আপনি দক্ষিনপন্থী, বামপন্থী নাকি মধ্যপন্থী সেই অবস্থান এই আলোচনায় একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। বিষয়টিকে এধরণের দৃষ্টিতে বিচার করতে গেলেই বরং ভুল হবে, এটি একটি সোজা সরল আইনি ব্যাপার। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী রাস্ট্র যদি কারোর সম্পত্তির দখল নেয় তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। সেই আইনবলেই তাহলে রাস্ট্র যদি কারোর রোজগারের উপায় বন্ধ করে তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে বা ব্যাক্তিদেরও ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংকটকালে ২৪ মার্চ একটি মাত্র কলমের খোঁচায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশব্যাপী সার্বিক লকডাউন ঘোষণা করলেন। তার প্রভাবে সারা দেশে অসংখ্য মানুষ রোজগার হারালেন। এদের মধ্যে ১৪ কোটি মানুষই হলেন পরিযায়ী মজদুরেরা এবং অন্তত ১০ কোটি হলেন আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে কোনওরকম ক্ষতিপূরণের আইনানুগ ঘোষণা করা হল না এবং এখনও অবধি এই বিষয়ে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, অদূর ভবিষ্যতে হবে বলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
শুরুর দিকে সরকারের তরফে মালিকপক্ষের কাছে আবেদন করেছিল যাতে তারা লকডাউন চলাকালীন নিজেদের কর্মচারীদের বেতন কিংবা মজুরি বন্ধ না করে, পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকারের সেই আবেদন নাকচ করে দেওয়া হল। এই অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের প্রাজ্ঞতা সম্পর্কে যে ধারণাই জনমানসে তৈরি হোক না কেন, সরকারের উচিত ছিল বেতন এবং মজুরি বন্ধ না হওয়াকে নিশ্চিত করতে নিজে থেকেই এব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। কেন্দ্রীয় সরকার চাইছিল যাতে রাজ্য সরকারগুলি এই ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব নেয় (যদিও রাজ্য সরকারগুলির কেন্দ্রের কাছে GST এবং অন্যান্য খাতে বিরাট বিরাট অংকের বকেয়া আটকে রয়েছে), কিন্তু প্রয়োজন ছিল লকডাউন ঘোষণার আগেই এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে সেই নিয়ে আলোচনা শেষ করে ফেলা। ক্ষতিপূরণ দেবার দায় কার সেই নিয়ে জলঘোলা করে ক্ষতিপূরণ দেবার কাজকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
এই অবস্থায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে এককথায় অভাবনীয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়ংকর চিত্র বলা যায়, কিছুদিন আগে অবধি দেশের নাগরিক হিসাবে যাদের সমস্ত অধিকার ছিল সেই পরিযায়ী মজদুরেরাই রাতারাতি বলা চলে নিছক ভিখারি হয়ে গিয়েছেন। লকডাউনের সময়ে সরকারের তরফে নেওয়া কল্যাণকারী পদক্ষেপের আলোচনায় অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশ বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশগুলির সাথে আমাদের দেশের তুলনা করার সময়ে বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে নিতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট। সেই সমস্ত শক্তিশালী আধুনিক পুঁজিবাদী দেশের সরকার লকডাউন চলাকালীন নিজেদের দেশের প্রত্যেক কর্মচারী, মজদুর এমনকি বেসরকারী ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদেরকেও বেতন কিংবা মজুরি দেবার ব্যবস্থা করেছে। এইভাবে সরকারগুলীর তরফে শ্রমিক-কর্মচারী এমনকি বেসরকারি ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের বেতন কিংবা মজুরি দেবার মোট অংক এতই বিশাল যে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে লন্ডনের খবরের কাগজ ফিন্যানশিয়াল টাইমস তাদের সম্পাদকীয় কলামে লিখেছে “এধরনের পদক্ষেপ একটা ছোটখাটো কমিউনিস্ট বিপ্লবের মতোই, বেসরকারি দখলে থাকা বাজারে কিভাবে সরকার হস্তক্ষেপ করবে তা কল্পনা করা সত্যিই কষ্টকর… লকডাউন চলাকালীন শেষ দুমাসে সরকার যেভাবে দ্রুততা এবং বেতন ও মজুরি, ঋণের ব্যবস্থাপনা কিংবা পণ্যের বেচাকেনা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তা ভাবাই যায় না…. রাতারাতি বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মচারীরা সরকারি তহবিল থেকে তাদের বেতন পেতে শুরু করলেন, আর্থিক বাজারের বেশিরভাগ লেনদেনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফে বরাদ্দ ইলেকট্রনিক মানি (টাকা পয়সার অনলাইন সংস্করণ) হয়ে উঠল বিনিময়ের উপায়।”
সরকারি তহবিল থেকে এভাবে ব্যয়বরাদ্দের সিদ্ধান্ত মানুষের দুর্দশায় সমব্যাথি হয়ে কিংবা মানবিকতার দোহাই দিয়ে কোনরকম দানের অহংকার থেকে করা হয় নি, এই দায় স্বীকার করা হয়েছে পুঁজিবাদী গনতন্ত্রে একজন ব্যাক্তি যে যে অধিকার প্রাপ্ত হয় তার ভিত্তিতেই। এই প্রসঙ্গে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি এই সত্যকেই তুলে ধরে যে এদেশে গরীব মানুষের প্রকৃতপক্ষে কোন অধিকারই নেই, সংবিধানে সেই নিয়ে যাই লেখা থাক না কেন।
যেরকম মনোভাব দেখিয়ে আমাদের দেশের সরকার গরীব মানুষের অধিকারসমুহকে এড়িয়ে গেছে তাতে মধ্যবিত্ত, সমাজের উচ্চশিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত অংশের অনেক মানুষই বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট, যারা মানুষের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সেই আঁচের বাইরে থাকেনি; লকডাউনের সময়ে মালিকপক্ষের তরফে বেতন, মজুরি দেওয়া অব্যাহত রাখতে জারী করা সরকারি নির্দেশকে নাকচ করার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্নও তুলেছিল যখন কাজকর্ম সব বন্ধ তখন শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন সংস্থাগুলি কিভাবে দেবে? এই প্রশ্ন তোলার সাথে সাথেই আরেকটি অতী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্ট তোলেনি, কাজকর্ম সব বন্ধ থাকায় বিনা বেতন কিংবা বিনা মজুরিতে কর্মচারীদের কিভাবে চলবে? তারা যদি এই প্রশ্ন তুলতেন তাহলে তারা এই সিদ্ধান্তেও পৌঁছতে পারতেন যে সরকারকেই লকডাউনের সময়ে মানুষের আয়ের সংস্থান করতে হবে, বেতন, মজুরি মিটিয়ে দেবার তহবিল ঘোষণা করতে হবে। তারা সরকারকে এই কাজ করতে নির্দেশিকা জারী করে শ্রমজীবীদের অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন। তা না করে তারা এই দায়িত্বের বোঝা তাদেরই কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন যারা এই ভার বহনে সবচেয়ে দুর্বল। এভাবে দায় এড়িয়ে যাওয়া কখনই গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সর্বজনীন সমানাধিকারের ধারনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়, বরং বলা যায় এই মনোভাব অনেকটাই সামন্ততান্ত্রিক।
গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় সরকার কিংকর্তব্যবিমুঢ়তার আড়ালে শ্রমজীবীদের অধিকারের প্রশ্নকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পিছনে ঠেলে জনগণের সামনে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা করা আর্থিক সহায়তা প্যাকজের চরিত্রকে বিতর্কের প্রধান বিষয় হিসাবে হাজির করিয়েছে।
যদিও একথা সকলেই জানেন ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ আসলে মূল সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার নামে কিছু গোষ্ঠী বা সংস্থাকে ঋণ পাইয়ে দেওয়া ব্যাতিত আর কিছুই নয়, একাজে রাজকোষীয় খরচ প্রায় করা হয় নি বললেই চলে। এই নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন, এবং আমি মনে করি তারা সঠিক বিতর্ক উত্থাপন করেছেন। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি মূলত চাহিদা নির্ভর অবস্থায় রয়েছে, এখন রাজকোষ থেকে খরচ না করে বাজারের চাহিদা বাড়ানোর নাম করে সরকারের তরফে কতিপয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য ঋণের সুযোগ পাইয়ে দেবার কর্মসূচি কার্যত ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতাকেই বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ সরকারি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ শেষবধি চাহিদা, ঋণের নেবার পরিমাণ এবং তার ফলে অয়ারথিক অবস্থার উন্নতি কিংবা নতুন করে কাজের সুযোগ কোনটাই বাড়াতে পারবে না। কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ব্যাতিরেকে আর্থিক বাজারের বেশিরভাগটাই এই আর্থিক প্যাকেজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বিশেষ করে যারা লকডাউনে নিজেদের কাজ বন্ধই রাখতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু এইসব কোনকিছুই শ্রমজীবীদের অধিকারের প্রশ্নকে এড়িয়ে যাবার অজুহাত হতে পারে না। এমনকি এই কথা জোর দিয়েই বলা যায় যদি অর্থমন্ত্রী সত্যিই মনে করেন যে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি আসলে চাহিদা নির্ভর নয় বরং ঋণ নির্ভর এবং সেই কারনে তিনি সরকারের তরফে ঘোষণা করা আর্থিক সহায়তা প্যাকেজকেই দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে যথেষ্ট মনে করেন তাহলেও দেশের অসংখ্য রোজগার হারানো মানুষকে ক্ষতিপূরণ না দেবার প্রশ্নটি তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না কারণ এই অসংখ্য মানুষগুলি রোজগার হারিয়েছেন তাদের নিজেদের দোষে নয়, এর একমাত্র কারণ সরকার কর্তৃক সার্বিক লকডাউনের বিজ্ঞপ্তি জারী করা। দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে কি কর্তব্য সেই নিয়ে অবস্থান স্থির করার প্রশ্নকে রোজগার হারানো মানুষের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নের থেকে আলাদা করে বিচার করতে হবে। যদিও এক্ষেত্রে অনেকের মতো আমিও মনে করি সরকারি বিধিনিষেধের ফলে রোজগার হারানো মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়াও দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার একটা উপায়।
আমরা এক এমন সময়ের সাক্ষি থাকছি যখন সরকারি নির্দেশে এদেশে এমন ভয়াবহ ভাবে মানবাধিকার হরণের ঘটনা স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো হয় নি, বরং যা হচ্ছে তাকে দেশভাগ এবং ১৯৪৩ সালে বাংলার মন্বন্তরের সময়কার অবস্থার সাথেই কেবলমাত্র তুলনা করা যায়। আমাদের স্মরনে রাখতেই হয় যে সময় উত্তর ভারতে গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি তখনই লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী মজদুরেরা কিভাবে বিনা খাবার, পানীয় জলটুকুও না পেয়ে অকল্পনীয় কষ্ট স্বীকার করে ট্রেনে ওঠার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন (এমনকি তাদের সেই ট্রেনযাত্রার জন্য ভাড়াও গুনতে হয়েছে), ভুলে গেলে চলে না এইসবই হল আসলে বুনিয়াদি মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই ভয়ংকর উল্লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাদের ক্ষতিপূরণ না দেওয়া হয় তবে আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করার কাজে সেটা হবে প্রথম ধাপ।
বহু অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলীর পক্ষ থেকে বারে বারে লকডাউনের কারনে দুরবস্থার কবলে পড়া প্রতিটি পরিবারকে (যারা নিজে থেকে সরকারি সহায়তা গ্রহণ করতে চান না তারা ছাড়া আর সকলেই) অন্তত আগামী তিন মাসের জন্য মাসিক ৭০০০ টাকা নগদ, বিনামুল্যে ছয় মাসের জন্য মাথা পিছু ১০ কেজি খাদ্যশস্য বিলি করার দাবী জানানো হয়েছে। দ্বিতীয় দাবিটির কিয়দংশ কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিলেও আর্থিক সংকটে পড়া পরিবারগুলীর হাতে নগদ টাকা তুলে দেবার দাবীতে তারা কর্নপাত করেন নি। যদিও এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে দুর্দশাগ্রস্থ পরিবারগুলীর হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া কিন্তু আদৌ কোন সহানুভূতিমূলক ব্যাবস্থা নয়। সরকারি আদেশে লকডাউন জারী হবার ফলে রোজগার হারানো মানুষের অধিকার হিসাবেই এই দায় সরকারের রয়েছে, এভাবেই একে বিচার করতে হয়।
অর্থনীতিবিদেরা যেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন সরকার সরাসরি সেই পরামর্শ না মেনে দেশবাসীদের জন্য অন্যরকম কোন আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে কিন্তু তাহলেও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যে অধিকার তাদের রয়েছে তাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। যদি সেই অধিকার অস্বীকার করা হয় তবে তা হবে সোজাসুজি নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়ানক উদাহরণ যা কোনরকম গণতন্ত্রের ধারনার সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তথ্যসুত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ