Agrarian Success During LF Gvt- Part 4

সাফল্য শস্য উৎপাদনে- শুদ্ধস্বত্ব গুপ্ত
পর্ব-৪

ধান উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কেন্দ্রের পাঠানো চালের ওপর ভরসা করে থাকতে হতো। সেই রাজ্যই ধান উৎপাদনে চলে গিয়েছিল দেশের শীর্ষে। কেবল চালই নয়, আলু সহ সবজির উৎপাদনেও দেশের শীর্ষে পৌঁছাল পশ্চিমবঙ্গ। সাফল্য মাছ চাষেও। বিকল্প কেবল উৎপাদনে বৃদ্ধিতেই নয়। সুফল হাতে গোনা ধনী কৃষক বা জোতদারের হাতে যায়নি। পৌঁছেছিল প্রান্তিকতম পরিবারে। জনগণকে অংশীদার করে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর হওয়ার পথে বিকল্পের খোঁজ চলেছে ৩৪ বছর।


লকডাউনের মধ্যেই রাস্তায় ফসল ফেলে বিক্ষোভ দেখাতে হয়েছে কৃষকদের। ফসলের দাম মিলছে না। শহরের মধ্যবিত্ত, গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ আলু কিনেছেন প্রায় পঞ্চাশ টাকায়। কে তুলেছে লাভ? কৃষকদের পাঁচ-ছয় টাকা কেজি দরে বেচে দেওয়া আলুতে ফুলে উঠেছে ফড়ে আর আড়তদারের পকেট।


ধান কত টাকায় বেচছেন কৃষকরা? কুইন্টালে ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য ১৮৬৮ টাকা। রাইসমিল মালিকদের কাছে ধান বেচে ১১০০-১২০০ টাকার বেশি মিলছে না কৃষকের। মুখ্যমন্ত্রী অক্লেশে বলছেন কৃষকের আয় তিনগুণ হয়েছে।
দশ বছর আগে কৃষক মাণ্ডি চালুর সার দিয়ে ঘোষণা মনে পড়ছে? মনে পড়ছে বেছে নেওয়া খবরের কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন? কৃষকরা বলছেন, মাণ্ডিতে ধান কেনার লোক নেই। সঙ্কটে কম দামে বিক্রি হচ্ছে ধান। এরাজ্যে ভালো চাল মুদি দোকানে পৌঁছেছে কেজিতে পঞ্চাশ টাকায়। এ সরকার কার, বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়। দিল্লির সরকারই বা কার? তারা তো আইনই করেছে যাতে ন্যূনতম সংগ্রহমূল্য ব্যাপারটাই হাপিস হয়ে যায়।


এ রাজ্যের প্রধান খাদ্য ভাত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সবার মুখে জোগানোর মতো ধান উঠত না মাঠে। খাদ্যে ঘাটতি রাজ্যে বারবার হয়েছে খাদ্য আন্দোলন। অবশ্য উৎপাদনের অভাবই যে খাদ্যসঙ্কটের একমাত্র কারণ তা নয়। এ রাজ্যই ধীরে ধীরে খাদ্য উৎপাদনে দেশের সামনের সারিতে চলে গিয়েছে ৩৪ বছরে। চাল উৎপাদনে দেশের মধ্যে এক নম্বরে পৌঁছেছে। সবজি চাষেও উঠে গিয়েছে সব রাজ্যের তালিকায় সবার ওপরে। আলু উৎপাদনে হয়েছে দ্বিতীয়।


উৎপাদন হলেও সাধ্যের মধ্যে গরিব, প্রান্তিক মানুষ যে শস্য পাবেন তা নিশ্চিত নয়। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বন্টনের ব্যবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। কালোবাজারি, ফড়ে আর মজুতদাররা সরকার চালালে উৎপাদনের ঘাটতি অতি দ্রুত সঙ্কটের চেহারা নেয়। যেমন এখন দেখা যাচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারি কমিটিতে গৌরবজনক উপস্থিতি মজুতদারের!
বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে এই শ্রেণি ভারসাম্য শ্রমজীবীর অনুকূলে আনার চেষ্টা হয়েছে। লক্ষ্য ছিল, উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চয় করতে হবে। তার সঙ্গে দেখতে হবে সেই উন্নয়নে যেন লাভবান হতে পারেন গরিব, মেহনতি মানুষ। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে প্রায় দ্বিগুন বা ৯৮ শতাংশ বেড়েছে ধানের উৎপাদন। সেই সঙ্গে দেখা গিয়েছে ধান কাটা ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনাও কমে এসেছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নীতিতে যখন কৃষক আত্মহত্যা বেড়েছে সারা দেশে, এরাজ্যে তুলনীয় সংখ্যা নগন্য। কৃষিতে সাফল্যের ভিত গড়েছে পুনর্বন্টনমূলক ভূমিসংস্কার এবং তিন স্তরে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে জনতার অংশগ্রহণ বাড়ানোর মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু ৮৪ শতাংশ জমি থেকেছে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে উৎপাদনের সুফলও পেয়েছে অনেক বেশি সংখ্যায় পরিবার।


ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে ষাটের দশকে ‘সবুজ বিপ্লব’ নীতিতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সারের সরবরাহের লক্ষ্য নেওয়া হয় কৃষি উৎপাদনে। সবুজ বিপ্লবের মডেল প্রয়োগ করা হয়েছিল বড় জোতভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতিতে। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার মতো রাজ্য সেই নীতিতে উৎপাদন বাড়াতে পেরেছে অনেকখানি একথা ঠিক। তেমনি বেড়েছে বৈষম্য। খালিস্তান আন্দোলনের পিছনে এই বৈষম্যের ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মডেল ঠিক একেবারে উলটো। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ছোট এবং প্রান্তিক কৃষিজোতের প্রাধান্য বজায় রেখে।


নয়া উদারবাদের সময়ে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগের দায়িত্ব তুলে দিয়ে কর্পোরেটের বিনিয়োগে উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়। কৃষি থেকে উচ্ছেদ বাড়তে থাকে সারা দেশে। উন্নয়নে জনতার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সেই বিপদের মোকাবিলা করতে হয়েছে এরাজ্যে। বীজ, উন্নত সার, বিজ্ঞানসম্মত চাষের প্রক্রিয়া, ফসলে বৈচিত্র্যকরণের এই কঠিন কাজে এগনো গিয়েছিল পঞ্চায়েতের সক্রিয় তদারকি থাকায়। আবার ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষি সমবায় গড়ে কাজ করা হয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মাধ্যমেও ধান কিনে চাল তৈরি করিয়ে কিনে নিয়েছে সরকার। কৃষি উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক স্তরে পৌঁছেছে এই বিকেন্দ্রীকরণের হাত ধরে।


দেশের মোট কৃষিজমির মাত্র ৩ শতাংশ থাকলেও খাদ্যশস্যের মোট ৮ শতাংশের জোগান দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সবজি চাষে দেশে প্রথম, আলু উৎপাদনে দ্বিতীয়। ১৯৭৬-৭৭ অর্থবর্ষে, যখন দায়িত্ব পেল বামফ্রন্ট সরকার, খাদশ্যের উৎপাদন ছিল ৭৪ লক্ষ টন। ২০১০-১১ অর্থবর্ষে উৎপাদন বেড়ে হয় ১৭০ লক্ষ টন। বেড়ে যায় শস্য নিবিড়তা। কোনও একটি জমিতে একাধিকবার চাষ হলে শস্য নিবিড়তা বাড়ছে ধরা হয়। ১৯৯২-৯৩ অর্থবর্ষে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে শস্য নিবিড়তার হার ১৫৫ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবর্ষে বেড়ে হয় ১৯২ শতাংশ। দেশে দ্বিতীয় স্তরে উঠে যায় রাজ্য। বৃহৎ সেচ প্রকল্পের দায়িত্ব কেন্দ্র নেয়নি। ফসলে বৈচিত্র্য আনা বা শস্য নিবিড়তায় কার্যকর হয়েছিল রাজ্যের ক্ষুদ্রসেচের সাফল্য।
বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচকের অভাব ছিল না। বাম-ডান দু’দিক থেকেই হয়েছে সমালোচনা। বস্তুত বামপন্থীরাও আত্মসমালোচনার দৃষ্টিতেই মূল্যায়নে আগ্রহী ছিলেন। ফলে সমালোচনা, যুক্তি-তর্কে আপত্তিরও কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু গত দশ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার যে একের পর এক কৃষি সমবায় ভেঙে দিল, শস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা কার্যত তুলে দিল ফড়ে, দালাল, প্রতিপত্তিবানদের হাতে, কৃষককে যেভাবে চালকল মালিকের দয়ার ওপর ভরসা করে থাকতে বাধ্য করা হলো, পরিবর্তনের এমন দশায় নীরব থাকলেন এই সমালোচকদের বড় অংশ।

Spread the word

Leave a Reply