Blood In The Abyss: An Introspect

তপারতি গঙ্গোপাধ্যায়

ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে ছোট হাতটি বেরিয়ে আছে। শরীর থেঁতলে গেছে কংক্রিটের জঙ্গলে। মৃত সন্তানের আঙ্গুলগুলি শক্ত করে ধরে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন বাবা। দেহ উদ্ধারের অপেক্ষায়।

ভূমিকম্পে বৃহত্তর পরিবারের ২৫ জন সদস্যকে হারিয়েছেন। সারি সারি মৃত প্রিয়জনদের দেহের পাশে স্তব্ধ নাগরিক।

স্ত্রী পুত্র কন্যার মৃতদেহের পাশে ৪৮ ঘণ্টা শুয়ে আছেন। একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। একটি পায়ের রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে নীল। তিনি চাননা তাকে উদ্ধার করা হোক। এরপর আর জীবনের কী অর্থ থাকে?

ওদিকে আর এক ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছে তীক্ষ্ণ গোঙানি আর কান্না! এক স্থানীয় মানুষের চিৎকার, দুহাতে তুলে ধরেছেন এক সদ্যোজাতকে, যার নাড়ি তখনও জুড়ে আছে মৃত মায়ের সাথে। জীবনের সব অর্থই যার অজানা!

যেকোনো অ্যাপোক্যালিপ্স এই বৈপরীত্যের সন্ধান দেয়। এটাই সম্ভবত ভারসাম্য, নিত্যতা সূত্র। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তার ব্যতিক্রম না। কিন্তু তুরস্ক এবং সিরিয়ার মানুষের প্রতি সারা পৃথিবীর যে বৈষম্যমূলক অবস্থান, সেটা আমাদের সভ্যতার অ্যাপোক্যালিপ্স।

কাহ্রামানমারাশ, তুরস্কের দক্ষিণ পূর্ব সীমায় সিরিয়া বর্ডার এর কাছের এই প্রাচীন শহর অ্যাসিরিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক। অনেক ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করছে। কাহ্রামানমারাশ প্রদেশের দক্ষিণে তুরস্ক সিরিয়া বর্ডারের কাছে গাজিয়ানটেপ এ স্থানীয় সময় ভোর ৪:১৫ মিনিটে রিখটার স্কেল ৭.৮ এর প্রথম এবং প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে মধ্য তুরস্কের কাছে একিনোজু তে দুপুর ১:৩০ মিনিটে রিখটার স্কেল ৭.৭ এর দ্বিতীয় ভূমিকম্পের এপিসেন্টার তৈরি হয়েছিল গত ৬ ফেব্রুয়ারি। গত একশো বছরের সবথেকে শক্তিশালী ভূমিকম্প। পূর্ব অ্যানাতোলিয়ান ফল্ট বরাবর অ্যারাবিয়ান আর অ্যানাতোলিয়ান প্লেট এর সংঘর্ষে তৈরি এই দুটি কম্পনের পরে অন্তত কুড়িটি আফ্টারশক এসেছে। তুরস্কের হ্যাতে, আদিয়ামান, ওসমানিয়ে, মালাতিয়া সহ বিভিন্ন শহরের প্রায় ৬৫০০ টি বাড়ি এবং সিরিয়ার ঐতিহাসিক আলেপ্পোর প্রায় ১৬০০ টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। আরো দুই প্রাচীন শহর আন্তাকিয়া এবং সানলিয়ুর্ফাও ধ্বংস হয়ে গেছে।

“আমাদের আওয়াজ কি শুনতে পাচ্ছ? তাহলে সাড়া দাও।” গত দশদিনের সবথেকে পরিচিত স্লোগান গর্জনের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে সিরিয়ার আকাশে বাতাসে। প্রতিটি ধ্বংসস্তূপের সামনে নিঃশব্দে বসে আছেন উদ্ধারকর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। একটি পিন পড়লেও শব্দ পাওয়া যাবে। এটা সবথেকে পরিচিত দৃশ্য। কেন? কারণ আধুনিক সেইসমিক্ লাইফ ডিটেক্টর, সার্চ ক্যামেরা নেই। মোবাইল ভরসা। ফলে স্তূপের কয়েকফুট নীচ থেকে ভেসে আসা আওয়াজ শোনার জন্য স্তব্ধতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আজ দশদিন কেটে গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। মাইলের পর মাইল গণকবর খুঁড়ে তাতে কাঠের পাতলা অস্থায়ী ফলক পোঁতা হয়েছে। সদ্য পরিবার হারানো মানুষেরা নিজের ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া আশ্রয়ের পাশে ফিরে আসছেন, জড়ের মত বসে আছেন। অনেকে এখনও মাটিতে কান পেতে আছেন, অনেকে পাগলের মত পাথর ঠুকে চলেছেন, যদি চাপা পড়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে শব্দ পৌঁছায়। কিন্তু আর কোনো সাড়া আসছে না।

দুই দেশে এই মুহূর্তে মোট মৃতের সংখ্যার হিসেব ৪৫ হাজার ছুঁয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে এখনও অগণিত মানুষ। ১২ টি প্রদেশের ২ কোটির বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ১০ হাজারের বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তুরস্কে। সিরিয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিভিন্ন দেশের সেরা এবং অভিজ্ঞ টিমগুলি এসে পৌঁছেছে তুরস্কে। যাঁরা মূলত গভীর খনি, পাহাড়ী অভিযান, ওয়াটার টানেল এর মধ্যে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তুরস্কে পৌঁছে তাঁরাও দিশাহীন। এই ধ্বংসচিত্র তাঁরা কখনো দেখেননি আগে। কোথা থেকে শুরু করবেন বুঝতে পারছিলেন না। উদ্ধারকর্মীরা নিজেরাও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। দমবন্ধ করা ছোট ছোট খোপের ভিতরে মৃত বাবা মায়ের কোলের মধ্যে বেঁচে আছে দুধের শিশু। তাদের উদ্ধার করার পরে জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কাঁদছেন তাঁরা। গালে চুমু খেয়ে, অতি যত্নে ধুলোমাখা অবিন্যস্ত চুল সরিয়ে তুলে দিচ্ছেন মেডিক্যাল টিম এর হাতে। এই বাৎসল্যের কোনো দেশ নেই, কোনো কাঁটাতার নেই। হাঙ্গেরি, চীনের এলিট রেসকিউ টিম লাইফ ডিটেক্টর এর সাহায্যে অসংখ্য মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করছে। ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড এর সার্চ ডগ এলাকা ছেনে ফেলছে। কোথাও আবার ভূমিকম্পের শিকার হওয়া মানুষদের পোষ্য কুকুরগুলিও তাদের পথ দেখাচ্ছে। কখনো ধ্বংসস্তূপের চিলতে ফোকর থেকে হাত দেখা যাচ্ছে, বা সাহায্যের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্লান্তি ভুলে দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মিলিটারি টিম। ভূমিকম্পের ১০০, ১৫০, ২০০ ঘণ্টা পরেও মানুষকে উদ্ধার করা হচ্ছে। জল এবং অক্সিজেন এর অভাবে অনেকের হার্ট কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন এবং সি পি আর চলছে। অনেককে রাবল কেটে সঙ্গে সঙ্গে বের করে আনা যাচ্ছে না। তাদের ওই অবস্থাতেই স্যালাইন চালু করা হচ্ছে। পাঁচশোর বেশি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে আজ অবধি। যাদের মধ্যে তিনশোর বেশি শিশুর কোনো পরিচয় নেই। তাদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। তাদের নাম, ঠিকানা জানার কোনো উপায় নেই। এর সাথে সবথেকে বেশি করে দেখা দিচ্ছে প্যানিক অ্যাটাক। ক্লস্ট্রোফোবিয়া। ফুসফুস, হার্ট, কিডনির স্থায়ী ক্ষতি। তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে মানুষদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই পথের ধারে অসংখ্য সংস্থা মানুষদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ত্রাণের খাবার, পানীয়। স্থানীয় মানুষ আর উদ্ধারকর্মীরা সেই খাবার ভাগ করে নিচ্ছেন। লেনন যেমন গাইতেন,

“Imagine all the people

Sharing all the world”

কিন্তু সত্যিই কি এই মানবিকতা সর্বব্যাপী? কারণ সিরিয়ার চিত্র কিন্তু একদম অন্য কথা বলছে! ভূমিকম্পের পর থেকে আজ অবধি একটিও আন্তর্জাতিক কার্গো বিমান সিরিয়ার মাটি স্পর্শ করেনি। স্থানীয় মানুষদের অক্লান্ত চেষ্টায় উদ্ধারকাজ চলছে। একই পরিস্থিতে যেখানে তুরস্কের হাজার হাজার মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে, সিরিয়ায় সেখানে শয়ে শয়ে মানুষ মরছেন। এখনও অবধি মৃত্যুর হিসেব ৬০০০। তাহলে মানবাধিকার তুরস্ক এবং সিরিয়ার জন্য আলাদা কেন? উত্তর হলো অ্যামেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ক্রিমিনাল জিওপলিটিক্যাল পলিসি। ২০০৪-০৫ সালে বুশ এর আমল থেকে সিরিয়ার উপর বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ, আমদানি সংক্রান্ত স্যাঙ্কশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে অ্যামেরিকা। তার সাথে লাগাতার সিআইএ, ন্যাটোর আক্রমণ, প্রাকৃতিক সম্পদে অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট তৈরি এর মূল উদ্দেশ্য।

মধ্যপ্রাচ্যে স্যাঙ্কশনের নামে অ্যামেরিকার পরিকল্পিত হত্যা শুরু সেই কোল্ড ওয়ার এর সময় থেকে। উদ্দেশ্য কি? সেসব দেশের সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যাতে তাদের রাগ গিয়ে পড়ে সরকারের উপর। এই সুযোগে সেসব দেশের কিছু জিহাদী গ্রুপকে ফান্ড করে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে পরোক্ষভাবে পরিচালিত করে সি আই এ এবং ন্যাটো। এই মিলিত প্রচেষ্টায় সেদেশের সরকার উৎখাত হয়। তারপর সেসব দেশে অ্যামেরিকার পছন্দের শাসন চালু করা যায়। উদাহরণ, সাদ্দাম হুসেইন এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফি।

১৯৯৩ এর আশেপাশে যখন অ্যামেরিকা সার্বিয়ার মিলোসেভিচ জমানায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, সেই সময়ের একটি সিআইএ ডকুমেন্টে বলা হচ্ছে, “our sanction is yet to impose sufficient hardship on local consumers needed to spark a groundswell in anti-regime sentiments in Serbia.”

ইরাকের প্রায় পাঁচ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই স্যাঙ্কশনের কারণে। লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান সবাই এর শিকার। অ্যামেরিকার তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেমস জেফ্রিকে যখন সিরিয়ার মিশনের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি বলেন, “My mission is to make Syria a quagmire for Russia, not to fight terrorism.” জেফ্রি আরো বলেন, “don’t try to turn Syria into Denmark. Stalemate is stability.”

ঠিক সেভাবেই সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ কে উৎখাত করার জন্য ২০১১ সালে সিআইএ র মিলিটারি অপারেশন টিম্বার সিকামোর শুরু হয়। তাতে অ্যামেরিকার অবিশ্বাস্য অর্থক্ষয় হয়েছিল। কিন্তু ইরান এবং রাশিয়ার সাহায্যে সিরিয়া এই যুদ্ধ জিতে যায়। ফলে লিবিয়া এবং ইরাকের ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা যেটা করতে পেরেছিল, সিরিয়া সেটা হতে দেয়নি। অর্গানাইজেশন ফর দ্যা প্রহিবিশন অফ্ কেমিক্যাল ওয়েপনস্ (OPCW) আসলে একটি কভার আপ যার মাধ্যমে অসংখ্য প্রোপাগান্ডা তৈরি হয় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৩ গৌটা কেমিক্যাল অ্যাটাক, ২০১৮ ডুমা গ্যাস অ্যাটাক ইত্যাদি। এগুলি মিথ্যে প্রমাণিত হয়। এছাড়া এডওয়ার্ড স্নোডেন এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর জুড়ে সিরিয়ার ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ করেছিল অ্যামেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির হ্যাকিং টিম, আসাদ নন। এই ধারাবাহিক পরাজয়ের প্রতিহিংসায় ২০১৭ থেকে ট্রাম্প সরকার সিরিয়ার উপর আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা Ceaser Act চালু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এনার্জি সেক্টর সহ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর উপর। কোনো টেকনিক্যাল, হিউম্যানিটেরিয়ান এইড পায় না সিরিয়া। বাড়ি তৈরি, জলের পাইপ সারানো, রাস্তা মেরামত, বিদ্যুৎ সরবরাহ, চিকিৎসা পরিকাঠামো, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কিচ্ছু না। সিরিয়ার অর্ধেকের বেশি তেল এবং গ্যাস অ্যামেরিকার দখলে। এছাড়া সারা সিরিয়া এবং বর্ডার জুড়ে অ্যামেরিকার মিলিটারি পোস্ট বসানো। ফলে পাশের দেশগুলির সাথে কোনো বাণিজ্য করতে পারে না সিরিয়া। অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্ত। ২০১৭ থেকে ২০১৮, মাত্র এক বছরে ইনফ্লেশন এর হার অবিশ্বাস্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রায় ৮০০ গুন বেড়েছে! সিরিয়ার পাসপোর্ট পৃথিবীর কোথাও গ্রাহ্য হয় না। ফলে সিরিয়া থেকে বেরিয়ে যাবার পথও বন্ধ। এভাবেই আবদ্ধ জলাভূমির মত তিলে তিলে একটা সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

একটা আপাদমস্তক রেসিস্ট আর ইসলামোফোবিক দেশ অ্যামেরিকা। ৬ তারিখের ভূমিকম্পের পরে ১০ তারিখ অবধি চারদিন, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা অ্যামেরিকা চোখ বুজে ছিল। তুরস্কে সারা পৃথিবীর ত্রাণ যাচ্ছে, কিন্তু সিরিয়ার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। এর মধ্যেই কিছু দেশ, যেমন ইরান, রাশিয়া, ফ্রান্স, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, পাকিস্তান, চীন অ্যামেরিকার স্যাঙ্কশন অগ্রাহ্য করে সিরিয়াকে সাহায্য পাঠায়। কুর্দিরা সাহায্য করে। সিরিয়ার রাষ্ট্রদূতদের আবেদনে, অসংখ্য মিডিয়ার লেখালেখিতে, বিভিন্ন এনজিও র চিৎকারে শুধুমাত্র নিজের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য অ্যামেরিকা মাত্র ছয় মাসের জন্য স্যাঙ্কশন তুলে নেবার অর্ডার ইস্যু করে ১০ তারিখ। শুধু খাতায় কলমেই ইস্যু করেছে, কার্যত সিরিয়াতে কোনো হিউম্যানিটেরিয়ান এইড ঢুকছে না। মানে খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, টেন্ট ইত্যাদি। কারণ বর্ডারে অ্যামেরিকার পোষা জিহাদী গ্রুপগুলো বাধা দিচ্ছে। রাশিয়ার হস্তক্ষেপে উত্তরের একটি বর্ডার খুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। তুরস্ক স্টেট কন্ট্রোলড বলে তার ক্ষেত্রে ত্রাণের কোনো সমস্যাই নেই, কিন্তু সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ যখন বর্ডারের উপর নিয়ন্ত্রণ চাইছেন, তাকে দোষারোপ করছে অ্যামেরিকা। এছাড়াও যারা এইসময় সিরিয়াকে সাহায্য করবে, অ্যামেরিকা পরে তাদের উপরে স্যাঙ্কশন চাপাতে পারে, এই ভয়টা কাজ করছে অনেক দেশে। সুতরাং ১০ তারিখের নোটিশ ইস্যুর পরেও ছয়দিন কেটে গেছে। এখনও অবধি সিরিয়া আদৌ কোনরকম সাহায্য পায়নি। দশ দিন হয়ে গেল, একটা কংক্রিট কাটার মেশিন আসেনি সিরিয়ায়। স্বেচ্ছাসেবকরা বড়ো গামলা, বালতি করে হাতে হাতে পাথর তুলছেন। ফলে উদ্ধারকাজ খুব ধীরে হচ্ছে। অনেক জায়গা থেকে উদ্ধারকারীরা হতাশ হয়ে ফিরেও গেছেন। হাজার হাজার মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাচ্ছে। খাবার, পানীয়, অক্সিজেন, মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট সব প্রায় শেষ। হাসপাতালের ডাক্তাররা দিশাহারা। এই ভূমিকম্পে সিরিয়ার ত্রাণ বা উদ্ধারকাজের তেমন কোনো ছবি ভিডিও নেই। হোয়াইট হেলমেট নামক একটি সংস্থা কাজ করছে শুধু, যারা আসলে অ্যামেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফান্ডেড একটি রেবেল গ্রুপ বলে পরিচিত। যেহেতু রিকনস্ট্রাকশন এর জন্য কোনো কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে না সিরিয়া, এই দুর্দিনে মাইনাস পাঁচ ডিগ্রিতে, এই তুষারপাতে, খোলা আকাশের নীচে কতদিন থাকবেন সাধারণ মানুষ? অ্যামেরিকার নিন্দা করে রাষ্ট্রপুঞ্জে কড়া বিবৃতি দেওয়া হয়েছে ৪৮ ঘণ্টা আগেও। সিরিয়ার সাংবাদিকরা, আইরিশ ক্যাবিনেট সদস্যরা কড়া বিবৃতি দিয়েছেন।

অথচ গত বারো বছর ধরে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্ক থেকে ইদলিব এর পথে একাধিক বর্ডার পেরিয়ে ইসলামিক জিহাদীদের লাগাতার অস্ত্র সরবরাহ করেছে অ্যামেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কিন্তু গত দশদিন ঠিক সেই পথেই ত্রাণ পাঠানোর ক্ষেত্রে এত অসুবিধা কেন? সিরিয়ার উপর ফাইন্যান্সিয়াল স্যাঙ্কশনও আছে। ইউএস ফান্ডেড সংস্থাগুলি ডোনেশন পাচ্ছে। সাধারণ মানুষদের জন্য অনলাইনে কোনো অর্থ পাঠানো যাচ্ছে না, প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এখনও, এই মুহূর্তেও স্যাঙ্কশন তুলে নেওয়ার আবেদন আসছে। আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট অফিস এবং ইউনাইটেড নেশনস সিরিয়ায় ডিরেক্ট হেল্পলাইন চালু করতে বলেছে। যদিও তারাও দায়ী। গতবছর ইউএন-এর বরাদ্দের মাত্র ৪৭ শতাংশ ত্রাণ পৌঁছেছে সিরিয়ায়। এই ভূমিকম্পে সিরিয়ার ৯০ লক্ষর বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ। সিরিয়ার জন্য ৩৯৭ মিলিয়ন ডলারের হিউম্যানিটেরিয়ান গ্রান্ট চেয়েছে ইউএন। বস্তুত, এই ভূমিকম্প অ্যামেরিকার যুদ্ধের, বোমাবর্ষণের খরচ অনেকটা কমিয়ে দিল।

সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাকের দিকে তাকালে মনে হয় মৃত্যু যেন কত সহজ। কোনো প্রতিসারক মাধ্যমে যেমন আলোর গতিপথ বদলায়, এই অগণিত মৃত্যুর মধ্যে আমাদের চেতনার গতিপথ, গভীরতা বদলে যায় না? সিরিয়ার থেকে মায়ানমার কোথায় আলাদা? ১৯ বছরের ভিয়েতনাম, ৮ বছরের ইয়েমেন অথবা এই ১২ বছরের সিরিয়া মধ্যে কোন্ স্ট্র্যাটিফিকেশন কাজ করে? আদৌ করে কি? শীতল যুদ্ধ কোনোদিনও শেষ হয়নি। সিভিল ওয়ার এর নামে পশ্চিমী একনায়কতন্ত্রের উল্লাস চলছে। স্বাধীন চেতনা, বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের বহনক্ষমতাকে মাঝে মাঝেই চ্যালেঞ্জ জানায়। আমাদের সামাজিক চরিত্রগঠন করে শিক্ষা ও তার সঠিক প্রয়োগ। সেটা পুঁথিগত শিক্ষা নয়। আমাদের চিন্তার প্রতিফলন। সুবিধাবাদী নিরাপত্তা আমাদের বিচ্ছিন্ন খোলসে মুড়ে রাখে। আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ড আমাদের সামনে শুধু উদাহরণ, শিক্ষা নয়। কিন্তু আপেক্ষিকতাবাদ পরবর্তী পৃথিবীর আরো উন্নত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রয়োজন অপ্রয়োজনের বিভাজন, আবেগ, যুক্তি ও বিবেচনার সঠিক সংযোগ, কলমের প্রতি আস্থা আর নিঃশর্ত ভালোবাসার লড়াই আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ১৮৩৫ সালের চিলির ভূমিকম্পে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে চার্লস ডারউইন লিখেছিলেন,

“A bad earthquake at once destroys the oldest associations; the world, the very emblem of all that is solid, moves beneath our feet like a crust over a fluid; one second of time conveys to the mind a strange idea of insecurity, which hours of reflection would never create.”

প্রতিটি শব্দ আমাদের বৃহত্তর জীবনের, সভ্যতার, বিবর্তনের অমোঘ অর্থবহ রূপক। 

Spread the word

Leave a Reply