২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০২১
দ্বিতীয় পর্ব
॥ ৮ ॥
ইতোমধ্যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলেও জিন্নাহর বক্তব্যের পর তা তীব্রতা লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদে ভাষা বিষয়ক যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় তাও ছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে করা চুক্তির লঙ্ঘন। ছাত্ররা একে নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসভঙ্গতা বলে অভিহিত করে। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এই বিশ্বাসভঙ্গতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, বিভিন্ন সভা সম্মেলনে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতির দাবী উত্থাপিত হতে থাকে। বিতর্কও কম হয়না। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিভিন্ন অংশের নানাবিধ দাবীর প্রেক্ষিতে আন্দোলন হয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাথে ছাত্ররা সংহতি ঘোষণা করে ও আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটী কর্মচারীদের সাথে ছাত্রদের বিছিন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ও ছাত্রদের হল থেকে বের করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে কয়েকজনকে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বহিস্কারাদেশসহ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে ১৭ এপ্রিল ৪৯ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়।
॥ ৯ ॥
এভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষা নিয়ে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল তা ক্রমেই বিস্তৃত ও যুক্ত হতে থাকে অন্যান্য পেশার আন্দোলনের সাথে। ইতোমধ্যে ছাত্রাঙ্গনে মুসলিম লীগের অনুসারী ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। অপরদিকে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ছাত্রফেডারেশন ও ছাত্র সমাজ ক্রিয়াশীল ছিল। পাকিস্তানের যাত্রার শুরুতেই কমিউনিস্ট পার্টির অনুপ্রেরণায় যুবসমাজ গড়ে তুলেছিল গণতান্ত্রিক যুবলীগ। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতে এবং পরবর্তীকালে এই সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ইতোমধ্যে আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী ভারত সরকার কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ঢাকায় এসেছেন। তাকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় ১৯৪৯ -এর জুনে আওয়ামী মুসলিম লীগ। এমনিতেই পাকিস্তানের প্রথম থেকেই কমিউনিস্টরা মুসলিম লীগ শাসকদের নিপীড়নের মুখে ছিলেন। রাজশাহীর নাচোল বিদ্রোহ, ময়মনসিংহের টংক আন্দোলন, সিলেটের নানকার আন্দোলন, যশোর অঞ্চলের তে-ভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের সেই আক্রমণ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। কমিউনিস্ট পার্টি তাও আত্মগোপনে থেকে কাজ করছিল। ইতোমধ্যে ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী কমিউনিস্টদের উপর গুলিবর্ষণ হলে কমরেডরা শহীদ হন। পাকিস্তানের এই জেলহত্যাকান্ড আজও স্মরিত হয় ‘খাপড়া ওয়ার্ড’ দিবস হিসাবে।
॥ ১০ ॥
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনেও পরিবর্তন ঘটে এই সময়কালে। প্রথমে ১৯৪৯ এর সেপ্টেম্বরে জিন্নাহর মৃত্যু, পরবর্তীতে ১৯৫০-এর অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলীতে নিহত হলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন প্রথমে গভর্ণর জেনারেল ও পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খাজা নাজিমুদ্দিন ‘৫১-এর শেষভাগে পূর্ব পাকিস্তানে এসে পল্টনের এক জনসভায় ঘোষণা করেন উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এটা ছিল ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে তার করা চুক্তির পুরোপুরি বরখেলাপ। এর ফলে ছাত্রসহ বিরোধী রাজনৈতিক মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এটা অনুমেয় ছিল যে এর উপযুক্ত প্রতিবাদ না হলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় উর্দুর স্বপক্ষে প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেবে। তাই একদিকে রাজনৈতিক অঙ্গণে দ্রুততার সাথে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় ও পাশাপাশি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ও গঠিত হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হবে।
এই হরতাল প্রস্তুতির সময় সরকার একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এই হরতাল ভাঙ্গা নিয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ বৈঠক কালে সংখ্যাধিক্য ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। তবে এও সিদ্ধান্ত হয় যে পরদিন অথ্যাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে হরতাল ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হলে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্ত হবে।
একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস বলছে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র এই সিদ্ধান্তে ছাত্ররা চরম বিক্ষুদ্ধ হয় এবং একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্বরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের পূর্ব পাশে পুকুরপাড়ে কতিপয় ছাত্রনেতা মিলিত হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত জানালে সাধারণ ছাত্ররা বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে চাপ দিতে থাকে। এসময় একটি মধ্যবর্তী প্রস্তাব হিসাবে বলা হয় যে দলেবলে না ভেঙ্গে দশ জন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে। সেমত তিনচারটি দশজনের মিছিল বের হলে প্রথমে পুলিশ তাদের ট্রাকে তুলে নেয় এবং পরে লাঠিচার্জ শুরু করে ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্ররাও দলে দলে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের দিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে শ্লোগান দিয়ে অগ্রসর হয়। এভাবে বহুক্ষণ চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভিতরে গুলী ছুড়লে সেখানে ছাত্রদের ব্যারাকের বারান্দায় আবুল বরকতের মাথায় গুলী লাগলে তার মগজ বেরিয়ে আসে। ইতোমধ্যে রাস্তায় গুলীতে সালাম, রফিক, জব্বার সহ আরও বহুব্যক্তির নিহত, আহত হওয়ার খবর আসে। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ডাকা হরতালে পুলিশের গুলীতে শহীদ হন সফিউর রহমান। গুলীতে নিহতদের লাশ কবর না দিয়ে চাপা দেয়া ও পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।
॥ ১১ ॥
২১ ফেব্রুয়ারি এই গুলী ও জীবনদান বাঙালীর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। একুশের এই ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন ‘আর প্রত্যাবর্তন নয়’ এই বিন্দুতে পৌঁছায়। একুশের এই পথ ধরেই বাঙালী পঞ্চাশ থেকে সত্তর অবধি বিভিন্ন আন্দোলন এগিয়ে গেছে গণতন্ত্র, স্বাধিকার, স্বাধীনতা-বাঙালীর জাতীয় রাষ্ট্র গঠন তথা স্বাধীন বাংলাদেশের পথে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবল রাষ্ট্রভাষা বাংলাই নয়, বাংলা ভাষারও দেশ।
তবে সেই ভাষা দিবস এখন কেবল বাঙালীর নয়, সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
( রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি , বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
(বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে)