ডিসেম্বর ৫, ২০২০ শনিবার
★প্রথম পর্ব★
বিকল্পের সংগ্রামই এখন সময়ের চাহিদা
শান্তনু দে
মোদী, মমতাকে ‘না’ বলা জরুরি।
কিন্তু, কেবল না বলাই যথেষ্ট নয়। নো ইজ নট এনাফ। একইসঙ্গে জরুরি হলো একটি বিশ্বাসযাগ্য বিকল্প নির্মাণ। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলার জন্য একটি সৃজনের রাজনীতি। নেতার বিকল্প নয়। নীতির বিকল্প।
দিল্লি, কলকাতা। দুই সরকার। এক নীতি। নয়া উদার নীতি। একে পরাস্ত করতে জরুরি একটি বিকল্প ভাষ্য। নয়া উদারবাদের বিকল্প ভাষ্য। যেমন আন্দোলন-সংগ্রামে, তেমনই প্রয়োগে তার অনুশীলন।
এই বিকল্পের লড়াইয়েই সম্প্রতি জয় পেয়েছে বলিভিয়া। তার আগে আর্জেন্টিনা। এই বিকল্পের জন্যই আন্দোলন-সংগ্রামে চিলি, ব্রাজিল, ইকুয়েদর, কলম্বিয়া, পেরু-সহ লাতিন আমেরিকা। আবার প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় এই বিকল্পেরই অনুশীলনে ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া। ব্রাজিলের মারানহাও প্রদেশ। মোদীর ভারতে যেমন কেরালা, তেমনই বোলসোনারোর ব্রাজিলে মারানহাও। কেরালায় যেমন পিনরাই বিজয়ন, মারানহাওতে তেমনই ফ্লাবিও দিনো। ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিডিওবি)-র শীর্ষ নেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পরাজয়, বাইডেনের জয়ের নেপথ্যে যেমন বার্নি স্যান্ডার্স ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে থাকা ডেমোক্র্যাটিক সোস্যালিস্টস অব আমেরিকা (ডিএসএ)-র বিকল্প কর্মসূচী, তেমনই ব্রিটেনে নব্য লেবারের মধ্যে এক অন্য হাওয়া জেরিমি করবিন ও তাঁর বিকল্প অ্যাজেন্ডা। কিংবা ফ্রান্সে, কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত বামপন্থী নেতা জ্যাঁ-লুক মেলেশোঁর সাফল্যের পিছনে আসলে ছিল এই বিকল্পের সন্ধান। যেমন বিহারে, জয়ী আসলে এই জনজীবনের অ্যাজেন্ডা। জনগণের জলন্ত ইস্যু। রুটি-রুজি। কামাই, পধাই, দাওয়াই, সিচাই। কাজ, শিক্ষা, ওষুধ, সেচের জরুরি দাবি।
বারো বছর ধরে চলছে বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কট। উতরোনর কোনও লক্ষণ নেই। বরং দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের তিনের দশকের মহামন্দা থেকে এবারের মন্দা পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী। সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পুঁজিবাদের প্রতিটি চেষ্টাই তৈরি করছে আরও গভীর সঙ্কট। মহামারি এই সঙ্কটকে আরও তীব্র করেছে। সঙ্কট থেকে বেরোনোর জন্য ‘বলির পাঠা’ করা হচ্ছে শ্রমজীবী জনগণকে। তাঁদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে ব্যয়সঙ্কোচের দাওয়াই। কমছে বিপুল অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। কমছে মজুরি। অন্যদিকে অল্প কিছু অংশে বাড়ছে মুনাফা, বাড়ছে আয়। বাড়ছে বৈষম্যের ব্যবাধান। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব।
বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। উন্নত দেশগুলিতেও এর প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। উত্তরের খোঁজে মানুষ। শ্রমজীবী মানুষের এই বিক্ষোভে তিনটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এই তিনটি অবস্থানের একটি বামপন্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্য দু’টি পুঁজিবাদী শিবিরের অন্তর্গত। যারা পুঁজিবাদের কোনও বিকল্প ভাবতে অক্ষম। এই দু’টি অবস্থানের একটি উগ্র দক্ষিণপন্থা, যা প্রচণ্ড শক্তি অর্জন করেছে। এদের অবস্থান, তোমার সমস্যার জন্য ‘ওরা’ দায়ী। এই ‘ওরা’ মানে অভিবাসীরা, সংখ্যালঘুরা। মেরুকরণের সমীকরণে এরা আরও তীব্রতার সঙ্গে নয়া উদার জমানা কায়েম করতে চাইছে। বিপরীতে, চিরায়ত নয়া উদারবাদী অবস্থান। যারা মনে করেন, শ্রমিকদের দুর্দশার কারণ আর যাই হোক না কেন, বিশ্বায়ন নয়। এই মধ্য-দক্ষিণপন্থার জঠরেই উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান। তৃতীয়ত, বামপন্থীরা। নয়া উদারবাদ কানাগলিতে। একমাত্র বামপন্থীরা, যাঁদের কাছে আছে এই সঙ্কট থেকে বের হওয়ার সুলুক সন্ধান।
ট্রাম্প, মোদীর জয়ের পর থেকেই কথাটা ঘুরে ফিরে আসছে। শক— এক আকস্মিক আঘাত, অথবা তীব্র অভিঘাতে এক বিহ্বলতা।
অতি সম্প্রতি কানাডার লেখিকা, সমাজকর্মী নাওমি ক্লাইন একটি বই লিখেছেন। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো বইটির শিরোনাম। নো ইজ নট এনাফ। নাওমির এই বইয়ের সঙ্গে আমাদের অনেক জায়গাতেই সহমত না হওয়ার কথা। সে অন্য আলোচনা। কিন্তু, তাঁর এই বক্তব্য অনবদ্য: নো ইজ নট এনাফ।
শক ডকট্রিনে ‘না’ বলাটা জরুরি।
তবে, নিছক ‘না’ বলাই যথেষ্ট নয়। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত আমাদের কাছে দাবি করছে আরও বেশি কিছু। সামথিং মোর। জরুরি হলো, একটি বিশ্বাসযোগ্য এবং উদ্দীপ্ত করার মতো ‘হ্যাঁ’— যারা আমাদের ভাগ করতে চায়, তাদের বিদ্বেষের বিষকে ছাপিয়ে ঐক্যের জমি চাষের জন্য চাই একটি যোগ্য পথনিশানা।
প্রত্যাখ্যান থেকে প্রতিরোধে উত্তরণ। রিফিউজ্যাল থেকে রেসিসটেন্স। আবার কেবল প্রতিরোধই যথেষ্ট নয়। প্রতিরোধের সঙ্গে থাকুক নির্দিষ্ট লক্ষ্য। বিরোধিতার নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্যম অবস্থান থেকে অ্যাকশানের নির্দিষ্ট কর্মসূচী। এই অ্যাকশান মানে বিকল্প কর্মসূচী নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন। যেমন চিলিতে। বুলেটে যে বেপরোয়া, ব্যালটে যার প্রতিফলন।
ধুলো থিতু হওয়ার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। নির্মল, স্বচ্ছ পরিবেশের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারি না। টালমাটাল পরিস্থিতি মানে, আমাদের তার মধ্যে থেকেই কাজ করার শিক্ষা নিতে হবে। উথাল-পাথাল ঢেউয়ে জাহাজের ডেকে কীভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নিতে হবে তার পাঠ।
চাই একটি পজিটিভ শক। যেমন বলিভিয়াতে, যেমন বিহারে।
প্রত্যয়ী ‘না’র সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হবে একটি সাহসী এবং সমুখপানের ‘হ্যাঁ’। থাকতে হবে ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিকল্পনা— যা হবে বিশ্বাসযোগ্য এবং যাতে থাকবে এক অমোঘ আকর্ষণ শক্তি, যার বাস্তব রূপ দেখার জন্য বিপুল সংখ্যায় মানুষ নামবেন রাস্তায়— তা সে যতই তাঁদের পক্ষ থেকে আঘাত ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হোক না কেন।
বিকল্পের এমন এক স্বপ্ন, যা আকাশকুসুম না, যা আদায়যোগ্য। যে স্বপ্নপূরণের জন্য মানুষ অনায়াসে জলকামানকে উপেক্ষা করতে পারেন। ভাঙতে পারেন পারে একের পর এক ব্যারিকেড। মধ্যরাতের গ্রেপ্তারেও থাকেন অকুতোভয়।
শুরুতে আমাদের উপলদ্ধি করতে হবে, কাকে আমরা ‘না’ বলছি— কারণ এই ‘না’ কেবল একজন ব্যক্তি, কিংবা একটি গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নয়। কেবল একজন মোদী, মমতাকে নয়। আমরা একইসঙ্গে না বলছি এই ব্যবস্থাকে— যা তাঁদেরকে পৌছে দিয়েছে এই উচ্চতায়। এরপরেই আমাদের এগোতে হবে একটি ‘হ্যাঁ’র দিকে— এমন একটি ‘হ্যাঁ’, যা আনবে মৌলিক পরিবর্তন, আজকের এই কর্পোরেট দখলদারিকে নির্বাসিত করবে ইতিহাসের পাদটিকায়।
‘গত কয়েক দশক ধরে যে কথাগুলি বলা যাচ্ছিল না, এখন যা সশব্দে বলে প্রার্থীরা লক্ষ লক্ষ ভোট পাচ্ছেন, সেগুলি হলো: কলেজে ফি মকুব, ন্যূনতম মজুরিকে দ্বিগুণ করা, ১০০ শতাংশ পুনর্নবীকরণ শক্তি, এখানে উদ্বাস্তুদের স্বাগত, যুদ্ধ বিপন্ন করে আমাদের সকলের নিরাপত্তাকে। সাম্প্রতিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বার্নি-ব্রিগেডের সাফল্যে যা স্পষ্ট।
‘যে নেতারা ব্যর্থ নয়া উদার স্থিতাবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁরা কখনও বক্তৃতাবাগীশ এবং নব্য-ফ্যাসিবাদীর মুখে দাঁড়াতে পারেন না।’ বলেছেন নাওমি।
এই বিকল্পের সংগ্রামেই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতা। ধর্মঘটে, অবরোধ-বিক্ষোভে জানকবুল রাস্তার লড়াই থেকে নির্বাচনী সংগ্রাম।
ঠিকই, এক অন্ধকার সময়। যদিও চিরন্তন সত্য: সঙ্কটের জঠরে থাকে সম্ভাবনার বীজ।
যেমন বলেছিলেন ডিকেন্স, যেমন বলেছেন মাও।
ডিকেন্স বলেছিলেন ‘ইট ওয়াজ দি বেস্ট অব টাইমস, ইট ওয়াজ দি ওয়ার্স্ট অব টাইমস’। তেমনই এটি যেমন নিকৃষ্ট সময়, তেমনই সর্বোত্তম সময়। মাও বলেছেন, ‘স্বর্গের নিচে চলছে মহাবিশৃঙ্খলা। পরিস্থিতি দুরন্ত।’
বিকল্পের লড়াইয়ে এই সঙ্কটকে সম্ভবনাময় পরিণত করার সৃজনের রাজনীতিই এখন বামপন্থীদের কাছে চ্যালেঞ্জ।