিনি প্রকাশ্যে নিজেকে ‘হিটলারের অনুগামী’ বলে দাবি করেন। লাতিন আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি ‘কলম্বিয়ার ট্রাম্প’ নামে পরিচিত, যেমন ব্রাজিলের বোলসোলারো। হার্নান্ডেজের পক্ষে সমর্থনের হার ৪৭.৩ শতাংশ।
পেত্রো একসময় (২০১২-১৪) ছিলেন রাজধানী বোগোতার নির্বাচিত মেয়র। তার বহু আগে আটের দশকে ১৯ এপ্রিল আন্দোলন— বামপন্থী এম-১৯ গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্য। অস্ত্র সমর্পণের পর পেত্রো নেন মধ্য-বামপন্থী অবস্থান। ৬১-বছরের পেত্রো গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। পেয়েছিলেন ৮০ লক্ষের বেশি ভোট, প্রায় ৪২ শতাংশ। ২০১৮ থেকে কলম্বিয়ার সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের সদস্য।
পেত্রোর কথায় তাঁর নির্বাচনী জোট প্যাক্টো হিস্টোরিকা (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট) আসলে ‘সামাজিক আন্দোলন, আদি জনগোষ্ঠীর আন্দোলন, নারীবাদী ও পরিবেশবাদীদের জোট।’ এই জোটে অতি বামপন্থী, কমিউনস (একসময়ের দাপুটে মার্কসবাদী গেরিলা সংগঠন ফার্কের রাজনৈতিক দল), মধ্য-বাম থেকে রয়েছে কলম্বিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মতো ২০টি রাজনৈতিক দল।
সরকার চালানোর ক্ষেত্রে পেত্রোর সামনে রয়েছে অনেক বাধা। শক্ত চ্যালেঞ্জ।
এক) সংসদের দুই কক্ষ— সেনেট এবং প্রতিনিধিসভা কোথাও পেত্রোর গরিষ্ঠতা নেই। সংসদের দুই কক্ষেই রয়েছে দক্ষিণপন্থী, মধ্যপন্থী এবং নয়া উদারবাদী দলগুলির আধিপত্য।
দুই) কলম্বিয়ার নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে আধা সামরিক গোষ্ঠীগুলির নিবিড় সম্পর্ক, যাদের শিকার হতে হয়েছে হাজারো নিরাপরাধ সাধারণ মানুষকে, যারা প্রকাশ্যে পেত্রোর বিরোধিতা করে আসছে। কলম্বিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এদুয়ার্দো জাপাতিরো রীতিমতো টুইট করে পেত্রোর বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিলেন। লঙ্ঘন করেছিলেন দেশের আইনকে, যে আইনে দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না সামরিক কর্তারা।
তিন) কলম্বিয়া মানে লাতিন আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্ত ঘাঁটি। লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপের জন্য সবচেয়ে বিশ্বস্ত হলো কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। এর স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অপরিসীম। এক কলম্বিয়াতে রয়েছে সাত-সাতটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। এর সঙ্গেই পেন্টাগন নিয়মিত অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীকে। প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য নির্ভর করে কলম্বিয়ার সেনাবাহিনীর ওপর। ২০১৯, ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন পদক্ষেপে সক্রিয়ভাবে যোগ দেয় কলম্বিয়ার সেনাবাহিনী। সামরিক খাতে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি’র ১২ শতাংশ। রয়েছে ২ লক্ষ ৯৫ হাজারের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম। চে’র কথায় ‘ইয়াঙ্কি মন্ত্রিসভা’ অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের (ওএএস) প্রথম বৈঠক হয়েছিল কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতায়। ১৯৪৮ সালের ৩০ এপ্রিল। ওএএসের প্রথম মহাসচিবও হন একজন কলম্বিয়ান।
চার) কলম্বিয়ার রপ্তানির অর্ধেকের বেশি আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। শুধু পেট্রোলিয়াম থেকেই আসে ৫৭ শতাংশ। লাতিন আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। কলম্বিয়ার প্রায় ৯২ শতাংশ কয়লাই রপ্তানি করা হয়। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী দেশ। গত বছরের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টন। রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পান্না, নিকেলের অফুরন্ত ভাণ্ডার। উর্বর কফিখেত। বিপুল এলাকাজুড়ে আমাজনের গহীন জঙ্গল। এই অপার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রয়েছে কানাডা ও মার্কিন সংস্থাগুলির আধিপত্য। ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ওয়াশিংটনের ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ তাই ছিল ছুতো, লক্ষ্য আসলে তেল আর প্রাকৃতিক সম্পদ। তাছাড়া, কলম্বিয়াতে রয়েছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম-সহ একশটির বেশি ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থা। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিরাপদ রাখতে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কলম্বিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রকের সঙ্গে ১ কোটি ১০ লক্ষ ডলারের চুক্তি করেছে।
পাঁচ) এই নির্বাচন নিয়ে তাই সমান তৎপর ছিল ওয়াশিংটন। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় তাই কলম্বিয়া সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন বিদেশদপ্তরের রাজনৈতিক বিষয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুলান্ড। কে এই নুলান্ড? ২০১৪, ইউক্রেনে মার্কিন মদতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করার অন্যতম মস্তিষ্ক। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় নুলান্ড সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাইরের লোকেরা যাতে (নির্বাচনকে) প্রভাবিত করতে না পারে, তা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে।’ যোগ করেন, ‘ভেনেজুয়েলা সীমান্তে রুশদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।’ পেত্রোর জয়ের পরে এই তৎপরতা, হস্তক্ষেপ আরও বাড়বে, যেমন হচ্ছে পেরুতে।
অন্যদিকে, শান্তির জোরালো সওয়ালকারী পেত্রোর আশা তিনি সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারবেন। ২০১৬–তে বামপন্থী গেরিলা গোষ্ঠী ফার্কের সঙ্গে হওয়া সরকারের শান্তি চুক্তিকে মেনে চলবেন, যার বেপরোয়া লঙ্ঘন করে এসেছে বিদায়ী উগ্র দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি ইভান দুকের প্রশাসন। অস্ত্র সমর্পণের পর কয়েকশ প্রাক্তন গেরিলাকে হত্যা করা হয়েছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ভূমি সংস্কার চান পেত্রো। তিনি মনে করেন জমির মালিকানা কিছু গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। আর লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন কৃষক রয়েছেন চরম দুর্দশা, অমানবিক অবস্থার মধ্যে। নয়া উদারবাদের বিপরীত পথে হাঁটতে চান পেত্রো। যে উদারনীতি দেশে দারিদ্রের সংখ্যা এখন ৪০ শতাংশ।
পেত্রোর জয় আসলে দক্ষিণপন্থী উরিবিস্তা আন্দোলনের অবসানের প্রতীক, যা ২০০২ সালে উরিবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে কলম্বিয়ার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে ছিল।
কলম্বিয়া এই প্রথম উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাকে। ফ্রান্সিয়া মার্কেজ একজন বামপন্থী সমাজকর্মী, যিনি প্রকাশ্যে কলম্বিয়ার রাজনীতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপের নিন্দা করেছেন। তিনি চান শান্তি। নতুন করে সামরিকীকরণের বিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির নতুন করে বোঝাপড়া চান তিনি। আদি জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা বন্ধের সঙ্গেই অবিলম্বে ভূমি সংস্কার চান তিন। পেত্রো এবং মার্কেজ দু’জনেই চান প্রতিবেশী দেশ ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সুসম্পর্ক।
এর মধ্যেই আশার আলো মানুষ পরিবর্তন চাইছেন। নির্বাচনী প্রচারে পেত্রো বলেছেন, ১৯৪৮ থেকে হিংসায় আক্রান্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কিছু বড় পরিবর্তন জরুরি। তাঁর সরকার কৃষি সংস্কার করবে, শক্তিশালী করবে শ্রম আইনকে, কলম্বিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ ও আদি জনগোষ্ঠী মানুষের সমানাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।