A Matter of Survival of the Peasantry

কৃষকদের বেঁচে থাকার প্রশ্নকে সামনে রেখে

প্রভাত পট্টনায়েক

মূল প্রবন্ধটি পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ৩রা জানুয়ারি ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত

দিল্লি সীমান্তে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারী কৃষকেরা লড়াইয়ের দাবী আদায়ে অত্যন্ত সঠিকভাবে সেই সব বিষয়ের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন যেগুলির মোকাবিলা তাদের জীবন-জীবিকার সাথে জড়িয়ে রয়েছে, বলা যায় এদেশে চাষআবাদ করে কৃষকেরা আর বেঁচে থাকতে পারবেন কি না সেটাই মূল কথা। নয়া উদারবাদের ধাক্কায় অনেকটা ভেঙে পড়লেও এখনও অবধি আমাদের দেশে এমন কিছু বন্দোবস্ত ছিল যার ভরসায় কৃষকেরা কোনোমতে হলেও বেঁচে ছিলেন। মোদী সরকারের পাশ করানো তিনটি কৃষি আইনের নাম করে বেঁচে থাকার সেই ন্যুনতম বন্দোবস্তের গোটাটাই এক ধাক্কায় লোপাট করে দেওয়া হয়েছে। নয়া এই তিনটি আইনের সাহায্যে আমাদের দেশের কৃষিক্ষেত্রে নয়া উদারবাদ নিজেকে সর্বোচ্চ স্তরে প্রয়োগ করছে। আর ঠিক সেকারনেই এই তিনটি আইনের পরিধির মধ্যে থেকে কৃষকদের সাথে সরকারের কোনোরকম আলাপ আলোচনা সম্ভব নয়, তিনটি আইনকেই সরাসরি বাতিল করতে হবে।

স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার লাগামছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হাতে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে দখল হতে দেওয়া হচ্ছে। এই দখলদারির খেলায় বড় খেলোয়াড় হিসাবে আম্বানি এবং আদানির মতো কর্পোরেটরা, যাদের কৃষিবিপণন সংস্থা রয়েছে তারাই হবে সবচেয়ে বেশী লাভবান। এই অবস্থাকে বুঝতে গেলে প্রথমে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা টানতে হবে।

সাতের দশকে আমাদের দেশের কৃষিব্যবস্থায় পুঁজিবাদের বেড়ে ওঠা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কারোর মনে হতেই পারে প্রায় অর্ধ শতাব্দির বেশী সময় ধরে পুঁজিবাদের গড়ে ওঠার পরেও যখন কৃষকেরা বিপন্ন হয় নি তখন কেন এইবার পুঁজিবাদের হাতে কৃষিক্ষেত্রকে দখল করা নিয়ে এতো হইচই করা হচ্ছে। এত বিশাল সময় ধরে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠার পরেও দেশের কৃষিজীবীরা নিশ্চিহ্ন হন নি, তাহলে এখন তারা ধ্বংস হয়ে জাবেন এমন আশংকা করা হচ্ছে কেন?

সেইসময় পুঁজিবাদের বেড়ে ওঠার পরিধি আসলে কৃষিঅর্থনীতির অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষক এবং জমিদারদের একসাথে নিয়ে সেই জটপাকানো ব্যবস্থা এমনভাবেই সক্রিয় ছিল যাতে কৃষিক্ষেত্রের বাইরে থাকা পুঁজিবাদী শক্তির হাত থেকে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সচেতনভাবে সুরক্ষিত রাখা হত। সেই আমলেরই বন্দোবস্ত হল ন্যুনতম সহায়ক মুল্য, প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি এবং ভর্তুকিযুক্ত গনবন্টন ব্যবস্থাসহ আরও অন্যান্য সব রক্ষাকবচ। বলা যায়, একদিকে ফসল উৎপাদনকারী কৃষক এবং অন্যদিকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রেখে সেসময় সরকারের ভুমিকা ছিল মধ্যস্থতাকারী হিসাবে। সারা দেশের যেখানেই কৃষিক্ষেত্রকে সুরক্ষাকবচ দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এমন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালিত হয়েছে সেখানেই কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিবাদ বিকশিত হয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রের দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী শক্তির প্রভাব ব্যতিরেকেই।

কৃষিঅর্থনীতির বাইরে থাকা পুঁজিবাদী শক্তির হাতে কৃষিকাজকে দখল করতে দেওয়ার অর্থ হবে কৃষিক্ষেত্রকে সরাসরি পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার আওতাধীন করে তোলা। কৃষি অর্থনীতির ধ্বংসসাধন সম্পর্কে তাত্ত্বিক রচনায় পণ্য উৎপাদন প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতেই রোসা লুক্সেমবুর্গ দেখিয়েছেন কীভাবে কৃষি অর্থনীতির মুলচ্ছেদ ঘটিয়ে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম হয়। পণ্য উৎপাদন বলতে কি বোঝায় সেটা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। বাজারের উদেশ্যে উৎপাদন কিংবা পুঁজিচক্র সম্পর্কে মার্কসের ব্যাখ্যা করা আবর্তনের নিয়ম “পণ্য – মূল্য – পণ্য” অনুযায়ী উৎপাদন হলেই পণ্য উৎপাদন হচ্ছে এমনটা নয়। পণ্য উৎপাদন হবে তখনই যদি বিক্রেতার জন্য উৎপাদিত পণ্যের কেবলমাত্র বিনিময় মূল্য থাকবে কিন্তু ক্রেতার জন্য একইসাথে ব্যাবহার মূল্য এবং বিনিময় মূল্য দুইই থাকে। উল্লেখ্য এই মুল্য স্থির হবে বাজারের স্বতস্ফুর্ত কার্যক্রমের দ্বারা।

পণ্য উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই ব্যবস্থায় বড় উৎপাদক সংস্থাগুলি ছোট উৎপাদকদের গিলে খায়। বর্তমান অবস্থার এই প্রবন্ধের আলোচনার প্রসঙ্গে বলা যায় কৃষিক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা একবার কৃষকদের সাথে পুঁজিবাদকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে কৃষিকাজ পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিগঢ়ে চলে যাওয়ার পরে কর্পোরেট সংস্থাগুলির হাতে দেশের কৃষকসমাজের সমাধি খনন সম্পন্ন হবেই। ন্যুনতম সহায়ক মুল্য কিংবা প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি চালু থাকার ফলে বাজারের উপরে বিবিধ বিধিনিষেধ লাগু থাকায় তার যথেচ্ছ সতস্ফুর্ততা বাধাপ্রাপ্ত হয়। গিলে খাওয়ার সদিচ্ছা সত্বেও ন্যুনতম সহায়ক মুল্য নিজেই তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে।

নয়া উদারবাদ প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে লক্ষ্য ছিল বাজারের সতস্ফুর্ত পরিচালনা পুনঃস্থাপন করা। এই লক্ষ্যভেদ করতে হলে সেই সমস্ত বন্দোবস্তকেই নাকচ করতে হবে যা যা কৃষকদের কর্পোরেট পুঁজির থেকে সুরক্ষিত রাখে। ইতিমধ্যে সুরক্ষার বন্দোবস্তের অনেককিছুই (যদিও ন্যুনতম সহায়ক মুল্য, গনবন্টন ব্যবস্থা, প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি এগুলি অন্তুত নাম-কা-ওয়াস্তে হলেও ছিল) বাতিল করে দেওয়ার ফলে বহু কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা লাফিয়ে বেড়ে চলে। ধ্বংস করে দেওয়া না হলেও এক দীর্ঘ সময় যাবত ন্যুনতম সহায়ক মূল্যকে বাড়ানো হয় নি। এতদিন কোন সরকারই এই সব বন্দোবস্তগুলিকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেবার নির্লজ্জতা দেখায়নি। দেশের কৃষকদের কর্পোরেটদের সামনে নির্বিত্ত মজদুর কিংবা খুব বেশী হলে বাধ্যতামূলক ভাড়াটে চাষিতে রূপান্তরিত করার মতো নির্লজ্জ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে মোদী সরকারের তীব্রতা অন্য সরকারগুলিকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে।  

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃষি বাজারের উপরে কোনোরকম হস্তক্ষেপের সুযোগ না রেখে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে পণ্য উৎপাদনকারী ব্যবস্থায় রুপান্তরিত করা হলে তিনটি নির্দিষ্ট বুনিয়াদী পরিবর্তন করতে হবে। প্রথমে দেশের জমি সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্ববাজারের অধীনস্থ করতে হবে, যার অর্থ হবে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়া। এমনটা হবে কারন তখন জমি নীতি কিংবা কৃষি জমির ব্যাবহার উন্নত দেশগুলির ক্রয়ক্ষমতার উপরে নির্ভর করবে। বর্তমানে উন্নত দেশগুলিতে খাদ্যের বাজারে চাহিদা থাকে মূলত সাধারণ খাদ্যশস্যের বদলে গ্রীষ্মকালিন সময়ে উৎপাদিত ফসলের উপরে, ফলে পণ্য উৎপাদন ব্যাবস্থায় দ্বিতীয় যে পরিবর্তন সাধিত হবে তা হল আমাদের দেশের কৃষিজমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের বদল ঘটানো। এর ফলে দেশের খাদ্যশস্যের ভান্ডারে টান পড়বে এবং আকালের সময়ে বাড়তি খাদ্যের চাহিদা মেটাতে আমরা খাদ্য আমদানি করতে বাধ্য হব। তৃতীয়ত দেশের কৃষকসমাজ কর্পোরেটদের দয়ার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তাদের অর্থনৈতিক পরিচিতির অবনমন ঘটবে। এমন হবার অনেক পদ্ধতি হতে পারে। অনুমানের সুবিধার্থে আমরা একটি পদ্ধতির কথা ভাবতেই পারি – বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের দেশের কৃষকেরা যদি মজুরির বিনিময়ে কর্পোরেটদের জন্য শস্য উৎপাদন করতে শুরু করে তবে আকালের সময়ে তারা চরম দেনাগ্রস্থ হতে বাধ্য হবে অথবা যদি কখনো ফসলের দাম পড়ে যায় ( কর্পোরেটদের সাথে ফসল বিনিময়ের চুক্তিমুল্য যাই হোক না কেন বাজারে ফসলের দাম পড়ে যাওয়ার কুপ্রভাবও সরাসরি কৃষকদেরই ভোগ করতে হবে )। একবার যদি তারা কর্পোরেটদের সামনে ঋণের জালে জড়ায় তবে তাদের জমিহারা হয়ে মজদুরে পরিনত হবে।

এইসবকিছুই আমাদের ঔপনিবেশিক সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয় যখন উৎপাদিত ফসলে ন্যুনতম সহায়ক মুল্য কিংবা খাদ্য/শস্য প্রক্রিয়াকরণে কোনোরকম সরকারি হস্তক্ষেপ ছিল না এবং কৃষকদের বেঁচে থাকতে হত আগাগোড়া বাজারের মর্জি মাফিক। তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে আমামদের দেশের সাহিত্যে সেই বুক চাপড়ানো অবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। এতকিছুর পরেও বেশ কিছু মেধাবৃত্তিকার খোলা বাজারের সামনে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দেবার পক্ষে সাফাই দেন। তাদের কথাবার্তায় মনে হয় নিজেদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ইতিহাস সম্পর্কে বিজেপি’র উদাসিন থাকার তাও একটা মানে বোঝা যায়, কিন্তু বিজেপি পরিচিতির বাইরেও অনেকেই যেভাবে কৃষিক্ষেত্রে সরকারের আওতামুক্ত পণ্য উৎপাদনী প্রক্রিয়ার পক্ষে আওয়াজ তুলছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।

কৃষিক্ষেত্রকে আগাগোড়া পণ্য উৎপাদনের আয়ত্ত্বে নিয়ে যাবার অর্থই হল কৃষকদের চরম দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেওয়া। কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের অধোগতির সমানুপাতেই সারা দেশের মেহনতি মানুষের লড়াই আন্দোলনের অবস্থা নির্ণীত হয় বলে সারা দেশেই মেহনতি মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার বৃদ্ধি ঘটবে। এই ব্যাপারটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে আমরা একটি অবস্থার কথা ভাবতে পারি। ধরা যাক কৃষিজমিতে স্বাভাবিক চাষ-আবাদের বদলে অর্থকরী ফসল ফলানো শুরু হয়েছে কিন্তু প্রতি একর জমিতে কর্মসংস্থানের অবস্থা একই রয়েছে। যদি কর্মসংস্থানের চিত্র একই না থেকে কিছুটাও অধোগতিপ্রাপ্ত হয় তবে সার্বিক দারিদ্রের অবস্থা অবশ্যম্ভাবী। আরও ধরে নেওয়া হল অর্থকরী ফসল ফলানো সত্ত্বেও কৃষক এবং ক্ষেতমজুরদের মাথা পিছু আয়ও এক রয়েছে। এই অবস্থাতেও যদি কেবল একটি বছরে অর্থকরী ফসলের বাজার মুল্য পড়ে যায় তখন গোটা দেশের মেহনতি মানুষের (কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং শ্রমিক) আয় পড়ে যাবে এবং উল্লেখযোগ্য হিসাবে তাদের ক্রয়ক্ষমতাও কমবে যার ফলে বাধ্যতামূলক ধার করে বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়বে।

এভাবেই একবার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লে তাদের দুর্দশার শেষ থাকবে না এবং ক্রমাগত সেই অবস্থা ক্রমাবনতির দিকে যাবে। এমনটা হবেই কারন আমাদের দেশে কৃষক এবং বাজারের মাঝে কর্পোরেটরা থাকায় পণ্য উৎপাদনে বাজারে দাম পড়তে শুরু করলে তার প্রভাব উৎপাদকের উপরেই এসে পড়বে কিন্তু বাজারে দাম বৃদ্ধির সময় এমন কিছু হবে না। সুতরাং বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লে সেই সুবিধা ভোগ করা কিংবা দাম কমে গেলে সেই ক্ষতিপূরণের সুযোগ দুটোর কোনটারই বাস্তবতা নেই। ফলত ঋণগ্রস্থ কৃষকের গলায় দেনার বোঝা ঝুলতেই থাকবে, তাদের দারিদ্র আরও ভয়াবহ চেহারা নেবে। এর ফলে কৃষিকাজ থেকে সরে এসে মজদুরি করা জনগণ কাজের খোঁজে ঘুরতে থাকবে, তার হবে কাজের বাজারে বেকারদের এক বিশাল মজুত বাহিনী। সবটা মিলিয়ে এই অবস্থা সংগঠিত শ্রমিকদেরকেও সংকটের মধ্যে টেনে আনবে।

এই কারনেই কৃষকদের আন্দোলনের মূল বিষয়টি নয়া তিনটি কৃষি আইনের কি ভালো কি খারাপ সেইসব আলোচনার তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের সেই বিষয়টি আমাদের দেশে কৃষকদের বেঁচে থাকার প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply