গেষ্টাপো। ক্যামিসিয়া বা ব্ল্যাকশার্ট। স্টেরমাটেলং বা ব্রাউনশার্ট। এই শব্দগুলো ইউরোপের প্রবীণ মানুষদের শিরদাড়ায় এখনও এক শীতল প্রবাহ সৃষ্টি করে। আমাদের কেউ কেউ শব্দগুলো, আর এর ইতিহাস কমবেশি জানলেও, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই বাংলা বা ভারতবাসীদের।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/02/gestapo-1.jpg)
গেষ্টাপো বাহিনী হিটলার তৈরি করেছিলেন ১৯৩৩ সালে। কাদের নিয়ে তৈরি হ’য়েছিল এই বাহিনী? হিটলারের পার্টির নাম ছিল Nationalsozialistische Deutsche Arbeiterpartei (National Socialist German Workers’ Party), এক কথায় ‘নাজি পার্টি’ নামেই মানু্ষ এদের চেনে।
নাজি পার্টির সক্রিয় সদস্যদের নিয়ে ‘গেষ্টাপো বাহিনী’ তৈরি করেছিলেন তৎকালীন প্রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হার্মান গোয়েরিং। প্রথম দিকে এই বাহিনী আলাদা ভাবে কাজ করলেও ৩ বছরের মধ্যেই এই বাহিনীকে মূল পুলিশ বাহিনীর মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বহু হত্যার নায়ক কুখ্যাত হাইনরিখ হিমলারকে দায়িত্ব দেওয়া হ’য়েছিল এই বাহিনী পরিচালনার।
এদের কাজ কি ছিল? মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা এবং হত্যা করা। সব আইন কানুনের উর্দ্ধে এদের কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আদালতের বা দেশের আইন কানুনের অনুমতি না নিয়েই ইচ্ছে করলেই এরা যাকে খুশী গ্রেপ্তার করতে পারত।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/02/gestapo-2-1024x740.jpg)
১৯৪৪ সালে এদের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৩২হাজার-এ। যে কোনও কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, ইহুদী’র বাড়ি ঢুকে ধরে আনা, অকথ্য অত্যাচার চালানো এমনকি বিনা বিচারে হত্যার অধিকারও এদের ছিল।
‘স্টেরমাটেলং’ বা ‘ব্রাউনশার্ট’। মূলত মারকুটে-হিংস্র চরিত্রের নাজি পার্টির কর্মী, বিশেষত যারা আগে মিলিটারি বা পুলিশে কাজ করত বা এই কাজে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তাদের নিয়ে হিটলারের আমলে তৈরি করা হয়েছিল ‘ব্রাউন শার্ট’ বাহিনী বা ‘স্টেরমাটেলং’।এরা মুলত ঝটিকা আক্রমণের বাহিনী হিসাবে কাজ করত। এই বাহিনীতে ঢোকার মূল যোগ্যতা ছিল এরা কতটা নাজি পার্টির প্রতি অনুরক্ত এবং তাদের দর্শনে বিশ্বাসী।
‘ব্ল্যাক শার্ট’ বা ‘ক্যামিসিয়া’ ছিল ইটালির মুসোলিনীর বাহিনী। প্রধানত বিক্ষুব্ধ প্রাক্তন সেনা. উগ্র-জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসীবাদের সমর্থক, কমিউনিস্ট বিদ্বেষীদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী স্বঘোষিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবে দাবি করত। কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী এবং প্রগতিশীল গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের ওপর হিংস্র আক্রমণ চালানোই ছিল এদের কাজ। এরা নিজেদের দেশের আইন-কানুন বিচার ব্যবস্থার উর্দ্ধে মনে করত। ধর্মঘট ভাঙা, ট্রেড ইউনিয়নের দপ্তর আক্রমণ করা, কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টদের বিভিন্ন সামাজিক ও ট্রেড ইউনিয়ন থেকে বেছে বেছে আক্রমণ ক’রে তাড়িয়ে দেওয়াই ছিল এদের মূল কাজ।
আপনি কি দেশ ও রাজ্যর শাসক দলের সাথে কোথাও কি এদের মিল পাচ্ছেন?
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/02/civic-gestapo-1.jpg)
২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন এক বাহিনী গঠন করা শুরু করেন, নাম ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার’।
এদের কাজ কি? যে কোনও পুলিশ দপ্তরের কাজে সহায়কের ভুমিকা পালন করা। কি ভাবে নিয়োগ হয়? লোক দেখানো নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর লোক দেখানো কিছু পরীক্ষাও হয়। কিন্তু কাদের নিয়োগ পত্র দেওয়া হয়, কিভাবে দেওয়া হয় সবাই সব জানে। শাসকদলের দপ্তরে এদের ফর্ম দেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি হয় – একথা কে না জানে। যোগ্যতা কি লাগে? সরকারি নির্দেশে যাই বলা থাকুক না কেন, আসল যোগ্যতা শাসক দলের অনুগামী কি না, তাদের মিছিল-সভায় নিয়মিত যায় কি না, বিরোধী দলের ওপর আক্রমণে কতটা দক্ষ – মূলত এগুলোই যোগ্যতা হিসাবে বিবেচিত হয়। আর হ্যাঁ, আর একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা নির্ণায়ক মাপকাঠি আছে – কে কত বেশি রেস্ত দিয়ে খুশি করতে পারবে শাসক দলের নেতাদের। কয়েক জন হয়ত বা কিছু পুলিশ কর্তা বা সরকারি হোমড়া-চোমড়াদের সুপারিশে নিয়োগ পত্র পায়। এখন এদের সংখ্যা ১লক্ষ ৩০ হাজারের কিছু বেশি। এরা মাস গেলে ৯হাজার টাকা পেয়ে থাকে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/02/Civic-1024x300.jpg)
আইন অনুযায়ী এরা কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না, জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারে না। কারুর বাড়িতে গিয়ে বা রাস্তায় ধরতেও পারে না, কাউকে জরিমানাও করতে পারে না। এদের সব কাজ উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশে করতে হয়, আইন তাই বলছে।
কিন্তু এদের অনেককেই সব কাজেই দেখা যায়। রাত-বিরেতে লোকের বাড়ি যাওয়া, পাড়ায় মস্তানি করা, রাস্তায় লোক জনকে মারধর করা, ট্রাফিক আইন রক্ষার নামে অবাধ তোলাবাজি – কি না করতে হয় এদের! ভোটের সময় বিরোধীদের হুমকি দেওয়া, ভোটের দিন মারধর করা, ভোট লুঠ করা বা করতে সাহায্য করা, এসবও এখন এদের কাজের এক্তিয়ারে এসে গেছে। আর একটা বড় কাজ হচ্ছে বামপন্থীদের যে কোনও সভা, মিছিল বা ধর্মঘট ভাঙতে এদেরই লাঠি হাতে হিংস্র ভূমিকায় দেখা যায়। এরা কি নিজেদের দায়িত্বে করে এইসব অপরাধ? নাকি পুলিশের পোশাক পরে যে অপরাধগুলো করতে কিছু কর্তারা একটু লজ্জাবোধ করে বা ভয় পায়, সেগুলোই কি এই ন’হাজারী বাহিনী দিয়ে করানো হয়?
এরা পুলিশ দপ্তরের সাথে যুক্ত, কিন্তু এরা অবাধে শাসক দলের পতাকা হাতে মিছিল করে, মারপিট করে, ভোট লুঠ করে। রাস্তায় যানবাহন দাঁড় করিয়ে তোলা তোলে। এদের সবাই কি করে? না করে না। যারা শাসক দলের হোমড়া চোমড়াদের আশীর্বাদধন্য তারাই এইসব অপরাধ করার সাহস পায়। এও শোনা যায় এদের কেউ কেউ থানার বড়-মেজ-সেজ বাবুদের বদলি করিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিয়ে থাকে, যদি তারা শাসকদলের নেতা-নেত্রীর নির্দেশ সামান্যও লঙ্ঘন করে।
আবার এদের যখন ইচ্ছে বসিয়ে দেওয়ার অধিকার আছে সরকারের। অর্থাৎ কেউ যদি শাসক দল বা তার স্থানীয় নেতা- নেত্রীদের খুশী করে চলতে না পারে, তাহলে কাজ যাওয়ার ভয়ে তটস্থ ক’রে রাখার ব্যবস্থাও করে রাখা আছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2022/02/civic-police-1.jpg)
প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার বাইরে এই বাহিনী গড়ে তোলা হ’ল কেন? এই বাহিনী যদি পুলিশ দপ্তরের অধীনেই থাবে, তাহলে এই বাহিনীর সার্ভিস রুল বা চাকরী’র শর্ত তাদের মানতে হবে না কেন? কেন তাদের নিয়োগ থেকে শুরু ক’রে, মাস মাইনে ইত্যাদি’র প্রশ্নে অন্যান্য হোমগার্ডদের সাথে সমতা আনা হচ্ছে না?
এই বাহিনী কি আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে, না কি শাসক দলের মজুত বাহিনীর তৈরি করার জন্য করা হয়েছে। সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করা, আক্রমণ করা থেকে সব ধরণের অগণতান্ত্রিক কাজেই এদের লাগানো হচ্ছে, এবং এটা হচ্ছে রাজ্যের পুলিশ তথা মূখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ এবং পরিকল্পপনা অনুযায়ী।
২০২১এর ফেব্রুয়ারী মাসে প্রকাশ্য রাস্তায় সরকার বিরোধী আন্দোলনে যোগদানকারী মঈদুল মিদ্দাকে পিটিয়ে হত্যা বা ২০২২ এর ফেব্রুয়ারীতে সরকার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচিত মুখ আনিস খানকে বাড়ি ঢুকে খুন করার পর এই আওয়াজ স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে – সিভিক পুলিশদের গেষ্টাপো বাহিনীতে পরিণত করা চলবে না।