সুচেতনা চট্টোপাধ্যায়
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে কলকাতায় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের রেশ ছড়িয়ে পড়ার আগেই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আগাম প্রতিরোধের পন্থা অবলম্বন করে। সরকারি তৎপরতার মূল উৎস ছিল ভয়। নবগঠিত বলশেভিক শক্তির সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আপোষহীন অবস্থান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসকশ্রেণীকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু লন্ডন থেকে উপনিবেশ বিস্তারে গুরুত্ববাহী কলকাতায় এক প্রতিবিপ্লবী সুরক্ষা প্রাচীর গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয় জোর কদমে। কিভাবে বলশেভিক বিরোধী পদক্ষেপগুলির সূত্রপাত ঘটে? সেই সাথে কি করে যুক্ত হয় বলশেভিক জুজুর ভয়? ‘বলশেভিক ভীতি’-র পরিবর্তনশীল অবয়ব কিভাবে পুলিশী ব্যবস্থাকে নতুন এক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সজাগ করে তোলে? এই দিকগুলি আলোচনা করতে হলে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ওপর মহলের চিন্তাভাবনার গতি- প্রকৃতির দিকে নজর দিতে হবে।
বড়সাহেবদের দুশ্চিন্তা
লন্ডনে প্রথম বলশেভিকবাদ দমনের কথা অতি দ্রুত দুর্ভাবনা থেকে প্রয়োগে রূপান্তরিত হয়। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন, রাশিয়ায় বলশেভিক সরকার ক্ষমতায় আসার কিছু সপ্তাহ পরেই, বলশেভিকদের প্রতি ব্রিটেনের অবস্থান নির্ণয় করতে মন্ত্রীসভার মিটিং বসে। জার্মানীকে প্রেরিত বলশেভিক শাস্তি প্রস্তাবের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ হয়। বলশেভিকদের প্রতি সন্দিহান হলেও রণক্লান্ত ব্রিটিশ শাসকরা সেদিন স্বীকার করে নেন বলশেভিক সরকারের শান্তির উদ্দেশ্য ‘ন্যায়সঙ্গত’। পরদিন নববর্ষের গোড়াতেই এই মত বদলে যায়। বলশেভিক সরকার ব্রিটেনের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সূত্র ধরেই ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রপক্ষের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ সমবেতভাবে বলশেভিক রাশিয়াকে আক্রমণ করে। সৈন্য পাঠানোর পাশাপাশি রুশ ‘শ্বেত বাহিনী’কে লালফৌজের বিপক্ষে মোতায়েন করা হয়। প্রতিবিপ্লবী শক্তিজোটকে রণনীতিগত এবং আর্থিক সাহায্যের সিংহভাগ যোগান দেয় ব্রিটেন। ১৯১৯-২০ সালব্যাপী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে শ্বেতবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় লক্ষ্য করে ১৯২০ সাল থেকে শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে ব্রিটেন রাশিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে। ১৯২১ সালে ইঙ্গ-সোভিয়েত বাণিজ্যিক চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের উৎসাহে জিইয়ে রাখা রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।
‘বলশেভিক আতঙ্ক’
বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রাখতে যাঁরা বিশেষ আগ্রহী ছিলেন, তাঁরা অবশ্য শাস্তির বিরোধিতা করেন। উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে ব্রিটেনের রক্ষণশীল দল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বলশেভিক হানার সম্ভাবনাকে এক বিরাট সঙ্কট হিসেবে দেখেছিলেন। ব্রিটিশ উদারনৈতিক দল আরেকটু নরমসুরে একই কথা বলতেন। তাঁরা অবশ্য সরাসরি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। ব্রিটিশ শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে দুই দলের নেতারাই সাম্রাজ্য-জোড়া বলশেভিক-বিরোধী দমনমূলক পুলিশী ব্যবস্থার ওপর জোর দেন। জনপরিসরের নানা আলোচনায়, খবরের কাগজের পাতায়, জনসভার বক্তৃতায় বলশেভিকবাদকে এক ভয়াবহ সভ্যতাবিরোধী শক্তিরূপে হাজির করা হয়। এই প্রচারযুদ্ধে পুরোনো বর্ণবিদ্বেষী ধারণাগুলি নতুন বলশেভিকবিদ্বেষী পোশাকে ফিরে আসে। ইহুদি এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষের আন্তর্জাতিক বিস্তারের জন্য তাঁদের বলশেভিক তথা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদের অনুঘটক বলে দাবী করা শুরু হয়। সরকারি দলিলে সামাজিক ঘৃণার বর্ণবিদ্বেষী জোয়ারের সাথে মিশে যায় বলশেভিক জুজুর ভয়। সেই সাথে বলশেভিকবাদকে ১৯১৮ সালের বিশ্বব্যাপী ইনফ্লুয়েন্জা মহামারীর সাথে তুলনা করে একটি অতি সংক্রমক ব্যাধির আখ্যা দেওয়া হয়। প্রমাণ করার চেষ্টা চলতে থাকে সাম্রাজ্যের সুস্বাস্থ্য বলশেভিকরা ইদী ও মুসলিমদের মাধ্যমে এবং বহু অজানা ছদ্মবেশে ধ্বংস করতে উদ্যত; বলশেভিকবাদ জন-বিচ্ছিন্ন, সমাজ-বহির্ভূত বিভীষিকা; লেনিন হলেন প্রলয়ের মূর্তিমান অপদেবতা।
বিপ্লবের তার–Message
বলশেভিকদের এই ভাবমূর্তি যখন সাম্রাজ্য জুড়ে প্রচারিত হচ্ছে, ঔপনিবেশিক দুনিয়া বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাথে আস্তে আস্তে পরিচিত হচ্ছিল। কলকাতার ইউরোপীয় পুঁজিপতিদের মুখপত্র স্টেটস্ম্যান বলশেভিক-বিরোধী প্রচারে অগ্রগণ্য ভূমিকা নেয়। ১৯১৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর রবিবারের পত্রিকার পাতায় একটি ব্যঙ্গচিত্রে পেট্রোগ্রাড়ের বিপ্লবী কাণ্ডজ্ঞানহীন, বাস্তব-বিমুগ্ধ বক্তৃতা-বাজ হিসেবে উপস্থিত হন। আরেকটি বাগচিত্রে রাশিয়া এক গ্রাম্য, বুদ্ধিহীন সৈনিকের বেশে দেখা দেয়। সে একটা দড়ির ওপর দিয়ে টলায়মান অবস্থায় একনায়কতন্ত্র থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর। যদি একবার পা পিছলে যায়, নিচের হাঁ করা অতল নৈরাজ্যের যাতে নিমেষে তলিয়ে গিয়ে তার অপমৃত্যু ঘটবে নিঃসন্দেহে।
দিন ছয়েক বাদে রয়টারের টেলিগ্রাম মারফত বলশেভিক বিপ্লবের টুকরো খবর লন্ডন থেকে কলকাতায় পৌঁছোয়। স্টেটসম্যানের পূর্বতন হালকা তির্যক মেজাজ উবে যায়। কেরেনস্কি সরকারের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জল্পনা কাগজের পাতায় মলিন থেকে মলিনতর হতে থাকে। নভেম্বরের শেষে কেরেনস্কি ছাপা হরফের জঙ্গলে বিয়োগান্ত নাটকের ব্যর্থ নায়কের স্থান করে নেন।
গোয়েন্দা পুলিশের বিশেষ তদারকি
কলকাতায় ঔপনিবেশিক প্রভু, বিশেষত শ্বেত সম্প্রদায়ের বিরূপ মনোভাব লক্ষ্য করে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের একাংশ বলশেভিকদের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রবণতা সংগঠিত চেহারা নেয়নি। কিন্তু যে কোনো উৎসাহের চিহ্ন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চোখে হয়ে ওঠে বলশেভিকবাদ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাব্য ইঙ্গিত। ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন, ভারতে খিলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণ অসন্তোষের আকার নেয়। ১৯২০ সালে শ্রমজীবী-অধ্যুষিত কলকাতা শহরতলীর এক মিটিং-এ বলশেভিকদের প্রতি সম্প্রীতি ও সমর্থনের মনোভাব কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এক উত্তর ভারতীয় হিন্দু বক্তা উপস্থিত মুসলিম মঞ্জুরদের বলশেভিকবাদকে স্বাগত জানাতে উৎসাহিত করেন। পুলিশ সভয়ে লক্ষ্য করে শ্রমিকরা এই সভায় লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা জোর গলায় বলছে গোয়েন্দা বিভাগের চরদের চিনতে পারলেই পেটানো হবে। এই আচরণের নেপথ্যে অদৃশ্য বলশেভিকদের করাল ছায়া অনুধাবন করে কর্তারা মুষড়ে পড়েন। আগে নাকি কখনো শ্রমিকরা এ ধরনের উগ্র আচরণ করেনি।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র অবশ্য এরকম কিছু ঘটতে পারে এই আন্দাজে ততদিনে নানা প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির অনতিকাল পরেই কলকাতায় অবস্থিত পুলিশের দুই প্রধান দপ্তর—কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং বাংলার প্রাদেশিক পুলিশের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এর কর্তাব্যক্তিরা বলশেভিক বিভীষিকা সম্বন্ধে নানা সতর্কবাণী লাভ করে সজাগ হয়ে ওঠেন। লন্ডন থেকে নয়া দিল্লী এবং সিমলার পথ দিয়ে এখানকার প্রধান সচিব এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তর একাধিক নির্দেশনামা পান। ১৯১২ সালে কলকাতা নয়া দিল্লীর কাছে রাজধানীর গুরুত্ব হারিয়ে ছিল। তবু এই শহরের পুলিশ-প্রশাসনের সাম্রাজ্য- রক্ষার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা শিল্পীর বড়কর্তারা সমীহ করতেন। যে কোনো বিরোধী শক্তির উত্থান লক্ষ্য করলেই কলকাতার মত নেওয়া হতো। ১৯১৮ থেকে ১৯২১ সালের বলশেভিকবাদ নিবারণের পদক্ষেপসমূহ দিল্লী আর কলকাতার মিলিত প্রচেষ্টায় চূড়ান্ত চেহারা নেয়। ১৯১৮ সালে কলকাতায় অবস্থিত শ্বেত রুশ দূতাবাসের কূটনীতিক নবোকভ ভারতের ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটি ‘বলশেভিক ব্লু বুক’-এর সন্ধান দেন। নবোকভ দাবী করেন এই নীল পুস্তকে ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিষয়ে নানা বিরূপ রিপোর্টের সমাহার ঘটানো হয়েছে। এই সহায়তার প্রতিদানে নবোকভ হয়তো ভেবেছিলেন ব্রিটিশ রাজপুরুষদের বদান্যতায় তাঁর সামান্য চাকরীটি রক্ষা পাবে। কিন্তু গৃহযুদ্ধে শ্বেত বাহিনীর হারের পরিণতি হিসেবে কলকাতার রুশ দূতাবাস অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯১৯ সালের শেষে দিল্লী, সিমলা আর কলকাতার পুলিশকর্তাদের যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে বলশেভিকদের ঠেকানোর জোরালো চেষ্টা শুরু হয়। বন্দর-নগরী এবং ঘন শ্রমিক বসতি হিসেবে কলকাতা বলশেভিক চরদের আকৃষ্ট করতে পারে—এই সম্ভাবনা তাঁদের উদ্বেগের কারণ ছিল। স্থানীয় প্রশাসককূল অবশ্য জানতেন যে শ্রমিকরা সংঘবন্ধ হয়ে উঠলে তবেই বলশেভিকবাদ বা বামপন্থী রাজনীতির আগমন ঘটবে। কিন্তু দিল্লীর কর্তারা এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়া অব্দি অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। ‘বলশেভিক চরদের খুঁজে বার করতে তারা অতিমাত্রায় উতলা হয়ে পড়েন। দিল্লী থেকে জানানো হয় প্রতি মাসে ‘বলশেভিক’ সম্ভবনাপূর্ণ ঘটনা এবং সন্দেহজনক ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত করে তথ্যপূর্ণ বুলেটিন পাঠাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রস্তাব দেওয়া হয় দু’জন ‘অ্যান্টি-বলশেভিক অফিসর’ নিযুক্ত করার। কলকাতার প্রশাসকরা দ্বিমত হন। তাঁরা মনে করেছিলেন অদৃশ্য কোনো শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। তাঁরা সাধারণ পুলিশী ব্যবস্থাকে আরো সজাগ করে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতার সাথে দিল্লীর রফা হয়। দুজন প্রাদেশিক ইনস্পেক্টরকে বাংলায় ‘বলশেভিক গার্ড’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়। তাঁদের দায়িত্ব ছিল বিশেষ বুলেটিন তৈরি করে সিমলার কেন্দ্রীয় অ্যান্টি বলশেভিক অফিসারের হাতে নিয়মিত পাঠিয়ে দেওয়া। ১৯২০ সাল জুড়ে বলশেভিকদের বিষয়ে নানা আজগুবি রিপোর্ট ভারতের গোয়েন্দা- পুলিশ রচনা করে চলেছিল। কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যয়-সংকোচনের প্রকোপে এই কর্মনিপুণতায় ভাঁটা আসে। সেই সাথে ১৯২১ সালের ইঙ্গ-রুশ চুক্তির প্রভাবে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের বাতাবরণ মিলিয়ে যায়। তাই কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পদগুলি অবলুপ্ত হয়। কিন্তু রুশ গৃহযুদ্ধ চলার সময়কার বিশেষ ব্যবস্থার হাত ধরেই কমিউনিস্ট দমন প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নেয়। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সাম্যবাদ একটি রাজনৈতিক প্রকাতা হিসেবে জন্ম নেবার আগেই কমিউনিস্টদের নিশ্চিহ্ন করার সাজসজ্জা তৈরি করে রেখেছিলেন। বহিরাগত বিভীষিকার তকমা এঁটে সাম্যবাদী রাজনীতিকে অপরাধী কার্যকলাপের সমার্থক করতে তাঁরা ১৯১৭ সালের পর থেকে সচেতনভাবে উদ্যোগী ছিলেন।
কলকাতায় বলশেভিক জুজুর ভয়
১৯১৯-২০ সাল নাগাদ কলকাতা শহর এবং আশেপাশের শ্রমিক অঞ্চলগুলিতে বলশেভিক প্রভাবের কোনো ক্ষীণ আভাস খুঁজে বেড়াতে গিয়ে পুলিশের গোয়েন্দারা বাস্তব এবং কল্পনার আশ্রয় নেন। বিশেষত বর্ণ, ধর্ম এবং লিঙ্গ তাঁদের কাছে ছিল বলশেভিক হওয়ার সূচক। প্রান্তিক আর অচেনা হলেই তাঁরা নড়েচড়ে উঠতেন। রুশ নাবিকদের বলশেভিকবাদের শ্রমজীবী সমর্থক ভেবে কয়েদ করা হয়। বাঙালি মুসলমান নাবিকরা এই সংক্রামক ব্যাধির ধারক সন্দেহে জেরার মুখে পড়েন। ১৯২০ সালে ‘বলশেভিক চর’ সন্দেহে নানা বর্ণময় টুকরো খবর দিয়ে ফাইল ভরিয়ে ফেলা হয়। মাদাম দাসের কলকাতা ভ্রমণ পুলিশের দৃষ্টিগোচরে আসে। এই ইউরেশিয় মহিলা জাতীয়তাবাদী ও খিলাফতপন্থী নেতাদের সাথে দেখা করেন। যদিও শহরের রক্ষণশীল নেতারা তাঁর ধূমপানের অভ্যেস ভালো চোখে দেখেননি, মাদাম দাসকে পুলিশের খাতায় প্রায় মাদাম বোভারী, আনা কারেনিনা আর মাতা হারির সমগোত্রীয় হিসেবেই ফুটিয়ে তোলা হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদের কাহিনী, ‘সৌন্দর্য’, ‘ছটফটে মন’ লক্ষ্য করে তার মূর্ত বলশেভিক গুপ্তচর হবার অসীম সম্ভাবনা পুলিশের গোয়েন্দারা সহজেই অনুমান করে নেন। মাদাম দাস অবশ্য বেশিদিন কলকাতায় থাকেননি। কিছুদিন বাদেই তার জায়গা নেন আরো অনেকে। হারি ডুরকি, এক ইহুদী মার্কিনী নাগরিক কলকাতা ডকে পৌঁছোবার পর তাঁকে বলশেভিক চর বলে ধরে নেওয়া হয়। মার্কিনী মেঘভিস্ট বিশপ কিশার-ও পুলিশের সন্দেহভাজন হন। ডুরকি আবার জাহাজঘাটা থেকে অন্যত্র পাড়ি দেন। বিশপ ফিশার অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলে তাকে অনুসরণ করা বন্ধ হয়। এক চৈনিক নৈরাজ্যবাদী বলশেভিক বিদ্যকের অপেক্ষায় গোয়েন্দারা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি নাকি এসেই চীনে পাড়ায় বলশেভিক অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম শুরু করে নিতেন। কিন্তু দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শহরগুলি থেকে তাঁর কলকাতায় পৌঁছোবার কোনো খবর মেলেনি। শহরের চৌরঙ্গী এলাকায় ইহুদী মালিকানাধীন ঝলমলে ইউরোপীয় গয়নার দোকানগুলি এইসময় পুলিশী নজরদারীর শিকার হয়। পুলিশ ধরে নেয় ইহুদী বলশেভিক কোনো চর রুশ রাজপরিবারের অলঙ্কার বাজারে বিক্রি করবার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ বাংলায় বলশেভিক অন্তর্ঘাতের জনক হিসেবে লেনিনকে অভিযুক্ত করে দাবী করেন তিনি নাকি নকল টাকা ছাপিয়ে এই অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতি ধসিয়ে দেবার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তবে জনসমক্ষে এই ধরনের সরকারি প্রচার বিশেষ সাড়া ফেলেনি। বিশ্বযুদ্ধের ব্যয়ের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায় সরকারকে আর্থিক তাড়নায় জর্জরিত জনতার বিশাল অংশ ঘৃণার চোখেই দেখতেন।
পুলিশী তৎপরতার জের
যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ‘বলশেভিক আতঙ্ক’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসকদের গ্রাস করেছিল। তলা থেকে কোনো অজানা বিপর্যয় বিপ্লবের আকারে ব্রিটেন এবং অন্যান্য পুঁজির সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রশক্তিকে খান খান করে দিতে পারে—এই আশঙ্কায় বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী কন্টকিত হন। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে তাদের উৎসাহে বলশেভিকবাদ প্রতিহত করবার সাম্রাজ্য-বিস্তৃত বেড়াজাল সৃষ্টি হয়। এত তৎপরতা সত্ত্বেও লন্ডন বা কলকাতায় কোনো বলশেভিক ষড়যন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু এইভাবেই সাম্যবাদকে পরাস্ত করার দমনমূলক পুলিশী ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছিল। ১৯২২ সালে মুজফ্ফর আহমদের প্রচেষ্টায় কলকাতায় যখন একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বামপন্থী পরিসর জন্ম নেয়, তখন পুলিশ এবং রাষ্ট্র প্রস্তুত ছিল।
১৯২০ সালে কলকাতায় কোনো বলশেভিকের অস্তিত্ব ছিল না। তখনও কেউ নিজেকে সাম্যবাদী বলে পরিচয় দিতেন না। এই প্রবণতা ১৯২১ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাবে বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে আকৃষ্ট করে। পুলিশ তাই ১৯২০ সালে, বিশেষ ব্যবস্থা’ যখন তুঙ্গে, তেমন কাউকেই খুঁজে বার করতে না পেরে যাকে তাকে ‘বলশেভিক চর’ সন্দেহে অনুসরণ করা শুরু করেছিল। জন-বিচ্ছিন্নতার কারণে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সামাজিক পরিসরে বলশেভিক জুজুর ভয় চেষ্টা করেও তেমন ছড়িয়ে দিতে পারেনি। ১৯২০ সালে মৌলানা আক্রম খান সম্পাদিত মোহাম্মদী পত্রিকায় সরকারের বলশেভিক আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্যোগ কড়া ভাষায় সমালোচিত হয়। মোহাম্মদী-র পাতায় সমকালীন শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থনে বলা হয় কোনো কাল্পনিক বলশেভিক চর শ্রমিকদের ধর্মঘট সংগঠিত করেনি। ক্ষুধা এবং শোষণ শ্রমিকদের সচেতন করে তুলেছে। তাঁরা বলশেভিকদের মতোই লড়ছেন পুঁজির অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
প্রাসঙ্গিক সুত্র :
১। বাংলার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের নথি
২। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নথি
৩। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট অফিসের নথি
৪। দ্য স্টেটস ম্যান (ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা)
২০১৭ সালে কোরক সাহিত্য পত্রিকার শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত