সৌভিক ঘোষ
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতা।
নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদনের স্বার্থে মজুরি কমিয়ে দেওয়া, যখন ইচ্ছা তখনই ছাঁটাই ইত্যাদি যা কিছু।
আর যতটুকু যা পড়ে রইল তারই নাম উদ্বৃত্ত মজুত বাহিনী, অসহায় বেরোজগারি, নির্মম দারিদ্র্য। অর্থাৎ, কারখানার গেটের বাইরে অপেক্ষারত বিরাট লম্বা লাইন। সে লাইনে দাঁড়িয়ে… ‘যার ঘরে জ্বলেনি দীপ, চির আঁধার…’ কিংবা ‘যার বাছার জোটেনি দুধ, শুকনো মুখ…’ তারাই।
কোনও একটি দিন নিছক শারীরিক ‘অস্বাচ্ছন্দ্যের’ কারনেই যদি কেউ অনুপস্থিত হতে বাধ্য হয় তবে তার ‘বদলি’ হিসাবে অন্য কারোর এক দিনের ঠিকা নিযুক্তির সুযোগ!
মজদুর মানুষের জন্য ঐ তো অনেক, আবার কি চাই?
পাঠক ভাবতে পারেন অহেতুক অস্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি না লিখে সরাসরি অসুস্থ বলা হল না কেন! আসলে ও কথাটা শ্রমিক-মজদুর’দের জন্য তখনও ন্যায্য অধিকারের নিরিখে প্রযোজ্য নয় বলে ধরে নেওয়া চলত অথবা মালিকরা অমনটা ধরে নিলেও কিছু করার ছিল না।
এসবই মালিকেরা বলছিল। বলার উদ্দেশ্য তাদের প্রস্তাবিত লেবর স্কিম’কে পাশ করিয়ে নিতে একটা আবহ তৈরি করা। কোন স্কিম? কারখানায় কাজ, কাজের নিয়ম ও কাজের পরিবেশকে আরও বেশি করে মুনাফার পক্ষে টেনে আনতে পুঁজিবাদের সেই চিরায়ত কৌশল। উৎপাদনের খরচ কমাও। কি করে হবে? মাথা পিছু কাজের বোঝা বাড়িয়ে দাও, স্থায়ী মজুরির বিধি বাতিল করো, অস্থায়ী ঠিকা মজুরির পরিমাণ আরও কমাও।
তাই নয়া স্কিম। নাম কি? ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’- বাংলায় সময়োপযোগীকরণ, আধুনিকিকরণ এসব বললে অনেকটাই বোঝা যাবে। এহেন পরিকল্পনার কথাবার্তাগুলি কিরকম? কারখানায় শ্রমিক-মজদুরদের কাজের সময় না বাড়ালেই নয়। কারখানা চালানোর স্বার্থে, লাভ (পড়ুন মুনাফা, এবং মনে রাখুন ও দুটি এক না) ইত্যাদির স্বার্থে মজুরিতে কাটছাঁট না করলেই নয়। যারা কর্মরত তাদের কিছুটা বাড়তি কাজের বোঝা মেনে নিতে হবে।
সেটা কেমন?
যে একটা মেশিন ইউনিটে কাজ করে তাকে পাশের মেশিনের কাজও সামলাতে হবে। যার উপরে ইতিমধ্যে দুটি মেশিনের দেখভাল করার ‘দায়িত্ব’ চাপানো রয়েছে তাকে এবার থেকে অন্তত তিনটি মেশিনের দায়টুকু মাথা পেতে নিতেই হবে। আর ‘বদলি’র নামে ঠিকা কাজের যেটুকু বন্দোবস্ত রয়েছে সেসব বাতিল করে দিতে হবে।
এহেন আধুনিকীকরণে আর কিছু না হোক একটা ব্যাপার ঘটবেই। অন্তত পনেরো হাজার মানুষ কাজ হারাবেন।
কারখানার গেটের বাইরে থাকা লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মজদুরের এতদিন তবু ‘বদলি’র ছুতোয় অস্থায়ী হলেও রোজগারের ন্যুনতম একটা সুযোগ ছিল, এবার সেটুকুও যাবে।
এই অবধি পড়ে কেউ ভাবতে পারেন কোভিড-১৯ মহামারীর পর্ব কিছুটা কাটলে জাতীয় অর্থনীতির হাল ফেরাতে ইনফোসিস কর্তা নারায়ণমূর্তি যেরকম প্রেস্ক্রিপশন দিয়েছিলেন সেই নিয়েই বোধহয় কথা হচ্ছে! দুটি বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু মিল খুঁজে পেলেও আগ্রহী পাঠক জেনে রাখুন আপাতত আমরা যা নিয়ে কথা বলছি সেসব একশো বছরেরও আগেকার ব্যাপার।
১৯২৮, ব্রিটিশ শাসন, আমাদের দেশ তখনও ভারতবর্ষ।
তাই আজ যাকে আমরা ‘মুম্বই’ বলে চিনি তাকে ‘বোম্বে’ বলতে হবে। সে সময়কার মারাঠা অস্মিতা প্রদেশের নাম বদলানোর চাইতে পরিস্থিতির হাল বদলানোয় অধিক গরিমা উপলব্ধি করত। সেই প্রদেশ, সেই ‘বোম্বে’ ছিল কাপড় কলের বিরাট ক্ষেত্র। রেকর্ড অনুযায়ী প্রায় ৮৩ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত একের পর এক কাপড়ের মিল, কেতাবি ভাষায় টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট।
মিলগুলিতে কর্মরত শ্রমিক-মজদুরদের গড় মজুরি ছিল মাসে কুড়ি টাকা। একশো বছরের মূল্যবৃদ্ধির গড় হারকে ছয় শতাংশ ধরে হিসাব করলে আজকের পরিস্থিতিতে তিন হাজার সাতশো ছিয়ানব্বই টাকা’র মতো দাঁড়ায়। এই হিসাবের ব্যাপারটা বলা জরুরী যাতে চক্রবৃদ্ধির বিষয়টি সকলেই উপলব্ধি করেন এবং এও অনুভব করেন যে ঐ মজুরিতে বোম্বে’র মতো জায়গায় মানুষ কি অবস্থায় বেঁচে থাকত। বেঁচে থাকার জন্য মাথাপিছু ও ন্যুনতম ব্যয়ের নিরিখে তখনকার বোম্বে’তে আজকের মতোই অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় খরচ অনেকটাই বেশি ছিল।
সেই মজুরি’কে কুড়ি টাকা থেকে তিরিশ টাকা করার দাবী উঠল। যখন তখন যেকোনো অজুহাতে ‘ফাইন’ নেওয়াই ছিল দস্তুর- স্বাভাবিক দাবী ছিল এমন নির্লজ্জ অন্যায় বন্ধ হোক। দফায় দফায় ট্রেড ইউনিয়নের সাথে মিল মালিকদের আলোচনা হল ঠিকই এবং এটাই স্পষ্ট হল যে ওরা কোনও দাবীই মানবে না। ১৯২৭ থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল কারখানার মালিকেরা যে কোনও ছুতোয় নয়া বিধি অর্থাৎ ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’ চালু করতে চাইছে। কিন্তু শ্রমিকদের অসন্তোষ, ক্ষোভ এবং সেই ক্ষোভে ফেটে পড়ার ভয়ে তারা এক থালা ভাত একবারে খেতে পারছে না, গ্রাস গ্রাস করে গিলে নেওয়ার কৌশল নিয়েছে। একসাথে সমস্ত মিলে নয়া বিধি প্রয়োগ না করে এক একটি কারখানায় বিচ্ছিন্নভাবে নতুন নিয়ম চালু করার চেষ্টা শুরু হল। শ্রমিক-মজদুরদের সংগ্রামী ঐক্যকে পায়ে মাড়িয়ে যেতে এই ছিল পুঁজির মালিকদের সমবেত কৌশল।
কিছুদিন ধরে যখন যে কারখানায় মালিক বিধিনিষেধ চাপাতে যায় সেই ইউনিটের শ্রমিকরা নিজেদের মতো করেই প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ক্রমশ তারা সচেতন হলেন, এ লড়াই কারোর একার না। সবাই মিলে একসাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে না পারলে শেষে কেউই বাঁচবে না। মাসিক মজুরি কুড়ি টাকা থেকে তিরিশ টাকার দাবীকে যারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তারাও যে শেষ অবধি লড়বে একথাও তারা জানতেন। তবু জীবনপণ লড়াই যে শুরু হল তার একটাই কারণ। ট্রেড ইউনিয়নের লড়াই নিছক অর্থনৈতিক লড়াইয়ের গন্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ের প্রতি কিছুটা হলেও মনোযোগ দিল। আরও একবার প্রমাণ হল লেনিন সঠিক বলেছিলেন- অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার মাধ্যমেই শ্রমিকদের লড়াই শুরু হয়, কিন্তু ব্যাপারটাকে ওখানেই আটকে রাখা চলে না, ঐ সংগ্রামের মেজাজে কমিউনিস্ট রাজনীতিকে বাইরে থেকে ‘পুশ’ করতে হয়। শ্রমিক সংগঠকদের রাজনৈতিক কর্তব্য সেটাই।
সব মিলিয়ে বিয়াল্লিশটি মিল ইউনিট। একসাথে প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক-মজদুর। প্রত্যেকেই স্ট্রাইকের সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ। এতদিন বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা নিজেদের মতো করে পিকেটিং ইত্যাদি চালিয়েছেন। এবার তারা এক হলেন, ৪২টি মিলেই কাজ বন্ধ হল। ব্রিটিশ পুলিশ আগে থেকেই তৈরি ছিল, মালিকদের হয়ে তারাই স্ট্রাইক ব্রেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। হুমকি, নোটিশ জারী, গ্রেফতার, লাঠিচার্জ এসব শ্রমিকদের গা-সওয়া হয়েই গেছিল, তাই এবারের আক্রমণ শুরুই হল সরাসরি আক্রমণ দিয়ে।
একের পরে এক অভূতপূর্ব লড়াইয়ের নজির গড়ে এই স্ট্রাইক ভারতবর্ষে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন ইতিহাস লিখে রেখে যায়। দীর্ঘ ছয় মাসের সেই সংগ্রামে মালিক-পুলিশ-প্রশাসন একসাথে যথাবিহিত অত্যাচার চালিয়েছিল। তবু লড়াই চলেছে। সংগ্রামী তহবিল নির্মাণ করে সামান্য চাল ও ডাল বিলি করা হয়েছে। তাতেই জঠরের জ্বালা নিবৃত্ত করতে হয়েছে, প্রতিদিন কয়লার আগুনের মতো ধিকি ধিকি আঁচকে তারা কিছুতেই নিভতে দেয়নি। গোটা পর্বে দুটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
প্রথমটি কালাচৌকি নামের একটি পাথরখাদান এলাকার। দাদর থেকে শ্রমিকদের একটি লম্বা মিছিল সারাদিনের লড়াই শেষে ঘরে ফিরছিল। তারা সকলেই নিজেদের কারখানায় স্ট্রাইকার। কারখানার গেটে গেটে চব্বিশ ঘণ্টা সশস্ত্র পুলিশ পাহারা চলছিলই। এবার সরাসরি মিছিলের উপর হামলা হল। প্রথমে মিছিল আটকানোর কোনোরকম কারণ না দেখিয়েই হুমকি দেওয়া হল, আচমকাই লাঠিচার্জ শুরু হল। মিছিল ছত্রভঙ্গ হলে পিছন দিক থেকে ‘ফায়ার’ করার নির্দেশ দেওয়া হল। মাথায় গুলির আঘাতে একজনের মৃত্যু হল, আরেকজন গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এইবার দেখা গেল উল্টো ছবি। বিভিন্ন দিক থেকে ছত্রভঙ্গ হওয়া শ্রমিকরা পুনরায় জড় হতে শুরু করল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সংখ্যাটা প্রায় দশ হাজারে পৌঁছে গেল। ততক্ষণে পুলিশ বাহিনী অদৃশ্য। গতিক সুবিধার নয় উপলব্ধি করে চিফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং গাড়ি থেকে নেমেই ঘোষণা করলেন যাই ঘটুক না কেন কোনো মিছিলই করা যাবে না। বলেই বুঝলেন সে যুগ আর নেই! কালাচৌকিতে সেদিনের সন্ধ্যায় আলো জ্বলেছিল। নিজেদের মতো করেই শ্রমিকরা একটি স্ট্রেচার গোছের কাঠামো বানিয়ে নিলেন এবং তাতেই মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে মিছিল আরেকবার সামনে এগোল। না, শোকমিছিল নয়, এইবার স্লোগান উঠল ‘পুঁজিবাদ নিপাত যাক’, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ এবং ‘শ্রমিক ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক’। যারা ভাবেন মজদুর ইউনিয়ন আর কতটা কি করতে পারে তারা ঐ স্লোগানের বিষয়টি মনে রাখতে পারেন।
দ্বিতীয়টি আরও অভিনব। স্ট্রাইক চলাকালীন মহিলারাও একইরকম মেজাজ নিয়ে পিকেটিং, মিটিং ও মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন। শিল্পকারখানায় এমন ব্যাপার অন্তত বোম্বে’তে এর আগে কখনো ঘটেনি। প্রতিদিন নতুন নতুন লোক আসে, সারাদিনের শেষেও কেউই ফিরে যেতে চায় না। মজদুর ইউনিয়নের সে জোর কথায় যে এত মানুষের জন্য দুমুঠো খাবার জোটে? কিন্তু খাবার জুটেছিল, সহায়তা এসেছিল। একদিকে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার লিগ অফ ইন্ডিয়া, আরেকদিকে রাশিয়া বা বলা ভালো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই জোরেই পুরো এলাকায় চোদ্দটি ‘সেন্টার’ খোলা হল। এতদিন যখন শ্রমিকেরা, তাদের পরিবার কি খেয়ে বাঁচবে তার ঠিক ঠিকানা ছিল না, দেশীয় সংবাদমাধ্যমের বিরাট মাতব্বরেরা মুখে রা’টুকু কাড়েননি। এইবার তারাও ময়দানে নামলেন, শ্রমিকদের লড়াইতে রসদের যোগান এলে যে তারা বিশেষ দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হবেন এই তো স্বাভাবিক। আমরা যেন কোনোদিন ভুলে না যাই স্ট্রাইকের শেষদিন অবধি সেই সহায়তা জারী ছিল। কাগজওয়ালারা কি প্রচার করলেন? প্রথমে বলা হল এসব জঘন্য হাঙ্গামায় মস্কোর এজেন্ট এসে ঢুকছে। এতে চিঁড়ে ভিজছে না দেখে সেই একই লোককে এবার ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। উদ্দেশ্য এই যে ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট যখন সে তো চাইবেই দেশীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংস হয়ে যাক। বলাই বাহুল্য এসব কায়দা আজও আমাদের দেশে চলে। যারা সেসব চালায় তারা যে কাঁধে কাদের উত্তরাধিকার বইছে সেটুকু হয়ত নিজেরাও খেয়াল করে না।
তখন আমাদের দেশে নিষেধাজ্ঞার পরিস্থিতি, কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছে না। ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টির নামে কমিউনিস্টরা সেই বাধা পেরোতে লড়াই করে গেছেন। স্ট্রাইক শেষ হয়েছিল। ছয় মাসের জীবনপণ লড়াই’র পরে বম্বে’র স্টেট গভর্নমেন্ট হস্তক্ষেপ করে। মালিকদের সাথে ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনার শেষে এবং ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন স্কিম’ স্থগিত রাখার ঘোষণা হল। সরকার একটি কমিটি করে দেয় যারা শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে পর্যালোচনা করবে। এই অবধি পড়েই থেমে যাবেন না, ঠিক যেমন সেদিন শ্রমিক-মুজদুরেরা স্ট্রাইক তুলে নিতে রাজি হলেও ওখানে থেমে থাকেননি। তারা উপলব্ধি করেছিলেন এহেন সরকারী কমিটি আসলে মালিকদের বাড়তি সময় যোগাবে, নতুন অজুহাতে আবার তারা একই কাজ করবে। তবে আগের চাইতে এবারের লড়াই হবে অন্যরকম। কারণ এতদিন তারা আশংকায় থাকতেন কবে মালিকরা নতুন কায়দায় নিপীড়ন বাড়িয়ে চলে। এইবার সে লড়াইয়ের জন্য তারা মানসিক দিকে থেকে তৈরি রইলেন। উপলব্ধি করলেন পুঁজি বনাম শ্রমের দ্বন্দ্ব। এই উপলব্ধির জোরেই শ্রমিক আন্দোলন নতুন মাত্রায় পৌঁছে যায়, গেলও তাই। তাই ‘বোম্বে মিল স্ট্রাইক’ ঘটনামাত্র নয়, এক ঐতিহাসিক শিক্ষা।
এই গোটা পর্বের ইতিহাসকে নিজের চোখ, কান, হাত এমনকি দুপায়ের ভরসায় সাক্ষ্য করেছেন যারা, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলে ছিলেন তাদেরই অন্যতম। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ব্র্যাডলে’কে। রিপোর্টাজের ধাঁচে তার ধারাবাহিক লেখা থেকেই আমরা এই প্রতিবেদনের যাবতীয় উপাদান সংগ্রহ করেছি। এই প্রতিবেদনের ইংরেজি শিরোনামে কোটেশনের অন্তর্গত অংশটি বেন’রই নিজস্ব। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার নথিপত্র ঘাঁটলে এমন আরও অনেক জরুরী তথ্যের সন্ধান মেলে। বেঞ্জামিন ব্র্যাডলে যিনি বেন ব্র্যাডলে নামেই সুপরিচিত ছিলেন তাকে আজ হঠাৎ বিশেষভাবে উল্লেখের কারণ কি? কারণ একটাই। কমিউনিস্ট মূল্যবোধের আন্তর্জাতিকতা। যে ভারতবর্ষের যাবতীয় সম্পদ লুট করে, শোষণ করে ব্রিটেনের শ্রীবৃদ্ধি; নিজে ব্রিটিশ হয়েও সে দেশেরই মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষের অধিকারের পক্ষে, স্বাধীনতার লড়াইতে সক্রিয় অংশগ্রহণ- এমন ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও পৃথিবীর আর কোনও পার্টির, কোনও আন্দোলনের নেই।
দুনিয়া জুড়ে মানুষের মুক্তিআন্দোলনের ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখার সময় আমরা অনেকেই স্পেনের গৃহযুদ্ধে ক্রিস্টোফার কডওয়েল’দের অসামান্য লড়াই, ত্যাগ ও শেষে শহীদের মৃত্যুর প্রতি এক বিশেষ টান অনুভব করি। ক্রিস্টোফার’রা যেমন স্পেনের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তেমনই বেন ব্র্যাডলেরাও এদেশের লড়াইতে সরাসরি যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের হাতে নিপীড়ন, অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন। কডওয়েলদের স্মরণে রাখার সাথেই আমরা যেন এঁদেরও মনে রাখি। বোম্বে মিল স্ট্রাইকের সময় যাকে প্রথমে মস্কোর পরে ল্যাঙ্কাশায়ারের এজেন্ট বলে অপদস্থ করার চেষ্টা হয়েছিল ব্র্যাডলেই ছিলেন সেই লোক।।
আজ ৩০শে মে, সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন্স (সিআইটিইউ)’র প্রতিষ্ঠা দিবস, এবছর ৫৫তম। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের পাতা থেকে প্রতিবেদনের আকারে সংগ্রামী ঐতিহ্য, উত্তরাধিকারের যে এক টুকরো আমরা প্রকাশ করলাম তার একটিই উদ্দেশ্য। আজকের প্রজন্ম যেন মনে রাখে কোন কোন উত্তরাধিকার তাদের কাঁধে রয়েছে। সেসব কথা ভুলিয়ে দিতে প্রতিপক্ষের কৌশলগুলি আজও বেশ কিছুটা একইরকম রয়ে গেছে। সন-তারিখ ব্যাতিরেকে উপরের প্রতিবেদনটি পড়লে সম্ভবত অনেকেরই এখনকার পরিস্থিতির সাথে গুলিয়ে যেতে পারে।
তাই আজকের ভারতে নয়া শ্রম কোড ইত্যাদি করে মোদি’রা আসলে যা কিছু করতে চাইছেন সেসব উপলব্ধিতে দেশের শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গে সঞ্জাত না হলে চলে না।
ব্যবহৃত ছবির সুত্র – সোশ্যাল মিডিয়া