ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
৩ জুলাই,২০২০- বৃহস্পতিবার
আজ থেকে শুরু হয়েছে দেশজুড়ে কয়লাশিল্পে শ্রমিকদের ধর্মঘট। এই ধর্মঘট চলবে আগামী তিনদিন ধরে।
দেশের কয়লাক্ষেত্রকে পুনরায় ব্যাক্তিগত মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। অজুহাত দেখানো হচ্ছে লকডাউন পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে এই ছাড়া নাকি উপায় নেই। একদিকে বিজেপি সরকারের মিথ্যা অজুহাত আরেকদিকে দেশজূড়ে শ্রমিকদের “চট্টানি” ঐক্য। আজকের ভারতে এই দুইয়ের লড়াই দেখবে গোটা দেশ, দুনিয়া।
১৯৭২ এবং ৭৩ সালে দুদফায় দেশের কয়লাখনিগুলীর জাতীয়করণ করা হয়েছিল। ২০১৪ সালে দেশের ক্ষমতায় এসেই বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী দেশের সম্পদ বিক্রির খেলায় নামে। ২০১৫ সালে তৈরি করা হয় কোল মাইনস (স্পেশাল প্রভিশন) অ্যাক্ট। এই আইনের দ্বারা জাতীয়করণের আইনকে এড়িয়ে দেশের সম্পদ দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার রাস্তা খুলে দেওয়া হয়।
এই প্রথম ধর্মঘট হচ্ছে এমন নয়, এর আগেও হয়েছে। সেইসব আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়ে এবার শ্রমিকরা আরও বেশি এককাট্টা, আরও বেশি একসাথে। তারা ঘোষণা করেছেন এবারের ধর্মঘটে বাধা দিতে এলে প্রতিরোধ হবে, ধর্মঘট হবেই – কেউ একে রুখতে পারবে না।
২০১৫ সালে যখন বিজেপি সরকার বেসরকারিকরণের আইন পাশ করায় তখন আমাদের রাজ্যের তৃনমূল সরকার কোন বাধা দেয় নি। বরং নিজেদের গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে ধর্মঘট ভাঙতে, এবারেও রানিগঞ্জে তৃনমূলের বাহিনী হুমকি দিয়েছে ধর্মঘট তুলে নিতে। সারা দেশেই এই ধর্মঘট হচ্ছে – শুধু বিজেপি’র নীতির বিরুদ্ধে নয় তৃনমূলের সুবিধাবাদী অবস্থানের বিরুদ্ধেও।
কেন্দ্রের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড় এলাকাগুলি থেকে মোট ৪১টি কয়লাখনি নিলামের মাধ্যমে তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি হাতে। এরই মাঝে ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড এবং মহারাষ্ট্রের রাজ্যসরকার কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে, সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা হয়েছে। চিহ্নিত খনি এলাকাগুলি থেকে কোটি কোটি আদিবাসিকে জল-জঙ্গল-জমিচ্যুত করা হবে। তাদের জীবন-জীবিকার উপায়গুলি স্রেফ ধ্বংস হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে কয়লা শিল্পে এফডিআই (Foreign Direct Investment)’র বিরোধিতা করলেও ধর্মঘটের বিরোধিতায় তৃনমূলের বাহিনীর দেওয়া হুমকিই প্রমান করেছে তার রাজনীতি বিজেপি’রই পক্ষে।
গতকাল ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেশের কয়লা মন্ত্রী, সরকারী আধিকারিক এবং সিআইএল কর্তৃপক্ষের মুখের উপরে দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলি একযোগে নিজেদের বক্তব্য জানিয়ে বলেছে “কমার্শিয়াল মাইনিং ওয়াপস লো”।
এটা স্পষ্ট লড়াই হবেই। কোভিড-১৯ অতিমারী মোকাবিলায় অপরিকল্পিত সার্বিক লকডাউন ঘোষণার পরবর্তীতে সারা দেশে এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণী নামছে নিজেদের বেঁচে থাকার লড়াই করতে, অধিকার রক্ষার সংগ্রাম করতে, দেশ রক্ষার কাজ করতে।
প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তৃতায় আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার কথা বলছেন, এদিকে তারই নেতৃত্বে কেন্দ্রের সরকার একের পর এক জাতীয়কৃত সংস্থাগুলিকে বেচে দিচ্ছে বেসরকারি হাতে। কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নয়, এটাই বিজেপি’র রাজনীতি। মুখে দেশ রক্ষার স্লোগান আর কাজে দেশের সম্পদ দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে বেচে দিয়ে দেশের অর্থনিতিকে আরও পঙ্গু করে দেওয়ার রাজনীতি।
এরই বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা একজোট হয়েছেন। আজ, কাল আর তারপরের দিন দেশ দেখবে ধর্মঘট। এই লড়াই প্রতীকী নয়, এই লড়াই আসলে এক শ্রেণীর সংগ্রাম, আরেক শ্রেণীর একাধিপত্যের বিরুদ্ধে।
সরকার বলছে বেসরকারি হাতে গেলে উৎপাদন বাড়বে। বাস্তব তথ্য বলছে ঠিক উল্টোটা। ২০১৫ সাল থেকে এখনও অবধি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া ১১২টি কয়লাখনির মোট উৎপাদন হয়েছে ৩৫ মিলিয়ন টন, আরেকদিকে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে একা সিআইএল (Coal India Limited) উৎপাদন করেছে ৬০৪ মিলিয়ন টন কয়লা। এই একটি তথ্যেই পরিস্কার হয়ে যায় দেশি-বিদেশি কর্পোরেটরা এক বিশাল মুনাফার ধান্দা খুঁজে পেয়েছে কয়লা শিল্পে, তাদের মুনাফা নিশ্চিত করতেই বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের অর্থনীতি এসব স্রেফ জুমলা। এক নির্জলা মিথ্যা যা দিয়ে জনগনকে ধোঁকা দেওয়া চলছেই।
সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো ইতিমধ্যেই কয়লাখনি বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবী জানিয়ে স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছে। সিপিআই(এম) তিনদিনব্যাপি এই শ্রমিক ধর্মঘট সমর্থন করেছে।
কয়লাখনি বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাহার করার দাবী জানালো সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো
ইতিমধ্যেই ১০-১১ জুন বিরোধ দিবস এবং কালা দিবস হিসাবে পালিত হয়েছে শিল্পাঞ্চলে। সেই বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কুশপুতুল পুড়েছে। ইঙ্গিত স্পষ্ট – দেশের মেহনতি জনতা বুঝে নিয়েছেন তাদের স্বার্থ তাদের নিজেদেরকেই লড়ে বুঝে নিতে হবে।
শ্রমিকেরা ডাক দিয়েছেন “বিজেপি কর্পোরেটকা দালাল হ্যায়। বাপ দাদা কা সম্পদ বেচ কে খানেওয়ালা বিগড়া হুয়া বেটা হ্যায় মোদী সরকার। আত্মনির্ভরতা, স্বনির্ভরতা এক জুমলা হ্যায়”।
লড়াই শুরু হয়েছে। আগুন জ্বলে উঠে শক্তির সরবরাহ করে যে কয়লা সেই কয়লাকে মাটির তলা থেকে তুলে আনা মেহনতি হাত দুটো তিনদিন কয়লা তুলবে না – হাত দুটো ব্যাস্ত থাকবে আকাশের দিকে মুঠো করে তুলে রাখায় – খনির গহ্বর থেকে স্লোগান উঠে ছড়িয়ে পড়বে “আভি তো ইয়ে অংড়াই হ্যায়, লড়াই অউর বাকি হ্যায়”।
লড়াই থামে না, থামবে না….