কেন্দ্রীয় বাজেট ২০২২-২৩: জনগণের সাথে এক বিশ্বাসঘাতকতা
তারিখঃ ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর পলিট ব্যুরো নিম্নলিখিত বিবৃতি জারী করেছেঃ
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এমন একটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন যখন বেশিরভাগ মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং জনগণের প্রকৃত আয় ব্যাপক হ্রাসের সম্মুখীন। চলতি আর্থিক বছরে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) মহামারী-পূর্ব সূচককে অতিক্রম করবে বলে সরকারের অনুমান। মহামারী-পূর্ব অবস্থার তুলনায় ব্যক্তিগত খরচ খাতে ব্যয়ের হার এখনও অনেকটাই কম এবং কম শক্তি ব্যবহার করে এমন শিল্প-উৎপাদন সংস্থাগুলিও মূলত দেশের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে চাহিদার ঘাটতির কারণে ক্রমবর্ধমান মজুতের (ইনভেন্টরি) সম্মুখীন হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া, এই বাজেট সেই প্রেক্ষিতে একটি বড় ধাক্কা। এই বাজেট এসব সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ। প্রয়োজন ছিল শহুরে কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম প্রবর্তনের। বিপরীতে, এই বাজেটে এমজিএনআরিজিএ- কর্মসংস্থান খাতে ২৫০০০ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং খাদ্য, জ্বালানি ও সার সবেতেই ভর্তুকি হ্রাস করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ উন্নয়নেও ব্যয়বরাদ্দ ছাঁটাই হয়েছে।
২০২১-২২ সালের বাজেট ঘোষণার ভিত্তিতে এবারের বাজেটে মোট ১৭৪৯৯ কোটি টাকার ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। জিডিপির শতাংশ হিসাবে মোট ব্যয় (২০২০-২১ সালে ছিল ১৭.৮ শতাংশ) ২০২২-২৩ সালের বাজেটে ১৫.৩ শতাংশ, যা আসলে অবনমন। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি হয়েছে কারণ কর্পোরেট সংস্থাগুলি মহামারী চলাকালীন অবস্থাতেও মুনাফা করেছে। কর্পোরেশন কর আদায় বৃদ্ধিতে সেই প্রতিফলিত দেখা গেছে এবং সাধারণ মানুষের উপর আরোপিত পরোক্ষ কর থেকে GST এবং পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমেও সরকার আয় করেছে। তবে সরকারের ব্যয়ের বহর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির তুলনায় অনেকটাই কম এবং প্রকৃত অর্থে এহেন বৃদ্ধি গত বছরের বাজেটে ভবিষ্যতে আয় সংক্রান্ত সংশোধিত অনুমানের চেয়েও কম হয়েছে।
ব্যয়ের চাপ কেবল কেন্দ্রীয় সরকারের খরচের কারনেই বাড়েনি। জাতীয় সম্পদের বিক্রির অর্থ থেকে রাজ্যগুলিকে বাদ রাখা হয়েছে। ফলে রাজ্য সরকারগুলিকেও আয়ের উদ্দ্যেশে একই কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ২০২১-২২ সালের সংশোধিত আয় সংক্রান্ত অনুমান GDP-এর ৬.৯১ শতাংশ হলেও ২০২২-২৩ সালে সেই বৃদ্ধি ৬.২৫ শতাংশে নেমে আসবে৷
কৃষকদের জন্য সমস্ত বড় প্রকল্পের বরাদ্দ বাজেটে কাটছাঁট হয়েছে। কেন্দ্রীয় খাদ্য সংস্থা (এফসিআই) এবং বিকেন্দ্রীকৃত সংগ্রহ প্রকল্পের অধীনে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৮শতাংশ। এমনটা করা হল যখন কৃষকরা ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি নিশ্চয়তার জন্য লড়াই করছে। সারে ভর্তুকির জন্য তহবিল বরাদ্দে ২৫ শতাংশ হ্রাস করা হয়েছে। PM-KISAN-এর অধীনে, ১২.৫ কোটি কৃষক পরিবারকে ৬০০০টাকা দেওয়ার মোট বরাদ্দ প্রয়োজন ৭৫০০০ কোটি টাকা। অথচ ৬৮০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। শস্য বীমা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশুকল্যাণে স্বল্প বরাদ্দটুকুও ব্যয় করেনি সরকার। শিশুদের কল্যাণে ব্যয়ের জন্য সংশোধিত অনুমান ছিল বাজেটে ঘোষিত বরাদ্দের চেয়ে ৫৭০০ কোটি টাকা কম। শিশুদের স্কুল এবং অঙ্গনওয়াড়ি বন্ধের বিধ্বংসী প্রভাব মোকাবিলায় কিছুই করা হয়নি।
তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের কল্যাণের জন্য তহবিল বরাদ্দের পরিসংখ্যানে প্রান্তিক বৃদ্ধি দেখা গেছে তবে মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে, পিএম পোষণ প্রকল্প হিসাবে মিড-ডে মিল স্কিমের নাম পরিবর্তন করেও বরাদ্দ বাড়েনি। গত বছরে ৩৫ শতাংশ শিশু মিড ডে মিল না পেয়েও খরচ হয়েছে ১০২৩৪ কোটি টাকা। নারীশক্তি উন্নয়নের নামে অর্থমন্ত্রী ২ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়িকে উন্নত করার কথা বললেও সংশোধিত ব্যয়ের প্রস্তাবে ২০,০০০ কোটি টাকার বরাদ্দ আটকে দেওয়া হয়েছে।
গত দুই বছরে এলপিজি ভর্তুকিতে ব্যাপক ঘাটতি হয়েছে। গত বছর, ৬০ শতাংশ ব্যয়বরাদ্দ কমানো হয়, ২০২২-২৩-এর বাজেটে আরও ৬০ শতাংশ কমানো হয়েছে। ই-শ্রম পোর্টালের মাধ্যমে নথিভুক্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য এখনও কোনও নতুন বরাদ্দ নেই।
গত দুই বছরে মহামারীতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। অক্সফ্যামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের সবচেয়ে ধনী পরিবারগুলির সম্পদ ২০২১ সালে রেকর্ড সুচকে পৌঁছেছে। ভারতের শীর্ষ দশজন ধনীর হাতে মোট সম্পদের ৫৭ শতাংশ রয়েছে। তবুও, এই অতি মুনাফার উপর কর আরোপ করার এবং সেই সম্পদকে ব্যবহার করে জনগণের দুর্ভোগে স্বস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনও প্রস্তাব এই বাজেটে নেই।
সুতরাং, ২০২২-২৩ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট সাধারণ মানুষের স্বার্থে অগ্রাধিকারগুলি চিহ্নিত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কার্যত এই বাজেট জনগণের সাথে এক বিশ্বাসঘাতকতা।
দেশের জনগণের কাছে এই জনবিরোধী, কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী বাজেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম)-এর পলিট ব্যুরো। আয়কর সীমার বাইরে থাকা পরিবারবর্গের জন্য প্রতি মাসে ৭৫০০ টাকা সরাসরি নগদ অর্থ হস্তান্তরের এবং বিনামূল্যে খাদ্য-কিট বিতরনের দাবি জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো৷