cultural movement

By Spontaneous Public Support

মানবেশ চৌধুরি

এক

অনেকেই জানি যে, যারা সমসুযোগের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁদের এই বৈষম্য পিড়ীত হিংস্র রাষ্টের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, সমস্ত ফ্রন্টে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে, যতক্ষণ না বিজয় অর্জিত হয়।

এই কথাটাও অনেকে জানি, যতক্ষণ না বিজয় অর্জিত হয়, সেই মধ্যবর্তি সময়ে দীর্ঘ দিন ধরে উল্লিখিত ফ্রন্টের সংগ্রামগুলো বিভিন্ন পরিবেশে লাগসইভাবে চালিয়েই যেতে হবে।

আজ এই লেখায় সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের কথা অক্ষমতা সত্বেও প্রতিবেদক আলোচনা করার চেষ্টা করবে। নিজ বোধ ও বুদ্ধির অপিরসরতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তার মনে কোন সন্দেহ নেই।

গ্রামবাসী হবার সুবাদে সে গ্রামের কথা এখানে বলবে। যদি রাজ্যের অবস্থা বিবেচনায় আনি, তবে দেখতে পাই, গ্রামগুলোতে ধান পাট সরষে ইত্যাদি ফসলের আড়তদার, ফড়িয়া, বড় বড় যে সব পুকুর কাটা হচ্ছে – তার ইজারাদার, পুকুর খনন করে দেবার কন্ট্রাকটর, বাস বা লরির মালিক, বালু সিমেন্ট রড ইত্যাদি সামগ্রীর সরবাহকারী, অস্বাভাবিক সুদের কড়ারে টাকা ধার দেনেওয়ালা, পঞ্চায়েতের মাতব্বর, শাসকদলের মাতব্বর, এম এল এ – যারা হঠাৎ বিপুল টাকার মালিক বনেছে এবং লম্পট–গাঁড়োল-লুম্পেন এরকম লোকের চরম দাপট চলছে। পুলিশ-প্রশাসন সবই এদের হাতে।

এ বাংলায় যে বিপদ গণ্য করার মতো ছিল না, বিশেষ করে গ্রামদেশে ছিল প্রায় অনুপস্থিত, সেই সাম্প্রদায়িকতার চাষ শুরু হয়ে তা বিষাক্ত আগাছার মতো লকলক করে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেবার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ‘ধনগরিমার ইতরতা’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিরোধ, অবিশ্বাস, প্রদর্শণমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সংগে, সরকারী বদান্যতায় একধরনের মদমত্ত দেখনাদারি। জাত-পাত- বর্ণবাদ- ব্রাহ্মণ্যবাদ ‘এর উৎকট কুশ্রীতা জাঁকিয়ে বসেছে রাজ্যটায়।

প্রথম পরিচ্ছদে উল্লিখিত দুষ্কাণ্ডগুলির বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার বেগ বেড়েছে। সাথিরা রক্তাক্ত ও নিহত হচ্ছেন। পরিবর্তন ঘটানোর একটা জেদ মানুষের মধ্যে সঞ্চালিত হচ্ছে।

দুই

কিন্তু আমাদের বিনীত কথা, এই লড়াইয়ের পাশে সাহিত্য, শিল্প, নাটক, গান, সম্মিলিত বক্তব্য নিয়ে কী সংশ্লিষ্ট বন্ধুরা এগিয়ে আসছেন! আসছেন তো অবশ্যই। কিন্তু তবুও বোধহয় সংশ্লিষ্ট কৃতবিদ্যদের কিঞ্চিত আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে।
১৯৩৬ সালে ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘ তৈরি হয়েছিল।

তারপরে আমরা দেখেছি, মন্বন্তর, দেখেছি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেখেছি সেই যুদ্ধে বিপুল ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত সোভিয়েত শক্তির বিজয়। সেই পর্বে কত কত লড়াই!

দেখেছি পর্বে পর্বে কত শিল্প সম্ভার নিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা এগিয়ে এসেছেন!

সোভিয়েত বিজয়ের পর শহরে শহরে উল্লাস, বিজয় মিছিল জমায়েত, বিজয়ের প্রেরণায় আই এন এ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ছাত্র ধর্মঘটে কলকাতায় ছাত্র কর্মী রামেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের আত্মাহূতি, আই এন ক্যাপ্টেন রসিদ আলির বিচারের বিরুদ্ধে কলকাতা আন্দোলনকারীদের দ্বারা স্পন্দিত – ১৫ জন সাথির আত্মাহূতি। ডাক-তার ধর্মঘট, এরই মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গা, দাঙ্গাকে উড়িয়ে দিয়ে হাসনাবাদের মৈত্রীর মহত্ব, নৌবিদ্রোহ, কলকাতার রাজপথে শিল্পী, সাহিত্যিক-নাট্যকর্মী-গায়ক-গীতিকারদের মিছিল, তারপর তেভাগার লড়াই, তেভাগায় বিপুল আত্মদান।

আমরা কী তখনও পর্বে পর্বে দেখিনি, কেউ কবিতা, কেউ গান, কেউ নাটক, কেউ গল্প, কেউ উপন্যাস নিয়ে এই সব দ্রোহের সঙ্গে এসে মিশে একাত্ম হয়ে, সেগুলিকে কেমন আরও প্রাণবন্ত করে তুলতেন!

মানুষের চোখের জলে নোনতা স্বাধীনতা এলো। দেশভাগের পরে চ্ছিন্নমূল মানুষের লড়াই। তখনও কোথাও কোথাও চলছে তেভাগা সংগ্রাম। রাজ্যবাসীর খাদ্যের লড়াই, গ্রামের নিরন্ন মানুষের শহিদান, ছাত্র সাথিদের আত্মদান, স্বল্পকালীন যুক্তফন্ট আমলে জমির লড়াই, আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস – কত হত্যাকাণ্ড, কত সাথির জেল-জীবণ, কত ঘরছাড়া – তাদের পাশে কী সাংস্কৃতিক কর্মীদের আমরা দেখিনি নিজ নিজ সম্ভার নিয়ে এগিয়ে আসতে!

একটু ভেবে দেখতেই হবে, আমরা পরম্পরা বজায় রাখতে পারছি কি না! না পারলে কেন পারছি না?

তিন

১৯৭৩ সাল। কালবেলা শুরু হয়েছে তিন বছর আগেই। মহান নেতা মুজফফর আহমদ প্রয়াত হলেন। এই প্রতিবেদক নবীন গণনাট্য কর্মী। রাজ্য নেতা এসেছেন। খুব ভালো মানের গায়ক। গণনাট্য সংঘের ইউনিট সম্মেলন। ইউনিট সংগঠনের অবস্থা খারাপ। কেন? কাকাবাবুর মৃত্যুর পরে নন্দন-এ প্রকাশিত কবি শ্যামসুন্দর দে’র কবিতা পড়া ছিল। প্রতিবেদক তাই উচ্চারণ করলো – “গঙ্গোত্রী শুখালে ভাগীরথীও শুখায়” অর্থাৎ এই ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে কী করে গান-নাটক করা যায়! এই কথা বলায় রাজ্য নেতার সস্নেহ ধমক। তিনি বুঝিয়ে বললেন – যারা নান্দনিক ক্ষেত্রে কাজ করেন, তারা অনেক সময় বাস্তব লড়াই শুরু হবার আগেই কথা বলেন তাদের শিল্পে। এডভান্স কথা। আর আপনি বলছেন – গঙ্গোত্রী শুখালে – ইত্যাদি।

এক একটি সংগ্রামের সুরও বেঁধে দিয়েছেন কখনও গন শিল্পীরা। দুর্গতি মোচনের লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তখনকার ঘটমান-বর্তমানের মাঠে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাই হয়ে গিয়েছে যুগোত্তীর্ণ। এরকম কত উদাহরণ আছে।

সাংস্কৃতিক ফ্রণ্টের নানা শাখা। তার মধ্যে গণনাট্যের মধ্যে কত দিকপাল গীতিকার – শিল্পী এখনও আছেন। তাঁরা নিজস্ব উদ্যোগে কেউ কেউ গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরে গান আবিস্কার করেছেন, আবিস্কৃত সেই নতুন গান ও তার সুরধারা সমাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এরকম শিল্পী তো অঢেল সংখ্যায় জন্মান না! এঁরা নিজেরাই যেন প্রতিষ্ঠান। নিজেরাই সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। যদিও তাঁদের আয়ূসুর্য পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়ছে। তাঁদের বোধহয় একটা দায়িত্ব থাকছে, নতুন শিল্পী গড়ে দিয়ে যাবার।

গণনাট্যের মূল বিষয় প্রতিবেদক যেটুকু বোঝে, তা হলো সম্মিলিত উদ্যোগে এলাকায় এলাকায় ‘গণনাট্য সংঘ’-এর শাখা গড়ে তোলা। সেখানে অবিরত সৃষ্টি ও পরীক্ষা নিরীক্ষা। প্রতিষ্ঠানের থেকে কেউ আপাতভাবে বড় হতেই পারেন, কিন্তু সম্মিলিত সৃষ্টি কর্মের মধ্যেই তাঁর স্ফুরন বেশি ঘটে এবং সমসাময়ীক চলমান সংগ্রামে বেশি অবদান তিনি রাখতে পারেন বলে এই প্রতিবেদক মনে করে। এবং ১৯৪৩ সালে গঠিত ও কালেদিনে পল্লবিত গণনাট্য সংঘের মূল ধারায় অধিক জোর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলে তার অভিমত।

ইতোমধ্যে এই বাংলায় বিদ্যমান যে ভেদ-বিভেদের উৎকট বিপদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার নিরাকরণ কিসে? এক, যুথবদ্ধ লড়াইয়ে। আর এক, আমাদের লোকায়ত জীবনের সহজিয়া সংস্কৃতির মধ্যে যে ঐক্যের সুর প্রবাহিত, তাকে পুনরুদ্ধার করা। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির এখন বিপুল কর্মদ্যোগ প্রয়োজন। এই ব্যাপারে যে ন্যূনতা আছে তা দ্রুত কাটাতে না পারলে, বাংলার ক্ষতি হয়ে যাবে বলে প্রতিবেদক মনে করে।

আর একটি লেখক শিল্পীদের সংগঠন। কয়েকদিন আগে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রয়াত হলেন। তাঁর সঙ্গে তপোবিজয় ঘোষ, সৌরী ঘটক, উৎপল দত্ত প্রমুখের কথা প্রতিবেদকের মনে হচ্ছে। ১৯৭০-’৭৭ দ্রোহকালে তাঁরা কত গল্প উপন্যাস লিখে প্রগতিবাদীদের মধ্যে প্রতীতি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন!

এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, তাঁরা মানিক বন্দ্যোপাধয়ের ’লেখকের কথা’ বা তার অন্তর্গত ‘কেন লিখি’ নিবন্ধ বিষয়ে প্রতিবেদকের থেকে অনেক বেশি জানেন। তার খুব মনে হচ্ছিল, এই যে দিল্লির সীমান্তে স্বাধীনতার পরবর্তিকালের সব থেকে বড় কৃষক আন্দোলন সংঘটিত হলো, বাংলায় সর্ব ব্যাপক যে চণ্ডতা চলছে, যে চাকুরি চুরির মধ্যবর্তিতায় মন্ত্রি, অধক্ষ, আধিকারিকরা জেলবন্দি হয়ে আছে – যাদের কারও নাম পাঠ্যবইতে ‘শোভা’পাচ্ছে, এতো ধর্ষণ, এতো খুন, মেধা তলিকাভূক্তদের মাসের পর মাস অবস্থান – ইত্যাদি বিষয় বাংলার পাঠক গল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি শিল্পকর্ম দেখতে পাবেন।

হ্যাঁ এটা ঠিক, এখন পি সি জোশী – যিনি বর্ষার মধ্যে কর্দমাক্ত পথে নয় মাইল, কল্পতরু সেনগুপ্তের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে চট্টগ্রামের এক গ্রাম থেকে কবিয়াল রমেশ শীলকে আবিস্কার করেছিলেন – তাঁকে আমরা পাব না। আমরা মুজফফর আহমদ, সোমনাথ লাহিড়ি, ভবানী সেন, সরোজ মুখোপাধ্যায়, অসক্ত হবার জন্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও পাবো না।

কিন্তু বর্তমানের রাজনৈতিক সাংগঠনিক নেতৃত্বের মধ্যে কেউ কেউ তো অবশ্যই আছেন, যাঁরা এখনও সাংস্কৃতিক ফ্রণ্টের সাথিদের প্রতি প্রীতিময় হয়ে কিছু সহযোগ দিচ্ছেন। বলা বাহুল্য এই সহযোগ বাড়াতে হবে।

মানিক বন্দোপাধ্যায় বলেছিলেন – “কবি ছাড়া জয় বৃথা।“ এই বাক্যের ভিন্ন স্বর এই প্রতিবেদক উচ্চারণই করতে পারে না। কিন্তু সে বিনীত ভাবে বলতে চায় – কবি (বলা বাহুল্য ব্যপকার্থে) ছাড়া জয়ই হবে না।

Spread the word

Leave a Reply